Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অপেক্ষা নিবিড় অক্ষরশ্রমিকের

দেবতোষ দাশ

 

শরৎকালীন সাহিত্য পাঠযোগ্য নয়, তাহলে কি বসন্তকালীন সাহিত্য যোগ্য? নাকি গ্রীষ্মকালীন? বাংলা সাহিত্যের ওঠাপড়ার টাইমলাইন ঋতুচক্রে সেঁটে আছে বুঝি! শরৎকালে লেখকদের লেখা তেমন দাঁড়ায় না, কিন্তু বসন্তের বইমেলায় দাঁড়িয়ে যায় দিব্য, বা নববর্ষের নিঠুর এপ্রিলে! জাপান দেশের কোন তেল ইস্তেমাল হলে বা কোন ছলা এবং কলা এই কারিয়োক্রমের পেছনে দাঁড়ালে, স্থিরসিদ্ধান্তের এই সঞ্চারপথ তোয়ের হয় বিদ্বজ্জনেরা নিশ্চয়ই তা জানেন। নাহলে ভাবনা এত টাট্টু কোন গভীর আত্মবিশ্বাসে!

এমত টাট্টুভাবনার নিরিখে, আজিকাল বড় গোল শোনা যায় যে শারদ সাহিত্য অপাঠ্য। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর পক্ষ থেকে প্রস্তাব এল এই বিষয়ে কাহন ফাঁদার। সাতকাহন না-ফেঁদে, নেপথ্যের যাবতীয় কূট ও কচালকে একলগে মন্থন করে দেখা যাক কী ওঠে?

শারদ সাহিত্য হিসেবে কোনও সাহিত্যকে সম্পাদকমণ্ডলীর চিহ্নিতকরণের অর্থ নিশ্চিতভাবেই বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে প্রকাশিত গল্প-কবিতা-উপন্যাস-নাটকের সমাহারের দিকে তর্জনীনির্দেশ। মূলত শরৎকালে দুর্গাপূজাকেন্দ্রিক আমোদ ও প্রমোদের বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে যা আসে বা যা-যা আসে, তার মধ্যে একটি সাহিত্য। মধ্যবিত্ত শহুরে বাঙালি নতুন জামা, নতুন শাড়ির সঙ্গে একটি বা একাধিক পুজোসংখ্যা বগলদাবা করে। বিশ্বে আর কোনও জাতি বা সম্প্রদায় তাঁদের অন্যতম বড় উৎসবে, এপারে পুজোসংখ্যা ওপারে ঈদ সংখ্যা, এভাবে সাহিত্যকে জুড়ে দিতে পেরেছে কিনা আমার জানা নেই।

বছর-বছর ভালো গল্প/উপন্যাস লেখা সম্ভব নাকি, এই প্রশ্ন সঙ্গত বটে, কিন্তু পাল্টা-প্রশ্ন, বইমেলা বা নববর্ষে আবির্ভূত সাহিত্য তাই বলে কতটা দিগগজ? বাংলায় পূজাসংখ্যা প্রকাশ করে ছোট-বড়-মেজ-ন-কুট্টি প্রচুর পত্রপত্রিকা। স্বাভাবিকভাবেই প্রচারের জৌলুসে পাঠকের মন-মাথা আলো করে থাকে বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলি যা মূলত বড় মিডিয়া হাউজ থেকে প্রকাশিত। তাঁদের রূপলাবণ্যের গৌরব এখন কিছুটা অস্তমিত হলেও বাজার তাঁদেরই দখলে। প্রচারের পাতা আলো করে থাকেন যে লেখককুল, ভ্রমবশত মনে হতে পারে এঁয়ারাই লেখক। বাকিসব করে রব ঈর্ষাসহযোগে। সেই আবালপনা আগ বাড়িয়ে জনসমক্ষে প্রচারের সুলভ খাটা-পায়খানাও এখন বানিয়ে দিয়েছে জুকেরবার্গ। কমার্শিয়াল জৌলুসের সঙ্গে পাঙ্গা নিতে, কলেজ স্ট্রিটের কলমকুমাররা, ব্র্যাকেটে ব্যর্থ, এখন তাই তিন পয়সার বই বেচতে পাইপয়সার বাইজি নাচেন।

পুজোর মাল ভুষিমাল, বইমেলার মাল মালামাল, এমত ধারণা যদি গেঁড়ে থাকে সুধীমহলে, তাহলে এর পেছনে কতটা যুক্তি আর কতটা আলতো আঁতলেমি, ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে না-হোক, মিটারে মিটারে কিঞ্চিৎ বুঝে নিতে হবে। বাণিজ্যিক ব্যাপারকে আমরা প্রশ্রয় দিই না, জনপ্রিয়তাকে আমরা ঘৃণা করি। এ আমাদের রোগাভোগা প্রাচীন অরণ্য প্রবাদ। গরীবিয়ানাকে এখনও আমরা গ্লোরিফাই করি, বইয়ের তাকের ছবি দিয়ে কাউন্টার করি ফুটোপকেটকে। অথচ দেওয়ালে-দেওয়ালে নির্লজ্জ পারষ্পরিক গাঁড়ঘর্ষণ, ‘তোমার গল্প কী ভালো-আমার গল্প কী ভালো’ মার্কা বেহায়া পোস্টে আমাদের মাথা একটুও নীচু হয় না।

ওয়াশিংটন ডিসিতে তো কেবল সাদা বাড়ি নেই, আমাদের প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটেও আছে। তাহাদের সাদাবাড়ির পাশাপাশি আমরা আমাদের সাদাবাড়ির উদ্দেশেও গলার শির ফুলিয়ে চিল্লিয়েছি। পিএফ তুলে, গয়না বেচে ছেলেমেয়েকে আইটি পড়িয়ে মাইটি করেছি, তারপর পাঠিয়েছি তাহাদের সাদাবাড়ির দেশেই। লিটল ম্যাগ করেছি প্রখর বিপ্লবীয়ানায়, আবার গোপনে আমাদের সাদাবাড়িতে লেখাও পাঠিয়েছি। কফিহাউজের ইনফিউশন-বন্ধু আনন্দ শারদসংখ্যায় ‘চান্স’ পেয়েছে বলে ঈর্ষায় ঘনসবুজ হয়ে তাকে ‘আনফ্রেন্ড’ করেছি হেলায়, কথা বন্ধ করেছি। শারদ সাহিত্যের বিরোধিতা আসলে আমাদের এই আনন্দ-বিরোধিতার প্রাচীন অভ্যাস।

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক, মন্ত্রমাফিক নির্বোধ চিৎকারে গলা মেলাত ততোধিক নির্বোধ যে ক্যাডার, সে যদি জানত কেবল মার্কিন নয়, জগৎজোড়া ঘুঁটি সাজিয়ে কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদ রাহুর মতো হাঁ করছে বেবাক বসুন্ধরা গিলে নেবে বলে! যদি জানত তারই সুতোর টানে দেশের আজ হাঁড়ির হাল! তারই আঙুলের টানে নাচছে আজ চিয়ার গার্ল! নাচে হাফ-প্যান্ট, নাচে আচ্ছেদিন আর বাজারে জিন ছাড়ে বৃদ্ধ আলাদিন! সে জিন কখনও হাতিমতাই, কখন যে খেয়ে ফেলে গোটা ধর্মটাই!

ডাগর হওয়া ইস্তক আমরা এই গড়াপেটা ছাড়া কিস্যু দেখিনি, দেখেছি কেবল স্টেটাস-কো আর কো-অর্ডিনেশন, চারোতরফ বারোআনা বনসাই আর বাকি চারআনা মাঝারিআনা। যা কিছু পিতা পরম যত্নে সেভ করে রেখেছিলেন প্রশ্নহীন আনুগত্যে, সেইসব মিথ আর মিথ্যে, বিশ্বাস আর বদভ্যাস হেলায় ডিলিট হয়ে গেল নবমিলেনিয়ামে। স্টেটাস-কো ভোকাট্টা হতেই পিতা খানিক গেলেন ভেবলে, কনফি খান খান, তো হোয়াট ইজ টু বি ডান! কাল যে ছিল ব্যাঙাচি বিপ্লববাজ আজ সে নিমেষে দাদুরি ধান্দাবাজ!

কলেজ স্ট্রিটের কলমকুমাররা কবে বুঝবে সাহিত্যের কোনও নির্দিষ্ট ঋতু হয় না, সে চিরঋতুমতী। হাল চষার জন্য কেবল উপযুক্ত বলদের প্রয়োজন। ছাগল নয়। কমার্শিয়াল কলমচি আলোকবৃত্তে দাঁড়িয়ে ক্রমশ অক্ষরযাত্রা করেছেন পরিত্রাণহীন টিভিসিরিয়ালের দিকে, তাই আজ সে রাত ন’টার বাসি বেগুনির মতো পরিত্যাজ্য। ব্যর্থ আঁতেল-লেখকও বাংলা সাহিত্যের ভূগোল বাড়াতে আর অন্ধকারে ঘামাচি গালতে গিয়ে ক্রমাগত পাঠক-প্রত্যাখ্যাত। ফলত বাংলা সাহিত্য নামক চরাচরহীন চারণভূমি আজ নিবিড় অক্ষরশ্রমিকের জন্য অপেক্ষারত। পোড়া-অস্তিত্বের গন্ধ নিয়ে কবে আসবে সে অতিথি? আর কে না জানে, যার আগমনের কোনও তিথি নেই, সেই অতিথি!