মধুময় পাল
উদ্বাস্তু নই। কারণ, শুধু তো বাস্তু থেকে উৎখাত হইনি। দেশ থেকে উৎখাত হয়েছি, ঘরবাড়ি গিয়েছে, চার পুরুষের স্মৃতির ভিটে গিয়েছে, গিয়েছে সম্পর্কের চারপাশ — প্রতিবেশী, বন্ধুজন, গাছপালা, পুকুরঘাট, ভোরের পাখি, দুপুর-রাতের কথকতা। যার দেশ যায় তার সব যায়। সে পায় অনাত্মীয় ভূখণ্ড, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, আর কৃপার করুণা। আমরা উদ্বাস্তু নই, দেশভিখারি।
আমার যখন মাত্র চার মাস বয়স, দাদু ও দিদিমার সঙ্গে মা আর আমি এদিকে চলে আসি। দাদু, নলিনীকুমার বসু, ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জে কবিরাজি প্র্যাকটিস করতেন, আয়ুর্বেদ চিকিৎসক। সেই সময়কার সমাজে আমার দাদু ছিলেন একটা আশ্রয়, আমরা যেমন ডাক্তারকে সম্মানের চোখে দেখি, ডাক্তারের ওপর নির্ভর করি, ঠিক সেইরকম। গ্রামের কেউ অসুস্থ হলে, বাড়ির কোনও বাচ্চা অসুস্থ হলে, কবিরাজমশাই ছিলেন গ্রামের সকলের ভরসার জায়গা। মায়ের কাছে শুনেছি দাদু সকাল থেকে রোগী দেখতেন, সন্ধে হয়ে গেলে আর নয়। নিজে হাতে গাছের শেকড়-বাকড়, বাকল ইত্যাদি দিয়ে ওষুধ বানাতেন, আর সেই ওষুধে কাজও দিত খুব। তখন অ্যালোপাথির তেমন চল ছিল না ওসব জায়গায়, ধারেকাছে কোনও অ্যালোপ্যাথ ডাক্তার বা হাসপাতাল কিছুই ছিল না। এহেন আমার দাদুকে একদিন গ্রামের মোড়লরা চলে যেতে বললেন। ‘কইবরাজ মশাই, আপনের মাইয়ারে আর নাতিরে কইলকাতায় রাইখা চইলা আসেন। আপনে এখানে থাকবেন দিনকাল ভালো নয়। ভাদাইমা পোলাপানরা কখন কী করে!’ সালটা তখন ১৯৫২। ময়মনসিংহে সে অর্থে কোনও গোলমাল হয়নি। বাবার কাছে শুনেছি, ঢাকায় রায়ট প্রায় নিয়মিত ঘটনা ছিল। ওদের তাজিয়া বেরোচ্ছে, ওপর থেকে ঢিল পড়ল, এদের রথ বেরিয়েছে, কেউ একটা ইট মারল… এরকম কোনও না কোনও ইস্যুতে ঢাকায় গোলমাল লেগেই থাকত। কিন্তু কিশোরগঞ্জ ছিল শান্তিপূর্ণ জায়গা। দাদু প্রতিবেশীদের কথায় বিশ্বাস করে আক্ষরিক অর্থে খালি হাতে ওখান থেকে চলে আসেন। নিজের সার্টিফিকেটটা পর্যন্ত আনেননি। সঙ্গে শুধু স্ত্রী, মেয়ে আর নাতি। বাবা আগেই কলকাতায় চলে এসেছিলেন। তিনি কাজ করতেন কুমিল্লা ব্যাঙ্কে, নারায়ণগঞ্জ শাখার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার ছিলেন। এই ব্যাঙ্কই পরে ইউনাইটেড ব্যাঙ্কের সঙ্গে মিশে যায়। ব্যাঙ্কগুলো তখন লালবাতি জ্বালছে। মামলা চলছে হাইকোর্টে। ব্যাঙ্কের হয়ে মামলা দেখাশুনার জন্য বাবা পড়ে আছেন কলকাতায়। অবশ্য কলকাতায় ঠিক কোথায় আছেন তা জানা নেই। আমরা পৌঁছলাম শিয়ালদা স্টেশনে। দাদু বাবাকে খুঁজে পেলেন না। কলকাতা শহর সম্বন্ধে দাদুর কোনওরকম ধারণাই ছিল না, হয়তো ভেবেছিলেন কিশোরগঞ্জের মতোই আরেকটা জনপদ, একটু খোঁজাখুঁজি করলেই খুঁজে পাওয়া যাবে। এসে দেখেন হাজার হাজার লোক শুধু প্ল্যাটফর্মেই পড়ে আছে। আসার সময় মায়ের খুব কষ্ট হয়েছিল। পদ্মার পার থেকে আমাকে নিয়ে কোনওমতে চেপেচুপে ট্রেনে উঠেছিলেন। একেবারে দমবন্ধ-করা ভিড়। আমার তখন চার মাস বয়স। এর সবই পরে মায়ের কাছে শোনা। কোনওমতে জানালার ধারে একটা জায়গা পাওয়া গেল। সেখানে এক পরিবারের টিনের ট্রাঙ্কে আমাকে শোয়ানো হয়েছিল, যাতে মাথায় একটু হাওয়া লাগে। আমার মাথার নিচে একটা সরষের বালিশ ছিল৷ বর্ডার পেরোনোর আগে, বালিশে করে সোনাদানা যাচ্ছে কিনা পরীক্ষা করে দেখার জন্য এক রক্ষী এসে বেয়নেট দিয়ে বালিশটা খুঁচিয়ে দেয়। মা ভাগ্যিস আমাকে তখনই সরিয়ে নিয়েছিলেন। বেয়নেটের খোঁচায় বালিশ ফুটো হয়ে সব সরষে নিচে পড়ে যায়, বালিশটা একটুকরো ন্যাকড়া হয়ে পড়ে৷
দাদু বহু কষ্টে, বেশ কিছুদিন ধরে হাইকোর্টে বিস্তর ঘোরাঘুরি করে বাবাকে একদিন দেখতে পান। বাবা তখন মৌলালির উড়িয়া পাড়া লেনে একটা বস্তিতে থাকতেন। বাবার কাছে আমরা এসে উঠলাম। দাদু কিন্তু আর ফিরে যেতে পারলেন না। গ্রামে চিঠি লেখেন৷ ওখান থেকে উত্তর আসে৷ আপনের চিন্তা নাই.. আপনার ঘরদোর আমরা দেইখ্যা রাখছি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক… তারপর আপনি আইসেন। পরিস্থিতি আর স্বাভাবিক হয় না। হাফিজুদ্দিন চাচার কাছ থেকে একদিন চিঠি আসাও বন্ধ হয়ে যায়। অথচ এরাই বলেছিল যে দাদুকে ছাড়া তাদের চলবে না, অসুখবিসুখ হলে দাদু ছাড়া কে দেখবে তাদের! দাদুর কাছে শুনেছি প্রতিবেশীদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমাদের বাড়িতে অমৃতবাজার পত্রিকা আসত। রাতে হারিকেন জ্বেলে দাদু যুদ্ধের খবর পড়ে শোনাতেন আর সবাই গোল হয়ে বসে শুনত।
সেই দাদু যখন কলকাতায় এলেন, নিজের নাতিকে আদর করার যে ন্যূনতম সামর্থ্য, সেটাও হারিয়ে ফেললেন। আমি কখনও বলতাম, আমাকে একটু বাদাম কিনে দেবে, বা একটা লজেন্স… দাদুর চোখ দিয়ে জল পড়ত। তাঁর কাছে তখন ন্যূনতম এক পয়সা দু পয়সাও নেই যে নাতিকে আবদারের সামান্য জিনিস কিনে দেবেন। দেশভিখারির আদর করা বা আদর পাওয়ার যোগ্যতাও থাকে না।
রিফিউজি ক্যাম্পে থাকতে থাকতে অনুভূতিগুলো আরেকভাবে নষ্ট হয়। ডোল খেতে খেতে নষ্ট হয়, পরচর্চা পরনিন্দায় সময় কাটাতে কাটাতে নষ্ট হয়, নানা অনৈতিক কাজে নষ্ট হয়। দাদুর কাছ শুনেছি, রিফিউজি ক্যাম্পে বেশিরভাগই কোনও কাজ করত না। সপ্তাহে একবার করে ডোল আসত, প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ মাপা রেশন, সেটা লাইনে দাঁড়িয়ে নিতে হত। বাকি সময়টা আর কোনও কাজ নেই… তাস খেলে বা নিছক আড্ডা মেরে কাটানো, কারও কারও ক্ষেত্রে সন্ধেবেলার দিকে একটু নাটকের চর্চা… এরপর আর কিছু করার ছিল না। ডোল-নির্ভর একটা কর্মহীন জীবন মানুষকে চূড়ান্ত অলস ও কর্মবিমুখ করে তুলেছিল। আর ক্যাম্পগুলো ছিল অরক্ষিত। কুপার্স ক্যাম্প যেমন একটা লম্বা টানা গোডাউন, আলাদা ঘর-জানালা-দরজা কিছুই ছিল না। সেখানে মেয়েদের আব্রু রাখা সম্ভবই ছিল না। কেউ কেউ সামনে দিয়ে দড়ি টাঙিয়ে, গামছা বা শাড়ি ঝুলিয়ে একটু আড়াল তৈরির চেষ্টা করত, কিন্তু তাও অসভ্য লোকজন এসে সেসব ছিঁড়ে দিত।
দাদু এখানে এসে কবিরাজিটা আর করতে পারলেন না। এদিক ওদিক থেকে সাহায্য পেয়ে কিছু দরকারি জিনিস কিনেছিলেন, যেমন একটা হামানদিস্তা, উদুখল, চড়াই, কিন্তু শেষমেশ কবিরাজি জমাতে পারলেন না। কলকাতা শহরে তো কবিরাজিটা ঠিক চলে না। দাদু আর দিদিমা একটা সময় উঠে গেলেন গোবরার বস্তিতে। দাদু তখন শিয়ালদায় সেবা ঔষধালয়ে কাজ পেয়েছেন।
একটা কথা ঠাট্টা করে বলা হয়, উদ্বাস্তু বাঙালদের প্রত্যেকেরই নাকি ওদেশে প্রচুর জমিজমা ছিল। এদের সবার জমি যদি যোগ করা হয়, তাহলে গোটা পূর্ববঙ্গে এত জমি হবে না। আমি বলি, আমাদের জমি ছিল না। বাবা চাকরিনির্ভর ছিলেন, দাদু কবিরাজ পেশানির্ভর ছিলেন, আমাদের জমি ছিল না। তবে একটা উঠোন ছিল, দু-চারটে গাছ ছিল, দুটো ঘর ছিল, নিজস্ব স্নানঘর-পায়খানা ছিল। এখানে নিজস্ব টয়লেটটাও থাকল না। পরে শুনেছি, রানাঘাটে বা আরও অন্যান্য ক্যাম্পে পায়খানার ব্যবস্থা ছিল বীভৎস। এইভাবে দেশভাগ একটা মানুষের সবকিছু কেড়ে নিয়ে তাকে একটা নরকের মধ্যে এনে ফেলল। মায়ের কাছে শুনেছি, পাশ দিয়ে যেতে যেতে একদিন একজন লোক মা’র দিকে দু’টো টাকা ছুঁড়ে দিল। মা অবাক হয়ে ভাবলেন, এইভাবে টাকা দিচ্ছে কেন, ভিখারি ভেবেছে নাকি? দেখা যায়, যে লোকটা মা’কে দু’টাকা ছুঁড়ে দিয়েছিল সে দূরে গিয়ে চোখ মারছে। শিকারে এসেছে। একটা ভয় মা’কে চেপে ধরল। মা অন্যদিকে ঘুরে বসলে, লোকটাও অন্য দিক দিয়ে ঘুরে আসে। ক্যাম্পে সবটাই তো অরক্ষিত। সে এক ভয়ঙ্কর অবস্থা। এটা শিয়ালদা স্টেশনের ঘটনা, এটা সেই সময় যখন বাবাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
উদ্বাস্তু মানেই কিন্তু দেশভিখারি নয়। উদ্বাস্তু দু’ধরনের হয়। যেমন আমরা পরের দিকে সুরেশ সরকার রোডের বস্তিতে গিয়ে উঠলাম, চিত্তরঞ্জন মেডিকেল কলেজের কাছে, গভর্নমেন্ট কোয়ার্টারের পেছনদিকে। সেখানকার বাড়িওলির কথা আমার ছোটবেলা থেকেই মনে আছে। তিনিও পূর্ববঙ্গের, শেরপুরে বাড়ি, তিনি কিন্তু আমাদের চেয়ে আলাদা। তাঁর চোখে রিমলেস চশমা, চেহারা-ছবিও ভিন্ন। তাঁরা যে উদ্বাস্তু হবেন এটা তাঁর স্বামী আগে থেকে বুঝতে পেরেছিলেন। ফলে কিছু সম্পত্তি বিনিময় করে কলকাতায় একটা আস্তানা তৈরি করে রেখেছিলেন এবং ছেলেমেয়েকে আগেই এদিকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁদের শেরপুরে বিরাট দোকান ছিল, বারো বা চোদ্দপাল্লার দোকান। কোথাও আলতা বিক্রি হচ্ছে, কোথাও আলু বিক্রি হচ্ছে, কোথাও বা মুদি দোকানের জিনিস বিক্রি হচ্ছে, কোনওটা বা মনিহারী, কোথাও মাটির ঘট বিক্রি হচ্ছে। তখনকার দিনের বড়সড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্স বলা যেতে পারে, ষোল-আঠারো জন কর্মচারী সেখানে কাজ করেন। এহেন পরিবারটিও উদ্বাস্তু, এঁরাও নিজেদের বাস্তু থেকে উৎখাত হয়ে এদেশে এসেছেন, কিন্তু এখানে ইতিমধ্যেই একটা বাস্তু পেয়ে গেছেন, আমাদের মতো দুঃখকষ্ট এঁদের পোহাতে হয়নি। আমার মনে আছে, এই ভদ্রমহিলা চেয়ারে বসে কথা বলতেন, আর আমার মা ও অন্য মহিলারা মেঝেতে বসতেন। বস্তি এলাকায় এঁদের চারটে পাঁচটা ঘর ছিল, ভাড়া ছিল দশ বারো টাকা, সামনে কিছু দোকান ছিল, সেখান থেকে আয় হত, পূর্ববঙ্গ থেকে টাকা আসত, জিনিসপত্র আসত। ওঁদের ছেলেমেয়ের লেখাপড়া সব ঠিকঠাক চলত, আমাদের কিছুই চলত না। উদ্বাস্তু দু’রকম, এক, যাদের কিছুই ছিল না, যারা দেশভিখারি। আর অন্যরকম, যারা আগে থেকে ভবানীপুরে বা গড়িয়াহাটে বা অন্য কোথাও বাড়ি কিনে রেখেছিল, বালিগঞ্জ তখন প্রত্যন্ত এলাকা, সেখানে জমি কিনে বাড়িঘর করে নিয়েছিল, এঁরা উদ্বাস্তু হলেও দেশভিখারি নয়। অপরদিকে আমরা ছিলাম একেবারে নিঃস্ব৷ তাও দাদুর প্রচণ্ড জেদ ছিল। তিনি বলতেন, আমি তো রিফিউজি নই, আমি কেন রিফিউজি হব! ওখানে আমার বাড়ি আছে, ঘর আছে, পেশা আছে, আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব সব আছে। আমি তো দেশ ছেড়ে আসিনি, আমাকে তাড়ানো হয়েছে। আমার যখন সুযোগ আসবে তখন আমি আবার চলে যাব। দাদু আর কোনওদিন ফিরে যেতে পারেননি। প্রায় অনাহারে বিনা চিকিৎসায় মারা যান ১৯৬৯-এ। দিদিমা মারা যান ৬৮-তে। এদেশে আসার পর প্রায় ষোল সতের বছর ওরা বেঁচেছিলেন, কোনওদিন স্বস্তি পাননি, শান্তি পাননি।
আট ফুট বাই দশ ফুট ঘরে আমরা থাকতাম। বারো ঘর এক উঠোন। একটা টয়লেট। একটা স্নান করার জায়গা। একটা চৌবাচ্চা। কিন্তু অনেকগুলো পরিবার৷ ফলে অন্য সব ছেলেমেয়েরা যেভাবে প্রাতঃকৃত্য করতে শেখে, স্নান করে, ছোটবেলা থেকেই আমার অভ্যেসটা অন্যরকম ছিল। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে রাস্তায় টিউবওয়েল থেকে জল টিপে স্নান করে স্কুলে যেতে হত। যেহেতু সকাল থেকেই টয়লেটে ভিড়, কোনওদিন সকালে পায়খানা যেতে পারতাম না। স্কুল থেকে ফিরে এসে টয়লেট যেতাম। পরীক্ষা থাকলে আগের দিন মধ্যরাতে উঠে সব সেরে রাখতে হত।
ওদিকে বাবার ব্যাঙ্কে তো লালবাতি জ্বলে গিয়েছিল। ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া পরে কুমিল্লা ব্যাঙ্ককে অধিগ্রহণ করে নেয়। মামলা শেষ হয়ে যাবার পরে বাবাও অবশ্য আর ওদেশে ফিরে যাননি। ব্যাঙ্ক খুললেও যোগ দেওয়ার আর প্রশ্নই ওঠেনি। বাড়িতে এতগুলো মুখ, বাবাকে জীবিকার জন্য নানান ধরনের কাজ করতে হয়েছে। একসময় উনি ফেরিওয়ালা ছিলেন। ঘি ফেরি করতেন। কোনও একটা জায়গা থেকে ঘি কিনে নিয়ে আসতেন। রাতের বেলা ছোট ছোট বয়ামে ঘি ঢালতেন। কাচের বয়ামগুলো মোটা আর ভারি। সেগুলো কাপড়ের মোটা ব্যাগে পুরে পরদিন ভোরে সাইকেলে করে ফেরির কড়াকড়ি ছিল না। ওখানে কেউ বাবার চেনাজানা ছিলেন। ওঁদেরও শিক্ষকের প্রয়োজন ছিল। বাবা ওখানে একটা কি দুটো ক্লাস নিতেন। শুনেছিলাম, কলেজ থেকে মাসে তিরিশ টাকা পাওয়া যেত৷ ক্লাস করার পর বাবা দুপুরে প্রেসের কাজ করতেন। কোথাও থেকে উনি একটা সাহায্য পেয়ে ছিলেন, তা দিয়ে ট্রেডল মেশিন কিনেছিলেন। ট্রেডল মেশিনে তখন লেবেল ছাপানো হত। আমি যখন স্কুলে পড়ি তখন দেখেছি লেবেল থেকে আস্তে আস্তে কমপোজিং ইউনিট আসছে। পরের দিকে বেশ বড় হয়েছিল প্রেসটা। বাসুদেব প্রিন্টিং ওয়ার্কস। কলেজ স্ট্রিট বাটার পেছনে। সব মিলিয়ে বাবা সকাল সাতটা থেকে রাত এগারোটা সাড়ে এগারোটা অবধি কাজ করতেন। আমি ঘুমোলে বাবা ফিরতেন।
বাবা পরবর্তীকালে ভদ্রেশ্বরে কলোনিতে এক রিফিউজি ভদ্রলোকের কাছ থেকে একটা জায়গা কেনেন। ইচ্ছে করলেই জমি পেতে পারতেন, তখন যাদবপুরে কলোনি হচ্ছে, বাবা রিফিউজি পরিচয়ে জমি নিতে চাননি। দাদুর মতো বাবাও রিফিউজি পরিচয়টা স্বীকার করতেন না। ফলে আমাদের কোনও কাগজপত্র নেই৷ আজ যদি এন আর সি হয়, কেউ দেখতে চায়, কিছু দেখাতে পারব না। রিফিউজির যে বর্ডার স্লিপ, সেটা আমার দাদু বা বাবা, কেউই নেননি।
দাদুর আত্মসম্মানের প্রসঙ্গে আরেকটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। তখন হেস্টিংসে রিফিউজিদের দুধ দেওয়া হত। বিদেশ থেকে আসা দুধ রিফিউজিদেরই দেওয়া হত। দিদিমা কখনও বোধহয় দু’টো কার্ড করেছিলেন। একটা নিজের জন্য, একটা আমার জন্য। আমার মনে আছে, রোদে প্রায় আড়াই তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আমি আর দিদিমা দু’প্যাকেট দুধ পেয়েছিলাম। কী দারুণ মোলায়েম সেই দুধের প্যাকেট, হাত থেকে যেন পড়ে যেতে চায়। দেখলাম দিদিমা এসে পাড়ার দোকানে সেই দু’টো প্যাকেট বিক্রি করে দিয়েছেন। দাদু শুনে প্রচণ্ড রেগে যান। বলেন, দানের জিনিস তুমি নিতে গেলে কেন? না খেয়ে থাকলে না খেয়ে থাকব। লজ্জা করে না?
মা প্রথমদিকে ওদেশের অনেক কথা বলতেন, গল্প শোনাতেন। শেষদিকে সেসব বলাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। মনে পড়ছে, চিত্তরঞ্জন মেডিকেল কলেজের পেছনদিকে একটা খাটাল ছিল। বিশাল বড় খাটাল। সেই খাটাল থেকে আমি আর দিদিমা গোবর আনতাম। গোবরা রোডে মালগাড়ি লাইনের পাশে আমি আর দিদিমা ঘুঁটে দিতাম। শুকনো ঘুঁটে নিয়ে এসে দিদিমা আমাদের বাড়ির অন্য ঘরগুলোতে বিক্রি করতেন। দিদিমা আর একটা জিনিস করতেন, উনি মালা গাঁথতেন। আমাকেও মালা গাঁথা শিখিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা দু’জনে মিলে মালা গাঁথতাম। দেববাবুর বাজারে ঝুনু নামে একটা ছেলে ছিল, সে নানান মালা, চাঁপার মালা, গোড়ের মালা, ফুল, বেলপাতা ইত্যাদি বিক্রি করত। সে আমাদের গাঁথা মালা কিনে নিয়ে যেত। সেই মালা গাঁথা থেকে কিছু পয়সা হত৷
ঐ মালা গেঁথে যে’কটা পয়সা হত, হয়ত এক কুড়ি মালা গাঁথলে দু’পয়সা, পাঁচ কুড়ি মালা গাঁথলে দশ পয়সা পাওয়া যেত… সেখান থেকে এক পয়সা, দুপয়সা জমিয়ে দিদিমা আমাকে গল্পের বই কিনে দিতেন। দেবসাহিত্য কুটিরের বই, বঙ্কিমচন্দ্রের রাজসিংহ, দুর্গেশনন্দিনী, কপালকুণ্ডলা… শরৎচন্দ্রের রামের সুমতি, নিষ্কৃতি, এগুলো যে ছোটবেলা থেকে আমি পড়তে পেরেছি, তা শুধু দিদিমার জন্য। দিদিমার মতো একজন অনাহারে থাকা মানুষ, তিনিও একটা ছোট্ট বুকশেল্ফ করেছিলেন, তার মধ্যে বই রাখতেন। আমার পড়াশুনো শেখা বা পড়াশুনোর দিকে যে ঝোঁক ছোটবেলা থেকে তৈরি হয়েছিল, সেটা দিদিমার জন্যই। হারিকেনের আলোয় দিদিমা রাত্রিবেলা যখন কপালকুণ্ডলা বা রাজসিংহ পড়ছেন, তখন আমার মনের মধ্যে একেকটা ছবি তৈরি হত। এইভাবেই পাশাপাশি চলছিল আমাদের জীবনযুদ্ধ, আমার ছেলেবেলা, আমার পড়াশুনো শেখা আর এইসব মিলিয়ে আমাদের দেশভিখারির জীবন।
আমরা কেউ আর ওদিকে ফিরে যাইনি। দাদু ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। যেতে পারেননি। আর ওদেশে গেলেও ফেলে আসা সম্পত্তিটা যে দাদুর-ই, সেটা আর প্রমাণ করতেন কী করে? প্রমাণের সব কাগজপত্রও তো ওখানে, বাড়ির কোনও এক ঘরে ট্রাঙ্কের ভেতর। পাকিস্তান সরকারের শত্রুসম্পত্তি আইনে সেই ঘরবাড়ি নিশ্চয়ই ততদিনে দখল হয়ে গেছে। তখন ফিরে যাওয়ার চেয়ে এখানে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করাটাই তো মূল লড়াই ছিল। তাছাড়া দাদু-দিদিমা যদি ফিরে যান, একা একা তাঁরা কোথায় থাকবেন? ওখানে পরিস্থিতি কেমন, জানা নেই। দাদু ভাবতেন, মেয়েকে নাতিকে একলা ফেলে চলে যাওয়াটাও ঠিক হবে কিনা! সব মিলিয়ে একটা ভয়ঙ্কর অনিশ্চিত অবস্থা৷ তার চেয়ে বরং সবাই মিলে এখানেই থাকি। অনাহার এলে সবাই মিলেই অনাহারে থাকব। যদি সামান্য কিছু জোটে, তাহলে সবাই মিলে তা ভাগ করে খাওয়া যাবে।
বন্ধুরা প্রায়ই জিজ্ঞেস করে, আমি বাংলাদেশ গিয়েছি কিনা কিংবা যেতে ইচ্ছে করে কিনা। মা ও বাবার দেশ-গাঁ দেখতে ইচ্ছে করে কি না। বন্ধুরা মাঝে মাঝে যান। সেখানে হয়তো কারও আত্মীয়জন আছে, কারও প্রিয়জন। অগ্রজ দু-একজন কখনও জিজ্ঞেস করেন, আমার বাংলাদেশে যেতে ইচ্ছে করে কিনা। জবাবে বলি, ইচ্ছে করে, আবার করেও না। অনেক প্রশ্ন ছোটবেলা থেকে মাথার ভেতরটা জুড়ে আছে, কেন আমাদের চলে আসতে হল, আমাদের কেউ রাজনীতির লোক নয়, দাঙ্গাবাজ নয়, দুর্বৃত্ত নয়, তবু কেন পালিয়ে আসতে হল, কেন সব ফেলে চলে আসতে হল, বাঁঁচবার জন্য কী ভয়ঙ্কর লড়াইটাই না লড়তে হল, তবু তো দাদু-দিদিমা মারা গেল অনাহারে, বিনা-চিকিৎসায়। কেন? জবাব পাই না। একাত্তরের পর, বাবার দিকের কয়েকজন আত্মীয় ঘর-বাড়ি দেখতে যাবেন বলে ঠিক করেছিলেন। যাননি। সাহসে কুলোয়নি। তাঁদের ঘরবাড়ি যে শত্রুসম্পত্তি হয়ে গিয়েছে। শত্রুর জন্য কোন আপ্যায়ন অপেক্ষা করে থাকে?
এই কথাটা বলতে ভালো লাগে, আমার একটা পড়ার ঘর হয়েছে। সেই ঘরে বাংলাদেশের হাজার খানেক বই আছে। নানা বিষয়ের। কবিতার, গদ্যের। প্রবীণের, নবীনের। অনেক রসদ পাই। দেশভিখারি আমার ঘরে হারানো দেশের গুণীজনদের ভাবনা-চিন্তা আলো হয়ে আছে। বাংলাদেশের রবীন্দ্র-গান রোজ আমার ঘরে বাজে। কিন্তু যেতে যে ইচ্ছে করে না।
(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত)