Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

তারান্তিনো — আট

প্রিয়ক মিত্র

 

গত সংখ্যার পর

বছর দুই আগে গণিকাপল্লীতে একটা জোড়া খুন হয়। এক বেশ্যা ও তার অভিভাবিকাসম এক বৃদ্ধা মহিলাকে ছুরিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায় একটি বাড়ির মধ্যে। জানা যায় নন্দরাম চৌধুরী নামে এক ধনীর দুলাল ছেলের কীর্তি এটি। নিজের রক্ষিতা এবং তার সহচরীকে খুন করে টাকাপয়সা আত্মসাৎ করা — এই ছিল তার উদ্দেশ্য।

অনুসন্ধান শুরু করলেন এইচ এম জেমসন সাহেব। গোয়েন্দা বিভাগের সফল কর্মচারী। বহু তদন্ত সমাধা করেছেন সফলভাবেই। এক্ষেত্রেও তাই ঘটছিল। নন্দরামকে কব্জা করেই ফেলেছিলেন প্রায়, কিন্তু শেষমেশ হিসেবটা মিলল না।

নন্দরামের এক দুঁদে বিলিতি উকিল ছিল। তাকে কাজে লাগিয়ে নন্দরাম পুলিশ বিভাগের অন্তর্বর্তী একটি দুর্নীতির জাল নথি তৈরি করল, যে নথি মোতাবেক দোষী সাব্যস্ত হলেন জেমসন সাহেব।

বরখাস্ত হলেন এইচ এম জেমসন।

তারপর থেকেই আর্মেনিয়ান ঘাটের কাছে এই পোড়ো বাড়ির একটিমাত্র ঘরে আস্তানা গেড়ে থাকেন এইচ এম জেমসন। কী তার প্রকৃত উদ্দেশ্য কেউ জানে না।

এই লোকটিকে কেন নিয়ে এসেছেন এখানে জেমসন? একজন হাড় জিরজিরে রোগা এবং বাকশক্তিহীন গ্রাম্য কৃষক, যার স্ত্রীকে প্রকাশ্য দিবালোকে তুলে নিয়ে গেছে রমাকান্তর পোষা পিশাচের দল — তাকে নিয়ে কী এমন আগ্রহ থাকতে পারে জেমসন সাহেবের?

লোকটা বোবা! কানেও বোধহয় কিছু শুনতে পায় না। জিভের ভেতর থেকে থুতুসমেত যে ধ্বনিগুলো বেরিয়ে আসছে তার মধ্যে একটা অদম্য রাগ, বিদ্বেষ।

রমাকান্ত রায়। গুপ্তচরদের কল্যাণে এ শহরের কুখ্যাত বাবুদের খুব ভাল করেই চিনতেন জেমসন। গুপ্তচরবৃত্তিতে বাঙালিদের জুড়ি মেলা ভার। জেমসন নিজে সবসময়ই বাঙালি অধস্তন পছন্দ করে এসেছেন এইজন্য।

রমাকান্ত রায়ের হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে এই চাষিটির স্ত্রীকে। নাম না জানা এই লোকটার দিকে তাকিয়ে সংকল্প নিয়ে ফেলেছেন জেমসন সাহেব।

আসলে এই চাষিটির মধ্যে জেমসন সাহেব দেখতে পাচ্ছেন তার প্রিয় কুটির, প্রিয় শস্যক্ষেত্র এবং সবথেকে প্রিয় মানুষটিকে; যার গুলিবিদ্ধ রক্তে ভেজা লাশ তার রাতের ঘুম কেড়ে নেয় এখনও। এরকমই জেদী, নির্ভয়, সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সেই মানুষটি জেমসনের বাবা। তাদের ‘কান্ট্রিসাইড’-এর ছোট্ট গ্রাম থেকে শহরের কারখানায় কাজ করতে গিয়ে কারখানার মালিকের যাবতীয় অনাচারের বিরুদ্ধে যিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন‌। লন্ডন শহরের এক গলিতে সেই মালিকের সঙ্গে ডুয়েল লড়তে গিয়ে প্রাণ হারানো সেই মানুষটা নিশ্চিত মৃত্যুর সামনেও মাথা নোয়ায়নি, আজ অনেকদিন পর সাগরপারের এই দেশে এসে, বাবুয়ানির রঙচঙের ফাঁকে এই লোকটি আচমকা চোখে পড়ে গেছে জেমসন সাহেবের; যার সাহস আর খুনে জেদ মনে পড়িয়ে দিচ্ছে জেমসন সাহেবের বাবাকে‌।

লোকটাকে শান্ত করতে হবে আগে। লোকটাকে দুহাত দিয়ে চেপে ধরলেন জেমসন।

মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বললেন।

লোকটার চোখ ধক করে জ্বলে উঠল। জেমসনকে সে বন্ধু ভাবতে পারেনি এখনও। ভাবার কোনও কারণও নেই। জেমসন ওর ক্ষতি হয়তো করবে না বুঝে ও এখানে এসে হাজির হয়েছে তার সঙ্গে। কিন্তু এই সাহেবটা কে, কী তার বৃত্তান্ত, এসব নিয়ে অন্তত কোনও মাথাব্যথা নেই লোকটার।

এই লালমুখো সাহেব তাকে এখানে ধরে রেখেছে, আর ওদিকে তার বউকে কোথায় ধরে নিয়ে গেছে একদল জানোয়ার, তা সে এখনও জানে না!

সে তার ধারালো নখ কাজে লাগিয়ে টুঁটি চেপে ধরল সাহেবের!

জেমসন রুদ্ধস্বরে আর্তচিৎকার করে উঠল। সে অনুভব করল লোকটার নখ চেপে বসছে তার গলার চামড়ায়।

জেমসন বিপদ বুঝে তার দুটো হাত দিয়ে চেপে ধরল লোকটার হাতদুটো। একটু জোর প্রয়োগ করে একটা হ্যাঁচকা টান।

বর্শার আঘাতে লোকটার হাতদুটো দুর্বল হয়ে ছিল। হাতদুটো শিথিল হয়ে পড়ে গেল অচিরেই।

“হুজুর গরীবের ঘরে পায়ের ধুলো দিলেন যে বড়! হেঁ হেঁ!”

স্বভাবসিদ্ধ বিনয় এবং শেয়ালসুলভ ফন্দি নিয়ে হাত কচলাতে কচলাতে ইন্দ্রকমল সিংহের সামনে নত হয়ে বললেন রমাকান্ত রায়।

কথা কম বলা ইন্দ্রকমলের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইন্দ্রকমলের চোখ, ইন্দ্রকমলের পাথুরে চোখই যথেষ্ট।

ইন্দ্রকমল তার চোখ রাধামোহনের চোখে রাখল।

রাধামোহনের আবলুশি কালো মুখে কটা চোখ দেখলে অনেকেরই ভয় করতে পারে।

রাধামোহন বুঝে গেছে মনিবের আদেশ।

সে তার পকেট থেকে বের করে আনল একটি ছোট্ট কারুকার্যখচিত রুপোর কৌটো।

রমাকান্তর ভুরু কুঁচকে গেল। তারপরেই একটা প্রবল সম্ভাবনার কথা ভেবে চোখমুখ উজ্বল হয়ে উঠল তার। বিশ্বনাথ, তার বিশ্বস্ত অনুচরের দিকে একবার তাকালেন তিনি।

সম্ভাবনাটা টের পেয়েছে বিশ্বনাথও। কেবল বিশ্বাস করতে পারছে না।

ওই কৌটোর মধ্যে কী আছে? রাজা ইন্দ্রকমল সিংহের পারিবারিক অভিজ্ঞান? এওও হতে পারে? একজন অচেনা মেয়েমানুষের জন্য এই ঘটনা ঘটাবে ইন্দ্রকমল?

ইন্দ্রকমল সকলের অগোচরে সন্ধেবেলায় এসে পৌঁছেছে রমাকান্তর বাড়িতে। এর মানে রমাকান্ত খুব ভালো করেই জানে। রমাকান্তর মতন বেপরোয়া নন ইন্দ্রকমল। তার ভেতরের লুকোনো শ্বাপদকে অন্ধকারে মেপেজুখে লালন করেন ইন্দ্রকমল। আজ সকালে দূর থেকে ইন্দ্রকমলের চোখের চাহনি দেখতে পেয়েছিল রমাকান্ত!

কিন্তু তা বলে ওই একজন গ্রাম্য যুবতীর জন্য এতবড় মূল্য দেবে ইন্দ্রকমল? কী পেলেন ইন্দ্রকমল ওর মধ্যে?

রমাকান্ত আর বিশ্বনাথের সন্দেহ সত্যি করে কৌটো খুলল, আর ঝলমলিয়ে উঠল ইন্দ্রকমলের আংটির মাঝে বসানো আকাশি রঙের হীরে!

এই হীরের উৎস নিয়ে খানিক গল্পগাছা করা যাক!

আঠারো শতকের শুরুর দিক! উগান্ডার এক কোণে একটি জমজমাট বাজারে একটি ফলের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে একটি কাফ্রি কিশোর। তার চোখেমুখে আতঙ্ক! পালিয়ে বাঁচতে পারবে সে?

বহু ফলের ঝুড়ির মাঝে একটা আড়াল খুঁজে লুকিয়ে আছে সে। শয়তান লোকগুলোর চোখে পড়লেই সর্বনাশ।

আচমকা পিঠে একটা আলতো টোকা। শিরদাঁড়া হিম হয়ে গেল কিশোরটির।

পেছনে ফিরতেই চোখে পড়ল দৈত্যের মতন চেহারার ইমানিকে। ইমানির চোখ মানুষসুলভ নয়। ওই চোখ গিলে খেতে চায়। তার ওপর ওই ভয়াবহ চোখ লাল হয়ে আছে নেশায় এবং রাগে। সঙ্গে আরও দু তিনজন দৈত্য! আর একটা ফচকে সাহেব! ছোঁড়া সাহেব, মুখেচোখে ফাজলামি আর শয়তানি!

কাফ্রি কিশোরটি ক্রীতদাস! তার একটা নাম ছিল বটে। তবে নাম ঘুচে গিয়ে এখন সে শুধুই পঁয়ত্রিশ নম্বর। পালিয়ে বাঁচার চেষ্টায় ছিল সে। কিন্তু ইমানি আর তার দলবলের হাত থেকে নিস্তার নেই।

জাহাজে তোলবার আগে তাকে গরম লোহার সেঁক দেওয়া হবে। নম্বরের ছাপ মারা হবে সেঁক দিয়ে। জানে সে। ইমানির পোষা কুত্তা ইব্রাহিমি। বেঁটে বামন। মাদারির খেলায় ওস্তাদ। লালচে দাঁতগুলো বার করে সে যখন খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসে তখন তার খুদে চোখগুলো বুজে আসে! এই লোহা গরম করা আর সেঁক দেওয়ার কাজটা ইব্রাহিমিরই কাজ। আর বিভিন্ন নম্বরের ছাপ্পামারা কাফ্রিরা যখন লোহার গরম সেঁকের চোটে ছটফট করতে করতে পরিত্রাহি চিৎকার করে, তখন হাসির দমক বেড়ে যায় ইব্রাহিমির!

শয়তানের দূত ইব্রাহিমির পিঠে একটা ছুরি গেঁথে দেওয়া সহজ হত, যদি একটা ছুরি পাওয়া যেত — এটা বারবার মনে হয় পঁয়ত্রিশ নম্বরের।

পঁয়ত্রিশ নম্বরকে প্রায় পাঁজকোলা করে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল ইমানির লোকজন! একদম সামনে ইমানি, তার পাশে পাশে ছুটছে ইব্রাহিমি! ইমানি শক্ত করে হাত ধরে রয়েছে ইদার। ইদা ইমানির পালিতপুত্র। তার ভাগ্যও হতে পারত আর দশজন কাফ্রি কিশোরের মতন। কিন্তু কোনও কারণে এই বালকটির প্রতি অদ্ভুত স্নেহ জন্মে যায় ইমানির। একটি নামও দেয় ইমানি তাকে। ইদা চপল এবং দুঃসাহসী, পালক পিতার থেকে ক্রীতদাসদের প্রতি ঘৃণা আয়ত্ত করে নিয়েছে সহজেই। মাঝেমধ্যেই ইমানির হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ইদা চলে আসছে পেছনে। পঁয়ত্রিশ নম্বরকে একটা করে খোঁচা দিয়ে আবার সামনের দিকে ছুটে যাচ্ছে। জঙ্গলকে নিজের ইজারা নেওয়া এলাকার মতন ভেবে নিয়েছে ইদা। মাঝেমধ্যেই একটা করে সরু ডাল ভেঙে, দু একটা পোকামাকড় মেরে, একটি নিরীহ জংলি কাঠবেড়ালিকে তাড়া করে নিজের দাপট দেখাচ্ছে ইদা।

জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ওদের ডেরায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পঁয়ত্রিশ নম্বরকে, সেখান থেকে সোজা এই নম্বরের ছাপ্পামারা কাফ্রিরা চালান হবে জাহাজের পেটে!

ঘন জঙ্গলের মধ্যে একটা দানোর করায়ত্ত হয়ে যেতে যেতে বুক দুরুদুরু করছিল পঁয়ত্রিশ নম্বরের। এরা খুব মারবে নিশ্চয় ওকে, পালিয়ে যাওয়ার শাস্তিস্বরূপ! আরও অনেকরকমভাবে অত্যাচার করবে নিশ্চয় এরা…

আচমকা একটা প্রবল আর্তচিৎকার! একটা রিনরিনে কন্ঠস্বর আস্তে আস্তে বুজে আসছে। জঙ্গলের গহীন থেকে আসছে শব্দটা। খুব সম্ভবত, ওদের পেছনদিক থেকে।

হঠাৎ আবিষ্কার করা গেল ইদা নেই দঙ্গলের মধ্যে।

বিশাল চেহারা নিয়ে ইমানি ছুটল পেছনদিকে। তার সমস্ত অনুচররা পেছন পেছন দৌড় লাগিয়েছে, ছোট্ট চেহারা নিয়ে দৌড়চ্ছে ইব্রাহিমি!

পঁয়ত্রিশ নম্বর ভেবেছিল এই সুযোগ! তাকে মাটিতে নামিয়ে দিয়েছিল দানোটা! এবার দৌড়ে পালালেই হয়! কিন্তু শক্ত সাঁড়াশির মতন দুটো হাত তার ঘাড় চেপে ধরল, এবং তাকে প্রায় মাটির থেকে শূন্যে তুলে নিয়ে চলল পেছনদিকে। যেদিকে ইমানি, ইব্রাহিমি এবং বাকিরা ছুটে গেছে।

কিছুদূর পিছিয়েই দেখা গেল ইমানি, ইব্রাহিমি এবং বাকি দৈত্যরা স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে। ইমানির চোখেমুখে আতঙ্ক খেলে বেড়াচ্ছে। ইব্রাহিমির মতন নির্মম মানুষও সিঁটিয়ে রয়েছে। একজনও দৈত্যসম লোক এগোতে সাহস পাচ্ছে না!

এরা বলে ‘দুবোয়ানা’, অপদেবতা, দানো। মানুষ দানোরা যাকে ভয় পায়।

আসলে একটা চোদ্দ পনেরোফুট লম্বা ডোরাকাটা ময়ালসাপ! ইদার ছোট্ট দেহটা পেঁচিয়ে ধরে ইদার মাথাটাকে বিশাল হাঁ-এর মধ্যে ঢুকিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।

ইব্রাহিমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু ইমানির রক্তচক্ষুর আদেশ উপেক্ষা করতে পারল না ইব্রাহিমি! অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে কোমর থেকে একটা ছুরি বার করে এগিয়ে গেল সাপটার দিকে। ধূর্ত ইব্রাহিমি, নিষ্ঠুর ইব্রাহিমি, মানুষ খুন করতে যার হাত কাঁপে না, তার সর্বাঙ্গ থরথ‍র করে কাঁপছিল!

জান্তব সাপটা যেন খানিক বিরক্তি সহকারে ফিরে তাকাল ইব্রাহিমির দিকে। ইব্রাহিমিকে বোধহয় ধেড়ে ইঁদুর জাতীয় কিছু ঠাউরেছে সাপটা! ওর শিকারে বাধা দিয়েছে ইঁদুরটা, তাই একে সমুচিত শাস্তি তো দিতেই হবে!

জট ছাড়াল সাপটা। ইদার পাঁজর ততক্ষণে ভেঙে চুরমার! বেঁচে আছে কি ছেলেটা?

ইদার দেহকে নিজের বিশাল বীভৎস দেহের থেকে আলাদা করল ভয়াবহ সরীসৃপটা! আর মুহূর্তের মধ্যে সামনে ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা উদ্যত ইব্রাহিমিকে চার প্যাঁচে নিজের বিশাল দেহের মধ্যে জড়িয়ে ফেলল জন্তুটা! প্রতিটা প্যাঁচ শৈল্পিক, প্রতিটা প্যাঁচ ধীর এবং প্রতিটা প্যাঁচ মারণপ্যাঁচ!

ছবি : স্বস্তিক করগুপ্ত

ইব্রাহিমির কাঁপতে থাকা হাত থেকে ছুরিটা ছিটকে গেল অন্য কোনও প্রান্তে! ইমানি আর তার লোকেরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে তখনও! ইমানির নিষ্প্রভ হয়ে যাওয়া চোখ তখন মরণোন্মুখ ইব্রাহিমির থেকে ঘুরে গেছে ইদার নিথর দেহের দিকে। ইমানি বুঝতে চাইছে, ইদা তখনও বেঁচে আছে কি না।

মৃত্যুর আগে ইব্রাহিমির কাতর চোখ এবং হাত দুটোরই অভিমুখ ছিল প্রভু ইমানির দিকে। ইমানি শেষবার চাইল ইব্রাহিমির দিকে!

মুহূর্তের মধ্যে শুরু হল ময়ালের ভোজ। ইব্রাহিমির মাথা ঢুকে গেল ময়ালের হাঁ-এর মধ্যে। আজন্মের সব শয়তানি, সব পাশবিকতা আফ্রিকার জঙ্গলের এই মানুষখেকো প্রাণীটির গ্রাসে গেল ধীরে ধীরে।

অদ্ভুত শান্ত হয়ে থাকা এই পরিস্থিতির মধ্যে পঁয়ত্রিশ নম্বরের রোখ চেপে গেল আচমকা। এখনও সে একজন দৈত্যের হাতে বন্দি! কিন্তু ইব্রাহিমির ওপর তার সমস্ত জমাট বাঁধা রাগ, প্রতিশোধস্পৃহা তৃপ্ত হচ্ছে। তার হঠাৎ মনে হল এই প্রতিহিংসাটা চরিতার্থ করা প্রয়োজন।

আচমকা ঘাড়ের ওপর থেকে লোহার বাঁধনের মতন হাত ছাড়িয়ে নিল পঁয়ত্রিশ নম্বর। পেছনে হাত ঘুরিয়ে দানোটার পকেট থেকে ছুরিটা বার করে নিয়ে ছুট লাগাল সোজা, তিরের মতন গতিতে।

একটা অদ্ভুত স্থাপত্য তৈরি হয়েছে তখন। সাপটার প্যাঁচালো দেহের মধ্যে ঢাকা ইব্রাহিমির দাঁড়িয়ে থাকা দেহ। ইব্রাহিমির মাথা সাপটার গ্রাসে!

সাপটা তখন মোটামুটি শিকার হজমে ব্যস্ত! কিছু খেয়াল করে উঠতে পারল না সাপটা। ইমানি আর তার লোকেরা হতভম্ব।

পঁয়ত্রিশ নম্বরের চোখে অজগরের মাথাটাই হয়ে উঠল শয়তান ইব্রাহিমির মাথা!

একবার, দুবার, তিনবার।

প্রবল আক্রোশে ছুরিটা ময়ালের মাথায় গেঁথে গেল তিনবার পরপর।

ময়ালটার মুখ থেকে বেরিয়ে এল ইব্রাহিমের উচ্ছিষ্ট। তার পিষে যাওয়া দেহ ছিটকে পড়ল মাটিতে।

আফ্রিকার গহন জঙ্গলের মাটিতে ময়ালটার লতানে দেহ নিথর হয়ে পড়ল সশব্দে!

ইমানির লোকজন হাততালি দিয়ে উঠল। এবং মুহূর্তের মধ্যে পঁয়ত্রিশ নম্বরকে পালানোর কোনও সুযোগ না দিয়ে ইমানির পোষা রাক্ষসরা ওকে চ্যাংদোলা করে নিল উল্লাসে!

ইমানি ছুটে গেল ইদার দিকে। ইদার বুকে হাত রাখল সে। খুব ধীরে হলেও শ্বাস চলছে। ইদাকে নিজের কাঁধে তুলে নিল ইমানি!

প্রাথমিক আতঙ্ক কাটিয়ে ইব্রাহিমিকে কবর দেওয়া হল। ইদার চিকিৎসা চলল।

ইব্রাহিমির হন্তারক সাপকে মারার জন্য পঁয়ত্রিশ  নম্বরকে বানিয়ে দেওয়া হল জাহাজের খালাসি। ক্রীতদাসত্ব থেকে সে মুক্তি পেল। সে ভাবতে থাকল তার পরম শত্রুকে যে মারল, সে তো তার বন্ধুই হতে পারত। সেই বন্ধুকে মেরেই এই ইনাম পেল সে!

সাপটিকে মহা উল্লাসে এবং আক্রোশে কাটতে শুরু করল ইমানির দলবল! একটা আস্ত হরিণশিশুর হজম হওয়া দেহ পর্যন্ত পাওয়া গেল ময়ালটার পেটে। আর যেটা পাওয়া গেল, সেটা একটা হীরে; যার রঙ আকাশি!

(আবার আগামী সংখ্যায়)