মৌমিতা নাথ
চোর
টিটো আর কালিন্দী ছুটতে ছুটতে একটা বড় বাড়ির সামনে এসে থামল। রোজ গেটে তালা দেওয়া থাকে। আজ নেই। শুধু লোহার ছিটকিনিটা আটকানো। প্রায় এক মানুষ উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাড়ি। গেটের পাশে সাদা মার্বেলের ওপর কালো হরফে লেখা, রাজেন্দ্র প্রসাদ দেব।
টিটো তাকে ঠেলা দেয়। বাতাবি লেবু, হাত বাড়ালেই পাওয়া যাবে। গাছে উঠতেও লাগবে না… একটা গোটা লেবু!
জন্ডিস হওয়ার পর ডাক্তার কালিন্দীর মা’কে বাতাবি লেবু খেতে বলেছিল, কিন্তু যে ক’ঘর বাতাবি লেবুর গাছ আছে তারা কেউ দিতে চায় না। সাহেবদের গাছটা খোলা রাস্তার ধারে। কালিন্দী কয়েকবার চেষ্টা করেছিল সেই গাছ থেকে একখানা লেবু হাপিশ করতে কিন্তু সাহেবের দারোগা মা সারাক্ষণ সজাগ থাকে। হয়নি…
রাধাবল্লভ মন্দিরে রোজ সন্ধেবেলা পুজোর প্রসাদ খেতে কালিন্দী মন্দিরের দরজার কাছে ওঁত পেতে দাঁড়িয়ে থাকে। একদিন নকুলদানার সঙ্গে ঠাকুর মশাই এক কুচি বাতাবি লেবু দিয়েছিল। নকুলদানা দু’টো মুখে পুরে দিয়ে বাতাবি লেবুর টুকরোটা এক ছুটে বাড়ি ঢুকে মায়ের হাতে গুঁজে দিয়ে জয়ের হাসি হেসেছিল কালিন্দী। দুদিন পর পর প্রসাদে শুধু নকুলদানা। –“একটা লেবু দেবে?” –“তোর বাবা কি রোজ ঠাকুরকে পুজো দিয়ে যায় যে তোকে লেবু দেব! যা এখান থেকে নইলে এবার থেকে নকুলদানাও দেব না।” কালিন্দীর চোখে খরা। বুকে আগুন জ্বলে।
টিটো ধৈর্য ধরতে না পেরে গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, “তোকে যেতে হবে না, আমি ফুল আর লেবু নিয়ে আসলে তাতে ভাগ বসাবি না কিন্তু…!” সাহস। বাধ্যতা। টিটোর পায়ে পায়ে কালিন্দীও…
নুড়ি বিছানো রাস্তার দু’পাশে সাজানো বাগান। ফুল…। রাস্তাটা এঁকে বেঁকে বাড়ির মূল পৈঠাতে গিয়ে শেষ হয়েছে। পাঁচিলের গা ঘেঁষে আম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, বাতাবি লেবুর গাছ। টিটো কয়েকটা টগর, জবা আর গাঁদা ফুল টপাটপ তুলে নিয়ে প্লাস্টিকে ভরল। দেখাদেখি কালিন্দীও তার হাতের প্লাস্টিকটা একবার ঝেরে নিয়ে ফুলগাছের দিকে হাত বাড়াল। তার হাত অবশ হয়ে এসেছে। অন্যায় হচ্ছে? ভোরের আলোয় সদ্য চোখ মেলতে শুরু করেছে গোলাপগুলো। কালিন্দীর মায়া হল। থাক…
“এই দেখ”। দূরে বাতাবিলেবু গাছের নিচে টিটো। সবুজের ওপর ধূসর আস্তরণ। টিটোর হাতে যেন লেবু নয়, বিশ্বকাপ ট্রফি…
ফুল ফেলে কালিন্দী সেই দিকে ছুটল। সেও একটা লেবুর গায়ে হাত ছুঁইয়েছে এমন সময় বাজ পড়ার মতন পিলে চমকানো কণ্ঠস্বর, “কারা রে? কাকে জিগেস করে তোরা বাগানে ঢুকেছিস?”
বাড়ির মালিক। হাতে একখানা বাদামি ছড়ি, পরনে ধবধবে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি। পায়ে ফিতে বাঁধা চামরার চটি। মর্নিং ওয়াক থেকে ফিরেছেন ফর্সা সৌমদর্শন রাজেন্দ্র প্রসাদ দেব।
টিটো হাতের লেবুটা ফেলে দিয়ে লাফ দিয়ে পাঁচিল টপকে ঝপ করে নেমে গেল রাস্তায়। কালিন্দীর পাদুটো মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে। সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। রাজেন্দ্র প্রসাদের হাতের ওই লাঠি এবার কালিন্দীর পিঠে সপাৎ শব্দে আছড়ে পড়বে।
নাহ্ রাজেন্দ্র প্রসাদ কালিন্দীকে মারলেন না। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন পৈঠার দিকে। হাতের লাঠিটা বারান্দারর গ্রিলের গায়ে ঝুলিয়ে দিয়ে বসে পড়লেন। –“এই মেয়ে, এখানে আয়।”
রাজেন্দ্র প্রসাদের নরম স্বর কালিন্দীর পায়ের ওপর থেকে মাটির পাহাড় সরিয়ে দিল। কালিন্দী দু’পা এগিয়ে আসল। তার চোখ ফেটে জল আসার উপক্রম। তার খালি পা, পরনে বহু ব্যবহারে পাতলা হয়ে আসা জামা। — “কী গো শুনছ?” ডাক। ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন এক মধ্যবয়স্ক মহিলা। –“এই মেয়েটার হাতে দুটো বিস্কুট দাও তো। কে জানে শেষ কখন খেয়েছে।”
মহিলা ঢুকে গেলেন। রাজেন্দ্র প্রসাদ হাতের ইশারায় কালিন্দীকে আরও কাছে ডাকলেন। “না বলে বাড়িতে ঢুকেছিস কেন? আজ ফুল চুরি করেছিস কাল কী চুরি করবি? আনুমতি না নিয়ে বাগানে ঢুকেছিস, কাল কার ঘরে সিঁধ কাটবি?”
কালিন্দীর চোখ ফেটে জল আসছে। এর থেকে ভালো যদি রাজেন্দ্রপ্রসাদ ওই বাদামি ছড়ি দিয়ে কালিন্দীর পিঠের ছাল তুলে নিতেন।
রাজেন্দ্র প্রসাদের স্ত্রী দুটো বিস্কুট এনে হাজির হলেন।
“এই নে, বিস্কুটটা। ওই লেবুটা কুড়িয়ে নিয়ে বাড়ি যা। এবার থেকে জিজ্ঞেস করে তবে বাড়িতে ঢুকবি। এখন আয়।” রাজেন্দ্রপ্রসাদ বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। ধীরে। কালিন্দী যন্ত্রের মতো বিস্কুট নিল। প্লাস্টিকে পুড়ল লেবুগুলোও। গেটের বাইরে বেরোল। নামফলক। মানুষটার নাম। কালিন্দীর মুখ ঝুলে পড়ল। নিচে।
আর হঠাৎই টিটো। “এই লেবুটা আমি পেড়েছি, এটা আমার। আমার লেবু আমাকে দে।” বলেই টিটো কালিন্দীর হাত থেকে বাতাবিলেবুটা ছিনিয়ে নিয়ে দৌড় দিল ওদের পাড়ার দিকে।
কালিন্দী টিটোর চলে যাওয়া দেখল, তবে বরাবরের মতন তার পিছু নিল না। কালিন্দীর সামনে এখন অন্য কেউ এসে দাঁড়িয়েছে।
কালিন্দী জানে না, তাকে মানুষ বিবেক বলে।
মিথ্যে
কাকের কর্কশ কণ্ঠস্বর পাখিটির চরিত্রকে ভুল ব্যাখ্যা করে। নইলে এই জুবুথুবু ঠান্ডায় ডানায় ডানা ছুঁইয়ে একে অন্যের শরীরকে উষ্ণতা বিনিময় করত না হয়তো। আম্মিও তো সারাদিন খসখসে গলায় আব্বুকে গালাগাল করে। তা বলে কী আম্মি ভালোবাসে না? ভালো না বাসলে যে আব্বু চার সন্তান আর বিবি ছেড়ে বুড়ো বয়সে একটা বাচ্চা মেয়েকে নিকাহ্ করেছে, তার জন্য আম্মি মাছের সব থেকে বড় পিসটা তুলে রেখে দিতে পারত! আব্বুর নতুন বউ তো আফরোজার-ই বয়সী। চাঁদপুর স্টেশনের ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে বসে দু’টি কাকের আচরণ দেখে আফরোজা মনে মনে আম্মি আব্বুর কথাই ভাবছে। প্রান্তিক রেল স্টেশন। ট্রেনের বিলম্বিত গমনাগমন। আফরোজার কাছে ঘড়ি নেই। তবে এক এক করে তিনটে ট্রেন চলে যাওয়ায় হিসেব বলছে ৪-৫ ঘণ্টা কেটে গেছে। কিন্তু এখনও রফিক এল না। বলেছিল দু-এক ঘণ্টা দেরি হতে পারে। কাজ জমে আছে অনেক। তবে সে আসবেই। আম্মির ঘুম ভাঙার আগেই সে বেরিয়ে এসেছে মহল্লা থেকে। কয়েকটা সালোয়ারের সঙ্গে আম্মির একটা শাড়িও না বলে নিয়ে এসেছে। শাড়ি পরে কদমবুশি করলে রফিকের আম্মির মন গলতে পারে। এদিকে দুপুর হতে চলেছে। খিদেয় আফরোজার শরীরটা দুমড়ে আসছে। খানিক দূরে একটা চায়ের দোকান। বিস্কুট কেক। কিন্তু চায়ের দোকানের মালিকের ওই লোকটা সেই সকাল থেকে বসে আছে। নজর আফরোজার দিকে। চাহনি আফরোজার চেনা। এমন চাহনি তার মহল্লার অলিগলিতে মেলে। আফরোজা পেটে প্লাস্টিকের ব্যাগটা চেপে ধরল। চোখে রফিকের আসার পথ…
“কই যাবে মামণি?” কখন যেন উঠে এসেছে লোকটা। আফরোজার সামনে। –“আমি রেলপুলিশের লোক। সব আমাদের চোখে পড়ে। কী কেস?” –“এক বন্দু আসবে।” –“অ, তা নাম কী বন্দুর?” –“রফিক লস্কর, এল আই সি করে।” লোকটা দাড়ি খামচায়। –“কোথায় বাড়ি বলো তো? চেনা চেনা লাগছে।” –“মুমিনপুর।” লোকটা প্রগলভ হল। –“ও হো, আমাদের মুমিনপুরের রফিক? সে তোমার বন্দু? তা মানে ইয়ে, কেমন বন্দু?” নির্বিকার আফরোজার সামনে লোকটার পরের প্রশ্ন — “রফিকের সঙ্গে কোথায় যাবে মামণি?… বেয়ে টেয়ে করবে নাকি? ঘর তেকে পালিয়ে এয়েচ নাকি?”
আফরোজার বুক ঢিপঢিপ করে। রফিক কথা না রাখলে তাকে ঘরে ফিরে যেতে হবে। আম্মি এতক্ষণে সব বুঝে গেছে। ফিরে গেলে চুলের মুঠি ধরে দরজায় ঠুকে দেবে। রাগ বাড়ছে। রফিক না এলে যে বাবলা গাছের নিচে বসে স্বপ্ন দেখিয়েছিল, সেখানেই ওকে দাফন করবে। আলি এসব কাজে ওস্তাদ। আলি। ও আফরোজাকে দুসরা বিবি করে ঘরে তুলতে চায়।
চাঁদপুর স্টেশন থেকে নেমে রেললাইন ধরে মকরামপুরের দিকে একশো মিটার হাঁটলেই বাঁদিকে ময়লার স্তুপের ভেতর দিয়ে পায়ে চলা অত্যন্ত সরু একটা রাস্তা একেঁবেঁকে ঢুকে গেছে দর্জিপাড়া। ছোট ছোট প্লাস্টিক ঘেরা খুপরিগুলোর গায়ে গায়ে মাথা তুলে পরপর দাঁড়িয়ে পড়েছে ইটের পাকা বাড়ি। নতুন, প্লাস্টারহীন পাঁচ ইঞ্চির গাঁথুনির এই বাড়িগুলো অশক্ত, ভঙ্গুর। এরকমই একটি বাড়ির দশ ফুট বাই বারো ফুটের এক একটা ঘরে তিনটে করে সেলাই মেশিন। মাথা নিচু করে একমনে ব্যাগ সেলাই করছে রফিক। ঠান্ডা। খুব ইচ্ছে করছে একটা বিড়ি ধরাতে। সময় কম। দুপুরের আগেই স্টেশনে পৌঁছে যাবে বলেছিল আফরোজাকে। ম্যানেজার আরও দু’শোটা ব্যাগ দিয়ে গেছে। ফিনিশিং স্টিচ হবে। এই সময় খুব সতর্ক হয়ে কাজ করতে হয়। ফাইনাল ডেলিভারিতে যেন কোনও ডিফেক্টেড পিস না যায়, আলাদা করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। কিন্তু রফিক তাড়াহুড়ো করছে। সেলাই মেশিনে তার হাত-পা ঝড়ের বেগে ছুটছে। আজ যখন রফিকের আসল পরিচয় আফরোজা জানবে কী প্রতিক্রিয়া হবে তার! বুকটা চুপসে যাচ্ছে। প্রথমদিন আফরোজার সাথে দেখা করতে রফিক সুন্দর একখানা শার্ট প্যান্ট পরেছিল। মালিকের ছেলে কলকাতা গেলে এইরকম পোশাক পরে। রফিকেরও ইচ্ছে হয় সুন্দর পোষাক পরে চামড়ার ব্যাগ হাতে অফিস যায়…
“আর কতক্ষণ বসবে গো? চলো তোমায় মুমিনপুর দিয়ে আসচি। রফিকের বাড়ি আমি চিনি। কত্তবার গিসি।”
লোকটার অভিসন্ধি আফরোজা বুঝেছে, কিন্তু চুপ করে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই তার। আপাতত ঘরে ফেরার কথা আফরোজা ভাবতে পারছে না। পাশেই দর্জিপাড়ায় দিলরুবার বাপের ঘর। আকবরের সাথে ঝগড়া করে সে এখন দর্জিপাড়ায় উঠেছে।
আফরোজা ওঠার জন্য উশখুশ করছে লক্ষ করে লোকটি বলল, “কী মামণি, যাবে? এই সামনেই বাস রাস্তা। চলো দিয়ে আসি। সোন্দে হয়ে গেলে কিন্তু বাস পাবে না।” — “আমি মুমিনপুর যাব না। তুমি যাও।” আফরোজা দর্জিপাড়ার দিকে হাঁটতে লাগল।
কয়েক পা এগোতেই… রেললাইন ধরে ও কে? রফিক না? বড় করে শ্বাস নিল। ওর খিদে, ক্লান্তি এখন আর নেই।
রাস্তায় দু’জন বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। রফিকের মনের মধ্যে ঝড়। আফরোজার শান্ত দৃষ্টি। খানিক পর রফিক মাটি থেকে একটি নুড়ি কুড়িয়ে দু’হাতে সেটিকে ঘষটে ঘষতে বলে, “আমি ক্লাস ফোর অবদি পড়েচি। দর্জির কাজ করি। এটা চাড়া আর কোনও মিত্যে কতা বলিনি। আল্লার কসম্।”
আফরোজার পা টলে গেল। আঘাত। এত বড় মিথ্যে কথাটা যে বলেছে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কিচ্ছুক্ষণ। এই একটাই মিথ্যে…?
এই স্তব্ধতা হাজারটা কাঠ পিঁপড়ে হয়ে রফিকের সারা শরীরে বাইতে শুরু করেছে। রফিকের হাত কাঁপছে। গাল বেয়ে নোনাজল। আফরোজা রফিকের মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওর গা ঘেঁষে দাঁড়াল। সন্ধে নামছে। শীতের রাতে বাস চলাচল বেশিক্ষণ হয় না।
তবে শেষ বাসটা ওরা পেয়ে যাবে নিশ্চিত।
শাস্তি
টিভি, ফ্রিজ, খাট, আলমারির মতন ভারি জিনিসগুলো গাড়িতে তোলা শেষ হলে এখন ছোট ছোট আসবাবগুলো গাড়িতে তোলা চলছে। পাড়ার লোক কেউ এই বাড়ি বদল মেনে নেয়নি। নেবেই বা কীভাবে! রুবির মা কাকলি দিনে দু’বার প্রতিবেশীদের খবর নেন। বিল্টু কিংবা চুটকির মা’দের হলুদ-লংকা, নুন-চিনি ফুরোলে দোকানের বদলে কাকলির রান্নাঘরের চেয়ারে এসে বসে। ঘরের চাল পরিষ্কার করার জন্য সিঁড়ি কিংবা ইলেক্ট্রিক বোর্ডের ফিউজ সারাই করতে টেস্টারের প্রয়োজন হলে শিবু, লাল্টুরা ছেলে মেয়েকে পাঠিয়ে দেয় ডাক্তারকাকুর চেম্বারে। বিনা সুদে হাজার দু-তিন টাকাও ধার চাইলে পাওয়া যায়। গোটা পাড়ায় একমাত্র টেলিভিশন সেট আছে রুবিদের বাড়ি। বিকেল হলে সিনেমা টেলিভিশন দেখার জন্য মানুষের ভিড় দেখে রুবি বিরক্ত হয়। দ্বিতীয় টেলিভিশনের সেটটি রয়েছে দীপকের চেম্বারে। পক্ষপাতিত্ব। টিভির রিমোটটি দীপকের স্নেহধন্য কোনও বাচ্চা মেয়ের হাতেই থাকে।
রুবির ঈর্ষা নেই, আপত্তি আছে প্রচণ্ড।
কতক্ষণে এই বাড়ি থেকে বেরোবে! রুবি হাঁপিয়ে উঠছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল এখনও সমস্ত মালপত্র গাড়িতে উঠল না। আশেপাশেই কোথাও রয়েছে অনন্য। গোটা এলাকায় কোথায় কখন কী হচ্ছে সব খবর পৌঁছে দেওয়ার বিশ্বস্ত লোক তার আছে। অনন্য রুবির কাছেই টিউশন নিত। তখন রুবি সবে সবেমাত্র মাস্টার ডিগ্রির পড়া শেষ করে কলকাতা ছেড়েছে। চাকরির পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি। টিউশন। অনন্য বলত সিলেবাসের পড়া তাকে টানে না। রুবির হাতে রোজ চড় থাপ্পড় খেয়ে অনন্যর গালের চামড়া গন্ডারের চামড়া হয়ে গেছে। অথচ কথা বলায়, দৃঢ়তায় অনন্যর গালের চামড়ার সাথে সাথে শক্ত হয় তার চোয়াল, সংকল্প, চরিত্র, লক্ষ্য। রুবির চোখে সমীহ, স্নেহ।
কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট। ভাড়া। একবছরের চাকরিজীবনে স্কুলশিক্ষিকা রুবির সঞ্চয় একটা বাড়ি কেনার অযোগ্য। ষাট হাজার টাকা সেলামি দিয়ে ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়াতে কাকলির অত্যন্ত আপত্তি ছিল। কিন্তু উপায় ছিল না। রুবির অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক বাবা কিছুতেই এই বাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি নয়। তবু চোখের জল আটকে কাকলির কাছে রুবির সিদ্ধান্তই একমাত্র মুক্তির পথ।
পাড়ার লোক অন্য কথা বলে। ‘কলকাতার হাওয়া। স্কুল টিচার। এখন আর গ্রামের গন্ধ সহ্য হয়?’ ইত্যাদি। রুবি হাসে। কেউ জানে না। একমাত্র রুবি, কাকলি, অনন্য, দীপক।
গাড়িটা একটু একটু করে পেছনে ফেলে চলে যাচ্ছে রিফিউজি রুবিদের প্রথম তৈরি করা বাড়ি, উঠোন, শৈশব, লাইব্রেরি। রাস্তার মোড়ে যেখানে গলির রাস্তা মেইন রাস্তায় মিশেছে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে অনন্য। “যেখানেই থাকো, দেখা হবে রুবিদি।” গাড়িতে বসে কাকলির কান্নার শব্দ ছাপিয়ে শিকড় ছেঁড়ার শব্দ পেল রুবি। সান্ত্বনা দিতে রুবি কাকলির একটা হাত চেপে ধরতেই চমকে উঠল। এত ঠান্ডা হাত! সেই রাতে সুলেখার মা’য়ের হাতও এমনই ঠান্ডা ছিল। সুলেখার মা। রুবিরা চারজন ছাড়া বাড়ি বদলের কারণ জানে ওই নারীও।
সেই রাত। তখন রাত দু’টো কিংবা আড়াইটে। রুবিদের বারান্দার গ্রিলে ধাক্কা। রুবির বাবা বাইরের ঘরের দরজা খুলেছিল, “কারা? কী দরকার এত রাতে?” উঠে এসেছিল রুবিও। গ্রিলের দরজা ঝাঁকিয়ে অনন্য বলেছিল, “রুবিদি তুমি যদি এক্ষুণি আমার সঙ্গে সুলেখাদের বাড়ি না যাও তাহলে আমাদেরকে হসপিটাল হয়ে থানায় যেতে হবে। তুমি কি চাও তোমার বাবা জেলের ভাত খাক? তোমাদের সম্মান চুলোয় যাক?” দীপক মুখ নিচু করে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল।
অকালে পিতৃহীন সুলেখাদের মাটির বাড়ির একটা দেওয়াল মেরামতের অভাবে ধসে গেছে। খড়ের চাল আর ভাঙ্গা দেওয়ালের মধ্যেকার ফাঁকা জায়গাটা কালো পলিথিন দিয়ে ঘেরা। সুলেখার মা তিন চার বাড়ি বাসন মাজে। একমাত্র উপার্জন। মাঝে মাঝে রুবির বাবা নাকি সুলেখার মা’কে টাকা ধার দেয়। একটু একটু করে কীভাবে না জানি সুলেখার মা শোধ করে দিত সেই টাকা।
নড়বড়ে দরজা দিয়ে রুবি সুলেখাদের অন্ধকার ঘরে ঢুকেছিল। টিমটিম কেরোসিনের প্রদীপ। অন্ধকারে দিশেহারা রুবিকে রাস্তা চিনিয়েছিল সুলেখার মায়ের অসম্ভব ঠান্ডা সেই হাত। রুবির সমস্ত আন্দাজ রক্তে ভাসিয়ে এগারো বছরের সুলেখা বিছানায় শুয়েছিল। সংজ্ঞাহীন…
এখন গাড়ির সামনে বসা এই লোকটা তার বাবা! ছিঃ…
মায়ের সম্মানের কথা ভেবে থানা পুলিশ করতে পারেনি ঠিকই। কিন্তু শাস্তি একে দিতেই হবে।
একটা ঘরের মধ্যে নিঃসঙ্গ করে তিলে তিলে মারবে এই পিশাচটাকে।