সর্বজিৎ সরকার
আপাত কোনও কারণ নেই। তবু মন ভালো হয়ে গেল। আপাত কোনও কারণ নেই। অথচ মন খারাপ হয়ে গেল। এ হল শরৎ। কালখণ্ড। ঋতু। ঘুরে ঘুরেই আসে প্রতি বছর, এখনও আসে। ভোরের শিশির, আকাশের ঝকঝকে নীল, সাদা মেঘের পেঁজা তুলো, ভাসমান, এ সব প্রায় এক রকমই আছে। এমনকী, ঠিক শরতেই, এ সময়ে, রোদ্দুরের যে অন্যরকম একটা গন্ধ পাই, সেটাও পেলাম। তবু কী যেন পালটে গেছে মনে হয়। ছোটবেলায় দেখা শরতের থেকে এ অনেক আলাদা। কোথায় আলাদা, কেন আলাদা, বোঝা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়।
রাস্তার দুপাশে ম্যারাপ বাঁধা হয়ে গেছে। পাড়ার পুজোয় প্যান্ডেলের কাজও প্রায় শেষের দিকে। রাস্তায় বাজারে যে ভিড়, যে ব্যস্ততা, যে কেনাকাটার ধুম, যে উৎসাহ, যে উদ্দীপনা, যে হইচই, সব আছে। চলছে। মাত্র পাঁচদিনের উৎসব। এই অনর্গল খুশিস্রোতের চূড়াশীর্ষ। আর সেখানে পৌঁছনোর জন্যে যা যা করার আছে সবই চলছে।
তবু কী যেন পালটে গেছে মনে হয়।
অনুভবের যে জগৎ, তাকে ঘিরে এক বলয় থাকে। সে বলয় দেখার, শোনার, গন্ধের ও স্পর্শের। এক কথায় অনুষঙ্গের। অনেক ছোটবেলায় এই সব অনুষঙ্গের মধ্যে একটা প্রধান উপাদান ছিল শারদীয় সাহিত্য। পত্রিকার পূজাসংখ্যা, বা পূজাবার্ষিকী। মনে আছে আমাদের জন্য বাড়িতে আসত দেব সাহিত্য কুটীর এর শারদ সংকলন, যা শুধু পুজোর সময়েই বেরত। আর বড়দের জন্যে আসত নবকল্লোল, প্রসাদ আর দেশ। পরের দিকে, যখন আনন্দমেলা প্রকাশিত হতে শুরু করল, তখন এল আনন্দমেলা। আমার পাঠের অভ্যাস শুধু ছোটদের বইয়ে তৃপ্ত হত না, ফলে বয়সের একটু আগে থেকেই তা হয়ে উঠেছিল সর্বত্রগামী, অবাধ, এবং নিয়ন্ত্রণহীন। এক কথায় কিছুটা এঁচোড়ে পক্ক।
সেই পাঠ অভিজ্ঞতার খারাপ দিক নিশ্চিত অনেক কিছুই ছিল, কিন্তু ভালো দিকও যে অনেক ছিল, সেটা পরবর্তী সময়ে বুঝেছি। এটা লেখক হিসেবেও সত্যি। পাঠক হিসেবেও সত্যি।
আপাতত লেখক হিসেবে কেন সত্যি, সেটা বাদ থাক। পাঠক হিসেবে কোথায় তার সত্যতা সেটা বরং দেখা যাক।
কোনও পত্রিকার শারদীয় সাহিত্য সংখ্যা ঠিক কবে থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল আমার সঠিক জানা নেই। হয়তো পুজো বা উৎসবের সঙ্গে সে সময়ের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙ্গালির আনন্দ, অবসর এবং কিছুটা বিষাদেরও এক ধরনের গোপন, অভ্যন্তরীণ, যোগসূত্র ছিল। উৎসবের সঙ্গে আনন্দ ঠিক আছে, কিন্তু বিষাদের যোগসূত্র!
জানি কথাটা কেমন বেয়াড়া শোনাল। কিন্তু কথাটা সত্যি। অন্তত সেদিনের, মানে আজ থেকে প্রায় তিরিশ চল্লিশ বছর আগের মননশীল মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে এর একটা সত্যতা অবশ্যই ছিল। ছিল, কারণ এই বিষাদ ঠিক ব্যক্তিগত বিষাদ ছিল না। এটা এক ধরনের জাতিগত কৌম বিষন্নতা ছিল। যেটা আসলে একটি উৎসবকে ঘিরে যে প্রবল উত্তেজনা, তার মধ্যেই নিহিত থাকে। যে এই মুহূর্ত, যা নিরবিচ্ছিন্ন খুশির, আনন্দের, আলোকপ্রবাহের, তা আর কয়েকদিনের মধ্যেই আর থাকবে না। সরে যাবে। ভাসানে যাবে।
আর এই আনন্দমুহূর্ত থেকে বিচ্ছেদের মুহূর্তে সরে যাওয়ার আবহে, মধ্যবিত্ত বাঙালি পাঠক চিরকাল যে রাস্তাটা বেছে নিয়েছে, সেটা তাদের গানে, কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে ফিরে আসার। শারদ সাহিত্য এই জায়গাটাকে ভরিয়ে দিতে সক্ষম ছিল একসময়। আমার নিজের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, বেশিরভাগ ভালো গল্প বা উপন্যাস আমার এই সব শারদীয়াতেই পড়া। অপেক্ষা করে বসে থাকতাম আমরা। বাড়ির অনেকেই। আমার ঠাকুমা, মা, আর আমি বিশেষ করে। বাবা হয়তো কোনও একজন বা দুজন লেখকের জন্যে। সকলে সব লেখকের জন্যে নয় অবশ্যই। আমার বাছবিচার ছিল না তেমন। গোগ্রাসে গিলতাম। প্রিয় ছিল রমাপদ চৌধুরী, সমরেশ বসু ও কালকূট, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তারপর অন্যেরা।
লেখকেরাও নিশ্চই জানতেন, যে সংবেদনশীল পাঠকেরা অপেক্ষা করে আছেন তাঁদের জন্যে। ফলে, যে লেখা তাঁরা পূজাসংখ্যার জন্যে দিতেন সেটা সাহিত্যের মানের দিকে অনেকটাই উপরের সারির। লাভ হত সাধারণ পাঠকের, যাঁরা সাহিত্যের কূটকচালি জানেন না, চিরে চিরে শবব্যবচ্ছেদে বসেন না, তাঁদের। একটা সুস্থ রুচির, এবং সৌন্দর্যবোধের ধারণা ধীরে ধীরে তইরি হয়ে উঠত তাদের, সাহিত্য সম্পর্কে।
গোল বাধল এর পরের সময়কালে। মাঝের তিরিশ বছরে। উৎসবের আঙিনায় এতদিন ঘুরত ফিরত তিনটে শব্দ। আনন্দ, অবসর, বিষাদ। যাদের কথা আগেই বলেছি। হঠাৎ কোত্থেকে একটা নতুন শব্দ ঢুকে পড়ল এই পরিসরের মধ্যে। তার নাম ‘বিনোদন’। এই শব্দটার সঙ্গে সঙ্গে তার আরও যে সব সাঙ্গপাঙ্গ ঢুকে পড়ল উৎসবের আঙিনায়, তাদের কারও নাম ফূর্তি, কারও হুল্লোড়, কারও নাম মস্তি, কারও আমোদ, আবার কারও নাম, (বেশ রাশভারী) ‘এ-সময়ের দর্পণ’।
শব্দটা আসা মাত্র একটু একটু করে শারদীয়ার চরিত্র কেমন যেন পাল্টাতে লাগল। ভালো সাহিত্য মানে হয়ে দাঁড়াল পাঠককে খুশি করা। বেশি চিন্তা ভাবনা করতে না দেওয়া। একটু আধটু কাঁদিয়ে টাঁদিয়ে তারপর আবার পাঠকের পিঠ চাপড়ে বলে দেওয়া, না না বেশ আছেন, ঠিক আছেন, ভালোই তো আছেন, অত ভাবছেন কেন?
সময়ের দর্পণ টাইপের লেখারা আবার একটু গম্ভীর প্রকৃতির। তারা নানান কায়দা টায়দা করে শেষে পাঠককে বোঝাতে শুরু করল, দেখুন সময় কী দ্রুত গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। আমরা সবাই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। এই ভুবন এক গ্রাম। এই মুহূর্ত ছাড়া আর কিছুই সত্যি নেই। এই দেখুন আমরা কে কোথায় আছি, কে কোথায় শুয়ে পড়ছি, কে কোন দলে যাচ্ছি, কে কোথায় দল ভাঙছি, কে কোথায় কাঠি করছি, কে কোথায় ল্যাঙ খাচ্ছি, কিছুই আসলে আসে যায় না কিছুতেই।
যে সকল লেখালিখির ডাকনাম ফূর্তি, মস্তি, আমোদ, এরা আবার বেশ চকচকে ঝকঝকে। কোথাও দাঁড়ায় না। তরতর করে চলে। তড়বড় করে পড়িয়ে নেয়। কিছুটা সেক্স, ইঞ্চিখানেক ভায়োলেন্স, ওয়ান-টি-স্পুন পলিটিক্স, টু-টি-স্পুন প্রি মিক্সড কান্না, উদাস ভাব টাব বেশি একেবারেই না, প্রয়োজনমতো হয়তো কখনও-সখনও।
– কী বলছেন?
– গভীরতা? অনুভব? সে সব আবার কী জিনিশ!
আসলে সময়টা পালটে গেছে। কিন্তু পাঠক যদি সেটা বুঝে ফেলেন, সেইসব নিয়ে বেশি ভাবতে শুরু করেন, তাহলে তো খুব মুশকিল। চারিদিকে আপাতত শান্তিকল্যাণ আছে। স্থিতাবস্থা আছে। এটুকু জানাই কি যথেষ্ট নয়?
শারদ সাহিত্য আর সিরিয়াস লিটারেচর নিয়ে ভাবে না। বিজ্ঞাপন তার পাতায় একটা বড় জায়গা নিয়ে নিয়েছে। পাঠক যে আর শুধু পাঠক নেই। তারাও যে আসলে টারগেট কাস্টমার এই পণ্যজাতক পৃথিবীতে, পাঠক যে আসলে বাজারের ক্রেতা, এ কথা বুঝতে আপনাদের এত সময় লাগছে কেন বলুন তো!