সুবীর সরকার
সারা বছর ধরেই বাংলা ভাষায় প্রচুর লেখা প্রকাশিত হয়। হতেই থাকে। তবে বাংলার সেরা পার্বণ ‘শারদ উৎসব’কে ঘিরে প্রচুর লেখা প্রকাশ পেতে দেখি। সারা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল জুড়ে। মূলত ‘বিগ হাউজ’; মানে যাদের মূলধন বেশি, লগ্নি বেশি তাদের পত্রিকায় নামী দামী লেখকদের লেখাই প্রাধান্য পায়; সেই ‘বিগ হাউজ’-এর শারদ সংখ্যাই মূলত বাজার জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি ‘লিটিল ম্যাগ’-গুলিও তাদের স্বপ্ন শ্রম ও দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে তাদের লড়াই জারি রাখে। প্রচুর মেধাবী ছোট পত্রিকায় পাঠক খুঁজে পান তাদের স্বপ্নের লেখাগুলি। ব্যক্তিগত পাঠ অভিজ্ঞতায় আমি এটুকুই বলব ‘বিগ হাউজ’-এর শারদ সংখ্যায় মূলত হতাশা জাগানো লেখার প্রাধান্যই বেশি। আর ‘লিটিল ম্যাগ’-এর শারদীয়াতে কিছু দুর্বল লেখা থাকলেও ঋদ্ধ হবার মতন লেখাই বেশি। নূতন কথা আর নূতন স্বপ্নের স্পর্শ অনেক বেশি সেখানে। এটা আমার ব্যক্তিগত পাঠ পরিসর থেকে নির্মিত ধারণা।
আমি উত্তরবাংলার মানুষ। প্রান্তে থাকি। নিজের লেখাপড়া নিয়ে। বেশ আছি। উত্তরে অনেক পত্রপত্রিকা বেরোয়। অনেক ভালো কাগজ এখান থেকে তাদের স্বর পৌঁছে দিয়েছে বাংলা ভাষাবিশ্বে। শারদ ও দীপাবলীকে কেন্দ্র করে এখানেও পত্রিকা প্রকাশিত হয়। আবার এই সময়ের বাইরেও। সে যাই হোক, উত্তরের পত্রিকাগুলোতে অনেক মূল্যবান লেখা প্রকাশ পায়। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা। এবারে পাঠক হিসেবে এই সব ছোট কাগজের মূল্যবান লেখাপত্রের কথা কিছু বলা যাক।
বিপুল দাস। উত্তরের শিলিগুড়িতে তার বসবাস। বিপুল দাসের চমকে দেবার মতন একটা উপন্যাস ‘লাল বল’ পাঠ করেছিলাম ধুপগুড়ি থেকে প্রকাশিত ‘প্রবাহ তিস্তা তোরসা’ পত্রিকাতেই। এক নূতন ভাষা নিয়ে এসেছিলেন তিনি। উত্তরের ভূমিলগ্ন মানুষের লোকজীবন কী তীব্র এক আকুতি নিয়েই তার কলমে উঠে আসে। আজ বাংলা ভাষায় বিপুল দাস একটি নাম। মল্লার, তিস্তা তোরসা, দ্যোতনা, তিতির, দাগ সহ উত্তরবাংলা থেকে প্রকাশিত অনেক পত্রিকাতেই বিপুল দাসের অনেক মনে রাখবার মতন গল্প পড়ে আসছি। মনে আছে সুবোধ সরকার সম্পাদিত ‘ভাষানগর’-এ পড়েছিলাম বিপুলদার উপন্যাস ‘সরমার সন্ততি’। আর ‘ভাষাবন্ধন’-এ উত্তরের সমাজ ভূমিপুত্রদের শেকড় খোঁজবার এক মরমী আখ্যান ‘ভুবনজোতের বাঘ’। একটা দর্শন, জীবনের খুব ভেতরের উত্তাপ পাঠক হিসেবে আমাকে অদ্ভুত এক জাগরণের দিকেই নিয়ে গেছে।
যেভাবে পড়ে ফেলতে পেরেছিলাম অমিয়ভূষণ মজুমদারের উপন্যাস ‘ভুলি নাই’। প্রকাশিত হয়েছিল কৃষ্ণ দেব সম্পাদিত ‘প্রবাহ তিস্তা তোরসায়’। এই পত্রিকাতেই পড়েছি অমিয়ভূষণের প্রবন্ধ, দেবেশ রায়ের প্রবন্ধ, তপোধীর ভট্টাচার্যের সমৃদ্ধ হবার মতন প্রবন্ধ। এছাড়া অভিজিত সেন কিন্নর রায় সাধন চট্টোপাধ্যায় আফসার আহমেদ মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য সাগরিকা রায় শুভময় সরকার প্রমুখদের উচ্চমানের অনেক গল্প উত্তরবাংলার অনেক লিটিল ম্যাগেই তো পড়েছি। মনে আছে কিন্নর রায়ের ভিন্নস্বাদের একটি গদ্য পাঠ করতে পেরেছিলাম সঞ্জয় সাহা সম্পাদিত ‘তিতির’ পত্রিকায়। গৌতম গুহ রায় সম্পাদিত ‘দ্যোতনা’, শুভময় সরকার সম্পাদিত ‘মল্লার’, মৃণাল চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘দধীচী’ এই সব পত্রিকাতে নানান মূল্যবান লেখা পড়বার সুযোগ পেয়ে আমি পুষ্ট হয়েছি। এছাড়া উত্তরবাংলার আরও অনেক অনেক পত্রিকাতেই তো প্রচুর পরিশ্রমী লেখাপত্তর পড়বার সুযোগ পেয়ে এসেছি। সব পত্রিকার নাম উল্লেখ করলাম না। মনে আছে সেই কত অল্প বয়সের উন্মাদনায় পড়ে ফেলেছিলাম সুরজিত বসুর ‘অবতামসী’।লোকসংস্কৃতি বিষয়ক প্রচুর লেখা উত্তরের ছোট কাগজেই পড়েছি। অনেক কিছু জেনেছি। শিখেছি। নিখিলেশ রায়, জ্যোতির্ময় রায়, ভগীরথ দাস, গিরিজাশঙ্কর রায়, ধনঞ্জয় রায়, কমলেশ সরকার-দের লেখা অনেক প্রাপ্তি আমার। প্রান্তিক ইতিহাস নিয়ে এই উত্তরেই কাজ করছে দেবব্রত চাকীর ‘উত্তর প্রসঙ্গ’। বালুরঘাট থেকে বিশ্বরূপ দে সরকার সম্পাদিত ‘মধ্যবর্তী’-তে অনুপম মুখোপাধ্যায় ও অর্জুন বন্দোপাধ্যায়ের গদ্য পরে রীতিমত চমকে গিয়েছিলাম। এক তীব্র আবিষ্কারের আনন্দ পেয়েছিলাম। কত কথা বলার আছে। কিন্তু সব লেখার কথা বলতে গেলে আস্ত একটা গবেষণাপত্রই হয়ে যাবে।
পড়াশোনা একজন মানুষকে খুব ভেতর থেকে তৈরি করে। একটা জীবনবোধ গড়ে ওঠে। আমার ক্ষেত্রে তো এটাই সত্যি। ‘বিগ হাউজ’-এ রমাপদ চৌধুরী দেবেশ রায় সন্তোষকুমার ঘোষ আবুল বাশার-দের মতন কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে মূলত সৎ লেখা, জীবন বদলে দেওয়া লেখা বিরল। সেই চর্বিতচর্বণ। জীবনের বহতা ব্যাপ্তি সেখানে মেলে না। ঠিক বিপরীতে ‘লিটিল ম্যাগের’ অবস্থান। একটি সার্থক লেখা এখানেই পাঠ করার সুযোগ মেলে একজন সৎ পাঠকের। এটুকুই বলবার। লিটিল ম্যাগ আসলে লেখক তৈরি করে। পাঠক তৈরি করে। স্বপ্নের বিনির্মাণ ঘটায়। এখানেই তার সিগনেচার।