অভিজিৎ কুণ্ডু
সেই কবে বলে গিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। যত বেশি জানে তত কম মানে। গত কয়েক বছরে দেশের নানা প্রান্তের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘিরে যে তাণ্ডব চলছে, সেসব দেখে হয়তো তিনি বলতেন, বই ছেড়ে লাঠি ধরো, যাকে পাবে তাকে মারো। সনাতনপন্থী স্বয়ংসেবক ব্রিগেডের ছাত্র সংগঠন বিদ্যার্থী পরিষদের আস্ফালনে অতিষ্ঠ ছাত্র শিক্ষক মহল। গেরুয়া ধ্বজাধারী বাহিনীর র্যাডারে রয়েছে সেইসব ছাত্র-শিক্ষক মহল, যারা প্রশ্ন আর গবেষণার মাধ্যমেই জগৎকে চিনে নিতে চায়। সক্কালবেলায় ড্রিল করে খাকি প্যান্ট আর লাঠি হাতে দেশের সীমান্তরক্ষার সংকল্পে যারা দীক্ষিত নয়।
অনভ্যাসে বিদ্যাহ্রাস। সেইসব লাঠি (সাথে আরও মারাত্মক কিছু) নিয়ে তাই তারা নেমে পড়েছে শিক্ষা প্রাঙ্গণে। গত কয়েকবছর ধরেই রাজধানীর বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে অঘোষিত গেরুয়াকরণ। তর্ক-বিতর্কের কোনও অবকাশ নেই। আদর্শগত বা তত্ত্বগত কোনও বিরোধিতা এখানে চলবে না। সেমিনার বা কনফারেন্সে কাদের আমন্ত্রণ জানানো যাবে বা যাবে না, সেসব নজরদারির দায়িত্ব এরা নিয়ে নিয়েছে। সাথে পেয়েছে ‘প্রো-এস্ট্যাবলিশমেন্ট’ মানসিকতার কিছু প্রশাসন অথবা সরকারি গেরুয়া টিকি বাঁধা কিছু আধিকারিক।
লাগাতার হামলা চালানো হচ্ছে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মৌলিক ভিত্তিতেই। চিরকালই গণতান্ত্রিক আর নানা ধারার বাম আদর্শের আঁতুরঘর হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামডাক। সমাজের বৃহত্তর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বিভিন্ন বৃত্তিতে পাঁচ দশক ধরে জে এন ইউ-এর ছাত্রছাত্রীরা সাফল্যের সাথে জড়িয়ে গিয়েছে। এই পাঁচ দশকের বিভিন্ন মোড়ে র্যাডিকাল রাজনীতির হাত ধরেও কখনও কয়েকজন সমাজবিপ্লবে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহমান সুরে মিলেমিশে আছে প্রাতিষ্ঠানিকতা আর প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা। শিক্ষার এই পরিসরে কোনওকালেই শিকড় জমিয়ে বসতে পারেনি সনাতনপন্থী বা চরম দক্ষিণপন্থী মতবাদ। উচ্চশিক্ষার এই পীঠস্থান স্বাভাবিকভাবেই নয়া গেরুয়া জমানার কাছে পয়লা নম্বর দুশমন।
ছলে-বলে সঙ্ঘ ভাবধারার উপাচার্য বসিয়ে জে এন ইউ-কে বদলে ফেলার এজেন্ডা হাতে ছিলই। আগুনে ঘি পড়ে ২০১৬ সালে ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনায়। ‘দ্য কান্ট্রি উইদাউট আ পোস্ট অফিস’, আঘা শাহীদ আলির কবিতার বইয়ের শিরোনাম দিয়ে কাশ্মীর ট্রাজেডির অ্যালেগরি টেনে ক্যাম্পাসে মিটিং হয়েছিল। অত্যন্ত সংবেদনশীল ও বিতর্কিত বিষয়ে এমন সমাবেশ হওয়া সম্ভব যেকোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীন পরিসরে। আর জে এন ইউ গঠনের প্রাথমিক শর্ত বা রূপরেখা তো নেহেরু দর্শন অনুপ্রাণিত। মানবিকতা, সহনশীলতা আর যুক্তি — এই তিন স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়। সত্যের অনুসন্ধান যেখানে চলবে নিরন্তর চিন্তাভাবনার অভিযানের মাধ্যমে। সেটাই মনুষ্যজাতির প্রগতির লক্ষণ। ঠিক এই চিন্তাধারার পরিপন্থীরাই সেদিন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গোটা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে।
১৯৮৩ সালের পর আবার ২০১৬ সালে পুলিশ, সি আর পি এফ ঢুকে গেল ক্যাম্পাসে। ছাত্রসংসদের তৎকালীন সভাপতি সহ দুই ছাত্র গ্রেপ্তার হল। কিছু গণমাধ্যম প্রত্যক্ষভাবে মদত দিতে লাগল একটা মব হিস্টিরিয়া তৈরি করতে। পুলিশ হেফাজত আর কোর্ট চত্বরেও চলল বেপরোয়া শারীরিক নিগ্রহ। শেষ পর্যন্ত জামিনে ছাড়া পেয়ে গেল তিন ছাত্রই। পরবর্তী সময়ে এদের ডক্টরেট থিসিস অনেক বাধা সৃষ্টি করেও কোর্টের ‘ধমকে’র কাছে জে এন ইউ-এর বিরূপ প্রশাসনকে ঢোক গিলতে হয়েছে। কেটে গেল আড়াই বছর, এখনও কোনও চার্জশিট আদালতে পুলিশ পেশ করতে পারল না। ভুয়ো অভিযোগ, এডিটেড ভিডিও, ফেক অডিও-র সাহায্যে পেটোয়া মিডিয়ায় প্রচার চালানো এক কথা আর আদালতে অকাট্য প্রমাণ পেশ করা আর এক কথা৷ দেশদ্রোহী তকমা বা ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ এইসব প্রচার আদালতে প্রমাণের ধার ধারে না। তৈরি করে এক বিদ্বেষমূলক পরিবেশ; হঠকারী আর হিংসাত্মক জমায়েত তৈরি করাই এর উদ্দেশ্য। হয়তো পায়ের নিচে জমি আলগা হচ্ছে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ইভিএম অভিযোগ/দোষে দুষ্ট আরএসএসের ছাত্র সংগঠন একেবারেই সুবিধা করতে পারেনি ১৪ই সেপ্টেম্বরের জে এন ইউ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে। গণনার প্রাথমিক পর্বে সেই ইঙ্গিত পাওয়ার পর পরই তারা সচেষ্ট হয়েছে সেই গণনা বানচাল করতে।
শেষরক্ষা হয়নি। গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা অত্যন্ত ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিয়ে নিজেদেরই গড়া নির্বাচন কমিটিকে আগলে রেখেছে রাতভর। দু’দিনের মাথায় গণনা শেষে প্রমাণিত হয়েছে রাজনৈতিক আর আদর্শগতভাবে স্বয়ংসেবকদের ছাত্রসংগঠনকে প্রত্যাখ্যান করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা। প্রশ্ন এখানেই — কারা প্রত্যাখ্যান করল? চার-চারটি বামপন্থী সংগঠনের মিলিত শক্তি ‘লেফট ইউনিটি’ বনাম বিদ্যার্থী পরিষদের এই লড়াইকে অনেকে চেষ্টা করছে বিদ্যার্থী পরিষদের নৈতিক জয় হিসেবে দেখাতে। সত্যি কথা, বামপন্থী সংগঠনগুলো বিভাজিত নানা তাত্ত্বিক তর্ক-বিতর্কে। আবার এটাও সত্যি যে, মার্কসবাদ এমনই এক আবহমান তত্ত্ব যে, নানা বিশ্লেষণ ও উপ-বিশ্লেষণে এক শতাব্দী ধরে দেখছি নানা ধারার মার্কসীয় স্কুল অফ থট। তার সাথে রয়েছে ভারতীয় প্রেক্ষাপটে নানা ঐতিহাসিক ভাঙাগড়া, বাম শিবিরেই। তাহলে কি যারা আজ ‘লেফট ইউনিটি’ নাম নিয়ে নির্বাচনে লড়ল তাদের আভ্যন্তরীণ মতভেদকেই সামনে এগিয়ে রাখব? না, অন্যভাবে দেখব — এই চারটি দল: লিবারেশনপন্থী আইসা, মার্কসবাদী কম্যুনিস্ট পার্টির ছাত্র ফেডারেশন, কম্যুনিস্ট পার্টির এআইএসএফ আর ছাত্র ফেডারেশন থেকে কয়েকবছর আগে আলাদা হয়ে যাওয়া ডিএসএফ সমষ্টিগতভাবে তুলে ধরেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আপামর ছাত্রছাত্রীর মৌলিক আদর্শগত চাহিদা। বাম সংকীর্ণতার বদলে এক ধরনের গণতান্ত্রিক ছবিও এর মধ্যেই খোঁজা যেতে পারে। এই গণতান্ত্রিক বামশক্তির কাছেই কিন্তু হার মেনেছে একশিলা বিদ্যার্থী পরিষদের দম্ভ। বয়োজ্যেষ্ঠরা কতটা বুঝবেন এই সদ্য উনিশ-কুড়ি অতিক্রান্ত ছাত্র-ছাত্রীদের পরিপক্কতা, সেটার দিকে আমাদের তাকিয়ে থাকতে হবে।
অবশ্য শুধু জে এন ইউ’র দিকে তাকিয়ে থাকলে হয়তো ছবিটা পরিষ্কার হবে না। অল্প সময়ের ব্যবধানে পর পর বেশ কয়েকটা ছাত্রসংসদ নির্বাচনে বাম-গণতান্ত্রিক শক্তি বিজয়ী হয়েছে। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে এই প্রথম কোনও ছাত্রী সভাপতি পদে বিজয়ী হল। কানুপ্রিয়া কউর বামমনস্ক সংগঠন এসএফএস — স্টুডেন্টস ফর সোসাইটির সদস্যা। রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা কলেজে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে ছাত্র ফেডারেশনের প্রতিনিধিরা। আইসা’র সদস্য সাফল্য পেয়েছে গাঢ়ওয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে সহ-সভাপতি পদে। বিক্ষিপ্তভাবে অসম প্রতিদ্বন্দ্বী আর প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কিন্তু প্রতিরোধ হচ্ছে। এখনও নির্বাচিত সদস্যদের উপর, ছাত্রসংগঠনের কর্মীদের উপর লাগাতার আক্রমণ চলছে জে এন ইউ-তে। পাল্টা মারামারির পথে না হেঁটে, ছাত্র-শিক্ষকেরা সামিল হয়েছে বিশাল প্রতিবাদ মিছিলে। পরিকল্পিতভাবে হিংসা ছড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়ার চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটা সংগঠন। গেরুয়া বনাম এক রামধনু জোট স্বাভাবিকভাবেই মান্যতা পাচ্ছে এই ‘অস্থির পরিবেশে’। ছাত্রসংসদে ‘লেফট ইউনিটি’ তারই ইঙ্গিত।
স্নায়ুচাপ বাড়ছে। একটার পর একটা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বা প্রতিষ্ঠানে অনুগামী উপাচার্য বা প্রধানের মাধ্যমে প্রগতিশীল সবরকমের কর্মকাণ্ডকে আটকে দেওয়া চলছে৷ সবচেয়ে বেশি আক্রমণ নামানো হচ্ছে সমাজের নিম্নবর্গের বা বামপন্থী ভাবধারার কোনও উত্থানকে। দিনদুপুরে গুম হয়ে যাচ্ছে নাজিবের মতো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছাত্র জে এন ইউ-এর হস্টেল থেকে। এক বছরের ওপর কেটে গেলেও এই অভিশপ্ত অন্তর্ধানের কোনও কিনারা করতে পারেনি পুলিশ থেকে সিবিআই। একটানা হিংসা চালিয়ে যাওয়া বিদ্যার্থী পরিষদের বিরুদ্ধে আধিকারিক বা আইনি ব্যবস্থা না নিয়ে, উল্টে বিশ্ববিদ্যালয়ে আপাতকালীন বাধানিষেধের নিয়ম চালু করা হচ্ছে৷ যাতে তাদের হিংসা-হামলার কথা সকলের মধ্যে না নিয়ে যাওয়া যায়। মিছিল-মিটিং বন্ধ করার আদেশ দিচ্ছেন রেজিস্ট্রার, ক্লাস ক্যাম্পেইন করা চলবে না, হস্টেলে চলবে যত্রতত্র তল্লাশি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্য যে চরিত্র, স্বাভাবিক যে জীবনযাত্রা — সে সব কিছু স্তব্ধ করে দেওয়ার খেলায় মেতেছে ছাত্রদের রায়ে পরাজিত পরিষদ আর তাদের পৃষ্ঠপোষক প্রশাসন। অতিরিক্ত স্নায়ুচাপেই হোক বা সহনশীল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাবেই হোক, দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পর্যন্ত বলে ফেলেছেন — জে এন ইউ-এর ছাত্র সংসদের সমর্থকেরা দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে! কারণ, অন্যদিকে আওয়াজ উঠেছে — ইভিএম নেহি, এয়ে ব্যালট হ্যায়/মোদিজী পে ম্যানডেট হ্যায়!