Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কতটা কান পাতলে তবে কান্না শোনা যাবে? — দ্বিতীয় পর্ব

সুমনা রহমান চৌধুরী

 

অসমে এনআরসি নিয়ে আগের লেখাটিতে তুলে ধরেছিলাম সেখানে এই এনআরসি প্রক্রিয়া চলাকালীন কুলসুমা বিবিদের মতো কয়েক লক্ষ প্রান্তিক গরীব মানুষ যে ভয়ঙ্কর সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন তার কিছু বাস্তবিক রূপ। যাইহোক মাঝে অনেক জল কুশিয়ারা হয়ে বরাক ব্রহ্মপুত্র দিয়ে বয়ে গেছে। এবং ইতিমধ্যে মোটামুটি সারা ভারতবর্ষ জেনে গেছে অসমে ৪০ লক্ষ মানুষ দেশহীন হয়ে উদভ্রান্তের মতো দিনযাপন করছেন।

যদিও সুপ্রিম কোর্ট, কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে বারেবারে এই ৪০ লক্ষ মানুষকে এখনই ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হবে না বা তাদের বিদেশি বলে ট্যাগানোও হবে না। তারা আবার আবেদনের সুযোগ পাবেন। ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল অব্দি পথ খোলা আছে তাদের। মোটকথা এই ৪০ লক্ষ মানুষদের নাগরিকত্ব প্রমাণের সুযোগ দেওয়া হবে, যাতে কোনও বৈধ নাগরিক বঞ্চিত না হন। মানুষগুলো আবার আশায় বুক বাঁধছিলেন। কষ্টেসৃষ্টে নথি যোগাড় করছিলেন। নতুন করে আবার তৈরি হচ্ছিলেন নিজেকে ভারতীয় প্রমাণ করার জন্যে।

কিন্তু ৩০শে অগাস্ট থেকে শুরু হওয়া ‘ক্লেইম এন্ড অবজেকশন’ প্রক্রিয়ায় দেখা গেল খেলা গেছে পাল্টে। কীভাবে? বলছি। প্রথমে বলা হয়েছিল এই ৪০ লক্ষ এনআরসি-ছুটরা প্রথমবার যেরকম নথি দিয়ে আবেদন করেছিলেন, সেইভাবে আবার আবেদন করবেন। এবারে নথি কী কী দিতে হবে তার দুটো তালিকা আছে —

তালিকা A (১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ (মধ্যরাত) পর্যন্ত জারি করা হতে হবে)

  1. ১৯৫১ সালের এনআরসি।
  2. ১৯৭১ সন অব্দি প্রকাশিত ভোটার তালিকা।
  3. ভূমি এবং রায়তি স্বত্বের নথি।
  4. নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র।
  5. স্থায়ী বাসিন্দার প্রমাণপত্র (PRC)।
  6. শরণার্থী পঞ্জিয়নের প্রমাণপত্র।
  7. পাসপোর্ট।
  8. ভারতীয় জীবন বীমা নিগমের বীমা।
  9. সরকারি অনুজ্ঞাপত্র/প্রমাণপত্র।
  10. সরকারি চাকরির নিয়োগপত্র।
  11. ব্যাংক, ডাকঘরের হিসেবের নথি।
  12. জন্মের প্রমাণপত্র।
  13. বোর্ড/বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাগত প্রমাণপত্র।
  14. আদালতের নথি/প্রক্রিয়াজনিত নথি।
  15. রেশন কার্ড।

তালিকা – B (এই তালিকা A তালিকার যে কোনও একটি নথির সাথে সংযুক্ত হলে গ্রাহ্য হবে)

  1. জন্মের প্রমাণপত্র।
  2. ভূমির নথিপত্র।
  3. বোর্ড/বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাগত প্রমাণপত্র।
  4. ব্যাংক, জীবন বীমা, ডাকঘরের হিসেবের নথি।
  5. সার্কল অফিসার/গ্রাম পঞ্চায়েত সচিবের প্রমাণপত্র।
  6. ভোটার তালিকা।
  7. রেশন কার্ড।
  8. অন্যান্য।

এবারে এই তালিকা দেখে প্রথম যে প্রশ্ন মনে আসে তা হল, আজ থেকে ৪৭ বছর আগের যেসব নথিপত্র চাওয়া হয়েছে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্যে, সেইসব নথি এত বছর পর কজনের ঘরে সযত্নে সংরক্ষিত থাকতে পারে? দ্বিতীয়ত, গরীব অশিক্ষিত প্রান্তিক মানুষ কতজনের ঘরে প্রপার কাগজপত্র এবং নথি থাকতে পারে? ৪৭ বছর আগের কজনের ঠিকমতো বার্থ সার্টিফিকেট বা জন্মের প্রমাণপত্র থাকতে পারে? কজনের বিয়ের রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট থাকতে পারে? ভুলে গেলে চলবে না এদেশে এখনও সরকারি নিয়মে রেজিস্ট্রেশনে যায় শহর বা উপশহরের শিক্ষিত শ্রেণি, বৃহত্তর গ্রাম ভারতবর্ষে এখনও ধর্মমতে বিয়েই প্রাধান্য পায়। এবং দুশ্চিন্তার বিষয় হল, এত বছর পর যখন ছেলে-মেয়ের বিয়ে দেওয়াও শেষ, এই জায়গায় দাঁড়িয়ে দুজন পড়ন্ত বয়সী বৃদ্ধা-বৃদ্ধ কী করে প্রমাণ করবেন আজ থেকে এত বছর আগে তারা বিয়ে করেছিলেন?

যে লিগ্যাসি ডাটা বা বংশবৃক্ষ চাওয়া হয়েছে, তাও সবার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ লিগ্যাসিতে শুধু বাপ ঠাকুর্দার নাম দিলেই শেষ নয়, লিখতে হবে ঠাকুর্দার বাবা, তার বাবা, তার বাবার বাবা’র নামও। এবং শুধু নাম লিখলেই চলবে না, নামের বানানের সাথে সরকারি বানানের হুবহু মিল থাকতে হবে। এবারে মিল থাকলেই শুধু চলবে না, জানাতে হবে সেইসব ঠাকুর্দাদের স্কুলের নাম, গ্রামের নাম সহ নানা হাবিজাবি তথ্য। এই অজস্র তথ্য এইসব ঠাকুর্দাদের পরবর্তী প্রজন্মের কজনের মনে রাখা সম্ভব? কজনের পক্ষে সম্ভব আগের প্রজন্মের যাবতীয় তথ্য এবং নথি সযত্নে সংরক্ষিত করে রাখা?

তাও চল্লিশ লক্ষ মানুষ যতটা সম্ভব তৈরি হচ্ছিলেন নিজেকে ভারতীয় প্রমাণ করতে। কিন্তু মাননীয় প্রতীক হাজেলা গোল বাধালেন তাতেও। তিনি সুপ্রিম কোর্টকে সুপারিশ করেছেন পাঁচটি নথি এনআরসি তালিকা থেকে সরিয়ে দিতে। মানে এই পাঁচটি নথি আর যাতে মান্যতা না পায় নাগরিকত্ব প্রমাণে। নথিগুলো হল —

  1. ১৯৫১ সালের এনআরসি।
  2. ১৯৭১ সালের আগে প্রকাশিত ভোটার তালিকা।
  3. স্থায়ী বাসিন্দার প্রমাণপত্র (PRC)।
  4. শরণার্থী পঞ্জিয়নের প্রমাণপত্র।
  5. রেশন কার্ড।

এবারে খসড়া-ছুট ৪০ লক্ষ মানুষের মধ্যে একটা বড় অংশেরই ভরসা ছিল এই নথিগুলো। সুপ্রিম কোর্ট এই প্রস্তাব গ্রহণ করবে না নাকচ সেটা বোঝা যাবে ১৯শে সেপ্টেম্বর এই সংক্রান্ত রায়ের পর। এবং যদি প্রতীক হাজেলার এই প্রস্তাবে সুপ্রিম কোর্ট সিলমোহর বসিয়ে দেয়, তাহলে এই চল্লিশ লক্ষ মানুষের জীবনে যে আরও নিকষ কালো অন্ধকার ঘনিয়ে এল সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ এনআরসি-র যে মড্যালিটি অনুযায়ী তালিকা A-তে এই পনেরোটি নথির নাম আছে, তা কিন্তু ঠিক করা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট, কেন্দ্র, রাজ্যের সর্বসম্মতিক্রমে। এবার ঠিক মাঝখানে এসেই দুম করে নিয়ম বদলে ফেলার প্রস্তাব করা হল! লালমোহনবাবুর ভাষায় বলতে গেলে “হাইলি সাসপিশিয়াস”!

চল্লিশ লক্ষ মানুষ আশায় বুক বাঁধছিলেন। বিশ্বাস করেছিলেন সুপ্রিম কোর্ট, কেন্দ্র, রাজ্যকে। ‘নিজেদের বৈধ প্রমাণ করার সুযোগ দেওয়া হবে তাদের’ নিজেকে এই বলে বলে প্রবোধ দিচ্ছিলেন তারা। কিন্তু বাস্তবে সুযোগ দেওয়া তো দূর, আরো গভীর খাদের দিকে ঠেলে দেওয়ার চক্রান্ত করা হচ্ছে তাদের সঙ্গে। ১৯৫১ সালের এনআরসি বা ১৯৭১ সালের আগের ভোটার তালিকাগুলো, রেশন কার্ড নাকচ হয়ে গেলে নিজেকে ভারতীয় প্রমাণের আর কোন পথটা খোলা রইল এই মানুষগুলোর কাছে? এই মানুষগুলোর শেষ ভরসা ১৯৫১ সালের এন আর সি আর ১৯৭১ সালের আগের ভোটার তালিকা, রেশন কার্ড এগুলোই তো ছিল! সাধারণ প্রান্তিক কজন মানুষের কাছে পাসপোর্ট, জমির দলিল, এলআইসি পলিসি, বোর্ড/ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেট কিংবা সরকারি চাকরির নথি আছে? কিন্তু ৪০ লক্ষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রকেরা এইসব ভাবলে তো!!?

এতদিন সারা অসমে হিন্দুদের ঘরে ঘরে গিয়ে প্রচার করা চলছিল, “এনআরসি আসলে করা হচ্ছে মুসলমানদের জন্যে, তাদেরকে অসম থেকে বিতাড়নের জন্যে, সব বাঙালিই আসলে মুসলমান যারা বাংলাদেশ থেকে এসে উঠেছে।” এবং নাগরিকত্ব বিলে বলা হচ্ছে — “২০১৪ সালের ভোটার লিস্ট দেখে মুসলিম বাদে অন্য সব ধর্মের মানুষের নাম এনআরসি-তে তোলা হবে, কারণ তারা শরণার্থী, অন্য দেশ থেকে হিংসার বলি হয়ে এসেছে।” মানে সহজ ভাষায় মুসলমান বাদে এই ভারতবর্ষে সবাই বৈধ। তাহলে এবারে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল, শরণার্থী নথি মান্যতা হারানোর পর হিন্দু বাঙালিরা আদৌ বুঝতে পারবেন তো, লড়াইটা আসলে হিন্দু বনাম মুসলমান নয়, লড়াইটা আসলে উগ্র অসমীয়া জাতীয়তাবাদ বনাম বাঙালির অস্তিত্বের? এবং সর্বোপরি যে “রামরাজ্যের” ট্যাবলেট তাদের গিলানো হচ্ছে, সে রামরাজ্যে তাদের অবস্থাও আসলে তাজমহল তৈরি করা শ্রমিকদের মতোই? উত্তরটার জন্য ২০১৯ তোলা রইল।