পরিমল ভট্টাচার্য
ইউক্রেনের মেয়ে এলিনা ফিলাটোভা। এলিনার আছে অদম্য কৌতূহল, অপার স্বাধীনতা আর একটি মোটরবাইক। গতির দেবতা যেখানে নিয়ে যায়, সেখানেই চলে যান তিনি। ইদানীং তাঁর প্রিয় বাহন হল একটি বড় কাওয়াসাকি নিঞ্জা, ১৪৭ হর্সপাওয়ারের, সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১৮০ কিমি। সিংহের মতো তার গভীর গর্জন, গুলির মতো দ্রুতগতি আর দীর্ঘ সফরের জন্য অতীব আরামদায়ক। এলিনা খুব ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন, এবং তাঁর সবচেয়ে প্রিয় গন্তব্য হল কিয়েভের উত্তরাঞ্চল, বাড়ি থেকে ১৩০ কিলোমিটার দূরে।
প্রকৃতি এখানে অপূর্ব, অঢেল। কিন্তু ঝিরিঝিরি হাওয়া দিলে নিঃশ্বাস নেওয়া চলবে না, চোখও বন্ধ করে ফেলতে হবে। চারিদিকে অসংখ্য প্রজাতির ফুল ফুটে আছে, কিন্তু ভুলেও তাদের গন্ধ শোঁকা চলবে না। গাছ ভরে আছে ফলে, কিন্তু সেসব স্পর্শ করাও চলবে না। মৌমাছির গুঞ্জনের মতো সারাক্ষণ বেজে চলবে গিগার কাউন্টারে বিপ-বিপ ধ্বনি।
এ হল চের্নোবিলের ডেড জোন, অর্থাৎ মৃত অঞ্চল।
এমন এক জায়গা কেন প্রিয় এলিনার? তার কারণ এখানে সম্পূর্ণ বিজন রাস্তায় দীর্ঘ দীর্ঘ সফর করা যায়। তার চেয়েও বড় কথা, এখানকার বাসিন্দা সব মানুষেরা ছেড়ে চলে গিয়েছে, অথচ প্রকৃতি আশ্চর্য সুফলা। অপূর্ব সুন্দর সব জঙ্গল আর হ্রদ রয়েছে এখানে। এখানে রাস্তায় কখনও ট্রাক কিম্বা সাঁজোয়া গাড়ি চলেনি, তাই কুড়ি বছর আগে রাস্তাগুলো যেমন ছিল ঠিক তেমনই আছে। বড়জোর হয়তো দুচারটে ঘাস গজিয়েছে, অথবা একটি গাছ অ্যাশফল্টের ফাটল খুঁজে নিয়ে শিকড় চারিয়ে দিয়েছে। সময় এই রাস্তাগুলোকে ক্ষইয়ে দিতে পারেনি; এবং সেইজন্য ঠিক এইরকমই থেকে যাবে যতদিন না স্বাভাবিক যানচলাচলের জন্য ফের অবারিত হবে।
এবং সেটা হবে আজ থেকে কয়েক শতাব্দী পরে। যদি তখনও মানুষ এই পৃথিবী গ্রহে থাকে।
১৯৮৬ সালে চের্নোবিলে ভয়াবহ দুর্ঘটনা যখন ঘটে, এলিনার বয়স তখন বারো, ইস্কুলে পড়তেন। পরবর্তী ঘটনাক্রম আজ সুবিদিত। দুর্ঘটনা ঘটার পরে পরেই তদানীন্তন সোভিয়েত সরকার চের্নোবিলের বিপর্যয় সম্পূর্ণ চেপে গিয়েছিল। বিদেশের রেডিও সম্প্রচার আর যাদের আত্মীয়স্বজন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়, তাদের মারফৎ দেশের সাধারণ মানুষ ক্রমশ খবরটা জানতে পারে। বিপর্যয়ের সাত-দশদিন পর থেকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তে লাগল। প্রথম দশ দিন, যখন ঘটনাটা রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তায় মোড়া ছিল, স্থানীয় যে সব মানুষেরা তীক্ষ্ণ বিকিরণের কবলে পড়ে, এবং কিছু না জেনে যারা বাইরে থেকে ওই অঞ্চলে গিয়েছিল, তারা হয় মারা যায় অথবা গুরুতর স্বাস্থ্যহানির শিকার হয়। প্রথমে বিষ বমনকারী প্ল্যান্টের আশেপাশে দশ কিলোমিটার এলাকা থেকে অধিবাসীদের সরানো হতে থাকে। পরবর্তী এক মাসে তিরিশ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল থেকে প্রায় দেড় লক্ষ মানুষকে জোর করে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। চের্নোবিল হয়ে ওঠে আধুনিক বিশ্বের বৃহত্তম মানুষের ছেড়ে-যাওয়া অঞ্চল।
ইতিমধ্যে ঘটে গিয়েছে এক আশ্চর্য ঘটনা। বিগত তিন দশকে চের্নোবিলের পরিত্যক্ত অঞ্চলে তৈরি হয়েছে এমন এক পরিবেশ যেখানে মানুষের কোনওরকম ভূমিকা ছাড়াই গড়ে উঠেছে এক আশ্চর্য অভয়ারণ্য। ফিরে এসেছে বন্যপ্রাণী এবং পাখিরা। চের্নোবিল আর তার আশেপাশের এলাকা হয়ে উঠেছে তাদের মুক্তাঞ্চল। বর্তমানে এটি ইউরোপের অন্যতম বৃহত্তম অভয়ারণ্য। বিস্তীর্ণ ঘাসজমি, পাইন ও অন্যান্য পর্ণমোচী গাছের বন, জলাশয়, নদী — এসব স্বাভাবিক বাসস্থান হয়ে উঠেছে এমনকি বেশ কিছু বিপন্ন ও অবলুপ্ত-হতে-বসা প্রাণীরও। প্রচুর সংখ্যায় বুনো শুয়োর, চিতল হরিণ, সম্বর এবং নেকড়ে দেখা যায় এখানে। এছাড়া রয়েছে ইউরোপীয় বাইসন, যারা নিকটবর্তী বেলারুশিয়া থেকে এসেছে বনে মনে করা হয়। রয়েছে এক বিরল প্রজাতির বন্য ঘোড়া, যাদের এখানে ছাড়া হয়েছিল ১৯৯০-এর দশকে; এখন তাদের যূথবদ্ধভাবে বিচরণ করতে দেখা যায়। সম্প্রতি ক্যামেরার ফাঁদ পেতে অস্তিত্ব মিলেছে বাদামি ভাল্লুকের, যারা ঠিক বিপন্ন প্রজাতির না হলেও এই অঞ্চলে শেষ দেখা গিয়েছিল একশো বছরেরও বেশি আগে। জীববিজ্ঞানীদের জন্য এ এক আশ্চর্য গবেষণাগার। তেজস্ক্রিয় বিকিরণ এইসব প্রাণীদের দেহে কী ধরনের পরিবর্তন আনছে, তাই নিয়ে কাজ চলেছে।
তবে এসবের থেকে কিছু কম বিস্ময়কর নয় একদল মানুষ, যাঁরা মাটি কামড়ে পড়ে আছেন। পুনর্বাসন প্রত্যাখ্যান করেছেন, কিম্বা ফিরে এসেছেন চুপিসাড়ে।
তাঁরা আজন্ম খোলা প্রান্তর আর অনাবিল প্রকৃতির মাঝে কাটানোর পর কিয়েভ শহরে দুই-কামরার খুপরি বাসায় থাকতে পারেননি। বর্তমানে এমন ১৮৭ জন রয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশের বয়স আশি থেকে নব্বই-এর মধ্যে। তাঁরা যৎসামান্য চাষবাস করে, আশেপাশের বন থেকে ছত্রাক ইত্যাদি সংগ্রহ করে এবং মাছ ধরে (যা বেআইনি) জীবিকা নির্বাহ করে চলেছেন।
তেমনই এক দম্পতি লিওনিদ ও একাতেরিনা। তাঁদের কথা লেখা হয়েছে ব্রিটেনের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ২৪ এপ্রিল, ২০১৬-য় প্রকাশিত একটি রিপোর্টে। লিওনিদ ও একাতেরিনার বয়স যথাক্রমে সাতাশি ও ঊননব্বই। দুর্ঘটনার আগে তাঁরা নদীতে বোট থেকে ভাসমান ক্রেনের সাহায্যে মাল খালাসের কাজ করতেন। ১৯৯৩ সালে তাঁরা পালিয়ে আসেন প্রিপিয়াত নদীর ধারে লিওনিদের দাদুর বানানো শতাব্দীপ্রাচীন কাঠের বাড়িতে।
‘কিয়েভ আমার ভালো লাগেনি। রাস্তা পার হবার আগে বারে-বারে এদিক ওদিক তাকাতে হত। এই বয়সে… এখানে আমরা সুখেই আছি।’ একাতেরিনা বলেন।
ওঁদের এইভাবে বসবাস আইনত অবৈধ। চের্নোবিলের নিষিদ্ধ ‘জোন’-এর কর্তৃপক্ষের চোখে এঁরা হলেন উদ্বাস্তু। এখানে ফলানো শাকসব্জি কোনওভাবেই যাতে বাইরে না যায়, সে ব্যাপারে কড়া নজর রয়েছে। তাতে অবশ্য এঁদের কোনও সমস্যা নেই, কেবল —
‘আমি একটিই জিনিস চাইব’ — লিওনিদ বলেন — ‘আমাদের উদ্বাস্তু বোলো না। আমরা স্থানীয় বাসিন্দা। এ হল আমাদের বাড়ি।’
***
“রাত্রিবেলা উঠোনে একটা শিয়াল এসেছিল। আমি জানলা দিয়ে তাকিয়ে ওকে দেখতে পেলাম, চোখ দুটো গাড়ির হেডলাইটের মতো জ্বলছে। এখন আমার সবকিছুতেই অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। সাত বছর হল একা থাকছি এখানে, সাত বছর হল লোকে এই জায়গাটা ছেড়ে চলে গিয়েছে। কখনও কখনও রাত্রিবেলা আমি শুধু চুপচাপ বসে থাকি আর ভাবি, ভাবতে থাকি, যতক্ষণ না ফের আলো ফোটে। সেদিনও সারারাত জেগেছিলাম, বিছানায় বসেছিলাম, তারপর বাইরে বেরিয়ে সূর্য উঠেছে কী না দেখলাম। কী বলব তোমায়? মৃত্যুর থেকে ন্যায়নিষ্ঠ আর কেউ নেই, কেউ একে এড়াতে পারে না। এই পৃথিবী শেষপর্যন্ত সবাইকেই নেয় — দয়ালু, নিষ্ঠুর, পাপী, তাপী… সব্বাইকে। বিশ্বে এছাড়া আর কোনও ন্যায় নেই। সারাটা জীবন আমি সততার সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করেছি। কিন্তু আমি কোনও ন্যায়বিচার পাইনি। ঈশ্বর হয়তো সবকিছু ভাগ বাঁটোয়ারা করছিলেন, কিন্তু দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানোর পর যখন আমি গিয়ে পৌঁছলাম, কিছুই আর অবশিষ্ট ছিল না। কমবয়সীরা মারা যায়, বয়স্কদের মরে যেতে হয়।… প্রথমদিকে আমি ওদের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করতাম। আমি ভাবতাম ওরা ফিরে আসবে। কেউই বলেনি যে চিরকালের জন্য ছেড়ে চলে যাচ্ছে, সবাই বলেছিল এই মাত্র কিছুদিনের জন্য যাচ্ছে। কিন্তু এখন আমি কেবল মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে আছি। মৃত্যু কিছু কঠিন নয়, কিন্তু ভয়ের তো বটেই। কোনও গির্জা নেই এখানে। যাজক আসেন না। পাপস্বীকার করব যে, এমন কেউ নেই। প্রথমে ওরা যখন বলল আমাদের ওপর বিকিরণের প্রভাব পড়েছে, ভেবেছিলাম এ এক ধরনের রোগ, যার হয় সে তৎক্ষণাৎ মারা যায়। না, না — ওরা বলল — এ এমন জিনিস যা ভূমির ওপর থাকে, মাটিতে মিশে থাকে, কিন্তু আমরা দেখতে পাই না। হয়তো জন্তুরা দেখতে শুনতে পায়, কিন্তু মানুষ পায় না। পুলিশ আর সৈন্যরা এসে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়ে গেল — কিছু কিছু লাগাল লোকের বাড়িতে, কিছু রাস্তার ধারে। ৭০ ক্যুরি, ৬০ ক্যুরি — এইসব লেখা থাকত বোর্ডে। আমরা চিরকাল আলু খেয়ে এসেছি, কিন্তু হঠাৎ আমাদের আলু খাওয়া নিষিদ্ধ হল। এতে কারও কারও খুবই খারাপ লেগেছিল, কেউ আবার মজা পেয়েছিল। ওরা আমাদের বলল, রবারের দস্তানা আর মুখোশ পরে বাগানে কাজ করতে হবে। আর তারপর একজন নামজাদা বৈজ্ঞানিক এসে বললেন, আমাদের উঠোনগুলো ধুয়ে ফেলতে হবে। কী কাণ্ড! আমি নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ওরা বলল, আমাদের চাদর কম্বল পর্দা সব ধুয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু চাদর কম্বল তো কুলুঙ্গিতে তোরঙ্গয় রাখা আছে। সেখানেও কি বিকিরণ পৌঁছেছে? কাচের ওপাশে? বন্ধ দরজার ওপাশে? বনে, মাঠে…? ওরা সব কুয়োগুলো বন্ধ করে দিল, তালা মেরে ওপর থেকে সেলোফেনে মুড়ে দিল। বলল, জলও নাকি দূষিত হয়ে গিয়েছে। এত স্বচ্ছ, কী করে দূষিত হয়? ওরা কীসব হাবিজাবি কথা বলতে লাগল। বলল — তোমাদের এখান থেকে চলে যেতে হবে, না হলে মরবে। ছেড়ে চলে যাও। এসব শুনে লোকে ভয় পেয়ে গেল। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। রাত্রিবেলা লোকেরা তাদের জিনিসপত্র গোছগাছ করতে শুরু করল। আমিও আমার জামাকাপড় বাক্সবন্দি করতে লাগলাম, সৎ পরিশ্রমে অর্জন করা লাল পদকটাও নিলাম। এত দুঃখ হয়েছিল কী বলব। দুঃখে আমার বুক ভরে গিয়েছিল। যদি একটুও মিথ্যে বলি তো আমার দিব্যি। তারপর শুনলাম, সৈন্যরা যখন একটি গ্রাম পুরো খালি করে দিচ্ছে, এক বৃদ্ধ দম্পতি সেখানে থেকে গিয়েছেন। তার আগে লোকেদের যখন ঘুম থেকে তুলে জোর করে বাসে তোলা হচ্ছিল, কেউ কেউ তাদের গরুগুলোর কাছি খুলে দিয়ে জঙ্গলে পালিয়ে যাচ্ছিল। সেখানে আত্মগোপন করে অপেক্ষা করছিল। এ যেন অনেকটা সেই যুদ্ধের সময়ের মতো, যখন গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হত। কিন্তু আমাদের নিজেদের সৈন্যরা এভাবে আমাদের তাড়া করবে কেন? (কাঁদতে শুরু করেন) আমাদের জীবন সুস্থির নয়। আমি কাঁদতে চাই না। ওই যে! ওই দেখো একটা কাক। আমি ওদের তাড়াই না। যদিও কখনও-সখনও কাকেরা ভাঁড়ার থেকে ডিম চুরি করে। তবুও আমি ওদের তাড়িয়ে দিই না। গতকাল একটা ছোট্ট খরগোশ এসেছিল। কাছেই একটা গ্রাম আছে, সেখানে একজন মহিলা একা থাকেন। আমি বলেছিলাম, এখানে এসে থাকো। হয়তো তাতে সুবিধে হবে, হয়তো না, কিন্তু অন্তত একজন কথা বলার তো লোক পাওয়া যাবে। রাত্রিবেলা সারা শরীরে যন্ত্রণা হয়। আমার পা দুটো ঝিনঝিন করে, মনে হয় যেন ছোট ছোট পিঁপড়ে দৌড়চ্ছে, স্নায়ুগুলো দপদপ করে। মনে হয় যেন গম পেষাই হচ্ছে খচর মচর করে। তারপর স্নায়ুগুলো ক্রমশ শান্ত হয়। সারা জীবন ধরে আমি প্রচুর পরিশ্রম করেছি, প্রচুর দুঃখ পেয়েছি। অনেক কিছু পেয়েছি, আর কিছু পেতে চাই না। আমার পুত্রকন্যারা আছে… তারা সবাই শহরে থাকে। কিন্তু আমি আর এখান থেকে নড়ছি না। ঈশ্বর আমায় আয়ু দিয়েছেন, কিন্তু সুখের কপাল দেননি। আমি জানি, বয়স্ক মানুষের সঙ্গে কথা বলা খুব বিরক্তিকর; কমবয়সীরা ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। আমি আমার সন্তানদের কাছ থেকে তেমন কোনও আনন্দ পাইনি, জানো। আমার মতো যেসব মহিলারা শহরে চলে গিয়েছে তারা সারাক্ষণ কাঁদে। হয় তাদের মেয়েরা কিম্বা পুত্রবধূরা তাদের মনে আঘাত দিয়ে চলে। আমার স্বামী এখানে আছেন, কবরে শায়িত আছেন। এখানে শায়িত না থাকলে তিনি এখন অন্য কোথাও থাকতেন। আর আমি থাকতাম তাঁর সঙ্গে। (হঠাৎ উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন) আমি ছেড়ে চলে যাব কেন? এই জায়গাটা সুন্দর। গাছে পাতা ধরছে, ফুল ফুটছে। ছোট্ট মাছি থেকে শুরু করে জীবজন্তু, সবাই বাঁচছে।” (স্বেতলানা আলেক্সেভিচ)
***
দশ বছর ধরে পাঁচশোরও বেশি জন মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে স্বেতলানা আলেক্সেভিচ গেঁথে তুলেছেন চের্নোবিলের আনবিক বিপর্যয়ের মৌখিক ইতিহাস। এই মানুষেরা তাঁদের কথা বলেছেন রাশিয়ান, ইউক্রেনিয়ান, বেলারুশিয়ান, রুমানিয়ান ও আরও কয়েকটি পূর্ব-স্লাভিক ভাষায়। এর কয়েকটি ভাষা স্বেতলানা নিজে জানেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে দোভাষীর সাহায্য নিতে হয়েছে। বিপন্ন হৃদয় খুঁড়ে বের করে এনেছেন দুঃস্বপ্ন, শোক আর তিক্ত নিঃসঙ্গতার কথাগুলো। নৈঃশব্দ্যগুলোও। সেই সব কথা আর নৈঃশব্দ্য বিভিন্ন ভাষায় হাতফেরতা হতে হতে আমাদের কাছে এসে পৌঁছয়।
সত্যিই কি পৌঁছয়? সত্যিই কি সব ভাষার সব শব্দের, সব নৈঃশব্দের অনুবাদ সম্ভব?
Hiraeth — ‘হিরাইথ’ একটি ওয়েলশ্ ভাষার শব্দ, কোনও ভাষাতেই যার সঠিক অনুবাদ সম্ভব নয়। হিরাইথ মানে হল নস্টালজিয়া, স্মৃতিমেদুর অনুভূতি — এমন এক স্মৃতির অনুভূতি যার কোনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই। হিরাইথ হল ঘরে ফেরার টান — এমন এক ঘরে ফেরার টান, যে ঘরের আসলে কোনও অস্তিত্ব নেই। এ এমন এক স্বদেশভূমির আকাঙ্খা, যা কোনওদিন কোথাও নেই, ছিল না। বহুকাল আগে কেটে বাদ দেওয়া অঙ্গে সুড়সুড়ি লাগার অনুভূতির কথা আমরা জানি। কিন্তু কেমন হবে সেই অনুভূতি, যে অঙ্গ কোনওকালেই ছিল না? কিম্বা ধরা যাক এক নারীর জন্য, এক পুরুষের জন্য, একটি মুখশ্রীর জন্য তপ্ত নিদ্রাহীন শ্বাসরোধী আসক্তি — যদি হাজার বছর ধরে পথ হাঁটার পর, সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে ঘুরে মরার পর জানা যায় সেই নারীর, সেই পুরুষের, সেই মুখের কোনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই? একে কি বলা যাবে হিরাইথ?
বিভিন্ন লেখায় বর্তমান চের্নোবিলের বর্ণনা পড়তে পড়তে এক বিচিত্র হিরাইথে বিদ্ধ হলাম আমি — এক স্মৃতিমেদুর অনুভূতি, এমন এক জায়গার প্রতি যা আমার জানাচেনা জগৎ থেকে বহু যোজন দূরে। বেশ কিছুদিন ভেতরে ভেতরে সেই অনুভূতির ক্ষরণ হতে হতে অবশেষে খুঁজে পেলাম সেই জায়গাটে : আমার ঘরের কাছেই, শৈশব থেকে আমার বেড়ে ওঠা শহরের ভেতর অন্য এক অচেনা শহরে।
কলকাতা থেকে চল্লিশ কিলোমিটার উত্তরে হুগলী নদীর পূর্বপাড়ে এক বিস্তীর্ণ শিল্পাঞ্চল, বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের এক অণু-ভারতবর্ষ, যার নাম জগদ্দল। উনিশ শতকের মাঝামাঝি শিল্প বিপ্লবের ঢেউ এসে পৌঁছেছিল এখানে, গড়ে উঠেছিল চটকল ও অন্যান্য নানান কলকারখানা। গোটা উপমহাদেশের অর্থনীতি আর কর্মসংস্থানের চুম্বক হয়ে উঠেছিল একটি এলাকা, দক্ষ শিল্পশ্রমিক তৈরি হয়েছিল কয়েক প্রজন্ম ধরে। সেই ইতিহাসের কঙ্কালের হাড়গোড় খুঁজতে গিয়েছিলাম আমি অপুর দেশ লেখার সময়ে। আমার সঙ্গী ছিল বাল্যবন্ধু শুভাশিস, স্থানীয় শিল্পাঞ্চল বাঁচাও কমিটির সেক্রেটারি।
‘এককালে এই ছিল ভারতবর্ষের প্রথম এসইজেড।’ শুভাশিস বলেছিল, তারপর একটুক্ষণ চুপ করে থেকে যোগ করেছিল — ‘এখনও এসইজেড, তবে ভিন্ন অর্থে। এখন এ হল স্পেশাল এক্সটিংকশান জোন!’
হুগলী নদী মজে এসেছে, তার বুকে জেগে উঠেছে বালির চর। এককালে পাটের গাঁট নিয়ে বড় বড় গাদাবোট আসত। পাড় বরাবর মিলের জেটি আর ক্রেনগুলো ভেঙে দুমড়ে পড়েছে জলে। কারখানার উঁচু ইটের চিমনির মাথায় বটগাছ, চিলের বাসা। নদীর সমান্তরাল যে রেলের লাইনগুলো ঢুকে গিয়েছে গোডাউনের ভেতর, যার ওপর দিয়ে এককালে মালগাড়ির সারি চলে যেত বন্দরের দিকে, সেখানে গজিয়ে উঠেছে মহিষের খাটাল। দুপাশে লোহালক্কড় আর বয়লারের ছাইয়ের পাহাড় পেরোলে সারি দিয়ে মজদুর লাইনের ইটের ঘর। বেশিরভাগ তালা বন্ধ, কিংবা শুয়োরের খোঁয়াড়। মিলগুলো বন্ধ হয়ে যাবার পর শ্রমিকেরা বেশিরভাগই বিহার উত্তরপ্রদেশের দেহাতে ফিরে গিয়েছে, অনাহারে অর্ধাহারে বিনা চিকিৎসায় মারাও গিয়েছে অনেকে। যাদের কোথাও যাবার নেই, যারা অশক্ত শরীরে মাটি কামড়ে পড়ে আছেন এখানে, তাঁদেরই একজন ক্ষয়াটে চেহারার বৃদ্ধ বৃন্দাবনজী। এককালে তিনি জুট মিলে সিনিয়ার ফিটার ছিলেন। আমরা গিয়েছিলাম তাঁর বাসায়।
চারিদিকে আগাছা আবর্জনা আর বাতিল ছেঁড়া টায়ারের স্তূপের মাঝে টানা একসারি ঘর, পেছনে ভাঙা পাঁচিলের ওপাশে লেবার অফিসারদের পরিত্যক্ত বাবু কোয়াটার্স — লাল ইটের সুঠাম ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যে সাপের মতো জড়িয়েছে মোটা মোটা বটের শিকড়, ঝোপঝাড়ের ভেতর উঁকি দিচ্ছে জংধরা দোলনা, স্লিপ, বাঁধানো বাক্সেটবল কোর্টে ফাটিয়ে উঠেছে শিয়ালকাঁটার ঝাড়। তাতে হলুদ ফুল ফুটে আছে।
একসময় চারশো পরিবার এখানে থাকত, বৃন্দাবনজী বলেছিলেন। এখন বড়জোর পনের-বিশটা।
বৃন্দাবনজীর ঘরের বাইরে ইটবাঁধানো উঠোন, একটা খর্বাকৃতি বটগাছ, নিচে কমলা তেলসিঁদুর লেপা ছোট্ট হনুমান মূর্তি। গাছের নিচে খাটিয়া পেতে বসিয়েছিলেন আমাদের। তাঁর বর্ষীয়ান স্ত্রী মাথার ঘোমটা সামলাতে সামলাতে পেতলের থালায় ঠেকুয়া আর লোটায় করে জল এনে রাখলেন। কিছুদিন আগে ছটপুজো হয়েছিল, তার প্রসাদ।
চলে যাওয়া দিনগুলোয় ছটপুজোর সময় দশ-দশ কিলো আটা ঘিয়ের ঠেকুয়া বানাতাম, বলছিলেন বৃন্দাবনজীর স্ত্রী। রাত থাকতে মেয়েপুরুষের লম্বা জলুস বের হত মজদুর লাইন থেকে — সবার খালি পা, মাথায় কুলো ভর্তি ফল মিঠাই ধুপ দিয়া। দেশোয়ালি গান গাইতে গাইতে সবাই একসাথে গঙ্গা মাইয়ার ঘাটে যাওয়া হত। কোথায় গেল সেসব দিন? ফাগুন মাসে হোলি, আষাঢ়ে রথযাত্রা, মাঘে পোঙ্গল, তারপরে ঈদ… সব উৎসবে শামিল হতাম আমরা, হাতের কর গুণে বলছিলেন। হফতার দিন মীনাবাজারের মাঠে ভারী মেলা বসে যেত, গঙ্গার ওপার থেকেও লোকে ফেরি চেপে আসত মজা নিতে। কোথায় গেল সেসব দিন? লোকজন নেই, দুটো কথা বলার লোক নেই, মিলের সাইরেন নেই, সকাল বিকেল এত চুপচাপ, এমন সন্নাটা ছেয়ে থাকে, রাত্রিবেলা শেয়াল ডাকে হুক্কাহুয়া — মনে হয় যেন শ্মশানে বাস করছি, চারিদিকে কেবল ভূতপ্রেত। এখানে থাকতে থাকতে আমরাই সব ভূত হয়ে গেছি। জীবন্ত ভূত!
জিন্দা ভূত! — শব্দদুটো বার দুয়েক জিভের ডগায় ঘোরাতে ঘোরাতে উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠেছিলেন স্বামী স্ত্রী একসঙ্গে। পোড়ো পরিত্যক্ত ক্ষয়ের মাঝে দুই প্রাণী, দুজনেই বৃদ্ধ, গভীর বিপন্নতার থেকে উঠে আসা এই হাসি ওঁদের বেঁধে রেখেছিল।
ভাষায় মৈথিলী টান আর দেহভঙ্গি মিলে যে গভীর বিষণ্ণ ইমেজ সৃষ্টি হয়েছিল, তা অনুবাদ করা যায় না ‘হিরাইথ’-এর মতোই।
বেলারুশিয়ান লেখক ও সাংবাদিক স্বেতলানা আলেক্সেইভিচের চের্নোবিল নিয়ে বইটির ইংরেজি অনুবাদে নাম -- Voices from Chernobyl: The Oral History of a Nuclear Disaster। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৬ সালে। ২০১৫ সালে স্বেতলানা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।