Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মলুটিতে একদিন…

অনির্বাণ ভট্টাচার্য

 

ডেভিড ম্যাককাচন। এদেশের মন্দির গবেষণার স্টলওয়ার্ট। সত্যজিত রায়ের চিঠিটা মনে পড়ছে। ‘উইয়্যার্ড প্রলিফারেশন অব মোল্ডি ক্রাম্বলিং টেম্পল্‌স্‌…’। বক্রেশ্বরের পুরনো কিছু শিবমন্দির নিয়ে এক কিংবদন্তীকে চিঠিতে অন্য আরেক কিংবদন্তীর খেদ। বক্রেশ্বর। দুবরাজপুর। হেতমপুর। ঘুরিষা। ইলামবাজার। কেন্দুলি। ইতোন্ডা। গোটা বীরভূম। পড়শি বিষ্ণুপুরের পরিচিত জনপ্রিয়তা পেরিয়ে এই জেলার নিরাভরণ ম্যাজিক। টেরাকোটা। স্থাপত্য। ইতিহাস। ধরতে গেলে সংক্ষেপে হয়ত অসম্ভব। তাই, অগোচরে বিশেষ কিছু জাদুবাস্তব। ছবিঘর। পর্দা খোলা হোক…

মহুলটি। মহুল গাছের জঙ্গল। কথ্য ভাষায় মলুটি। শুনলেই চোখ চকচক করে উঠবে মন্দির-গবেষকদের। একটা পাহাড়ি টিলা। চন্দননালা নদী। একটু দূরে চুমড়ে নাম্নী আরেক ক্ষীণস্রোতা। রামপুরহাট বা মল্লারপুর থেকে দুমকা যাওয়ার রাস্তা। আগের বীভৎসতার থেকে অনেকটা ভাল। বাস যোগাযোগ প্রায় না থাকা থেকে কিছুটা বেশি। বীরভূমের প্রাচীনতম শিবমন্দিরের জন্য খ্যাত মাসরা গ্রামকে একদিকে রেখে মলুটির যে রাস্তা ডানদিকে বেঁকে যায়, একটা সময় পর তার পরিষ্কার তফাৎ চোখে পড়ে। প্রাচীন ময়ূরেশ্বরের অধীনে বীরভূমির এই অঞ্চল আজ ঝাড়খণ্ডে। পড়শি রাজ্য ঢুকতেই রাস্তা চকচকে। চন্দননালা নদীর পাড় বরাবর লোভনীয় জার্নি।

মলুটি গ্রামে ঢোকার পথনির্দেশ

কথন। সপ্তদশ শতকে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্‌র প্রিয় বাজপাখি উদ্ধার করে দিয়ে বসন্ত রায় রাজতালুক পান। হয়ে যান বাজ বসন্ত। বীরভূমের কাতিগ্রামের এই মানুষটির বংশধরেরা প্রথমে দামড়া থেকে পরে মলুটিতে আসেন। নানকার বা করমুক্ত রাজ্য মলুটিতে বাজ বসন্তর পরিবারটি চার তরফে ভাগ হয়ে যায়। আর চার তরফের নিজেদের মধ্যে এক ধরনের বিরল প্রতিযোগিতা থেকে নির্মিত হয় ১০৮টি মন্দির। অষ্টাদশ শতক থেকে উনবিংশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত সময়কালে মাত্র চারশ বাই চারশ মিটার জায়গায়। এই ১০৮টির মধ্যে ৭২টি আজও অক্ষত।

মলুটির ৫৭টি চারচালা মন্দিরের কয়েকটি

স্থাপত্য। অলঙ্করণ। বৈচিত্র। ঐক্য। ৭২টির ভেতর ৫৭টি চারচালা ঘরানার। বাকিগুলি রেখ দেউল, রাসমঞ্চ, সমতল ছাদ কিংবা একবাংলা। পরপর তিনটি চারচালা স্থাপত্যের শীর্ষে মন্দির মসজিদ গির্জার ধরনে সাম্প্রদায়িকতা থেকে বেরনো এক অন্য ইতিহাস।

চারচালা মন্দির-কমপ্লেক্সের অন্য দিক, বেশ কিছু পর্যাপ্ত সংরক্ষণে টিকে আছে

সমতল ছাদের দুর্গামন্দির

আরাধ্য হন মূলত শিব। যদিও শাক্ত মন্দিরও কম নয়। অলঙ্করণে কোথাও ফুলপাথর। কোথাও টেরাকোটা। মহিষাসুরমর্দিনীর প্যানেল। রামায়ণ। বকাসুর বোধ। যক্ষ ও যক্ষী। সামাজিক ইতিহাসের ক্রনোলজি। মোঘল যুগ থেকে ব্রিটিশ ক্রমবিকাশের সিরিজ। সমতল ছাদের একটি দুর্গামণ্ডপের ওপরে অর্ধব্রবৃত্তাকার প্যানেলে রাজপরিবারের ছবি। উঁকি মারছে ইতিহাস।

মহিষাসুরমর্দিনীর একটি প্যানেল

একটি প্যানেলে রামায়ণের দৃশ্য

একটি প্যানেলে বিরল যক্ষীর প্রতিকৃতি

সম্প্রতি ইউনেস্কোর গ্লোবাল হেরিটেজ ফান্ড মলুটিকে হেরিটেজ ভিলেজ আখ্যা দিয়েছে। এগিয়ে এসেছে ইন্ট্যাক। যদিও সংরক্ষণে সমস্যা রয়ে গেছে অনেক। কোথাও শুরু হয়ে কাজ অর্ধসমাপ্ত। কোথাও প্যানেলে নতুন রং করা। পেশাদারিত্বের চূড়ান্ত অভাব।

চণ্ডীমণ্ডপ, যা আধুনিকীকরণের জেরে প্রাচীনতা হারিয়েছে, পাশেই নতুন অপেশাদার হাতে রং করা নষ্ট হওয়া টেরাকোটার প্রাচীনতা

এই ম্যাজিকের বাইরে স্থানীয় বীরভূম অঞ্চলে মলুটির প্রসিদ্ধি দেবী মৌলিক্ষার জন্য। মৌ অর্থাৎ মাথা, ইক্ষা অর্থাৎ দেখা। বৌদ্ধ তান্ত্রিক বজ্রযানীদের আরাধ্যা সিংহবাহিনী দেবী মৌলিক্ষা হিসেবে নামাঙ্কিত হন। অবয়ববিহীন শুধুমাত্র দেবীমস্তক ওপর ভিত্তি করে নির্মাণ। ল্যাটেরাইট পাথরকে ছেনি দিয়ে কেটে। এক বাংলা একটি মন্দিরে যার অবস্থান। কৌশিকী অমাবস্যা বা দীপাবলী — মলুটি বনাম তারাপীঠ লড়াই। কে জেতে, বলা কঠিন। কথন অনুযায়ী এই মৌলিক্ষা মন্দিরেই সাধক হিসেবে আসেন বামদেব চট্টোপাধ্যায়। ওরফে বামাক্ষ্যাপা। যদিও তার আগে মলুটির আত্মীয় ফতেচাঁদের সাহায্যে চার তরফের বিষ্ণু মন্দিরে পুজোর জন্য ফুল তোলার কাজ পান। মলুটির সাধনা শেষ করে তারাপীঠ যাওয়ার আগে তাঁর ত্রিশূল এবং শঙ্খ রেখে যান বামদেব। আজও সংরক্ষিত সেই ইতিহাস।

দেবী মৌলিক্ষা মন্দির প্রাঙ্গণ

মৌলিক্ষা মন্দিরতলায় মলুটির প্রাচীনতম মন্দির, নির্মাণকাল ১৭১৯, নির্মাতা রাজা রাখড়চন্দ্র

মলুটির মন্দির-ম্যাজিকের ভেতর এক ম্যাজিশিয়ান। অষ্টআশি। শ্রবণক্ষমতা গেছে। ওইটুকুই। হাঁটাচলা, কথা, স্মৃতি — কোনও কিছুই থামেনি একচুলও। গোপালদাস মুখোপাধ্যায়। স্থানীয় নামে ‘বটুদা’। মাস্টারমশাই। এককালে বিমান সেনার কাজ করেছেন। ছড়ানো ছেটানো গল্প। ফিরে এসে মলুটিতেই স্কুল শিক্ষকতা। আজন্ম মন্দিরের সঙ্গে আত্মীয়তা। মলুটির ইতিহাস লিখেছেন। প্রায় একার চেষ্টায় সংরক্ষণের দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন ভাঙা ঐশ্বর্যদের। ইউনেস্কোর গ্লোবাল হেরিটেজ বা ইন্ট্যাক, সেখান থেকে মলুটির একটা আস্ত ওয়েবসাইট। বিদেশি হাতছানি। সমস্ত তাদের বটুদার জন্য। গ্রামের সবার কাছে যার কৃতিত্ব এক কথায় পাহাড়প্রমাণ। আধো অন্ধকার ঘরে পুরনো পুঁথি জমাচ্ছেন। কিছু কয়েনও আছে। চন্দননালা নদীর ধারে প্যালিওলিথিক মানুষের অস্ত্র, পাথর। কাটার, ব্লেড, স্ক্র্যাপার। মাস্টারমশাই চিনিয়ে দেন। জমিয়ে রাখা এসব রত্ন কতদিন? তাঁর পরে কে? মাস্টারমশাই জানেন না। একটা মিউজিয়াম করার ইচ্ছে আছে। হবে না?

মন্দির সংরক্ষণ দেখতে ব্যস্ত গোপালদাস মুখোপাধ্যায়

নিজের বাড়িতে গোপালদাস মুখোপাধ্যায়

 

মলুটির চন্দননালা নদীর ধারে পাওয়া পুরাপ্রস্তর যুগের মানুষের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি দেখাচ্ছেন গোপালদাস মুখোপাধ্যায়

গোপালদাস মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর আত্মীয়ার সঙ্গে এই প্রতিবেদক

ক্রমশ প্রচারের আলো ফিরছে মলুটিতে। বিংশ শতকে প্রায় হারিয়ে যাওয়া মলুটি অনেকটাই আশার রাস্তায়। বিদ্যুৎ সরবরাহ যদিও এখনও নৈরাশ্যের রাজ্যে। বেশ কিছু সোলার প্যানেল দিয়ে মেরামতির চেষ্টা। দেখে ভালো লাগল না। গোপালদাস মুখোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত আলোর ঘরে এই কৃত্রিম আলোর জোর কোথায়? জল চাইলাম। মাস্টারমশাইয়ের ভাগ্নে-বউ ধীরাদি এক গ্লাস জল খাওয়ালেন। ‘আর খাবেন?’ মহিলা হাসলেন। ‘আসলে যেই আসে, জল খেতে চায়’। অসম্ভব মিষ্টি। যোগাযোগ এবং রাস্তার উন্নতি চোখে পড়ে। রামপুরহাট বা মল্লারপুরে ফিরে আসতে হলে বিকেলের দিকে বেরিয়ে গেলেই চলবে। শেষ বাস কটায়? খোঁজ করে জানা গেল বিকেল সাড়ে চারটে। ঝাড়খণ্ড পর্যটন দপ্তর এবং দুমকা জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে দুটি সরকারি বাংলো। আগে থেকে বলে রাখলে খাওয়ার ব্যবস্থাও মন্দিরের পক্ষ থেকে হয়ে যায়।

এই আলোটুকুই সম্বল। গোপালবাবুর উত্তরসূরিদের প্রচেষ্টা, ইচ্ছে, লড়াই পাথেয় হোক। ইতিহাসে আলো ঢুকুক…