জিললুর রহমান
একদিন মানুষ প্রকৃতির বিস্ময়কে ধ্বনি দিয়ে ধরতে চেয়েছিল, একদিন যূথবদ্ধ মানুষের পরিশ্রমের মধ্যে তাল আনার জন্যে ধ্বনির ব্যবহার হয়েছিল, একদিন মানুষ সূর্যকে দেবতা জ্ঞান করে প্রশস্তি গেয়েছিল, একদিন মানুষ কল্পিত দেবতাদের জন্য রচনা করেছিল প্রার্থনার শ্লোক। এর সবই কবিতা ছিল। পরে প্রাচ্যে রচিত হয়েছে রামায়ন-মহাভারতের মতো মহাকাব্য, পাশ্চাত্যেও তেমনি ইলিয়াড-ওডেসি। এইসব মহাকাব্যে মানুষের প্রেম ভালোবাসার কাহিনীর সাথে যুদ্ধ ও দেবতারা যোগ দিয়ে এক বাস্তব ও কল্পনার অসম্ভবপর সমন্বয় ঘটায়। কিন্তু সে অতিন্দ্রীয়তার যুগ পার হয়ে সমাজ যেমন এগিয়ে এসেছে, মানুষকে আর দেবতা-ঈশ্বরের রূপলাবণ্য ছটা ছড়িয়ে ক্ষমতাধরের বশীভূত রাখা সম্ভব হয়ে উঠছে না। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় আমাদের সামনে মহাবিশ্ব উদোম হয়ে ধরা দিলে ঈশ্বরচেতনা-সহ নানান বিষয়ে চিন্তার জগতে বিপ্লব ঘটে যায়। পুঁজির বিকাশ আর তার গতিপ্রকৃতির ব্যাখ্যা পাওয়া যায় একদিন। আর মার্কসবাদী সাম্যবাদী নিদেনপক্ষে মানবতাবাদী নানা ধরনের চিন্তা মানুষের মধ্যে কাজ করতে থাকে। তাই, কবিতা মুক্ত হয়ে এসেছে অজ্ঞেয়বাদীদের দেবতা-তোষণ ও প্রশস্তি-রচনা কিংবা পরবর্তীতে রাজন্যবর্গের নামগান গাওয়া থেকে।
বাংলা কবিতা সেদিক থেকে আরও এককাঠি সরেস। বাংলা ভাষায় যে কবিতাগুলো আদিকাব্য হিসেবে এখন পর্যন্ত ধরা হচ্ছে, সেই চর্যাগীতির কবিতাগুলো মানুষেরই গান গেয়েছে, অভাবের রূপ এঁকেছে, দারিদ্রের ভয়াবহতাকে চিত্রিত করেছে। যদিও পরে দীর্ঘ সময় কাল বাংলা কবিতা আবার সেই আরাধনামগ্নতায় মশগুল হয়ে যায়, এমনকি আমাদের প্রিয় রবীন্দ্রনাথও কল্পিত জীবনদেবতার জন্য তাঁর কবিতা রচে গিয়েছেন।
এ সময়ের কবিতা বলতে আমি বুঝি, যে সময় থেকে মানুষ বিজ্ঞানমনস্কতার ছোঁয়া পেয়ে কবিতাকে ভিন্ন অর্থে আপন ভাবনা বা চেতনাকে মানুষকেন্দ্রিক করে তুলেছে। সে দিক থেকে বাংলা ভাষায় নজরুলই প্রথম দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে মানুষের জয়গানের কথা উচ্চারণ করেন। আমি জানি না ‘এ সময়ের কবিতা’ বলতে আপনারা কোন সময় থেকে কবিতাকে দেখতে চান। তবে বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশের দশক বিশ্বকে যে নাড়া দিয়েছে — তা ভালো করে দেখলে আমরা দেখি, মানুষের বাস্তবতা আর অগ্রগতিকে কবি মেনে হোক বা না মেনে হোক ঠাঁই দিতে বাধ্য হয়েছেন। টি এস এলিয়ট সমাজ বাস্তবতা মানতে পারেননি, তিনি মানুষ এর গীর্জা-বিমুখ মন নিয়ে আফসোস করেছেন, তিনি মূলত ‘ওয়েস্টল্যান্ড’ বা ‘পোড়োজমি’ কবিতায় বিশ্বাসের বিপর্যয় দেখেন। টি এস এলিয়ট যখন ‘পোড়ো জমি’ লিখেছিলেন, মানুষের ধর্মবিমুখতায় যখন, নিজের ভেতরে গোঙাচ্ছিলেন, মানব সভ্যতার বিকাশের চিহ্নগুলোকে তো অনুল্লেখ্য ছেড়ে যেতে পারেননি। বরং সুন্দর করে চিত্রিত করেছিলেন যে, সমকালের মানুষ উচ্চারণ করে “প্রার্থনালয়গুলো যেখানে মানুষ রোববার কাটায় সেখানে গড়ে ওঠা উচিত। শহরে প্রার্থনালয় নয়, রুটির দোকান হওয়া উচিত বলে মনে করে লোকে।” অথচ এ নিয়েই যত আক্ষেপ ছিল এলিয়টের। যুগে যুগে কবিরা চেয়েছে হয়তো এক ধরনের মনোবিকাশ, কিন্তু মানবসভ্যতার বিকাশ বিজ্ঞানের প্রভুত উন্নতি মানুষকে এগিয়ে নিয়েছে অন্ধ ভাবাদর্শের চেয়ে অনেক অগ্রগামী করে। রবীন্দ্রনাথ যখন দেখতেন প্রভাতে ঈশ্বরের আলোয় আলোয় পৃথিবী পূর্ণ হয়ে উঠেছে, তখন ইশকুলে বিজ্ঞানের ছাত্র ভালো করেই জানে যে আলো সূর্যের, আর সূর্য এক শক্তিমান ধুলিপিণ্ডবৎ — যা একদিন আগুন ছড়াতে ছড়াতে নিঃস্ব হয়ে যাবে, ঠান্ডা হয়ে যাবে। কিন্তু শাশ্বতকাল ধরে কবিরা ভাবের সাগরে ভেসেছেন, ধর্মবোধে লিপ্ত থেকেছেন। কিন্তু বাস্তবতার নিগড় বড় কঠিন। আর আমার ধারণা — এই অন্ধ বিশ্বাসের পতন থেকেই শুরু হয়েছে আধুনিক কবিতার যাত্রা। এ সময়ের কবিতার সূত্রপাত্র হয়তো তাই নজরুল-মায়াকোভস্কি-সুকান্তদের উচ্চারণ থেকেই ধরা যাবে।
বাংলা ভাষার পরম সৌভাগ্য যে বাংলা কবিতা এই বস্তুবাদী ধারায় অগ্রসর হয়েছে ক্রমাগত। কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, সমর সেন থেকে এই যাত্রার সূচনা হয়েছে। সাতচল্লিশ পরবর্তী বাংলায় রাজনৈতিক পরিবেশের সাথে কবিতা প্রগতিশীলতার প্রধান হাতিয়ার রূপে এগিয়ে আসে। আহসান হাবীব-শামসুর রাহমান-শহীদ কাদরী-মোহাম্মদ রফিক-নির্মলেন্দু গুন আরও অনেকে এই ধারায় কবিতাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। কবিতা থেকে ধার্মিকতা এভাবে বাংলা কবিতার বিকাশমান ধারা আশির দশকের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে এত বেশি উচ্চকিত হয়ে ওঠে যে কবিতা হয় স্লোগান নয় শরীরী প্রেমের মধ্যে ডুবে থাকে। কিন্তু স্বৈরাচার পতন এবং একই সময়ে বৈশ্বিক রাজনীতিতে সোভিয়েত পতনের কারণে কবিতা যেন দিকহারা হয়ে পড়ে। এসময়ে নব্বই দশক আবার নানা রঙিন পুষ্পে পল্লবিত হয়ে বাংলা কবিতার চেহারা পালটে দেয়। বাংলা কবিতা মুক্তি লাভ করে কেন্দ্রমুখিনতা থেকে। বহুভাষিকতা আর বহুচেতনার সমন্বয় আমাদের গোচরে আসে। এসময়ে লিটল ম্যাগাজিনগুলো বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখে। এই সময়ে কবিতা যেমন বিকেন্দ্রিত হয়েছে তেমনি বৈচিত্র্যও লাভ করেছে।
“একদিন আমাদের সে বয়স ছিল, সকালে সন্ধ্যায় ধেয়েছি ঘোরের বশে কবিতার নানান আখড়ায়, আড্ডা আর আড্ডায় মশগুল থেকেছি নিরন্তর, ভোরে সঙ্গীতের সুর আর রাত গভীর করে পাঠ; সে সবের ফাঁকে ফাঁকে মাথার ভেতরে কিলবিল করে উঠত পোকার মতো শব্দগুলো, কখন যে বসে পড়ল একের পাশে এক, আমি বললাম — কবিতা। কেউ বলল — হয়তোবা। এভাবেই যেদিন শুরু করেছিলাম, তখন রাস্তায় নামলেই মিছিল — হাঁটলেই ভরে উঠত মুখ স্লোগানের ফল্গুধারায়। স্বৈরশাসন বিতাড়নের আন্দোলন। আবার কখনও হাতের বাঁপাশ দিয়ে চম্পাফুলের ঘ্রাণ ভেসে চলে গেল হয়তো রিকশায়, হয়তো রাস্তায়, কখনও দেখেছি মুখ, কখনও চিবুক — আহা, সেই সব দিনেই হয়তো আমার কলম বলে উঠল — “আমার রমণী যারা, সূর্য বদলের সাথে সাথে হাতছাড়া হয়”। সে দিনগুলো — আশির উপান্তের দিনগুলো — আমাদের মনে কৃষ্ণচূড়ার রঙ — সোনালু ফুলের রঙ ধরাতে ধরাতে কোনও এক মহাসূর্যোদয়ে আমাদের উপনীত করেছিল নব্বইয়ের মহা জলোচ্ছ্বাসের সামনে। “জলপতনের শব্দে মূর্চ্ছা যাই/ সাজানো বাসরে কালনাগিনীর ফণা/ তবু এসো ভাত খেয়ে নিই ভাত/ এবেলা হবে না নাওয়া” — এমন সময় এসে দাঁড় করিয়ে দিল এক ভিন্ন বাস্তবতায়। আমাদের নতুন করে বুঝতে হল প্রেম, নতুন করে লিখতে হল ভাষা। বাংলা কবিতায় তাই আশির দশকের শেষদিকে এক নতুন কাব্যভাষার আন্দোলন সূচিত হওয়ার ফলশ্রুতিতে নব্বইয়ের দশক হয়ে উঠল এক মনোমুগ্ধকর কাব্য আন্দোলনের কাল। সেদিন ছিল কেন্দ্র ভাঙার দিন — স্বপ্ন ভেঙে স্বপ্ন গড়ার দিন — কবিতার নতুন স্বরের দিন — আমাদের নতুন স্বপ্নের দিন। সমাজে গণতান্ত্রিক হতাশা, প্রেমে বেদনার বাস্তবতা, প্রত্যাখ্যানের রূঢ়তা, স্বপ্নে লোকসংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের প্রণোদনা — এর ভেতরেই কোথাও বেজে উঠেছিল বিসমিল্লা খাঁর সানাই — ভোরের হুইসেল, নতুন কবিতার স্বর — উত্তর আধুনিকতার বহু বাচনিকতা।
চল্লিশ পরবর্তী আধুনিক বাংলা কবিতা যে কেন্দ্র-কুক্ষিগত ফর্ম ও শব্দ চেতনা নিয়ে বিকশিত হচ্ছিল, তা আশির সামাজিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় স্লোগানমুখিনতায় এক অদ্ভুত কিছুটা ঝাঁঝালো অথচ জনপ্রিয় রূপ ধারণ করে, যা কিছুটা উচ্চকণ্ঠ, কিছু ফর্দ-স্বরূপ, কিছু বর্ণনার ঘনঘটা। পরে, নব্বইয়ের এই মহা আয়োজনে সারা বিশ্বজুড়ে বাংলাভাষীরা আলোড়িত হয়ে ওঠে, নতুন স্বরে নতুন ভাষায় কবিতাকে সাজাতে। লিটল ম্যাগাজিনগুলোই মূলত এর প্রধান হাতিয়ার হয়ে ওঠে — গাণ্ডীব, প্রান্ত, লিরিক, নিসর্গ, নদী, নৃ, পেঁচা, জীবনানন্দ, একবিংশ সহ অনেক অনেক কাগজ সারা বাংলা জুড়ে এর আয়োজনে নেমে পড়ে। তার পর থেকে কবিতা যেন এক বিচিত্র শরীর পেয়ে গেল, কবিতার ভাষা পেল নতুন উচ্চারণ, কণ্ঠে যত না দাবি, তার চেয়ে কিছু বেশি অনুযোগ, কিছু অভিব্যক্তি, কিছু বেদনার টুংটাং। এর পরে এই ধারা যেন ক্রমবিকশিত হবার পালা, যেন পদ্মার জল মেঘনায় পড়ে এক দুদ্দাড় বেগে প্রবল পরাক্রমে ছুটে চলেছে সাগর গর্জনের দিকে — পূর্ণতার পথে।”
এই নব্বই দশকের কবিতা ভিন্নভাবে আলোচনার দাবি রাখে। এই সময়ে আমরা লিরিকের মাধ্যমে উত্তর আধুনিকতার চিন্তাচর্চার সাথে যুক্ত হয়েছিলাম — যার ফলে কবিতায় বেশ নান্দনিক প্রভাব পড়েছে বৈকি! সমসময়ের আরও কিছু লিটল ম্যাগ — যেমন প্রান্ত, নদী, গাণ্ডীব — এরাও নানা শিরোনামে কবিতার নতুন মাত্রা তৈরির কাজে অবদান রেখেছে। একবিংশ সেসময়ের তরুণ কবিদের প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়, শেষ দিকে খোন্দকার আশরাফ হোসেনও উত্তর আধুনিকতা নিয়ে উচ্চকিত হয়েছিলেন বৈকি!
তারও পরে এসে আজকের কবিতাকে যদি আমরা দেখি, অর্থাৎ এই ২০১৮ সালে, তবে আমরা দেখতে পাব এর মধ্যে আরও দুদশক পার হয়ে গেল। কবিদের ভাষায় শূন্য দশক ও প্রথম দশক। এখন চলছে দ্বিতীয় দশক। এর মধ্যে আমরা অতিক্রান্ত হয়েছি, এক মহা হতাশাগ্রস্ত গণতন্ত্রকাল — সামরিক-ছায়াগ্রস্ত তত্ত্বাবধায়ক শাসন, ফের গণতন্ত্র হতে হতে না হওয়ার আকাল। সবচেয়ে বড় কথা — রাজনীতি-বিমুখতার কাল। এর মধ্যেও কবিতা রচিত হয়েছে, হচ্ছে। এই দ্বিতীয় দশকে যারা কবিতা লিখছেন, তারাও এই রাজনীতি বিমুখতার ভেতরেই নিজেদের তৈরি করে নিচ্ছেন।
তার মানে এই নয় যে প্রতি দশকে দশকে সকল কবি তাঁর কাব্যস্বর পালটে নেন। যতটা দেখেছি রবীন্দ্রনাথে, কিছুটা জীবনানন্দেও — আমাদের কবিরা তেমনতরো বিবর্তনের দিকে খুব একটা নজর রাখেন না। কেবল উল্লেখ না করলেই নয় — সিকদার আমিনুল হকের নাম — যিনি শেষ বয়সে তাঁর কবিতার ভাষা ও আঙ্গিকের বৈপ্লবিক পরিবর্তন করে চিরস্মর্তব্য হয়ে থাকবেন। এর বাইরে আমাদের বলতেই হবে, এই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বিগত শতকের সত্তর বা আশির দশকের অধিকাংশ কবি তাদের সূচনাকালের ভাষাভঙ্গিতেই লিখে চলেছেন। নগন্য কয়েকজনের লেখার বিষয়বস্তুতে সমসাময়িকতার প্রভাব পাওয়া গেলেও বুননভঙ্গিতে তেমন কালের আঁচড় দেখি না। তাই আমি আলোচনাকে কেন্দ্রীভূত করতে চাই এসময়ের তরুণতম কবিদের দিকে। অর্থাৎ যারা এই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে কবিতা লিখতে শুরু করেছেন — যা এখনও সুনির্দিষ্ট রূপ ধারণ করেনি — যার নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে নতুন কিছু গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা যেতে পারে। তবে দ্বিতীয় দশকের কবিদের কবিতার দিকে মনোযোগ দিলে এমনটা মনে হতেই পারে, এ যেন নব্বই দশকের ধারারই ক্রম-অগ্রসরমানতা।
কিন্তু সে ধারাবাহিকতা কিছুতেই নঞর্থকভাবে দেখার জো নেই। “সেই সাথে টেকনোলজির বিকাশ কবিতাকে এনে দিল মানুষের হাতের মুঠোয়। কবিকে প্রতীক্ষা করতে হয় না দীর্ঘ সময়কাল, কখন ছাপানো হবে, কখন পৌঁছাবে পাঠকের হাতে, কখন কেউ এসে বলবে, “খুউব ভালো লাগলো কবি”। একটা কবিতা লিখে কবি আর কী এমন চায় — নাই অর্থ, নাই প্রতিপত্তি — শুধু কেউ যেন কানে কানে বলে — ভালো লাগল, খুব ভালো লাগল। সেই দুটি কথা শোনার জন্য আজ আর প্রতীক্ষার প্রয়োজন নেই। অন্তর্জালে কবিতা মুহূর্তে পৌঁছে যায় পাঠকের মহা সমাবেশে। এই জোয়ারে অনেকেই সামিল হয় বটে — কেউ কবি, কেউ ঠিক কবি নন, তবে কবিতার মতো করে বলে যাচ্ছেন মনের গোপন। অনেকের অনুযোগ শুনি, অনেকেই চিৎকার করে ওঠেন — “জাত গেল-জাত গেল” বলে। আমি বলি, ক্ষতি কী! লিখুক না সকলে দুছত্র। সে তো মনের কথা বলার জন্য শব্দ তুলে নিয়েছে, বন্দুক তো আর তোলেনি। আর এমন করে শব্দের এই ভুবন কি তাকেও কিছুটা নন্দন বচনের দিকে ধাবিত করে না — সেও কি করছে না পাঠ কিছু শোভন লেখনী?”
তবে, কালচক্র তো আর কারও জন্য বসে নেই। আমাদের সামনে এসে উপনীত হচ্ছে দ্বিতীয় পৃথিবী।
“নগরে সূর্যাস্ত ঢাকা পড়ে ভবনের তলে, সুতরাং দেখা যায় না তাকে সহজ ভঙ্গিমায়। ভবনে ঘেরা থেকে তবু বিদ্রোহে সে ঘোষণা দেয় সত্তার; অস্তমান সূর্যের দিক হতে, ধীর ধোঁয়ায়, ঘেরাওকে করে গ্রাস। অতঃপর যার সাথে আঁতাত করে অস্ত যায় সে, তাকে না দেখেই নিয়মিত বলি সাঁঝ”
(উবাইদুল্লাহ রাফী/দ্বিতীয় পৃথিবী)।
একটা সন্ধ্যার — এক সূর্যাস্তের জন্য এক ঔপন্যাসিক বর্ণনাকে উঠে আসতে দেখি অতি সাম্প্রতিকতমকালে। আশির শেষ থেকে নব্বইয়ের মধ্যযাম পর্যন্ত যে কবিতা সঙ্কুচিত হবার পথে এগুচ্ছিল, তা থেকে কি বেরিয়ে এসেছে? বা আসছে? আর ভাষা?
“রাতকে পোড়ানোর কষ্ট বিকিরণ করে সূর্যের চুমুতে জোনাকিরা শিউলি হয়ে যায়। জোনাকি জন্ম বড় ভালোবাসি। জ্বলব বলেই ঘর ছেড়েছি, সূর্য তেতে ওঠার আগেই শিশির হতে চেয়েছি কিশোরীর করতলে”
(অব্যয় অনিন্দ্য/ ক্ষমতা ও জোনাকির লংড্রাইভ)।
কী ভাষায়, কী বিষয়ে, কী ফর্মে কবিতা যেন দিনে দিনে আরেক মাত্রার দিকে এগিয়ে চলেছে। যারা বসে আছেন ছন্দের দোলায় একে ধরবেন, স্বপ্নের মায়ায় নিত্য ভাসবেন, কবিতা তাদের হয়তো কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ করবে। আমাদের দ্বিতীয় দশকের কবিতাকে এ সময়ের তরুণ মানসের বিচরণ ও ব্যাপ্তিতে পাঠ করতে শিখতে হবে। না হলে হয়তো পৌঁছে যাব কোনও ভুল অনুসিদ্ধান্তে। আর আমার মনোজগত সময়ের শিখার আঁচ থেকে দূরে দ্বীপ সদৃশ একা মুহ্যমান পড়ে র’বে। এখানে এখন উচ্চারিত হচ্ছে –
“কবির কলম থেকে দুঃখের দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে সুখ।
আহা, সুখ —
আমার ভাদ্দরবউ — তোমার পরস্ত্রী আর ঈশ্বরের আপেক্ষিকতা”(অব্যয় অনিন্দ্য/ ঈশ্বরের আপেক্ষিকতা)।
আমরা এই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে পা ফেলে সম্মুখীন হচ্ছি এক মহা বৈশ্বিক পরিবেশের। আমাদের প্রতিবেশে যেমন নিত্য আবিষ্কার এসে উপস্থিত হচ্ছে — নিত্যনতুন অনাচারও এই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। সামাজিক অবিশ্বাস অনাচার তো আছেই, বিশ্ব রাজনীতিতে যে মাত্রাতিরিক্ত সহিংসতা — নারকীয়তা, আমাদের বর্তমানকে গ্রাস করছে তাতে কবিতার বিষয় তো বটেই, ভাষা, ভঙ্গি, ফর্ম, সব কিছুই তছনছ হওয়া স্বাভাবিক। আবার স্বাভাবিক মানবিকতায় স্বপ্নও ভিড় করে আসে।
“চোখ বন্ধ করো, মুখ উপরে তোলো –
ভাবো, নীলে নাক ঠেকেছে — নীলের গন্ধ নাও; তোমার ফুসফুস ভরে যাচ্ছে ঐশ্বর্যময় নীলে।”(আল ইমরান সিদ্দিকী/ প্রাণায়াম রিপ্রাইজ)।
তবে, স্বপ্ন কিন্তু বাস্তবতাকে এড়িয়ে যেতে পারে না। তাই আজকের কবিতার স্বর এই ম্লান ভাবালুতা থেকে কিছুটা যেন বাইরে টেনে আনতে চায় নিজেকে।
“অতি অবমন্তা দিন যেন মিশে আছে এইসব দিনে। ছড়িয়ে পড়ছে প্লেগের জীবাণু, উঠে আসছে বিষণ্ণতা আমাদের হরিৎ মানস ম্লান করে দিতে। ভয়াবহ দাবানলের দিন আর জঙ্গলে ধ্যানীর একজোড়া বিস্ফোরিত চোখ দেখাই বুঝি নিয়তি হবে আমাদের!”
(আল ইমরান সিদ্দিকী/ উলেন সূর্য)।
কিংবা কেউ উচ্চারণ করেন “যে পৃথিবী উপেক্ষিত”। যখন শুনি কেউ বলছে –
“পিন ও পতনের পৃথিবীতে যে চিরস্থায়ী গ্রিন সিগন্যাল জ্বলে উঠেছিল; সে কী সহস্রাব্দে, নাকি আলোকবর্ষ পূর্বেকার কোনও মিল্কিওয়েতে? নতুবা ধরিত্রী নিজেই জানে না কবেকার সে অন্ধ স্ট্রিপলিং থর্ন — বিঁধেছিল হিসেব না জানা নিজেরই অকাটমূর্খ পায়, কবেকার কোন ঘোর অমাবস্যায়!”
(আসমা অধরা/ যে পৃথিবী উপেক্ষিত)।
অর্থাৎ আমরা আজ আর হোমার কিংবা রামায়ণ-মহাভারতের ট্র্যাডিশন টেনে টেনে কিংবা হালের এলিয়ট কি রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাসের ভূমি থেকে রূঢ় বাস্তবতায় নেমে এসে কবিতাকে হাঁটতে দেখি বিশ্বসংস্কৃতি ও বিজ্ঞান বাস্তবতার নির্যাসে। হাতের মুঠোয় অন্তর্জালিকার গুণে মহাবিশ্বের তথ্যপ্রবাহ যেন তিরতির বেগে বয়ে যাচ্ছে এদিনের কবির নিউরনে নিউরনে। আকাশ সংস্কৃতির এই বহুল উপস্থিতি কবির সামনে খুলে দিয়েছে সমগ্র বিশ্ব ভাণ্ডার। তাই সে কখনও চলে যাচ্ছে মঙ্গল কি শনি পরিভ্রমণে, কখনও বা কোনও অতি বেগুনি রশ্মি ঠেলে দিচ্ছে ভিন্ন বিশ্বের ডিজিটাল জেব্রা ক্রসিং-এ। তাই বিচিত্র সব অনুষঙ্গে ভরে উঠছে কবিতার বিচিত্র চাদর।
প্রায়শই যেসব কবিতাগুলো আমাদের সামনে এসে পড়ছে, তাতে আমরা দেখি ছন্দমাত্রাহীন, টানা গদ্যের কবিতায় ভরে উঠছে সমস্ত পৃষ্ঠাগুলো। হতে পারে অসহিষ্ণু, সহিংসতার বাস্তবতা, আকাশ সংস্কৃতির অনাবিল উপস্থিতি, মারাত্মক অস্থিরতার সমাজ ও রাজনীতি এই সময়ের তরুণ কবিতাকর্মীদের এক নিরাকার জটিল ঘূর্ণির ভেতরে এনে ফেলেছে। তাই কাব্যগ্রন্থের নাম উচ্চারিত হয় “ব্রায়ান অ্যাডামস অ্যান্ড মারমেইড লিটল বিষ্যুদবার”, আর কখনও কোনও তরুণ হয়তো বা পড়তে বসেছে চে গেভারা-র ‘মোটর সাইকেল ডায়েরি’, অথচ তার মন ঢুকে পড়ছে মৌলভিবাজারের নিগূঢ় অস্থিরতায়, অথবা সে ভাবতে বসে পড়ছে, কী ঘটছে সিরিয়ায়, দামেস্কে কিংবা আফ্রিকায় বা আমাজনে। কবিতাগুলো কেমন যেন ভিন্ন হয়ে উঠছে, বক্তব্য নেই, গন্তব্য নেই, এমনকি চমকেরও দরকার নেই — শুধু দৃশ্যের পরে উঁকি দিচ্ছে আরেক দৃশ্য, শ্রুতিকল্পের পরে শ্রুতিকল্প। ছন্দহীনতার এই রেশ কবিতার জন্য কেমন হবে, কেমন তার ভবিষ্যত? কে জানে…
তবু আমাদের শুনতে ভালো লাগে –
“ফুল সরিয়ে সরিয়ে তার উলঙ্গ দেহ আবিষ্কৃত হয় — জানা যায়, ফুলের গন্ধে তার মৃত্যু হয়েছে। জনপদে জনপদে এ গল্প রটে যায়, সেবার গম কাটার মৌসুমে। চাষারা, বহুপুরাতন ধর্মগ্রন্থে তারা এই মৃত্যুকে চিহ্নিত করে। লিপিবদ্ধ — এ যেন কল্পিত স্মৃতি, অতীতের। তারা ফিরে যায় স্মৃতিতে লুকানো আকাশ ও নদীর নিকটে”
(হিজল জোবায়ের/ গম কাটার মৌসুমে লিখিত)।
কিংবা আমাদের ধ্বংসও এইভাবে রূপায়িত হতে দেখি একদম আত্মমগ্ন স্বরে –
“আজ সাইরেন বাজাতে বাজাতে রণজিত ডাক্তারের বাড়িটা ছাই করে দিলাম, আমাকে দেখে ডাক্তার কান্না খেয়ে বললেন, বাজান তুইও!”
(সাদী মোহাম্মদ/ মুন্সী বাড়ির ছেলে)।
কোনও উচ্চস্বর নেই, কোনও পরামর্শ নেই — কেবল নির্বিকার বলে যাওয়া, ঘটে যাওয়া…
যেন আমাদের চারপাশে যা ঘটে যাচ্ছে, শোনা যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে, সব — সব কিছু নিত্য, সকলই আমাদের জলহাওয়ার মতো বাস্তবতা। এর কোনও ব্যাপারে আমাদের মনোবেদনা থাকতেই পারে, তবে নেই কোনও অনুযোগ, এর প্রতিকার বা প্রতিবাদেরও যেন কোনও ভাষা এখানে নেই। হয়তো এসব কবিতা আমাদের ভেতরে খুব সুক্ষ্মভাবে সঞ্চারিত করে যাচ্ছে এক অনির্বচনীয় বেদনার বোধ। তবে মনে করি, সকল কবিতাই এই নিরাসক্ত ভঙ্গিতে উচ্চারিত হয় না। তাই কিছুটা অনুচ্চ হলেও আমরা একটু ব্যতিক্রম স্বরে বলতে শুনি –
“সবুজ পাতা ঝরে গেছে মহুয়ার ডালে কোকিলের কুহুতান
আজ ঝরা পাতাদের মিছিলে লিখে দিলাম সব অভিমান!
রক্তক্ষরণের জ্বালা, দুচোখের নোনা জলে — একটু একটু করে
ছুঁয়ে যাক হৃদপিণ্ডের সব অবকাশ!”(সাফিনা আক্তার/ দেবতা)।
এই দ্বিতীয় দশকের কবিতায়ও দেখি বিভিন্ন ধারা উপধারা বহমান। কারও কারও কবিতায় এখনও লোকস্বর মিথকথা পুষ্পরেণুর মতো ছড়িয়ে পড়ে। তাই কখনও উচ্চারিত হতে দেখি –
“পৃথিবী মাঝে সবাই রাবণ আর প্রেমলীলায় বৃন্দাবন। সীতা বিনে তৃষাতুর বনবাস, বাহারী সুধায় কাটে সহস্র মাস। মায়ামৃগের বরে যদি কাটে এবেলা, আমি তবে রাবণ হব”
(অনুপম চৌধুরী/ দেবালয়ের গোপন বোতাম/ আমিও তবে কানাই হব)।
আবার কখনও বা দেখতে পাই পৃথিবীর প্রতি পরম মমতা, প্রকৃতির প্রতিও। বিজ্ঞানের প্রভাবও কবিতায় দুর্লক্ষ্য নয় — যদিও শেষকালে কবিতার গন্তব্য ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারি না।
“তোর চুলে উড়ে ফুলোপ্রজার দল। গন্ধ শুঁকে বাহারি মাতম। মিষ্টি রোদে ভাসে গোলাপ রাঙা ঠোঁট। সূত্র মাতে না — মানচিত্রের চিহ্নিত টিলা। উজান বাতাসে শুকায় শান্ত নদী — উত্তাল ঢেউ। তিক্ততায় মুখর পারিজাতের বিষরেণু। মূর্ছা যায় বাতাবি লেবুর ফোলাফাঁপা চামড়া। কিনে ভূ-উপগ্রহের প্রতিটি আস্তানা।”
(অনুপম চৌধুরী/ দেবালয়ের গোপন বোতাম/ ফুলোপ্রজার চরণচন্দ্রিমা)
তবে আমাদের মতো যারা স্মৃতিকাতরতা বা স্মৃতিহাতড়ানো মানুষ, যাদের জীবন চলে স্মৃতির ঔজ্জ্বল্যের গল্প করতে করতে, তাদেরকেও এই সময়ের কবিদের বেশ এক হাত নিতে দেখি চরম সাফল্য ও উৎকর্ষতার সাথে।
“স্মৃতি এক পরিত্যক্ত ট্রাঙ্ক। খুললেই কিলবিল করে লাফিয়ে পড়ে
ন্যাপথলনের খুশবু। আমার মর্চে রাঙা ডাকনাম সেখানে শুয়ে থাকে অযত্নে। কখনও বাড়ি ফিরলে মা ঘষে ঘষে সাফ করে তোলেন। প্রায় প্রতিটি চোখঅলা প্রাণী ঘাড়ে একটি ট্রাঙ্ক নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। অবসরমতন খুলে মেলায় জীবনের লেন দেন। আর প্রিয়জনদের কানে তুলে ধরেন টুকরো টুকরো কথাপিণ্ড।”
(উপল বড়ুয়া/ কানা রাজার সুড়ঙ্গ/ ট্রাঙ্ক)।
এখানে কবি কি কেবলই স্মৃতিকাতরদের আঘাত করেছেন? নাকি নিজেই আঁকড়ে ধরেছেন স্মৃতিভাণ্ডারকে? এ কেবলই এক চিত্রায়ন। কবি দৃশ্যকল্প, শ্রুতিকল্প, উপমায় ভরে তুলেছেন ব্যাপারটিকে চমৎকারভাবে। তারপরও যেন সব নিরর্থ — এক নির্বিকার ভঙ্গি — যেনবা কবিই হয়ে উঠছেন ঈশ্বর কিংবা নিতান্ত দর্শক।
তবে কেবলই নিরর্থ ভাষণ এই কবির মূল ভঙ্গি নয় বলেই মনে হয়েছে কোনও কবিতায়। কখনও উঠে এসেছে অভাব, দুঃস্বপ্ন কিংবা স্বপ্নবাজিতার গল্পও।
“আমার বোন তখনও জ্বলন্ত উনুন। নিবে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ভিজে যাচ্ছিল অহেতুক কল্পনা।
…
প্রতিদিন সন্ধেরা ঘরে ফিরত। অথচ বাবার খালিহাত। প্রতিদিন আমার বোন সাজত ভরদুপুর। তারপর মুছে ফেলত নোনাজলে। আমরা ভাইরা জানতাম চুপচাপের ভাষা। কেবল মা জানত শূন্যে রান্নার বিবিধ পদ্ধতি…”
(উপল বড়ুয়া/ কানা রাজার সুড়ঙ্গ/ আমরা ছিলাম অসম্ভব স্বপ্নবাজ)।
এ যেন একুশ শতকের নতুন কাহ্নপা। আমার সারাগায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। রক্ত শিরশির করে ওঠে… কোনও কোনও কবিতায় জীবন যেন নতুন মাত্রিকতায় এসে ধরা দেয়। কখনও কখনও মনে হয় এই তো কবিতার শরীর বেয়ে উঠে আসতে ‘দেখি রক্তচুম্বন মাখা সেই ভয়াল বিষদাঁত’। আমাদের এই সাত কামিনীর সংসারে কী অর্থ ধারণ করে জরায়ুর লাল কিংবা ফসিলের ছাই?
“ডুবোচরে কথার ফসিলগুলো সজ্জা পাতে, ঢেকে দেয় জলের অহং।
দাবানল — ঐ দূর পশ্চিমে; এই পুবে কথার জোয়ার।
কোথা’ জমা শেষ স্তবকে মোড়া ঐ জরায়ুর লাল, ফসিলের ছাই?
কে খোঁজে আজ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তন্ন তন্ন ক’রে”(রুবেল সরকার/ সেই সাত কামিনীর সংসার)।
তবে একথা মানতেই হবে, পৃথিবী জুড়ে প্রেম-রস আদিরস মোহ কি নারী পুরুষের জৈবনিক রসায়ন — সে কোনও কাল বা যুগ অবহেলা করে হেলায় উড়াতে পারে না। তাই নানা ভঙ্গিমাতে প্রেম এসে ধরা দেয় এসময়ের কবিতার খাতায়।
“প্রেম ও কামের মাঝে ডুব দিয়ে আদিম কাছিম এক ভুলেছে সব, রপ্ত করেছে মনের ভেতর দেহকে গুটানোর কৌশল। ফুটেছে কামের ফুল”
(শেখর দেব/ বাঞ্ছাকল্পতরু/ আদিম কাছিম)।
তবে কথা হচ্ছে, কালের চিহ্ন লেগে আছে কবিতার গায়ে। আমরা এমন এক অস্থির সময়ের মধ্যে পার করছি প্রতিটা দিন — কোথাও কেউ অকস্মাৎ লাশ হয়ে ফেরে, কেউ মরে বোমার হামলায় কিংবা কেউ কেউ সম্মোহনে নিজেকেই আত্মাহুতি দেয়। দেশে তো বটেই, বিদেশের প্রতিটা শহরও যেন দিনে দিনে হয়ে উঠেছে ফুটন্ত কড়াই। কেউ যেন ক্রমাগত অগ্নিমধ্যে ঢেলে যাচ্ছে ঘৃত। তাই আজকের কবিতাও নিরুচ্চার থাকতে পারে না। তবে বিংশ শতকের সেই তেজোদ্দীপ্ত বিদ্রোহী উচ্চারণ হয়তো নেই। হয়তো বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির নিস্তব্ধতাই এর জন্যে দায়ী। হয়তো যুবকের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে না তেমন তেমন প্রতিবাদী নেতৃত্ব। তবু আমরা শুনি –
“সী-বিচে গেলে আমার মাঝে মাঝে পার্ল হারবার-এর কথা মনে পড়ে যায়। প্রতিরোধ-প্রতিশোধের দিনগুলোতে এখানে নির্ঘাত নেমে এসেছিল ডুবো সৈনিকেরা। বুকের ভেতর ছিল দীর্ঘ নিঃশ্বাস আর মাইনের তীব্র রোদ — উড়িয়ে দিতে।
…
যে বাড়িতে বোমা পড়ে, যে বাড়িতে মানুষ মরে যায়; পায়রা কিংবা বিড়ালও — যে হারিয়ে যায় — তার কাছে হিরোশিমা, পাহাড়ে আগুন, বন্দরের পূর্বাঞ্চলে নোঙ্গর ফেলা যুদ্ধজাহাজ — সবকিছুই বেদনা মিশ্রিত শতাব্দী পুরনো ভয়।
…
যে দিগন্ত ঢেকে যায় বোমার ধুলিকণায়, যে মানুষ ছিন্নভন্ন, যে শিশুর আঙুলে এখনও শোভা পায় মৃত্যুচিহ্ন, ভবিয়াশ্বের যে প্রান্তে পা রাখুক তার ভয়ক্লান্ত ছায়া — সে তো যুদ্ধ-বিগ্রহে প্রতি পরতে পরতে দিশাহীন শঙ্খচিল –উড়ে যাচ্ছে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে…”
(সৈয়দ সাখাওয়াৎ/ পাতাচূর্ণ উড়ে যাব আর সাথে সাথে/ শঙ্খচিল)।
এই যে এতসব কাসুন্দি ঘাঁটছি, তার হেতু বিচার করলে বুঝতে হবে, এখানে কিছু তো ঘটছে। এত কথার কচকচানি। তাই আমরা উচ্চারণ শুনি –
“যা ঘটছে, ঘটুক
যে পথের শেষ নেই
সে পথের শেষ মাথায়
ক্যালেন্ডারের প্রথম দিন জীবিকার বাক্স
খুলে দিয়ে বলুক, স্বর্ণধুলোর খনি খুঁজে পেতে
ঈশ্বর লিখিত কোনও নিবন্ধন লাগে না।”(অরিন্দম চক্রবর্তী/ সারামুখে ব্যান্ডেজ/ আকাশের যত মুহূর্তবাদ)।
তো, কথা হচ্ছে, এসময়ের কবিতা অব্জেক্টিভিটির হাত থেকে যেন নিস্তার লাভ করেছে। যেন শব্দগুলো বাক্যবন্ধে গ্রথিত হতে হতে শব্দের আভিধানিক অর্থবোধকতার ঊর্ধ্বে উঠে ভিন্ন ব্যঞ্জনায় আলোড়িত হয়ে উঠেছে। অতি চেনা শন্দগুলো একের পর এক গাঁথা হচ্ছে আর অন্যলোকের কোনও আস্বাদ আমাদের দিকে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করছে। হয়তো এখনও পুরোপুরি একটা নির্দিষ্ট রূপ লাভ করতে পারেনি, হয়তো বা তেমন কোনও রূপধারণের প্রয়োজনই নেই — তবু, মনে হচ্ছে, এইসব ভাঙাগড়ার অস্থিরতার পরে আমরা এখানে দেখতে পাব কোনও বিশেষ বৈশিষ্টের। আপাতত যে অনিন্দ্যসুন্দর পংক্তিগুলো আমাদের মনোলোকে আলোড়ন বিলোড়ন জাগাচ্ছে তার মধ্য থেকে নান্দনিকতার ঘ্রাণ শুঁকে যাই। চলুন, এগুনো যাক, বাইরে কত নক্ষত্র পতনের প্রতীক্ষায়, কত সূর্য ঠান্ডা মেরে যাচ্ছে…
এর পরেও কথা থেকে যায়, ইদানিং অনেক কবিতাতেই দেখা যাচ্ছে সুন্দর শব্দের ঠাসবুননের মধ্যে এক অর্থহীনতার ঘেরাটোপে অনির্দেশ্য রূপে বাক্যগুলো বাতাসে বিলীয়মান হচ্ছে। অনুভূতিতে দোলা লাগলেও অসংলগ্নতা অর্থহীনতা আসলে রচয়িতার উদ্দেশ্যবিহীন শব্দচারণারই প্রতিফলন ঘটায়। তাই বলে হৃদয় নিংড়ানো কবিতাগুলোর কথা যেন ভুলে না যাই।
“এইসব কাঁসার দুপুর। কয়েকটি গরাদের সাথে কথা হয় — নদী পার হয়ে কারা যেন চলে গেল রেলকলোনির দিকে! সেসব জানে না ঐ অমিত পিয়াল — কোথাও, হয়তো পড়ে আছে আপামর শেষ সাঁকোটির ছায়া! চাতালের জাম গাছ আমাকে ডাকছে অজস্র পত্রসমেত!”
(হাসান রোবায়েত/ ক্ষমা)