দেবব্রত শ্যামরায়
গত ১৪ই সেপ্টেম্বর সারা দেশ জুড়ে মহাসমারোহে ‘হিন্দি দিবস’ উদযাপিত হল। রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমে সারাদিন ধরেই হিন্দি দিবসের শুভেচ্ছা ভেসে এল। প্রায় প্রতিটি রাজধানী শহরে ফুল মালা শোভিত মঞ্চে সরকারি বেসরকারি খরচে হিন্দি ভাষায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হল, হিন্দি কবিতা পড়া হল, গান গাওয়া হল, নেতারা বক্তৃতা করলেন। অনুষ্ঠান শেষে হিন্দি ভাষা কেন সকলের শেখা উচিত তা জেনেটেনে, খাবারের প্যাকেট হাতে ঝুলিয়ে দর্শকরা খুশিমনে বাড়ি ফিরলেন।
আপাতদৃষ্টিতে এই ধরনের সাংস্কৃতিক আয়োজন মন্দ কী? বরং হিন্দি ভাষা সাহিত্যে যেসব মণিমানিক্য রয়েছে তার প্রতি অন্যভাষাভাষী মানুষদের আগ্রহী করে তুলতে পারে এই ধরনের পদক্ষেপ। হিন্দি সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের আদানপ্রদান বাড়বে৷ অবশ্যই তাই। কিন্তু প্রশ্নটাও ঠিক এই জায়গাতেই। কারণ শুধু হিন্দি কেন? ভারত যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধান যে বাইশটি ভাষাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল হিন্দি তাদের মধ্যে একটি ভাষামাত্র। দেশের অন্যান্য ভাষাগুলি যেমন বাংলা, ওড়িয়া, তামিল, তেলেগু, মারাঠি, সাঁওতালি প্রভৃতি হিন্দির মতোই সমমর্যাদায় স্বীকৃত। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কোনও ভাষাই কারও চেয়ে হীন নয়, অধিকও নয়৷ তাই সরকারি উদ্যোগে দেশজুড়ে হিন্দি দিবস পালিত হলে, একইভাবে ওড়িয়া দিবস, তামিল দিবস, বাংলা দিবসও পালিত হওয়া উচিত। তাই নয় কি?
হিন্দি দিবসের পক্ষে যাঁরা, তাঁরা সওয়াল করবেন হিন্দি আমাদের রাষ্ট্রভাষা, অতএব তার একটি আলাদা মর্যাদা আছে। হিন্দি যে রাষ্ট্রভাষা — দীর্ঘ সময় ধরে এই ধরনের একটি ধারণা কৌশলে নির্মাণ করা চেষ্টা চলেছে। আর তা করতে ব্যবহার করা হয়েছে দেশের বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তির উক্তির, যাঁরা বুঝে অথবা না বুঝে হিন্দি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা বলে গৌরবান্বিত করে গেছেন। বস্তুত, হাজার খুঁজলেও ভারতের সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা বলে আলাদা করে হিন্দি ভাষার কেন, কোনও ভাষারই উল্লেখ পাওয়া যাবে না, আমাদের দেশনির্মাতারা তা করেও যাননি। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সত্যিই যদি কোনও রাষ্ট্রভাষা থেকে থাকে, তাহলে ঐ বাইশটি ভাষার প্রতিটিই আমাদের রাষ্ট্রভাষা কারণ মর্যাদায় তারা প্রত্যেকে সমান।
তাহলে প্রশ্ন, এই বাহাত্তর বছরে অন্যান্য ভাষাগুলির মধ্যে শুধুমাত্র হিন্দির এত দবদবা হল কী করে? তার কারণ পুরোপুরি টেকনিকাল। ১৯৪৯ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর প্রখ্যাত হিন্দি পণ্ডিত বেওহার রাজেন্দ্র সিমহার ৫০তম জন্মদিনে ভারতের সংবিধান সমিতি বা Constituent Assembly of India দেবনাগরী হরফে লিখিত হিন্দিকে দেশের Official Languange বা দপ্তরের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেন। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরগুলিতে সুষ্ঠভাবে কাজকর্ম চালানোর জন্য একটি নির্দিষ্ট দেশীয় ভাষা ব্যবহার করার দরকার ছিল, এবং সেইসময় ক্ষমতার অন্দরে ক্রিয়াশীল হিন্দিবলয়ের কিছু হেভিওয়েটের প্রচেষ্টায় হিন্দি ভারত রাষ্ট্রের দাপ্তরিক ভাষার বা পোশাকি কথায় রাজভাষার জায়গা পায়। কিন্তু আমাদের সংবিধানপ্রণেতাদের মনেও যথেষ্ট সন্দেহ ছিল, এই বিবিধ বিচিত্র ভারতে শুধুমাত্র হিন্দিকে রাজভাষা বলে দেগে দেওয়াটা কার্যকরী হবে কিনা, বিশেষ করে অহিন্দি রাজ্যগুলির সঙ্গে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে তা সমস্যার হতে পারে। তাই, হিন্দির পাশাপাশি ইংরেজিও রাজভাষা হিসেবে স্থান পায়, যার একমাত্র অর্থ ভারত প্রজাতন্ত্রের কেন্দ্রীয় সরকারের কাজকর্ম ও নথির আদানপ্রদান, পারস্পরিক যোগাযোগ হিন্দি ও ইংরেজি এই দুই ভাষার যে কোনও একটিতে চালানো যেতে পারে। ব্যস, এইটুকুই।
এই মুহূর্তে ভারতবর্ষে ২.১৫ কোটি মানুষ কেন্দ্রীয় সরকারি চাকুরিতে নিযুক্ত, যাদের প্রতিদিন কাজের জন্য হিন্দি বা ইংরেজি ব্যবহার করতে হয়। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায় যে ইংরেজির পরিবর্তে সব কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী হিন্দিতেই কাজকর্ম চালান, তাহলেও দেশের মোট জনসংখ্যার হিসেবে এই সংখ্যাটা দু-শতাংশেরও কম। সেক্ষেত্রে এই দু-শতাংশ জনসংখ্যাকে হিন্দিতে আরও সড়গড় করে তুলতেই কি শাসকের তরফ থেকে হঠাৎ এত প্রচার-আড়ম্বর? না, হজম করা গেল না। সেটা যদি না হয়, তাহলে হিন্দি দিবসের এই ঢক্কানিনাদের পেছনে সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী?
উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট হয়ে যায়, যদি আমরা শুনি এ বছর দিল্লিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক আয়োজিত হিন্দি দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে এসে বিজেপি নেতা ভেঙ্কাইয়া নাইডু ঠিক কী বলছেন! ভেঙ্কাইয়া বলেছেন, ইংরেজি ভাষা নাকি আসলে এক ‘রোগ’ যা ব্রিটিশরা আমাদের জন্য ছেড়ে গেছেন। মুহূর্তে পরিষ্কার হয়ে যায়, কেন্দ্র সরকার ও শাসক দল শুধুমাত্র দপ্তরের কার্যকারিতার দিকে তাকিয়ে হিন্দি দিবসের উদযাপন করছেন না। তাঁরা ‘অসুস্থ’ ইংরেজির বিরুদ্ধে ‘শুদ্ধ ও পবিত্র’ হিন্দি ব্যবহারের নিদান দিচ্ছেন, যা উঠে আসছে তাঁদের মতাদর্শগত আধিপত্যবাদী অবস্থান থেকে। এবং ভেবে দেখলে, তাঁদের পক্ষে এমন করাটাই স্বাভাবিক, এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
এই মুহূর্তে দিল্লির সিংহাসনে বসে আছে এমন একটি সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদী দল, ‘বৈচিত্র’ শব্দটি শুনলে যাঁদের চিত্তবৈকল্য ঘটে। ভারতবর্ষের যে সুপ্রাচীন, বিভক্ত ও বহুস্তরীয় সমাজ, তাকে তাঁরা নিজেদের সুবিধেমতো একরঙে রাঙিয়ে নিতে চান। সবচেয়ে প্রথমে তাঁরা যে ভয়াবহ মতাদর্শে বিশ্বাস করেন — ব্রাহ্মণ্যবাদ, তাকেই হিন্দু সংস্কৃতির নাম দিয়ে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে দেশজুড়ে। সংখ্যাগুরুর খাদ্যাভ্যাস সংখ্যালঘুর ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে৷ চলছে ধরপাকড়, এমনকি শারীরিক আক্রমণ৷ এনআরসি-র মতো জটিল ও স্পর্শকাতর একটি প্রক্রিয়াকে দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য৷ লোকজ উৎসবগুলিকে প্রান্তে ঠেলে দিয়ে দেশজুড়ে জায়গা করে নিচ্ছে উত্তরভারতীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলি৷ দলিত ও প্রান্তিক সমাজকে ভুল বোঝানো চলছে, কৌশলে তাঁদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হচ্ছে বর্ণবাদী অসম কাঠামোর মধ্যে। রাজি না হলে, প্রতিবাদ শোনা গেলে গ্রেফতার করা হচ্ছে, চোরাগোপ্তা গুলি চলছে, স্তব্ধ করে দেওয়া হচ্ছে প্রতিস্বর। ফ্যাসিবাদের চরিত্রই তাই৷ দেশের সাংস্কৃতিক চরিত্রকে সমসত্ত্ব করে নিতে পারলে বিরুদ্ধমতের চাষ কমে যায়, শাসনকে করে তোলা যায় নিরঙ্কুশ। সংখ্যাগুরু একরঙা আধিপত্যবাদের এই যে ‘গ্র্যান্ড ডিজাইন’, হিন্দি দিবস উদযাপনের তারই এক কুশলী হাতিয়ার। হিন্দি দিবসে হরভংশ রাই বচ্চনের কবিতার আবৃত্তি আমাদের মুগ্ধ করলেও, হিন্দিকে হাতিয়ার করে এই সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সচেতন হয়ে ওঠা প্রয়োজন, সহনাগরিকদের সচেতন করে দেওয়া প্রয়োজন। দেশের প্রতিটি হিন্দি ভাষাভাষী মানুষ ও তাঁদের সংস্কৃতির ওপর পূর্ণ সম্মান দেখিয়েও হিন্দি দিবসের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের আজ গলা তুলতেই হবে।