Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সান্টা ক্লজ

অগ্নি রায়

 

এক

একঘেয়ে সাইরেনের শব্দ পিছনে ধাওয়া করে আসছে গত আধঘণ্টা। এই রাস্তাটা আমার চেনা। আমি জানি কুকুর তাড়া দিয়ে আমার গাড়িকে আপাতত যেদিকে ওরা ছুটিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য করছে তার সামনে দৈবের মতো অপেক্ষমান একটি ব্লাইন্ড লেন। ফলে এই দৌড় নিমিত্ত মাত্র। থেমে যাবে একটু পরেই।

যে চার্জশিট ইন্টারপোলের মাধ্যমে গত কয়েকমাস হল জারি হয়েছে আমার নামে সেই তদন্তের প্রত্যেকটি নথিও আমার জানা। ফাইলবন্দি প্রতিটি হাইফেন, কমা, এমনকি লাইনগুলির মধ্যের শূন্যতাটুকুও। আর এটাও জানি যে এই জাল কেটে বেড়োনোর ক্ষমতা নেই আমার। বিশ্বের সেরা আইনজীবীদের দিয়ে প্যানেল তৈরি করলেও নেই। তার কারণ আমার বিরুদ্ধে প্রত্যেকটি নথি অপূর্ব দক্ষতায় জাল করা হয়েছে। যে অবৈধ বেআইনি লেনদেনের বহু নজির এমনকি কিছু ফটোগ্রাফও সেগুলো ফটোশপ করা। এমনকি অ্যালিবাই সাজানোর মতো তথ্য যা আজকের কিছু জাপানি নভেলে নিখুঁতভাবে তৈরি করা হয়, সে সবও তো বিস্তর ছিল। কিন্তু সমস্ত হোটেলের বিল, প্রত্যক্ষদর্শী, সিনেমার টিকিট, এমনকি ইস্তানবুলের বিমানবন্দরে বোমা বিস্ফোরণের রাতে আমি যার সঙ্গে ঘুমিয়েছিলাম বসফরাসের রেণু মেখে, নিরুপদ্রব শৌখিন টাওয়ারে — সেই নীলনয়নাকেও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি! বদলে উল্টো সাক্ষ্যপ্রমাণ, ই মেল হ্যাক করে নকল কথোপকথন সাজিয়ে প্রমাণ করা হয়েছে যে ওই বিস্ফোরণ কাণ্ডের সঙ্গে পরোক্ষভাবে শুধু জড়িতই নই, ঘটনাস্থানেও নাকি হাজির ছিলাম কিছুটা দূরে। জঙ্গিদের ওয়ার রুমে।

ধোওয়া তুলসীপাতা তো আমি নই। এক ছাপোষা মেঘধন জীবন শুরু করে সুপার লোটোতে পৌঁছেতে সময় বেশি লাগেনি আমার। প্রচলিত সার্ফেস ওয়েবসাইটের সুগভীরে যে ডার্ক ওয়েবের জগত সেখানে বহু ডিল আমি করিয়ে দিয়েছি কাউকে জল আর কাউকে সোনার দরে। ব্যস ওইটুকুই। তবে সবরকম সাবধানতা কবচকুণ্ডলের মতো পকেটে পুরে বহু পকেটে আমাকে ঘুরতে হয়েছে। এমনভাবে রানওয়ে থেকে অন্য রানওয়ে হেঁটে যেতে হয়েছে, যাতে পায়ের দাগটুকুও না থাকে। তবে অস্ত্রের কিছু পরোক্ষ বেচাকেনাতেও ক্বচিৎ ঢুকতে হয়েছে অবশ্য কেরিয়ারের গোড়ার দিকে। সংগঠন, বিপ্লব জিহাদ এসব বিচার না করেই। বিনিময় মূল্য ছা়ড়া কিছুই এ জগতে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ডার্ক ওয়েবে বেচাকেনায় মুখোমুখি মোলাকাতেরও সুযোগ থাকে না কোনও।

ফলে কোনও জঙ্গি আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এই মাপের বিপর্যয় ঘটানো বা তাদের হাতে অস্ত্রের জোগান দেওয়ার কাজটা আমার পক্ষে করা অসম্ভব। এদের কাউকে আমি চিনিও না কস্মিনকালে। অথচ এমনভাবে সাজানো হয়েছে চার্জশিট যে একটা মাছি গলারও জায়গা নেই। যে ল্যাপটপের মাধ্যমে সমস্ত লজিস্টিক্স তৈরি হয়েছ নাশকতার, তার আই পি অ্যাড্রেস আমার সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সাইরেন ঘাড়ের কাছে চলে এসেছে। সামনে একটি নিরেট দেওয়াল এগিয়ে আসছে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার বেগে। লং কোটের বাঁ পকেটে যে ফয়েলটি যত্ন করে রাখা আছে সেটা বার করে জিভে রাখার সময় এসেছে এবার। চিত্রনাট্য কখন এবং কীভাবে শেষ হবে তো জানতাম না। তবে এটা জানি যে এই আসন্ন মৃত্যু এবং অপরাধের দায় আমার নয়। ছিলও না কোনওদিন। আমি নিশ্চিত গোটা জীবনের ভার আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে সামনের পাঁচিলের পাশে দাঁড়িয়ে নিষ্ঠুর হাসি হাসছে শান্তনু। আমার স্যান্টা ক্লজ! আমি জানি শেষ ঘুম নেমে আসার আগে একবার অন্তত মুখোমুখি দেখা ওর সঙ্গে হতে চলেছে আমার।

দুই     

আজ পর্যন্ত শান্তনুর সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠতায় আমার মোলাকাৎ হয়নি যাতে সেলফি তোলা যায়! অথচ সকালে উঠে বারান্দায় আকাশ দেখা থেকে শুরু করে রাতের শেষ সিগারেট, এমনকি স্বপ্নের মধ্যেও আমাকে অহরহ মিসড কল দিয়ে গিয়েছে ও চিরকাল। স্লিপ অ্যাপনিয়ার কারণে মুখোশ এঁটে শুতে হয়, তাই নির্লিপ্ত একটি ঘুম উপহার পাওয়ার কথা। কিন্তু তার মধ্যেও স্যান্টা পাঁচ নম্বর সাইজের চামড়ার বলে মারাদোনার মতো ক্ষিপ্র ড্রিবলিং করতে করতে ঢুকে এসেছে স্বপ্নে, মিটিং-এ অথবা ফেরার কালো রাস্তায়। সেন্টার ফরোয়ার্ড খেলত ও যতদূর মনে পড়ে কিন্তু অবিশ্বাস্য ধূর্ততায় জায়গা বদলে বদলে নিত লেফট এবং রাইট উইং-এর সঙ্গে। অর্থাৎ একটিই চরিত্র শুধু স্থান পরিবর্তন করতে করতে হয়ে উঠত বহু এবং বিপক্ষের ত্রাস। হাতে বাদামের ঠোঙা নিয়ে হাঁ করে দেখতাম, এঁদো কাদাওয়ালা মাঠে একটু একটু করে কীভাবে ফুটে উঠছে লাতিন আমেরিকার ফুল!

শান্তনুকে পাক্কা গোয়েন্দার মতো অনুসরণ করে পৌঁছে গিয়েছি কোথায় না কোথায়! শৈশবে এমন কোনও মাঠ বাকি ছিল না যেখানে ওর বুটের দাগ দেখিনি। বলতে গেলে একইসঙ্গে বড় হয়ে ওঠা তো আমাদের। মেট্রো গলিতে ঘনচক্কর, বারোদুয়ারির সামনে এদিক ওদিক দেখি নিয়ে টুক করে ঢুকে যাওয়া পিছু পিছু, ঝালমুড়ি চিবুতে চিবুতে হেঁটে ময়দান ছাড়িয়ে যাওয়া, গভীর রাত পর্যন্ত বসে থাকা ট্রাম গুমটির কোণায়। একসঙ্গেই সব কিছু কিন্তু একটু যেন দূরত্বে। ওর বাসের পিছনের পাদানিতে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে পৌঁছে গিয়েছি ঘুটিয়ারি শরিফের মাজারে। হঠাৎ ও কোনও বাসস্টপে নেমে গেলে চিতার মতো নিঃশব্দে লাফিয়ে নেমেছি রাস্তায়। ঠিক ওরই কায়দায় ঝুলে থাকা আগুনে দড়িকে তুলে নিয়েছি সিগারেট চুম্বনে। ভয়ংকর ব্যস্ত এবং দ্রুতগামী ট্রাফিকের রাজপথে নির্লিপ্তভাবে নেমে যাওয়া রাস্তা ক্রস করার জন্য আর রাস্তায় হট্টগোল বাধিয়ে উঠে পড়া অন্যদিকের ফুটপাথে — এই রাজকীয় পদচারণা শান্তনুর থেকেই শেখা।

পার্কের কাঠচাঁপা গাছের নিচে একটু কুঞ্জবন হয়ে থাকা বেঞ্চের কোণে যখন দিনের পর দিন ও প্রেম করেছে সেই মেঘলা হয়ে যাওয়া দুপুরগুলোতে আমি ফিল্ডিং কেটে গিয়েছি আড়ালে। যদি কোনও ক্যাচ ওঠে ঠিক সামলে নেব বলে। নিয়েওছি। পাড়ার গুলিখোর, মেয়েটির প্রতারিত প্রেমিক, তোলাবাজ কনস্টেবল — দশ প্রহরণে সামলেছি। সামলেছি এই সব নাচার লাফরা। কখনও মাথায় স্টিচ পড়েছে ঠোঁট ফেটে গিয়েছে কিন্তু কখনও টের পেতে দিইনি ওদের। ওদের প্রেম নিরাপদ থেকেছে, আমি কিছুটা দূর থেকে কড়া নজর রেখে দেখেছি সেই সব নির্বাক ফ্রেম।

পার্ক স্ট্রিটের নিশিগমনও প্রথম ঘটেছে শান্তনুর হাত ধরেই। না, হাত ধরে বললে আবারও ভুল হয়ে যাবে। সেই অর্থে করমর্দনও তো হয়নি কোনওদিন। অন্তত সেভাবে, যেভাবে একইসঙ্গে যুদ্ধ ও উষ্ণতা বিনিময় করে নেয় টেস্ট শুরুর আগে, দুই প্রতিপক্ষ ক্যাপ্টেন। কিন্তু এটুকু না বললে সত্যের অন্যথা হবে যে শান্তুনুর পিছু ধাওয়া করে চলে গিয়েছি কারনানি ম্যানশন থেকে ডায়মন্ড হার্বার ছাড়িয়ে অনেকানেক ঠেকে। তিন পেগ পাটিয়ালা নামিয়ে ও যখন ডায়াসে বসা ডিসুজার হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে হাওয়াইন গিটার, এনকোর বলে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও থেমে গিয়েছি ছ’টেবিল দূরত্বে। ওর আঙুল ক্রমশ স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছে নীল তারে আর পানমত্ত জনতার উল্লাসে নরকের দরজা খুলে গিয়েছে হোটেল ক্যালিফোর্নিয়ার।

শুধু নিজের শহরেই নয়, স্যান্টার ছায়া আমাকে অনুসরণ করেছে (নাকি আমিই করে গিয়েছি ওকে) হাওড়া ব্রিজ গঙ্গা ছাড়িয়ে দেশ ছাড়িয়ে, যখন যেখানে গিয়েছি। কোনও পাহাড়ের সানুদেশে বসে কফি খাচ্ছি দেখি সামনের পাকদণ্ডী দিয়ে উলের জ্যাকেট পরে পরিচিত ভঙ্গিতে ঢালু বেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে যাচ্ছে ও। ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, দেখি কাউন্টারের তরুণীর দিকে গ্রেগরি পেক সুলভ শ্রাগ ছুঁড়ে দিয়ে লম্বা লম্বা পায়ে এগিয়ে গেল ডিউটি ফ্রি শপের দিকে। জনবিরল সোনালী সৈকতে, ভিনদেশি নাইটক্লাবের মদির রাতে, বুদ্ধ মনেস্ট্রির গম্ভীর চাতালে কত, কত বার যে চোখাচোখি হয়েছে আমাদের। অথচ সৌজন্য বিনিময় নয়, আবহাওয়া নিয়েও তো কোনও বাক্য বিনিময় হয়নি কোনওদিনও! অন্তত তেমন কিছু তো মনে পড়ে না।

তিন

মানুষের মন বৃন্দাবন। এক এক সময় শান্তনুকে নিয়ে এবং আমার আর শান্তুনুর সম্পর্ক নিয়ে ধারণা এক একরকম খাতে বয়েছে আমার। কেন বারবার দেখা হয়। কীসের এই আনুগত্য আমার! কেন বারবার সে নিঃশব্দে চলে আসে ছায়ার মতো কাছে। শরীরের গোপন পরিবর্তন যেমন নিজের মায়ের কাছেও গোপন রাখতে হয়, তেমনই শান্তনুর প্রসঙ্গও আমি লুকিয়ে রেখেছি পারপার্শ্বিকের থেকে। দৈনন্দিনতার থেকে।

প্রথমে ভাবতাম ও বোধহয় সেই মধুসূদন দাদা। ঠাকুমার গল্পের সেই সেভিয়ার যে না চাইলেও সঙ্গে থাকে। ছেড়ে যায় না। বয়স একটু বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হতে লাগল ঘুনপোকা উপন্যাসের রবি ঠাকুরের চরিত্রের মতো। যে ফাঁকা ঘরে আরশোলা অথবা ইঁদুরের ভয়টাকেও কাটিয়ে দেয়। তার পরে যখন যৌবন ডাক দিয়েছে, বিছানায় ছটফট করতে করতে নিজের যৌনতাকে কতবার যে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছি। সমকামের বিভিন্ন তত্ত্ব তন্নতন্ন করে ঘেঁটে দেখে নিজেকেই প্রশ্ন করেছি — ‘অ্যাম আই আ গে? অর আ বাইসেক্সুয়াল?’

স্পষ্ট কোনও উত্তর আসেনি ভিতর থেকে। আসার কথাও হয়তো ছিল না। কিন্তু ততদিনে বদলেছি আমরাও। মানে আমি আর শান্তনু দু’জনেই। পুরনো বাসস্থান বদলে শহর আর দেশ বদলে সাপলুডো খেলতে খেলতে নতুন হয়েছে কনসিলড আলোয় ভাসা টেম্পারা দেওয়াল, পাহাড় দাপানো এসইউভি, বোতলবন্দি অভ্যাসের মহার্ঘ্য ব্র্যান্ড।

এই সময়েই নতুন একটা সন্দেহ তৈরি হল আমার। স্যান্টা আর কিছু নয়, হয়তো বড় মাপের কোনও এজেন্ট। নিজের দেশের বা অন্য কোনও শক্তিশালী উন্নত বিশ্বের ডিপ অ্যাসেট। গোড়ায় হয়তো ছিল না কিন্তু কালক্রমে ওকে কাজে লাগানো হয়েছে আমার উপর নজরদারির জন্য। অথবা ও আমারই কোনও রাইভ্যাল ডিপ ওয়েবের লোক। স্টকিংটাই ওর কাজ। আমার কাজটা তো খুব সোজাপথে নয়। ডার্ক ওয়েবের জগৎটা যেমন হয়, পেশাগত প্রয়োজনে প্রস্তুত থাকতে হয় মাটির তলায় ঢুকে যাওয়ার জন্য। বিশ্বের কোনও সার্চ ইঞ্জিন যাতে এই ওয়েবের হালহদিশ জানতে না পারে তার জন্য সতর্ক থাকার ব্যাপার রয়েছে। রয়েছে মন্ত্রগুপ্তি, ওয়েব রোবটের চোখে ধুলো দেওয়ার বিভিন্ন বেনামী ডোমেনের আলো আঁধারির খেলা। ফড়ে, দালাল, বিপ্লবী জঙ্গি, ব্যবসায়ী, হ্যাকার কারও নাগালে না গিয়ে তাদের সরবরাহের মডেল তৈরি বড় সোজা কাজ নয়। কারও চাই কোকেন, কারও অবৈধ পাসপোর্ট কারও বা বোমা বানানোর কাঁচামাল।

আমার সন্দেহ বাড়ে কারণ এই সব গোপন ও গভীর এলাকাতেও আমি শান্তনুকে বা শান্তনু আমাকে এড়াতে পারে না কোনওভাবে। ক্যাসিনোর গোপনতম কক্ষে, ম্যানিকিউর করা আঙুলের ইশারার ধারে, হলুদ বাল্ব ঝোলা টেবিলের উপর ব্লেড দিয়ে নিখুঁত করে সাদা লাইন টানা পাউডারের মহল্লায় আমি ঢুকি। ও বেরিয়ে যায়। অথবা আমি বেরোই। ও ঢুকে যায়। এই লাইনে টিকরমবাজ, ফড়ে, টিকটিকির অভাব নেই। নাছোড় হয়ে খোঁজ লাগাতে বলেছি এটা জেনেই যে কখনওই যা পাইনি সেই সন্ধান এখনও পাব না। শুধুমাত্র নামটুকু ছাড়া (বহু জায়গায় এই নামেই স্যাঙ্গাৎদের ডাকতে শুনেছি ওকে) আর বিশেষ কোনও তথ্য আমার জানা হয়ে ওঠেনি। এটা নিশ্চিত যে উল্টোদিক থেকে শান্তনুও তার গোয়েন্দাদের নামিয়ে দিয়েছে মাঠে। কোনও একদিন চাঁদভাসি রাতে প্রকৃত নদীর ধারে ওরা বুঝে নেবে নিজেদের হিসাব। ঝলসাবে চাকু ও গুপ্তি। চাপা আওয়াজ তুলবে অটোমেটিক রিভলবার।

আসলে গোটা জীবন ধরে এক পা এক পা করে আমি এগোচ্ছি ওর দিকে। অবধারিতভাবে সেও এগিয়ে আসছে আমার দিকে। শান্ত অথচ দৃপ্ত পদক্ষেপে।

এই যৌথ এবং অলীকজীবন থেকে মুক্তি পেতে হলে কোনও এক নির্মীয়মান স্কাই স্ক্র্যাপারের চল্লিশ তলার ন্যাড়া কার্নিশে আমরা মুখোমুখি হব — এমনটাই ভেবে রেখেছিলাম। কিন্তু তারও আগে অন্য ফাঁদ সে আমার জন্য ধীরে ধীরে বিস্তৃত করেছে এটা আমার হিসাবের বাইরে ছিল।

সেই ফাঁদের প্রান্তভাগে ক্রমশ এগিয়ে আসা দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে শান্তনু। আমার স্যান্টা ক্লজ। আমার মৃত্যু অপেক্ষমান দেখে প্রাণখোলা হাসি হাসছে ওই তো। ঠিক ছেলেবেলার মাঠগুলিতে বিপক্ষের ডিফোন্ডারকে ডজ করতে করতে বল জালে জড়িয়ে দেওয়ার পর যেভাবে হাসত। ওর দুটো হাত ক্রমশ ছড়াতে ছড়াতে ঢেকে দিচ্ছে দিগন্ত।

চার

২০১৬ সালের ২৮ জুলাই অর্থাৎ ইস্তানবুলের আতাতুর্ক বিমানবন্দর হামলার মাস চারেক পর সে দেশের কয়েকটি সংবাদপত্রের ভিতরের পাতায় মাঝারি মাপের একটি খবর প্রকাশিত হয়। সাধারণভাবে চোখ এড়িয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ভালো করে নজর করলে দেখা যাচ্ছে, খবরটি এরকম —

‘ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যোগসাজশ এবং ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমে তাদের অস্ত্র জোগান দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত এক ভারতীয় ব্যক্তির আত্মহত্যা। সূত্রে পাওয়া খবর অনুযায়ী ইস্তানবুলের প্রান্তবর্তী এলাকায় স্থানীয় পুলিশ বাহিনী তার গাড়িকে ধাওয়া করে। তবে তাকে জীবন্ত অবস্থায় গ্রেফতার করা যায়নি। গাড়ি থেকে দেহ পাওয়া গিয়েছে। সম্ভবত সায়ানাইডের বিষক্রিয়ায় ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে। ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে সে দেশের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে নয়াদিল্লির তরফ থেকে তদন্তে সম্পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস পাওয়া গিয়েছে বলে খবর। ইতিমধ্যেই মৃত ব্যক্তির গাড়ি এবং ব্যাগ ঘেঁটে বিমানবন্দর বিস্ফোরণ সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গিয়েছে।

তদন্তের স্বার্থে আপাতত বাকি তথ্য গোপন রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রক। এটুকু জানা গিয়েছে, ব্যক্তির বয়স ৪৩, গায়ের রঙ মাজা। আদতে সফটওয়্যার এঞ্জিনিয়ার। বহু বছর দেশছাড়া। স্যান্টা নামে সংশ্লিষ্ট মহলে পরিচিত। আসল নাম শান্তনু গুহমজুমদার।’