কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়
এইখানে কোথাও একটা বিছুটির ঝোপ আছে, অন্তত বছর দশ বারো আগে ছিল। খেলতে খেলতে একবার এই ডোবার ধারে এসে পড়েছিল, হাতে পায়ে লেগে বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড। একে জ্বলুনি, তার ওপর সন্ধে পার করে বাড়ি ঢোকার জন্য মায়ের কানমলা।
দেখেশুনে পা ফেলল মুনমুন। জায়গাটা একেবারে জঙ্গল হয়ে রয়েছে। বিনবিন করছে মশা। সাপখোপও থাকতে পারে। যখন বিছুটি লেগেছিল তখন মুনমুন অবশ্য সাপ বলত না। বলত লতা। বারো বছর আগে সারা পাড়ায় জঙ্গল আর জঙ্গলে লতারা গিজগিজ করত। এখন সে জঙ্গল নেই, লতারাও অদৃশ্যপ্রায়। কিন্তু এখানে দুএক পিস থাকা অস্বাভাবিক নয়। যদি না শীতে অলরেডি তাঁরা ঘুমোতে গিয়ে থাকেন। নাকি এখনও তত শীত পড়েনি?
সাপে কাটা ভয়ের কিন্তু কৌতূহল না মিটিয়ে থাকা আরও কঠিন। ওড়নার দুই প্রান্ত আর সালওয়ার মুঠো করে, উঁচু করে পা ফেলে ফেলে যথাসাধ্য ঝোপঝাড় এড়িয়ে, ইট বার করা পাঁচিলটার দিকে এগোল মুনমুন। পাঁচিলটা সরু কিন্ত উঁচু। পাঁচিলের গায়ে সেঁটে যেতে পারলে সুবিধে হত, কিন্তু গা বেয়ে আবার নর্দমা গেছে। ভাগ্যিস নর্দমাটা সরু আর শুকনো। কোনও মতে সরু নর্দমার এদিক থেকেই দুই পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে পাঁচিলের প্রান্ত দুই হাতে আঁকড়ে ওধারে উঁকি মারার চেষ্টা করল মুনমুন। বিশেষ সুবিধে হল না।
এই সব সময়ে মাবাবার ওপর রাগটা বেড়ে ওঠে। একজন পাঁচ দুই, অন্যজন চার দশ। মুনমুন ঠিক করে রেখেছে কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবে ওর হাইট পাঁচ ফুট, কিন্তু আসলে ও চার এগারো। ডাক্তারবাবুর ডিসপেনসারিতে মেশিন আছে, দাঁড়ালে পায়ের নিচে কাঁটা দেখে ওজন আর সামনের লম্বা ডাণ্ডার গায়ে সমকোণে লাগানো সরু লাঠি মাথার ওপর টেনে নামিয়ে লম্বা মাপা যায়। গত দু’বছর মুনমুন সকালবিকেল ঝাঁট দিতে গিয়ে মেশিনে দাঁড়ায়। ওজন নিয়ে ওর কোনও মাথাব্যথা নেই। ও দেখে আগের থেকে ও একটুও লম্বা হল কি না। ওর এখন বাইশ, ডাক্তারবাবু বলেছেন আঠেরোর পর মানুষ আর লম্বায় বাড়ে না, তবু মুনমুন মেশিনে চড়ে মাপে। ডিসপেনসারিতে ঢুকে থেকে মাপছে। আগে রোজ মাপত, এখন সপ্তাহে দু’তিন বার মাপে। চার এগারো যে চার এগারোই।
পাঁচিলের ওধারে হাত পাঁচেকের মধ্যে বারান্দা। বারান্দায় এখন লোকগুলো গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোকগুলো সামনের দরজা দিয়ে ঢুকেছে। গটগট করে। মুনমুনের মতো সাপখোপের জলাজঙ্গল দিয়ে ঢোকেনি। স্বাভাবিক। কারণ লোকগুলো পুলিশ। মোড়ের মাথায় জিপ দাঁড় করিয়ে মেঠো কাঁচারাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে এসেছে আর মুনমুন এসেছে শর্টকাটে, ডোবার পাশের জলাজঙ্গল পেরিয়ে। পাঁচিল আর বারান্দার মধ্যে একটা ঝুপসি আশশ্যাওড়ার গাছ। ঘন পাতার ফাঁক দিয়ে মুনমুন ওদের দেখতে পাচ্ছে, কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছে স্পষ্ট, কিন্তু পেছন ফিরে তাকালেও এই নভেম্বরের বেলা সাড়ে পাঁচটার আলোয় আশশ্যাওড়ার ছায়ায় পাঁচিলের আড়ালে চার এগারোর মুনমুনকে ওরা দেখতে পাবে না।
গোড়ালি নামিয়ে অলরেডি ব্যথা হতে থাকা বুড়ো আঙুল দুটোকে একটু আরাম দিয়ে পাঁচিলে আঁকড়ে আবার উঁচু হল মুনমুন।
সামনে যে গটগট করে হাঁটছিল, পেছনে কেউ এল না এল তাকাচ্ছিল না, সে দাঁড়িয়ে আছে মুনমুনের দিকে পেছন ফিরে। দূর থেকে দেখে মুনমুন ভেবেছিল মেরেকেটে পাঁচ নয়, কিন্তু এখন কাছ থেকে দেখে মনে হচ্ছে পাঁচ দশ হতে পারে। এ পরে আছে সাধারণ শার্টপ্যান্ট। এর পেছন পেছন অল্প ছুটে অল্প হেঁটে হাসছিল পাঁচ পাঁচের সাদা উর্দি পরা পুলিশটা। এই পুলিশটার মুখ চেনে মুনমুন, রথের মেলায়, ভোটের মিছিলে খুব লাঠি ঝাঁকায়। এখন অল্প ঝুঁকে শার্ট প্যান্ট পরা লোকটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, বগলে মোটা একটা ফাইল। আর এদের দুজনের থেকে অল্প দূরে দাঁড়িয়ে দুই হাত ক্রমাগত কচলে যাচ্ছে যে সে হল…..
‘কী যেন নাম তোমার?’
‘বিশা… শ্রী বিশ্বজিৎ দাস, স্যার।’ হাত কচলানো থামিয়ে বলে উঠল তৃতীয় জন। বছর চব্বিশ বয়স। টিংটিঙে রোগা, ছ’ফুট লম্বা। আসলে পাঁচ এগারো কিন্তু মুনমুন মনে মনে এক ইঞ্চি বাড়িয়ে নিয়েছে। উসকোখুসকো ঝাঁকড়া চুল নেমে চোখ প্রায় ঢেকে ফেলেছে। হাত দিয়ে চুল সরাল ছেলেটা। সরানোমাত্র আবার চুল ঝাঁপিয়ে চোখ ঢেকে ফেলল।
‘ভেরি গুড। তা বিশ্বজিৎ, সকালে তুমিই তো সবার আগে…’
রোগা ঘাড় নড়ল ওপর নিচে।
‘গুড। এবার সকাল থেকে কী কী হল বলো।’
তড়বড় করে উঠল পাঁচ-পাঁচের পুলিশটা। বগলের ফাইলটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমরা সাক্ষীর জবানবন্দি নিয়েছি স্যার… একেবারে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, এই যে স্যার…’
স্যার ডান হাতটা তুললেন। পাঁচ পাঁচ আবার কুঁকড়ে গেল।
‘তুমি বলো। কিছু না বাদ দিয়ে একেবারে গোড়া থেকে…’
‘আমি তো স্যার সকালেই ভ্যান নিয়ে ইস্কুলে বেরিয়েছি, রোজ যেমন বেরোই, আজ একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল স্যার, ওই বুধুদার বউ হেবি দাঁড় করিয়ে রাখে স্যার…’
‘স্কুলে যাওয়ার আগে কি তুমি এ বাড়িতে এসেছিলে?’
‘না স্যার, স্কুলের আগে তো স্যার হেবি তাড়াহুড়ো। ইস্কুল শুরু হয় তো স্যার আটটার সময় তার আগে তো স্যার আমার নিঃশ্বাস ফেলার সময় থাকে না স্যার। আমি এসেছিলাম স্কুল থেকে ফেরার পথে… এই ধরুন সোয়া আটটা…’
‘ভেরি গুড, তাহলে সেখান থেকেই বলো। আটটার সময় বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছে দিয়ে, সোয়া আটটার সময় এ বাড়িতে এসে তুমি কী দেখলে।’
‘ওই মহিলা… ইয়ে, ভদ্রমহিলা… মানে সুলতা, বারান্দায় বসে ছিল স্যার।’
‘এই বারান্দায়?’
‘হ্যাঁ স্যার।’
‘কোথায়?’
বারান্দার কোণের একটা জায়গা আঙুল দিয়ে দেখাল বিশ্বজিৎ।
‘এখানে স্যার।’
‘মুখচোখ কীরকম ছিল? কান্নাকাটি করছিল? বা করেছে বলে মনে হচ্ছিল?’
‘ইয়ে, মানে স্যার, আমি তো ঠিক দেখিনি…’
মুনমুনের ইচ্ছে হল বলে, ওকে অপরিচিত মেয়েদের মুখের দিকে না তাকিয়ে বড় করা হয়েছে স্যার। নেহাত দরকার পড়লে কানের পাশের হাওয়ার দিকে তাকিয়ে কথা বলে। দু’বছর কাটার পর অবশেষে মুনমুনের চোখে চোখ রাখতে পারে, তবুও এখনও ঝগড়ায় হারতে থাকলে চোখ স্লিপ করে গিয়ে কানের পাশে সরে যায়, মুনমুনের ধমকে ফেরত আসে।
‘তোমাকে দেখে কিছু বলল?’
‘কিচ্ছু না স্যার, একেবারে পাথরের মতো স্থির। সামনের দিকে তাকিয়ে বসে আছে, আমার দিকে তাকাচ্ছেও না। শেষটায় আমিই বললাম, শম্ভুদা আছে?’
‘তাতে কী বলল?’
‘কিছু না স্যার, যেমন কে তেমন মুখে বড়া। আমি ভেবেছি ঘুম চোখে শুনতে পায়নি বুঝি, আবার জিজ্ঞাসা করলাম, শম্ভুদা আছে? তখন আমার দিকে তাকিয়ে ঘাড় হেলাল। আমি বললাম, দেখা হবে?’
‘কী উত্তর দিল?’
‘হাসল স্যার।’
‘হাসল?’
‘শকে এক্সপ্রেশন গুলিয়ে গিয়েছিল স্যার। যতই হোক, নিজে হাতে স্বামীকে…’ স্যার হাত তুললেন। পাঁচ-পাঁচ কুঁকড়ে গেল।
‘হাসল স্যার। তারপর বলে কি, দেখা হবে না। আমি চলেই যেতাম স্যার, কিন্তু স্যার দীপকদা সামনের রবিবারের রক্তদান শিবিরের জন্য কী একটা কাজে শম্ভুদাকে দেখা করতে বলেছিল, আর্জেন্ট… তাই স্যার…’
‘তুমি না দেখা করে যেতে পারছিলে না। তারপর?’
‘আমি বললাম ভীষণ দরকার, একটা কথা বলেই চলে যাব।’
‘তখন কী বলল?’
‘বলল, ঘরে আছে, কিন্তু তোমার কথা শুনতে পাবে না। আমি ভাবছি মহিলা পাগল নাকি, মুন, ইয়ে মানে আমার বউ তো সেরকম কিছু বলেনি… আমি ভাবছি ফিরেই যাই, এমন সময় নিজেই বলে কী, ‘শম্ভুদা তোমার কথা শুনতে পাবে না, কারণ শম্ভুদা মরে গেছে।”
‘তুমি কী করলে?’
‘আমি তো হাঁ করে আছি স্যার, কী বলব ভেবে পাচ্ছি না। ওদিকে বড় রাস্তায় ভ্যানে পল্টু বসে আছে ওর আবার কাজে যেতে লেট হয়ে যাবে, আমি ভাবলাম একবার ঘরে ঢুকে নিজেই দেখে আসি কী ব্যাপার।’
‘ঢুকলে?’
‘ঢুকলাম স্যার।’
‘কিছু বলল না? বারণ করল না?’
‘না স্যার। যেমন চুপ করে বসে ছিল রইল। আমি ঘরে ঢুকে দেখি খাটের ওপর…’
‘খাটের ওপর?’
‘শম্ভুদা চিৎ হয়ে শোওয়া, মুখ হাঁ, চোখদুটো খোলা সোজা সিলিং-এর দিকে…’
বিশ্বনাথের গলা বুজে এল, হাত তুলে কপাল থেকে চুল সরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল আরও একবার।
‘তুমি কী করলে?’
‘আমি তো ছিটকে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম স্যার…’
‘ঘরের ভেতর কিছু চোখে পড়ার মতো দেখেছিলে? অগোছালো? লোক ঢুকে তছনছ করার চিহ্ন?’
‘তখন কিচ্ছু দেখিনি স্যার। চোখদুটো দেখেই আমার হয়ে গেছে।’
‘হুম… সুলতা মণ্ডল তখন কোথায়?’
‘বারান্দায় বসা স্যার। নট নড়নচড়ন। সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আর মহিলাকে কিছু না বলে পল্টুকে গিয়ে সব বললাম। পল্টু তো শুনেই ‘বাবাগো’ বলে ভ্যান স্টার্ট দিয়েছিল স্যার, কোনওমতে বুঝিয়েসুঝিয়ে থামালাম। বললাম আমি ভ্যান নিয়ে থানায় যাচ্ছি, তুই এখানে থাক, কিছুতেই রাজি হল না। আমার ওকে গাড়ি নিয়ে ছাড়ার ইচ্ছে ছিল না স্যার, হেবি নার্ভাস ছেলে স্যার, অ্যাক্সিডেন্ট করে বসল হয়তো, কিন্তু ও কিছুতেই থাকতে রাজি হল না। তাই ওকে বললাম আমি থাকছি, তুই থানায় যা, রাস্তায় কাউকে কিছু বলবি না… সোজা থানায় গিয়ে পুলিশকে বলবি সব গুছিয়ে। ও চলে গেল আর আমি থেকে গেলাম।’
‘তখন সুলতা মণ্ডলের সঙ্গে কোনও কথাটথা হয়েছিল?’
‘কিছু না স্যার। মহিলা সেই ঠায় বারান্দায় বসে রইলেন তো রইলেনই। ইয়ে… আমি তারপর আরেকবার ঘরে গিয়েছিলাম স্যার…’
পাঁচ-পাঁচ লাফিয়ে উঠল। ‘সে কী এটা তো আগে বলিসনি?’
‘মনে ছিল না স্যার।’
‘কী করতে গিয়েছিলে?’ স্যার জিজ্ঞাসা করলেন।
বিশ্বনাথ চুল সরানোর চেষ্টা করল কপালের ওপর থেকে।
স্যার ঠাকুমা বলত অনেক সময় স্যার চিতা থেকেও নাকি লোকে উঠে আসে। আমি তাই একবার নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখতে গিয়েছিলাম স্যার।’
‘কী দেখলে?’
‘কোনও নড়াচড়া নেই স্যার, হাওয়াটাওয়া কিচ্ছু নেই… তখনই বুঝে গেলাম স্যার, যা হওয়ার…’
‘ঘরের ভেতর কিছু ছোঁওটোওনি তো?’
‘পাগল স্যার? একবার ভাবলাম চোখদুটো বুজিয়ে দেব কি না, তারপর ভেবেটেবে আর…’
‘ভালোই করেছ। তারপর কী হল?’
‘ওই ঘরে দাঁড়ানো যাচ্ছিল না স্যার, এমন বীভৎস চোখদুটো… বেরিয়ে এসে বারান্দায় পায়চারি করতে লাগলাম… তারপর তো স্যার থানা থেকে স্যারেরা এলেন…’
‘কী দ্যাখতাছস?’
মুনমুনের ঘাড়ের কাছে গরম হাওয়া ফিসফিস করে উঠল। গলা থেকে আপসে বেরিয়ে আসা চিৎকারটা কোনওমতে থামিয়ে মুনমুন ঘাড় ফেরাল।
গাঢ় বাদামী একটা ভাঙাচোরা মুখ, মুখের ঊর্ধ্বাংশ ঘিরে সাদাকালো চুল সাপের বাচ্চার মতো ফণা তুলে রয়েছে। ভোঁতা নাক, মুখের ভেতর থেকে জর্দার ছোপওয়ালা দাঁতগুলো এমন বেরিয়ে আছে যে স্বাভাবিকভাবে মুখ বন্ধ হয় না। সর্বদা হাঁ করে থাকার ফলে মুখটায় একটা চিরস্থায়ী বিস্ময় ফুটে থাকে। এখন তার সঙ্গে দু’চোখ গোলগোল হয়ে থাকায় বিস্ময়ের বদলে আতঙ্কের ভাব প্রবল হয়েছে।
এ ভগবতীর মা। পাড়ার বেশিরভাগ লোক এর এই নামটাই জানে। মুনমুনের মা তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে বিধবা হওয়ার পর তখন এই ভগবতীর মা নিজের ঠিকে বাড়ির থেকে একটা বাড়ি মুনমুনের মাকে দিয়ে দিয়েছিল। সেই থেকে মুনমুন একে বাকিদের মতো ভগবতীর মা না বলে মাসি বলে ডাকে।
‘এখানে কী করছ?’ গলা নিচে রেখে যতখানি ঝাঁঝিয়ে বলা যায় বলল মুনমুন।
‘পুলিশ আইসে নাকি?’
মুনমুনের কাঁধে ভর দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করতে করতে বলল ভগবতীর মা। পায়ের চাপে শুকনো পাতা খসখস করল।
স্যার লোকটা একবার ঘাড় ঘোরাল কি?
‘কী করছ কী?’ ভগবতীর মাকে টেনে নামাল মুনমুন।
‘তরে দ্যাখসে?’
‘এইবার দেখবে। তুমি যা লাগিয়েছ। হয় চুপ করে দাঁড়াও, নয় যাও এখান থেকে।’
‘সুলতারে নিয়া আইসে?’
মুনমুন মুখে আঙুল দিয়ে দু’দিকে মাথা নাড়ল।
স্যারের মাথা আবার ঘুরে গেছে।
‘তারপর কী হল? যতক্ষণ পুলিস না এল তুমি এখানেই ছিলে?’
‘হ্যাঁ স্যার, এই চাতালে পায়চারি করছিলাম।’
গলাটাকে চিনতে পেরে ভগবতীর মায়ের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হল।
‘বিশারে ধরসে নাকি?’
‘উফ ওকে ধরবে কেন, সকালে ও-ই প্রথম এসে বডি…’ শব্দটা বলতে গিয়ে হোঁচট খেল মুনমুন… দেখেছিল বলে ওকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। থামবে এবার? শুনতে দাও কী বলছে।’
স্যারের ঘাড় এবার ঘোরেনি একবারও।
‘পল্টু পুলিশ নিয়ে আসার পর কী হল?’
পাঁচ-পাঁচ গলা ঝাড়ল। ‘আমরা তো এসেই স্যার সব ভিড়টিড় সরিয়ে, অ্যাম্বুলেন্সট্যাম্বুলেন্স ডেকে, ডাক্তার ডেকে বডি পরীক্ষা করিয়ে…’
‘ডাক্তার কী বলল?’
‘যা বলল তা বোঝাই যাচ্ছিল স্যার। গলার ওপর তখনও ওয়েপন প্যাঁচানো ছিল স্যার, একটা নারকেল দড়ি। শ্বাসরোধ করে হত্যা।’
‘টাইম?’
‘সে অত বলতে চায় না স্যার, বলে রাত দশটা থেকে শুরু করে ভোর পাঁচটার মধ্যে যখন খুশি হতে পারে স্যার। এর বেশি বলতে গেলে নাকি পরীক্ষাটরিক্ষা করতে হবে।’
‘সুলতা মণ্ডল কী বলল?’
কিচ্ছু না স্যার। কী হয়েছে জানি না, কে করেছে জানি না, কখন হয়েছে জানি না। ঘুমোচ্ছিলাম। কিচ্ছু টের পাইনি। সকালে উঠে ঘুম ভেঙে দেখছি এই ব্যাপার।’
‘আচ্ছা।’
‘তারপর তো অ্যাম্বুলেন্স এসে গেল, আমরা বডি নিয়ে চলে গেলাম স্যার। থানা থেকে ফিমেল হাবিলদার আনাতে হল সুলতাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য, আজকাল তো আবার জানেন নানারকম ফ্যাকড়া। সেই থেকে সারাদিন জেরা চলেছে, এক বুলি আউড়ে যাচ্ছে। কিছু জানি না, কিছু দেখিনি, ঘুমোচ্ছিলাম।’
‘এখানে কাউকে বসিয়ে গেলে পারতেন…’
‘এখানে স্যার শহরের মতো না। ম্যানপাওয়ারের হেবি টানাটানি স্যার। তার মধ্যে আবার রেললাইনের ওপারে একটা বারোয়ারি মনসা পুজো হচ্ছে স্যার, রাস্তাফাস্তা আটকে ক্যাচালের একশেষ। সেইখানে আমাদের পুরো ফোর্স অকুপায়েড স্যার, কাজেই এদিকে আর… তবে আমি সবাইকে দাবড়ে গেছিলাম স্যার, এ দিকে এলেই স্যার সোজা হাজতে পুরে দেব।’
‘দাবড়ানিতে কাজ দেবে?’
‘দেবে স্যার। হে হে, এ ব্যাপারেও স্যার এ সব জায়গা শহরের মতো নয়। পুলিশের ভয়টা এখনও খায় পাবলিক। তবে স্যার আমি কেষ্টাকে বলেছিলাম — পুজোর ঝামেলা মিটলে একবার এসে দেখেটেখে যেতে, হয়তো এসেও গেছে স্যার, আশেপাশেই আছে…’
চটাস!
শব্দটা শুনেছে সকলেই। বারান্দার কথা থেমে গেছে। এদিকওদিক তাকাচ্ছে সবাই।
‘কী করছটা কী?’ বিদ্যুৎবেগে মাথা নামিয়ে হিসহিসিয়ে উঠল মুনমুন।
ভগবতীর মা পা চুলকোচ্ছে ঘসঘস করে।
‘হালার মশা…’
‘আপনি তাহলে একটু দেখে আসুন, কেষ্টাকে যদি পান।’
স্যারের আদেশ আর পাঁচ-পাঁচের ‘ওকে স্যার’ বলে জুতোর আওয়াজ তুলে গটগটিয়ে হাঁটতে শুরু করার মধ্যের তিরিশ সেকেন্ডে কী হল, কেউ কিছু বলল কিনা, গুঁড়ি মারা অবস্থায় শুনতে পেল না মুনমুন।
‘তোমাদের শম্ভুদা কীরকম লোক ছিল?’
খুব ধীরে উঁচু হল মুনমুন। এখন বারান্দায় দুটো লোক। পাঁচ দশ আর পাঁচ এগারো।
‘বিশ্বজিৎ বলল, ভালোই তো স্যার। খুব সমাজসেবাটেবা করত স্যার, রক্তদান শিবির, কম্বল বিতরণ, ভোটের প্রচার, চোর ধরা পড়লে গণপিটুনি লিড করা….’
‘বাঃ, করিৎকর্মা লোক তো। লোকে শ্রদ্ধাভক্তি করত খুব?’
‘তা তো করতই স্যার, আবার অনেকে… শম্ভুদার আসলে মেজাজ খুব কড়া ছিল তো স্যার, ঝামেলাঝাঁটি হত মাঝে মাঝে…’
‘রিসেন্টলি কিছু হয়েছিল?’
‘গত মাসে স্যার ওই দক্ষিণপাড়ার খ্যাঁদা বাপির ছেলেদের সঙ্গে একটা ঝামেলা হয়েছিল স্যার… সত্যনারায়ণ পুজোয় মাইক বাজানো নিয়ে, ছেলেগুলো হেবি গুণ্ডা টাইপ স্যার, বাইকে চেপে চেনটেন নিয়ে এসেছিল…’
‘শম্ভুকে হুমকি দিয়েছিল?’
‘না স্যার, শম্ভুদাকে চমকানো অত সোজা না। শম্ভুদার ছেলেরাও রেডি ছিল স্যার, বারুজীবীর মাঠে হেবি মারামারি…’
পেছন থেকে একটা হাত এসে গলা জাপটে ধরল মুনমুনের। দুই হাতে গলা বেড় দেওয়া কনুইটা ধরে টাল সামলানোর চেষ্টা করতে লাগল মুনমুন, একটা মিহি গলা চিৎকার করে বলল, ‘ধরে ফেলেছি স্যার…’ আর সব ছাপিয়ে গেল আকাশফাটানো আর্তনাদ, ‘মাইরা ফালাইল রে…’
*****
‘বাইরে কী করছিলে?’
দুই হাতে দুজনকে টানতে টানতে বারান্দায় এনে পাঁচ-পাঁচ এখন কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুনমুনের কাঁধের কাছে ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছে ভগবতীর মা। কান্না আপাতত হেঁচকিতে এসে ঠেকেছে। মুনমুন গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বুকের ধড়ফড়ানিটা থামেনি এখনও। হাতও কাঁপছে অল্প অল্প। সেটা বুঝতে না দেওয়ার জন্য মুনমুন ওড়না আঙুলে প্যাঁচাতে লাগল।
‘স্যারের কথা শুনতে পাচ্ছিস না?’ ঝাঁঝিয়ে উঠল পাঁচ-পাঁচ। স্যার, ওর নাম মুনমুন স্যার আর…
বাকিটা ঝুঁকে পড়ে স্যারের কানে কানে বলল দত্ত।
‘তাই বুঝি?’
স্যার পেছন ফিরলেন।
‘এ তোমার…?’
‘বউ…ইস্ত্রী, স্যার।’ স্বীকার করল বিশ্বজিৎ দাস।
’তুমি জানতে ও পাঁচিলের ওপারে দাঁড়িয়ে আছে?’
‘না স্যার!’ প্রবল আন্দোলনে চুল ঝাঁকাল বিশ্বজিৎ। ‘আমি তো স্যার পইপই করে বারণ করেছিলাম স্যার, এই ঝামেলার মধ্যে বাড়ি থেকে বেরোতে।’
স্যারের দৃষ্টি মুনমুনের দিকে ঘুরল। ‘চুরি করে দেখছিলে কেন? এদিকে কাউকে আসতে বারণ করা হয়েছে জানো না?’
‘চুরি করে নয় স্যার, আসলে ওই সুলতা ছোটবেলার বন্ধু তো, এত বড় একটা ঘটনা, ইয়ে দুর্ঘটনা… তাই আরকি…’ তাড়াতাড়ি বলে উঠল বিশ্বজিৎ।
আবার বেশি কথা। কতবার বলেছে মুনমুন বাঁচানোর দরকার হলে ও নিজে বলবে, নিজে থেকে মুনমুনকে রক্ষা করতে আসার দরকার নেই। ওই পরিস্থিতিতে যতখানি কড়া দৃষ্টিতে সম্ভব বরের দিকে একঝলক তাকিয়ে চোখ ফেরত আনতে গিয়েই স্যারের চোখে চোখ পড়ে গেল।
‘রিয়েলি? ছোটবেলার বন্ধু?’ পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করলেন স্যার। দত্তর দিকে বাক্সটা এগিয়ে দিলেন। দত্ত জিভ কেটে কান ধরল। স্যার হাত বাড়ালেন বিশ্বজিতের দিকে। দত্তর মতো কান ধরে জিভ কাটল সেও।
সিগারেট ধরিয়ে দেশলাইটা হাতে ধরে এদিকওদিক তাকাতে লাগলেন স্যার। মেঝেতে ধুলোর পুরু স্তর। শুকনো পাতা উড়ে এসে জমে রয়েছে বারান্দার কোণে কোণে।
‘এখানেই ফেলে দিন স্যার। যা নোংরা। ঘরদোরের যা ছিরি।’
‘শীতকালে একবেলা ঝাঁট না দিলে ধুলো হয়।’ মুনমুন চেষ্টা করেও চাপতে পারল না কথাটা।
স্যার মুচকি হাসলেন।
‘খুব বন্ধু ছিলে মনে হচ্ছে?’
‘এক ক্লাসে পড়তাম।’
‘বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসতে? যোগাযোগ ছিল? দেখাসাক্ষাৎ হত?’
‘অনেকদিন আসা হয়নি।’
‘কেন?’
মুনমুন মুখ নামিয়ে রইল। আজ সকাল থেকে ক্রমাগত এই প্রশ্নটা নিজের কাছে করেছে মুনমুন। উত্তর পায়নি।
‘ঝগড়া হয়েছিল?’
দুদিকে মাথা নাড়ল মুনমুন।
‘বন্ধু কেমন ছিল? বদমেজাজি? রগচটা?’
‘কে আইব? যা ম্যাজাজ।’
ভগবতীর মায়ের হেঁচকি থেমে গেছে।
‘কার? শম্ভুর বউয়ের?’
‘বউয়ের ক্যান? শম্ভুর। সইন্ধাব্যালা নেশা কইর্যা চুর, ভদ্দরবাড়ির মাইয়ারা আসে কোন সাহসে?’
‘হুম। চলো ঘরে যাওয়া যাক। তুমিও এসো, কোথায় কীভাবে কী দেখেছিলে আমাকে দেখিয়ে দাও।’ বিশার দিকে তাকিয়ে বললেন স্যার। পাঁচ-পাঁচ পকেট থেকে চাবির গোছা বার করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল, স্যার এগোলেন, বিশা এগোল। ওড়নায় ভগবতীর মায়ের টান আর বিশার দৃষ্টির বারণ অগ্রাহ্য করে মুনমুনও এগোল দু’পা।
‘এই যে স্যার, ক্রাইম সিন।’
ঝড়াক করে কড়ায় লাগানো তালা খুলে ভেতরে ঢুকে এক হাত ছড়িয়ে দেখাল দত্ত। যেমন করে স্টেশন রোডের ত্রিনাথ বস্ত্রালয়ের লোকটা শাড়ি দেখায়।
‘ও বাবা, এ তো ঘুটঘুটে অন্ধকার। আলো নেই?’
‘থাকার তো কথা, যদি না লোডশেডিং হয়ে থাকে… দাঁড়ান দেখছি… এই যে স্যার…’
তিনচারটে খট খট আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে একটা চল্লিশ ওয়াটের বাল্ব, কয়েক সেকেন্ড দপ দপ করে একটা টিউবলাইট জ্বলে উঠল। ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে নিচু সিলিং থেকে বিপজ্জনকভাবে দুলতে শুরু করল ফ্যান।
আন্দাজ দশ বাই বারোফুটের ঘরের অধিকাংশ জুড়ে তক্তপোশ। চ্যাপ্টা তোশকের ওপর সাদা জমির ওপর লাল গোলাপ ছাপা কোঁচকানো বেডকভার। একটামাত্র ছোট জানালা। আলনায় সারি সারি ভাঁজ করা জামাকাপড়। দেওয়ালে পেরেক থেকে সাদা প্লাস্টিক ফ্রেমের আয়না আর রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ সারদার ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডার। ঘরের এককোণের চেয়ার উপচে ডাঁই করা জামাকাপড় মাটিতে এসে পড়েছে। তক্তপোষের পায়ার কাছে গড়াগড়ি খাচ্ছে মদের একখানা ফাঁকা বোতল।
স্যার বিশ্বজিতের দিকে ফিরলেন।
‘এই খাটে শম্ভু পড়েছিল?’
‘হ্যাঁ স্যার।’
‘তখন যেমন দেখেছ এখনও সব সেরকমই আছে?’
পাঁচ-পাঁচ বলে উঠল, ‘ক্রাইম সিন একেবারে ইনট্যাক্ট রেখেছি স্যার। কাউকে হাত পর্যন্ত দিতে দিইনি। যা দেখছেন, সব যেমন ছিল তেমন।’
‘ঘরটা তল্লাশি করেছ ভালো করে? জামাকাপড়টাপড়, আলনা সব দেখেছ?’
‘চিরুনি চালিয়ে স্যার। সব মেয়েলি জামাকাপড়, শায়া শাড়ি ব্লাউজ, নাথিং ইম্পরট্যান্ট।’
‘বাকি বাড়িটা?’ ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে জিজ্ঞাসা করলেন স্যার।
‘সব একেবারে খুঁটিয়ে দেখা হয়েছে স্যার, নো ফুটপ্রিন্টস, নো ক্লু, নাথিং। খালি বডির ওপর পড়ে থাকা দড়িটা, ব্যস। এই দিকে স্যার রান্নাঘর টান্নাঘর, কিছু দেখার নেই… ও দেখবেন? অ্যাই সর সর, স্যার রান্নাঘর দেখবেন… সুইচবোর্ডটা আবার কোথায়…. অ্যাই তো…’
তেলকালি মাখা রান্নাঘর আলোকিত হল। মেঝেতে তোবড়ানো সসপ্যান, উল্টোনো থালা, খোলা বঁটি। কাটা সবজি ছত্রাকার।
‘একী! এ সব কি আপনারা লণ্ডভণ্ড করেছেন নাকি?’
‘পাগল নাকি স্যার? ক্রাইম সিন বলে কথা। সব এইরকম ছেৎরে ছিল। সংসারে লক্ষ্মীশ্রী ছিল না স্যার। দেখুন না, বাসনকোসনের ছিরি।’
সাবধানে পা ফেলে ফেলে রান্নাঘরের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালেন স্যার।
‘কেউ এসে এসব করে গেছে তেমন নয় তো?’
‘কে আসবে স্যার? আর তছনছ করলে রান্নাঘর করবে কেন স্যার? শম্ভুর বরং একটু সন্ধের দিকে নেশাটেশা করে ফেরার অভ্যেস ছিল, মাথাগরম টাইপ, সারাদিন খাটাখাটনির পর বাড়ি এসে কিছু মনের মতো না হলে জিনিসপত্র ছোঁড়াছুঁড়ির স্বভাব ছিল বলে বলেছে কেউ কেউ।’
‘ওদিকে কী আছে?’ রান্নাঘরের দেওয়ালের বন্ধ দরজাটা দেখিয়ে জানতে চাইলেন স্যার।
‘একটু জমি আছে স্যার, বাগানটাগান করার শখ থাকলে করা যায়, কিন্তু কেউ করার নেই, একেবারে জঙ্গল হয়ে রয়েছে। আমার বউয়ের আবার এসব দিকে খুব ন্যাক আছে। আমাদের তো কোয়ার্টারে জমিটমি নেই, তার মধ্যেই বারান্দায় কাঁচালংকা টমেটো সব করেছে স্যার।’
‘চলো দেখে আসি।’
রান্নাঘরের দরজা খুলে বেরোতে গিয়ে ঝুলন্ত খালি খাঁচাটা এড়াতে পারলেন না স্যার। ঠং করে ঠুকে গেল মাথায়। সস্তা অ্যালুমিনিয়ামের খাঁচা। কবজা ভেঙে দরজা ঝুলে পড়েছে।
‘পাখি নেই?’ খাঁচার দিকে তাকিয়ে কপালে হাত বোলালেন স্যার।
‘বেড়ালটেড়ালে খেয়ে গেছে নির্ঘাত স্যার… সংসারের দেখছেন তো ছিরি…’
‘কী পাখি ছিল?’
‘টিয়াপাখি। মিঠু।’ না চাইতেও বলে ফেলল মুনমুন।
*****
সুলতার বাড়ির বারান্দায় ঝুলত মিঠু। বাঁশের কঞ্চির গেট খোলা মাত্র সরু গলায় চেঁচাত, ‘সুলুউউউ, সুলুউউউ, মুনমুউউন, মুনমুউউন।’ স্কুলে গল্প শেষ হত না, ছুটির পর উল্টো রাস্তায় হলেও হেঁটে হেঁটে প্রতিদিন ছুটির পর সুলতার বাড়ি পর্যন্ত যেত মুনমুন। কত গল্প। একেবারে গেঁড়ি বয়সে খেলার গল্প, আরেকটু বড় হলে ক্লাসের বন্ধুদের গল্প, তারপর ছেলেদের গল্প। সে গল্পের রসদ অবশ্য মুনমুনের থেকে ঢের বেশি ছিল সুলতার। মুনমুনদের ক্লাসের সবাই যখন পাঁচের নিচে, সুলতা তখনই পাঁচ তিন। এইট পাস করতে না করতে সম্বন্ধ আসতে শুরু করেছিল। চায়ের দোকানে ছেলেদের আড্ডার সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে গানের লাইন, শিস ভেসে আসত। যাতায়াতের পথে পিছু নিত সাইকেল। সুলতা হাসত মিটিমিটি।
নাইনে পড়ার সময় একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে প্রথমবার বাইকটাকে দেখেছিল মুনমুন। টকটকে লাল রঙ, রাস্তা দিয়ে গেলে ভটভট আওয়াজ সারা পাড়ার লোকে শুনতে পায়। সাইকেলরা অদৃশ্য হল নিমেষে। দোকানে দাঁড়িয়ে চা খেলেও জটলা নিঃশব্দে মাথা নিচু করে সুলতার পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকত। তখন সুলতার পিছু নেয় শুধু লাল বাইক। সবুজ রঙের সানগ্লাসের ওপার থেকে সুলতাকে মাপতে থাকে শুধু একজোড়া চোখ। সে চাউনির দিকে তাকিয়ে মুনমুনের গা শিরশির করত। লোকটার বয়সও তো অনেক। আধবুড়ো।
সুলতা চুলের ডগা কাটত দাঁত দিয়ে। ঠোঁটে ভাসত রহস্যময় হাসি।
কিছুদিনের মধ্যে সুলতার বিয়ে হয়ে গেল। পরীক্ষাটা দিয়ে নে অন্তত, বলেছিল মুনমুন। কী হবে দিয়ে? জিজ্ঞাসা করেছিল সুলতা। বিয়েতে খুব ধুমধাম হয়েছিল। টাটা সুমো চেপে বর এসেছিল, বরযাত্রীদের বাইকে ভরে গিয়েছিল গোটা মাঠ। বউভাতে গিয়ে সুলতাকে দেখে একমুহূর্তের জন্য ধাঁধা লেগে গিয়েছিল মুনমুনের। অনেক আলোর নিচে অল্প হেসে সিংহাসনে বসেছিল সুলতা। গয়না, ফুল, সেন্টের গন্ধটন্ধ মিলিয়ে ঠাকুরের মতো লাগছিল সুলতাকে। সুলতার দাদাবৌদি গর্বিত মুখে ঘুরছিলেন। পাকা বাড়ি হল সুলতার, খাওয়াপরার কষ্ট জীবনের মতো ঘুচল, এবার থেকে চাইলেই নতুন শাড়ি, নতুন গয়না। বদলে প্রতি সন্ধেয় একটা কি দুটো থাপ্পড়।
এই ম্লান, কদাকার রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে সেই সন্ধের সুলতার চেহারাটা মনে পড়ে চোখ করকর করে উঠল মুনমুনের। ওড়না দিয়ে চোখ চেপে শুকনো করে, নাক দু’বার টেনে, শ্বাস নিয়ে শিরদাঁড়া টানটান করে দাঁড়াল মুনমুন। ভগবতীর মা রান্নাঘরের মেঝের বাসনকোসন সরাতে শুরু করেছে। খোলা বঁটির পাশে অর্ধেক ছাড়ানো মোচা, হাওয়া লেগে কুচকুচে কালোবর্ণ ধারণ করেছে। পাশে রাখা বাটি উল্টে সরষের তেল গড়িয়ে পড়েছে মাটিতে।
‘কুরুক্ষেত্র কইর্যা থুইসে।’ বঁটি সাবধানে ভাঁজ করতে করতে নালিশ করল ভগবতীর মা।
‘এইসব মোচাফোচা খাওয়ার কোনও মানে আছে? যত্তসব।’ নিচু হয়ে মোচার খোলা কুড়োতে কুড়োতে বলল মুনমুন।
‘ক্যান তুই খাস না?’
‘পাগল নাকি? মা মাঝেসাঝে রাঁধলে দিয়ে যায়, তাছাড়া না। এত খাটবে কে?’
তুই খাবি না খাস না, বিশা কী দোষ করসে? ওরে রাইন্ধা দিস না ক্যান?’
‘কেন? আলুপটলে পেট ভরছে না নাকি?’
‘চব্বিশ ঘণ্টা প্যান্ট পইর্যা ঘোরস, কিছু কয় না?’
ভগবতীর মা গভীর সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টি দিল মুনমুনের সালওয়ার কামিজের দিকে।
‘কইবে আবার কী? ও যে সর্বক্ষণ লুঙ্গি পরে ঘোরে, আমার যে দেখলেই গা জ্বলে যায়, আমি কি বলেছি কিছু? না বললে শুনবে? আমার লুঙ্গি খারাপ লাগে বলে আমি পরি না, ওর সালওয়ার কামিজ খারাপ লাগলে ও পরবে না, হয়ে গেল। উফ মাসি, আমার প্যান্ট নিয়ে পরে ভাববে, এদিকে দেখো আগে।’
‘পুলিশে তো দ্যাখসে…’
‘দ্যাখসেই শুধু। ভাবেনি কিছু। সুলতা মোচা কাটতে কাটতে উঠে গেছিল কেন?’
‘শম্ভু বাড়ি আইছিল হয়তো। চিল্লামিল্লি করছিল, চড়থাপ্পড় মারছিল…’
‘সে তো রোজই মারত। প্রশ্নটা হচ্ছে কাল থাপ্পড় খাওয়ার পর সুলু এসে আবার মোচা কাটতে বসল না কেন?’
‘ক্যান আবার, সংসারে মন নাই।’
‘উঁহু, সুলু গোছানো মেয়ে, চিরদিনই ছিল। বইপত্র গোছাতেই সারা সন্ধে কাবার হত, পড়ার সময় হত না। ওই ঘরটা দেখলে? কাপড়জামা ডাঁই অথচ পাশে আলনায় সব পাটপাট ঝোলানো। নিজের শাড়ি, লোকটার পাজামা। দেখবে এসো…’
ভগবতীর মায়ের হাত ধরে টেনে শোওয়ার ঘরে নিয়ে এল মুনমুন।
‘ওই দেখো, আলনাটা। সব ভাঁজ, দেখেছ? একেবারে পাটে পাটে। এই দেখো টেবিল… একটা বাজে কাগজ নেই। আমার বাড়ির টেবিল দেখো গিয়ে, গোটা সংসার টেবিলেই। এই কাপড়গুলো দেখো, সব ধোওয়া কাপড়।’
চেয়ারের জামাকাপড় দেখাল মুনমুন।
‘বাইরের দড়ি থেকে তুলে এনে ঘরে রেখেছিল, কিন্তু ভাঁজ করেনি। যে মেয়ে এত গোছানি সে সারা রাতে কাপড় ভাঁজ করার সময় পেল না কেন?’
‘টিভি দ্যাখতাছিল বোধয়।’
‘তোমার মুণ্ডু। কাল সারা সন্ধে লাইট ছিল না। কালকে অন্যদিনের থেকে অন্যরকম কিছু একটা হয়েছিল, মাসি। যে জন্য সুলু কাপড় বাইরে থেকে তুলে এনে ভাঁজ করার সময় পায়নি, মোচা অর্ধেক কুটে উঠে পড়েছে…’
‘কী এমন হইব?’
‘সেটাই তো আমাদের বার করতে হবে মাসি, কী হয়েছিল।’
জানালার বাইরে বাগানে পায়ের শব্দ হল। মুনমুন চট করে সরে এল জানালার আধবন্ধ পাল্লাটার আড়ালে। ভগবতীর মায়ের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে আঙুল রাখল।
*****
‘স্যার, একটা কথা বলব স্যার?’
বাগানে দাঁড়িয়ে ডোবার দিকে তাকিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরালেন স্যার।
‘বলুন।’
‘সত্যি কি এত তদন্তের দরকার আছে স্যার? এ তো ওপেন অ্যান্ড শাট কেস।’
‘কীরকম?’
‘ফাঁকা বাড়িতে দুটো লোক। একজন খুন হয়েছে। কাজেই এটা কি স্যার ধরে নেওয়া যায় না…’
‘কেন, আপনার সমাজসেবী শম্ভুর কোনও শত্রু থাকতে পারে না বলছেন? এই তো শুনলাম বদমেজাজি লোক। একে মারছে, তাকে ধমকাচ্ছে… কী যেন নাম বলল ছেলেটা… কী হাঁদা না ভোঁদা…’
‘খ্যাঁদা বাপি, স্যার।’
‘তার সঙ্গে তো শুনলাম রীতিমত রামরাবণের যুদ্ধ। তাদেরই কেউ কোথা থেকে এসে রাগ ঝেড়ে গেছে।’
‘সে রাগ স্যার বউটারও থাকতে পারে। শম্ভুর মেজাজ গরম ছিল স্যার, বউটাকে মারত রেগুলার। দেখলেন তো, কালও মদ খেয়ে ফিরেছে, হয়তো ধরুন একটু বেশিই খেয়েছে… একটার বদলে দুটো চড় মেরেছে…’
‘আর অমনি বউ ঘুমন্ত বরের গলায় ফাঁস দিয়ে মেরে ফেলেছে? এরকমটা হলে এ পাড়ার অর্ধেক পুরুষ পপুলেশন এতদিনে গলায় দড়ি জড়িয়ে জিভ বার করে খাটের ওপর মরে পড়ে থাকত, দত্ত। তাছাড়া চড়চাপাটির কথাই যদি ধরেন, সে তো নতুন ব্যাপার কিছু না, রোজই হয় নিশ্চয়।’
‘কাল হয়তো বেশি হয়েছিল… রাগ জমতে জমতে একদিন বার্স্ট করে স্যার, জানেন তো?’
‘সে করতে পারে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে বার্স্ট করার থেকে না করার যুক্তিই বেশি। দাদাবৌদির তো অবস্থা ভালো না বলছেন।’
‘দাদার হার্টে ফুটো স্যার, বৌদি ব্লাউজ সেলাই করে।’
‘তবে? সুলতা মণ্ডল উঠতি গুণ্ডা, আচ্ছা আচ্ছা, সমাজসেবী বরের গলায় ফাঁস দিয়ে মেরে দাদার বাড়ি গিয়ে ব্লাউজ সেলাই করবে? খুন করা অত সোজা নাকি? তাছাড়া আপনি সাইকোলজির দিকটা ভেবে দেখছেন না দত্ত, রোজ ঠেঙানি খাওয়াটা সুলতা মণ্ডলের রিয়েলিটি ছিল। শুধু তো ও খাচ্ছে না, ওর চেনাজানা অনেকেই খাচ্ছে। খেয়েই থাকে। সেই রিয়েলিটির আশ্রয় থেকে বেরিয়ে, নিয়মিত খেতেপরতে দেওয়া স্বামীকে মেরে ফেলে ঠ্যাঙানিমুক্ত ভবিষ্যতের বিকল্পটা অনেক বেশি অনিশ্চিত এবং ভয়ের। সেই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ওপর ভরসা করার থেকে যে কোনও মানুষ বর্তমানের চড় খাওয়া প্রেফার করবে। এটা বেসিক হিউম্যান সাইকোলজি।’
‘বুঝলাম স্যার।’
‘কী বুঝলেন?’
‘সাইকোলজি খুব জটিল ব্যাপার।’
‘সাইকোলজি জটিল, কিন্তু সাইকোলজি একবার বুঝে ফেললে যে কোনও ক্রাইম সলভ করা জলের মতো সরল। বুঝলেন?’
‘জলের মতো, স্যার। কিন্তু স্যার তাহলে কে করল খুনটা? সুলতা মণ্ডল যদি না-ই করে থাকে, মানে যদি সাইকোলজিক্যালি খুনটা করা সুলতা মণ্ডলের পক্ষে অসম্ভব হয়ে থাকে…’
‘বাইরে থেকে কেউ আসতেও তো পারে?’
‘কে আসবে স্যার?’
‘কেন আপনার ওই হাঁদা না ভোঁদা বাপির দলের ছেলেরা?’
‘বাইরের ছেলে একেবারে ঘরে ঢুকে খুন করে গেল, কেউ দেখল না?’
‘কী করে দেখবে দত্ত? নভেম্বর মাসের রাত্তিরে? কী রকম কুয়াশা পড়ছে দেখছেন তো ক’দিন ধরে। তারপর এরকম ডোবার ধারে একটেরে বাড়ি…’
‘তা বলে স্যার, একজনকে গলা টিপে মেরে দিয়ে গেল আর পাশে শুয়ে একজন ঘুমোতে লাগল ভোঁস ভোঁস করে, এটা একটু অবিশ্বাস্য…’
‘আপনার এই আর্গুমেন্টে বরং একটা লজিক আছে। মহিলা দেখেছেন কারা ব্যাপারটা ঘটিয়েছে, কিন্তু ভয়ে বলতে পারছেন না।’
ধোঁয়া ছেড়ে সেটা মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত চুপ করে থাকলেন স্যার।
‘সামথিং হ্যাপেন্ড হিয়ার ইয়েস্টারডে, দত্ত। সামথিং যেটা আগে কোনওদিন ঘটেনি। কেসটা সলভ করতে হলে সেই ঘটনাটা আগে খুঁজে বার করতে হবে। তাহলে আপনি আপনার মোটিভ পেতে পারেন, আর যদি মোটিভ পেয়ে যান তাহলে বলা যায় না, আপনার সুলতাকে গারদে পোরার স্বপ্ন সফল হয়েও যেতে পারে। বুঝলেন?’
‘বুঝলাম স্যার।’
‘কী বুঝলেন?’
‘এগোতে হলে সবার আগে একটা মোটিভ চাই। তাই তো স্যার?’
‘ঠিক তাই। জাস্ট একটা মোটিভ।’
*****
‘মাগো, হেইডা কী?’
আর্তনাদে মুনমুনের মনোযোগ ছিঁড়ে গেল। জানালার পাশ থেকে ঘাড় ফেরাল ও। ভগবতীর মা মুখে আঁচল চেপে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে।
‘কী হল?’
চেয়ারের জামাকাপড়ের অধিকাংশ এখন ভাঁজ হয়ে তক্তপোষের ওপর। চেয়ারের ওপর পড়ে আছে এতক্ষণ জামার পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে থাকা একটা সাদা রুমাল। অল্প খোলা ভাঁজের আড়ালে সবুজের আভাস।
মুনমুন এগিয়ে গেল চেয়ারের দিকে। হাতে তুলে নিল রুমাল। রুমালের মধ্যে দোমড়ানো সবুজ শরীর, ছেতরানো পাখা, গলাটা মুচড়ে ধড় থেকে প্রায় আলাদা হয়ে গেছে। বাঁকা লাল ঠোঁটটা সবুজ বুকের ভেতর গুঁজড়ে ঘুমোচ্ছে মিঠু।
‘কী হেইডা?’
রুমালটা যত্ন করে মিঠুর চারপাশে জড়িয়ে দিল মুনমুন। ওর চোখ আবার জ্বলতে শুরু করেছে। কিন্তু এ জ্বলা অন্যরকমের। জ্বলন্ত চোখদুটো ভগবতীর মায়ের চোখে রাখল মুনমুন।
‘মোটিভ, মাসি। মোটিভ।’
*****
সাইকেলে বসে এক পা মাটিতে ঠেকিয়ে ঘাড় ঘোরাল বিশ্বজিৎ, ‘আসবে নাকি?’
অন্ধকারে ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে মুনমুন আর ভগবতীর মা।
‘তুমি যাও, আমরা আসছি।’ মুনমুনের গলা ভারী।
‘দেরি কোরো না।’ প্যাডেলে চাপ দিয়ে এগিয়ে গেল বিশ্বজিৎ।
মুনমুন, আর মুনমুনকে একহাতে শক্ত করে আঁকড়ে অন্য হাতে পেটের কাছের আঁচল মুঠোয় ধরে হাঁটতে শুরু করল ভগবতীর মা।
*****
দরজাজানালা বন্ধ করে, তালা টেনে পরীক্ষা করিয়ে, কাঁচা রাস্তাটা হেঁটে এসে জিপে এসে উঠলেন স্যার। দত্ত বসল ড্রাইভারের পাশের সিটে। সশব্দে দরজা বন্ধ করে ড্রাইভারকে বলল, চলো।
চারদিকে ঘুটঘুটে। এদিকের রাস্তায় আলো নেই, বারুজীবীর মাঠের ওপর সদ্য উঠতে থাকা দুয়েকটা বাড়ির জানালা দিয়েও আলোর আভাস আসছে না। সম্ভবত লোডশেডিং। ঠান্ডা হয়ে আসা বাতাসে ফিকে ধোঁয়ার গন্ধ। উনুন ধরিয়েছে কেউ। মাঠের ধারের তালসুপুরি গাছগুলো অন্ধকারে ঝাঁকড়া চুলওয়ালা ভূতের মতো দাঁড়িয়ে।
ডান হাত দিয়ে টেনে গলা আর কলারের মাঝখানের ফাঁকটা একটু কমিয়ে নিলেন স্যার।
‘দত্ত, কাল সকালে এখানকার পার্টি অফিসে একবার যেতে হবে। আজ গোটা দিন নষ্ট হল। কাল সকাল সকাল বেরোব। শম্ভুর অন্যান্য কানেকশনগুলো চেক করা দরকার।’
‘ওকে, স্যার। দশটায় হলে চলবে স্যার?… অ্যাই, কাল সকাল দশটার মধ্যে গাড়িটাড়ি মুছে রেডি রাখবি…’
মিনিটখানেক চলার পর হেডলাইটের আলোয় রাস্তার ধারে দুটো শরীর আলোকিত হল। হর্নে হাত রাখল ড্রাইভার। দরকার ছিল না। রাস্তার ধার দিয়েই হাঁটছিল দু’জনে, জিপ আসতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
বুড়িটা, পেটের কাছে কিছু একটা আঁকড়ে ধরে, সামনে ঝুঁকে পড়েছে। বুড়িটার পাশে ওই মেয়েটা, বিশ্বজিৎ না বিশ্বনাথের বউ। মেয়েটা শার্প। পাড়াগেঁয়ে মেয়েদের তুলনায় বেশ শার্প। হেডলাইটের আলোয় একমুহূর্ত মেয়েটার মুখ দেখতে পেলেন স্যার। চোখ বিস্ফারিত, মুখ রক্তশূন্য। মেয়েটা ভয় পেয়েছে। ভীষণ ভয়। এতক্ষণ পুলিসের সামনে দাঁড়িয়ে মাথা সোজা রেখে কট কট কথা বলছিল আর এখন ফাঁকা রাস্তায় জিপের হর্ন শুনে মুখ সাদা হয়ে গেল?
স্যারের বুক থেকে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল। এত কিছু বুঝে ফেললেন তিনি, খালি মেয়েদের সাইকোলজিটা…
(Susan Glaspell-এর A Jury of Her Peers অবলম্বনে)