পূর্ণা চৌধুরী
যদি প্রশ্ন করা যায় ‘Baboo’ কী ও কয়প্রকার? তাহলে সমস্যাটি এই দাঁড়াবে যে এই ডেফিনেশন এবং অ্যানালিসিস কোন পথে যাবে এই নিয়ে গোলমাল বাঁধবে। আমরা সহজ মতে দুইটি পথ বেছে নেব: ইতিহাসের রাজপথ আর সাহিত্যের অলিগলি। দুটি পথ স্বতন্ত্র, কিন্তু চলনে খুব মিল। ঠিক যেমন মূল গায়েন আর তার দোহার।
ইতিহাস পড়তে গিয়ে দেখলাম বাবু ইতিহাস বড় বিচিত্র। কোম্পানির আমল শুরু হবার পর যে ধামা-ধরা শ্রেণীটি তৈরী হল, তেনাদের মধ্যে খাজাঞ্চি দেওয়ানজী নায়েব বানিয়ানরা আছেন প্রথম ধাপে। এঁরা আদতে দালাল। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কোম্পানির সায়েবদের রফা করাতেন, দু’ পাঁচ টাকা নিজেরাও মারতেন। এছাড়াও কোম্পানির বড় কর্তাদের নায়েবগিরি করতেন, কোম্পানিকে এটাসেটা সরবরাহ করতেন। এঁদের মধ্যে পাথুরিয়া ঘাটার মল্লিক, ঘোষ আর ঠাকুর ছাড়াও যাঁদের নাম একনিশ্বাসে করা হত তেনারা হলেন, খিদিরপুরের ঘোষাল, জোড়াসাঁকোর সিংহ, নিমতলা আর কুমোরটুলির মিত্তির, রামবাগানের দত্ত, বাগবাজারের মুকের্জি, কুমোরটুলির সরকার… এঁরা সব সায়েবদের নথিপত্র আলো করে ছিলেন। এছাড়াও ছিলেন অক্রূর দত্ত, হিদারাম বাঁড়ুজ্জে এবং গোবিন্দ মিত্তিরের মতো কিছু ‘ব্ল্যাক ডেপুটি’ যাঁরা সায়েবদের হাড় ভাজা ভাজা করে ছেড়েছিলেন, অর্থাৎ কিনা তাঁদের প্রাপ্য দেনা পাওনা বুঝিয়ে দেননি। যে সময়ের নথি দেখলাম তাতে বাবু দ্বারাকানাথ Tagore হলেন ‘জুনিয়র ব্রাঞ্চ’ যিনি নিমক মহলের দেওয়ান হিসাবে দু’ পয়সা কামিয়েছেন।
কিন্তু এঁদের নিচেও দুই একটি সারি আছে। তাতে পেলাম আরও দুটি উপশ্রেণী। এক নম্বরে সরকার। পাঠক, এঁদের বাজার সরকার বলে ভুল করবেন না।
১৮৩৫ সালে Emma Roberts নামে এক মেমসায়েব বলছেন:
The Circars, who may be styled agents of all descriptions are for the most part tolerably well acquainted with the English language; but these men are notorious for their knavery: they live by the extravagance of their employees and the ruin of more than half of Company’s servants maybe traced in the facilities thrown in their way by the supple Circar, who in their zeal for ‘master’ has obtained for him money on credit to any amount.
It would be unjust and ungrateful to withhold the praise honestly earned by many of these men, who have shown utmost gratitude to employers from whom their gains have been exceedingly trifling consisting of a small percentage upon the articles supplied.
আরও এগোনোর আগে বলে রাখি, আমার ঘোর সন্দেহ “হাত ঝাড়লেই পর্বত” প্রবচনটির উৎপত্তি এই সায়েব-সরকার গোছের সম্পর্ক থেকেই।
এর পরের ধাপে কেরানীকুল। তাঁরা কাছা কোঁচা দুলিয়ে, গালে পানটি পুরে, in white muslin, flowing and graceful, হেলেদুলে আপিসে আসতেন। তাঁরা ইংরাজি বাংলা দুয়েতেই লিখতেন, কিন্তু very slow in writing and they will not be pushed। এয়াঁরা ছিলেন পাখির ওঁচা পায়রা, কারণ যেকালে ইংরেজ কেরানীর মাইনে ছিল ৮০ তংখা, ফিরিঙ্গি কেরানীর ৪০, এই থার্ড ক্লাস বাবুদের মাইনে ছিল ৪ থেকে ১০ তংখা। দু’ এক কলি ইংরাজি জানা থাকলে আরও ১০ টাকা বেতন বেশি। খুব সম্প্রতি আর এক জাতের সন্ধান পেলাম। তাঁরা হলেন ‘Bubbulias’। এনাদের চিনতাম না। এঁদের সম্পর্কে C.M নামক জনৈক attorney বলছেন:
Be it known that in almost all the attorneys’ offices they are retained,– a Baniyan, a Sircar, a Head Writer– their numerous attendants– a seat also of their dependant apprentices (who pretend to write without salaries) and to close the pack, the Bringers of Business, the Law-Brokers, the Bubbulias (or promoters of domestic broils)…
(Observations, etc, Upon the State of the Practice in the Supreme Court of Judicature at Fort William in Bengal, Calcutta 1825)
এই বুব্বুলিয়া-রা হলেন শয়তানের বরপুত্র। বড়োমানুষদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে এঁরা খুড়োকে ভাইপো, অথবা ভাইকে ভাইয়ের বিরুদ্ধে ফুঁসলে মামলা বাঁধাতেন তারপর সেই মামলা অ্যাটর্নি আপিসে এনে ১০ শতাংশ দালালি জোগাড় করতেন। অনেক অনেক পয়সাওয়ালা বড়োমানুষদের এনারা পথে বসিয়েছেন; এইসব বড়োমানুষরা আপনাপন বুদ্ধির দোষে সর্বস্ব খুইয়ে নিজেরাই বুব্বুলিয়া হয়েছেন সে নজিরও আছে।
এসব হল কোম্পানির আমলের কথা। দেওয়ানচি থেকে কেরানী, বুব্বুলিয়া, নানা নিধি বাবুদের যোগদানে যে সমাজটি তৈরী হল ১৮শো শতকে, মহারানীর আমলে তাঁদের শ্রেণী চরিত্র পাওয়া গেল বঙ্কিম-এর ‘লোকরহস্যে’:
“যাঁহার বাক্য মনোমধ্যে এক, কথনে দশ, লিখনে শত এবং কলহে সহস্র তিনিই বাবু। যাঁহার বল হস্তে একগুণ, মুখে দশগুণ, পৃষ্ঠে শতগুণ এবং কার্য্যকালে অদৃশ্য, তিনিই বাবু। যাঁহার বুদ্ধি বাল্যে পুস্তকমধ্যে, যৌবনে বোতলমধ্যে, বার্দ্ধক্যে গৃহিণীর অঞ্চলে, তিনিই বাবু। যাঁহার ইষ্টদেবতা ইংরাজ, গুরু ব্রাহ্মধর্ম্মবেত্তা, বেদ দেশী সম্বাদপত্র এবং তীর্থ “ন্যাশনাল থিয়েটার”, তিনিই বাবু। যিনি মিসনরির নিকট খ্রীষ্টিয়ান, কেশবচন্দ্রের নিকট ব্রাহ্ম, পিতার নিকট হিন্দু, এবং ভিক্ষুক ব্রাহ্মণের নিকট নাস্তিক, তিনিই বাবু। যিনি নিজগৃহে জল খান, বন্ধুগৃহে মদ খান, বেশ্যাগৃহে গালি খান, এবং মুনিব সাহেবের গৃহে গলাধাক্কা খান, তিনিই বাবু। যাঁহার স্নানকালে তৈলে ঘৃণা, আহারকালে আপন অঙ্গুলিকে ঘৃণা এবং কথোপকথনকালে মাতৃভাষাকে ঘৃণা, তিনিই বাবু। যাঁহার যত্ন কেবল পরিচ্ছদে, তৎপরতা কেবল উমেদারিতে, ভক্তি কেবল গৃহিণী বা উপগৃহিণীতে, এবং রাগ কেবল সদ্গ্রন্থের উপর, নিঃসন্দেহে তিনিই বাবু।”
এনারা নানা কর্মে সুদক্ষ। মদ মোহ মাৎসর্যে কল্কি অবতারের বরপুত্র। ১৮৬০ সালে বটতলায় ছাপা হরিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘কলির রাজ্যশাসন’-এ যে ছবি দেখেছি, তাতে মদ কোন পথে বাবুসমাজে ঘাঁটি গাড়ল তার একটা অতি মোটা দাগের ইঙ্গিত আছে। বলা হচ্ছে, কলির আজ্ঞায় সুরাদেবী কালাপানি পেরিয়ে গোরাদের বশ করেন। তারপর সেই নেশা এসে পড়ে টাউন কলকাতায়।
সুরা কন ক্ষমা কর এ দাসের দোষ ধর
এ জন্মে সাধিব তবে কার্য।।
আনি দেহ ইস্টিমার হইয়া সাগর পার
বশ করি আসি সেই রাজ্য।।
শুনে কলি দেন সায় আজ্ঞা পেয়ে মদ যায়
উপনীত বিলাত নগরে।।
ছুটিল সৌরভ তার পেয়ে সেই সমাচার
জয়ধ্বনি প্রতি ঘরে ঘরে।।
চোলে যেতে টলে পদ হয়ে ভাবে গদগদ
আধো আধো বচনে বচন।।
মাতিল যতেক গোরা যেন নদিয়ার গোরা
নদে ছেড়ে বিলাত গমন।।
পাইয়া সুরার তার নানা নিধি নাম তার
রাখিলেন ইংরাজ সকল।।
ব্র্যান্ডি আর ওয়াইন সুধার শ্যাম্পেন জিন
যার গন্ধে ক্ষিতি টলমল।।
এই কলির কেচ্ছায় কালাপানি পেরিয়ে যে মদের নেশা সাহেবদের মধ্যে গিয়ে ঢুকল, সেই নেশা এবার ফিরে এল কলকাতার বাবুসমাজে। বাবু হরিপ্রসাদের নকশাখানি খুব উচ্চ সাহিত্য না হলেও তার বক্তব্য খুব ফেলে দেওয়ার মতোও নয়।
রবার্ট ক্লাইভ-এর আমল থেকেই যে সব Punch House কলকাতায় গজিয়েছিল তার বিবরণ যা পাওয়া যায় তাতেই এর প্রমাণ। তবে কিনা এইসব গরিব রাইটার সাহেবদের অত বিয়ার শ্যাম্পেন খাওয়ার রেস্ত ছিল না। তাই আরক সিরাজ এইসব সস্তার মদ মিলিয়ে জুলিয়ে তাঁদের কোনও মতে চলত। যাঁরা সাহেবদের ধামা ধরলেন, সেই সব বাবুরা এই গুণটি ভালো মতো রপ্ত করলেন। গাঁজা ভাং আফিম তো ছিলই, তার ওপর জুটল মদ। পাঠকরা যদি এ বিষয়ে চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করতে চান, তাহলে টেকচাঁদ ঠাকুরের “মদ খাওয়া বড় দায় মদ খাওয়ার কি উপায়” (১৮৫৯) বইখানি জোগাড় করে পড়বেন। তাতে তিনি লিখছেন: “কলকাতায় যেখানে যাওয়া যায় সেখানেই মদ খাইবার ঘটা। কি দুঃখী, কি বড় মানুষ, কি যুবা, কি বৃদ্ধ সকলেই মদ্য পাইলে অন্ন ত্যাগ করে।” আমোদের খোরাক এই বইয়ে আরও আছে কিন্তু দেখছি আমার এই লেখাটি একটি quote শাস্ত্র হয়ে পড়ছে তাই লোভ সংবরণ করলাম।
শ্বেতচামরে ঘর ঝাড়িবে
নাচবে খ্যামটা স্বর্ণবাই৷৷
এবার আবার বঙ্কিমে ফিরি। তিনি বাবুকে define করলেন বটে, কিন্তু তাঁর তত্ত্বে ছ্যাঁদা থেকে গেল। সমস্ত গুণাগুণ এক আধারে মিশে যে পাম্প শু পরা কালিঘাটের পটমার্কা বাবুটির ছবি তিনি আঁকলেন, তাতে মুড়ি মিছরি সব এক বর্ণ, এক জাত। উচ্চবর্ণ বাবু, অর্থাৎ কিনা খাজাঞ্চী, দেওয়ানজি স্থানীয় কুলীন বাবুদের lifestyle আর কেরানী মুহুরী বাবুদের lifestyle যে এক হবে না, সে ভালো বোঝালেন না। পাঠক, এইবার এই ছবিখানি বিবেচনা করুন। এনারা হলেন বাবু সমাজের ব্রাহ্মণ।
উচ্চবর্ণ বাবুরা, অর্থাৎ নায়েব দেওয়ান জাতীয়রা, তাঁরা সকালবেলা শুদ্ধ হয়ে কিছু লোকজনের সঙ্গে মোলাকাৎ করেন, তার পর যে সকল তৈল মর্দনে “সুখানুভব” হয়, তাহা দ্বারা স্নান সমাপন। তার পর হল “পূজা হোমদান”। ভোজন করতঃ কিঞ্চিৎ বিশ্রাম (সায়েবদের deshabillé siesta)। অতঃপর “অপূর্ব পোষাক জামাজোড়া ইত্যাদি গায়ে চড়িয়ে” পালকী বা অপূর্ব শকট আরোহণে কর্মস্থলে গমন। কাজ কর্ম সারা হলে বাড়ি ফিরে গঙ্গা জল স্পর্শ করে শুদ্ধ হওন এবং তৎপরবর্তী কালে কিঞ্চিৎ জলযোগান্তে, সান্ধ্য মজলিশ বা স্বজন বন্ধু অথবা সায়েবদের সাক্ষাৎকার হেতু গমন। এই গমনের অমিত সম্ভাবনা।
পাঠক, মনে রাখবেন যে এই সময়টা থেকেই সায়েবদের তাড়া খাওয়া গুটি কতক নবাব সুলতান গোছের লোক কলকাতায় বাসা বেঁধেছিলেন। তাঁদের কল্যাণে যেমন অনেক খেমটাওয়ালী বেগম হয়েছিলেন, (হুতোম উবাচ) তেমনি পিল পিল করে কিছু বাইজি মুর্শিদাবাদ, বেনারস, লখনৌ, মহীশূর থেকে কলকাতার ঘাটে এসে ঠেকেছিলেন। শোনা যায় মীরজাফরের আমলের শেষে এক বড়োমানুষ মুর্শিদাবাদের নিক্কি বাইকে এক হাজার টাকা মাস মাইনেতে বাঁধা রেখেছিলেন। এছাড়া ঐ একই সময়ে কোনও এক বাবু রূপলাল মল্লিক সারা রাত ব্যাপী মেহফিলে তাঁহা তাঁহা বাঈজী জড়ো করেছিলেন। সেই মেহেফিল-এ মহামান্য সদাশয় সাহেবরাও যোগদান করেন। এ বাদে চিৎপুর আদি জায়গায় সান্ধ্যভ্রমণের জায়গার অভাবও তো ছিল না, যদি ট্যাঁকে দু’ পয়সা থাকে। এ সময়ে আবার দেবী বাই, হরিমতি বাইয়ের মতো কিছু হিন্দু মেয়েও বাই হিসেবে নাম কিনেছিলেন। বিশ শতকের প্রথম দিকেও তাঁরা মুজরো করতেন। এছাড়া অধিকন্তু ন দোষায় রইল বাড়ির নিকট এবং লতায় পাতায়, নিরাশ্রয় আত্মীয়ারা। বিশেষতঃ অনাথা বিধবা এবং পতিপরিত্যক্তা সধবারা।
কথা ছড়িয়ে যাচ্ছে। এইবার সব একত্র করি। বলেছিলাম বঙ্কিমবাবুর তত্ত্বের ছ্যাঁদার কথা। এই যে ব্যাখ্যানটি দেওয়া হল এনারা হলেন বঙ্কিমের বর্ণনার আধখানা। এঁরা ইতালিয়ান মার্বেল দিয়ে মেঝে তৈয়ের করেন, বাগানে পরী রাখেন। এঁদের পুত্র পৌত্রাদি কালেজে ইংরাজি পড়ে লন্ডন শহরকে ধরাধামে নামিয়ে আনেন। এঁরা হলেন কেনারাম রাজারাম বেচারাম ক্লাস। এক পুরুষ দালান দেন। এক পুরুষ সে দালান ভোগ করেন আর একপুরুষ সব বেচে খেয়ে ডুগডুগি বাজিয়ে বেড়ান।
এর পরের inferior ধাপে সরকার, মুহুরী কেরানী জাতীয় ‘সেলাম সায়েব, জো হুজুর’রা। এঁদের ট্যাঁকের জোর কিছু কম। তা বলে, শ্রী বিনয় ঘোষের ভাষায়, এঁদের “করুণ ক্যাবলা” মনে করার কোনও কারণ নেই। এঁদের সান্ধ্য ভ্রমণ হত যেখানে সে জায়গাও যথেষ্ট সরেস। কিন্তু দেখা গেল তাও যথেষ্ট নয়। এরপর তাঁরা উড়েনি, নাপতিনি, মালিনী, নেড়ি (বোষ্টমী) “সহচরী দাসীরূপা”দের শরণাপণ্ণ হতেন অতিরেক (এক্সেস) সাপ্লাই-এর জন্যে। এ সকল বৃত্তান্ত পেয়ে ধন্য হই শ্রীযুক্ত বাবু ভবানী চরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “কলিকাতা কমলালয়” (১৮২৩) নামক প্রামাণ্য গ্রন্থে।
ওই বইয়ে নাপতিনি ভ্রষ্ট চরিত্রা কুলরমণীদের একটি লিস্ট তুলে ধরেন: অমুক রায়ের মাগ, পালের বহু, দাসের ভগিনী, সুবোধ দত্তের বৌ, অমুক সাহার কন্যা… কিন্তু ব্রাহ্মণ বাড়িরই কথা উঠতেই একজন বলে ওঠেন:
যদ্যপি দ্বিজনারী দ্বিচারিনী হয়
শূদ্রাদির মাতৃতুল্যা গমনীয় নয়।।
ব্রাহ্মণীর মন্দকথা এনো না কো মুখে
ইহ পরকাল ক্লেশে যাবে রবে দুখে।।
তাঁকে নাপতিনি বোঝাচ্ছেন যে কলকাতার বাজারে এখন কোনও লঘুগুরু নেই।
কেহ হরে মাসিপিসী জানিল তা প্রতিবেশী
মামী হরে বিশ্বরূপ আশ।।
ভাদ্রবধূ হরে কেহ কহি যদি মনো দেহ
আছে বড়বাজারে প্রকাশ।।
খুড়ি না শাশুড়ি বাছে শুনি অনেকের কাছে
আর বহু বাজারে শুনিবে।।
যদি প্রশ্ন করা হয় এত সামগ্রী কোথা থেকে বাজারে আসত, তাহলে বলব যে অন্দরমহলে বাবুরা যাওয়ার সময় পেতেন না সে অন্দরমহলে এই সব নাপতিনি মালিনীদের নেড়িদের যাতায়াত ছিল। বিষবৃক্ষর হিরে দাসী আর হরিদাসী বৈষ্ণবীকে পাঠকের মনে আছে কি? ১৮৫৩-র হিসাব অনুযায়ী কলকাতা শহরে তখন সাড়ে চার লক্ষ জনসংখ্যার বারো হাজারই বেশ্যা, তার মধ্যে দশ হাজারের কাছাকাছি কুলীন সধবা অথবা অল্পবয়েসী বিধবা। অন্দরমহলের এনারা হলেন নন রেজিস্টার্ড উদ্বৃত্ত।
এইবার ঢুকে পড়লাম বটতলায়। শস্তা গণ্ডার চটি বইয়ের বাজারে। যদি জিগ্যেস করা যায় ‘বাবু বটতলায় ক’বার যায়?’ সঠিক উত্তর হবে ‘বারবার’। এ পাড়ায় পাঁজি, মেয়েদের ছড়া, পাঁচালি ছাড়াও যে বস্তুটি ছাপা হত তাঁকে ভদ্রভাষায় বলা হয় যৌনসাহিত্য। আমি কিনা দু’ পাতা ইংরেজি পড়া ফিমেল, তাই দুই একখানা পড়ে মনে হল এর আদত ঝাঁঝ পরভৃৎ উপভোগে। পরভৃৎ উপভোগ-এর মতো ‘nasty gibberish’ যদি কেউ না বোঝেন, Voyeuristic pleasure কথাটি নিশ্চিৎ বুঝবেন।
উপরোক্ত বাবুর দূতীবিলাসের (১৮৬০) এই দৃশ্যটি দেখুন:
সুস্বর অনল সম সন্তাপ জন্মায়।
সুস্থির রাইতে নারে পরে ছাতে যায়।।
মলয় মারুত তাহে লাগে তার গায়।
অস্থির হইয়া কামে চারিদিক চায়।।
অন্য মৌথপরি নারী দণ্ডাইয়া ছিল।
অর্ধেক শরীর তার দেখিতে পাইল।।
সুন্দরীর মুখ চক্ষু গুণ নিরখিয়ে।
বিতর্ক করিছে কত কামেতে মজিয়ে।।
ছাতে পুনর্বার আর তারে না দেখিয়া।
বারান্দায় বৈসে আসি মলিন হইয়া।।
দেখা যাচ্ছে নায়ক তাঁর অপরিতৃপ্ত “সন্তাপ” জুড়োচ্ছেন গেরস্থ বাড়ির ছাদে উঁকিঝুঁকি দিয়ে। কিন্তু আরও ক’টি Peeping Tom-কে আমরা দেখলাম বইয়ের পাতার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে সেই দৃশ্য চাখতে। পালিশ ষষ্ঠীর বাবুকে পাঠকদের মনে আছ কি? বঙ্কিমবাবু আলগা করে “একখানি অপকৃষ্ট অশ্লীল এবং দুর্নীতিপূর্ণ অথচ সরস পুস্তক” বলে ছেড়ে দিলেন কিন্তু সেই রসের দমকটি আমরা দেখলাম।
একদল পণ্ডিতের মতে ব্রাহ্ম ধর্ম আর জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক জোয়ার নাকি বাবুদের অপকৃষ্টি ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেছিল। বটতলা হাতড়ে আমার তেমনটি মনে হল না। এই vicarious ‘গুপ্তকথা’র চাহিদা দেখলাম বিশ শতকের গোড়াতেও চালু ছিল। ক’টি নাম বলি:
পতিত-পতিতার গুপ্তকথা, পীর-মোহান্তর গুপ্তকথা, ভাশুর-ভাদ্রবধূর গুপ্তকথা, জামাই-শাশুড়ির গুপ্তকথা, নফর-মালকিনের গুপ্তকথা, বাবু-বিবির গুপ্তকথা আরও নানাবিধ। বিশ শতকে ঝাঁকা মুটে এসব মাথায় করে দুই পয়সায় বেচত কিনা বলতে পারি না কিন্তু দেখলাম ১৯০৪-এও এই ধারাটি বেশ ভালোই বয়ে চলেছে। বাবু ভুবন চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের হরিদাসের গুপ্তকথার (১৯০৪) থেকে সামান্য একটুখানি বলি:
“দিবাশেষের বসন্তের শীতল বাতাস ধীরে ধীরে প্রবাহিত হচ্ছিল, বায়ুস্পর্শে আমি সুখানুভব কোচ্ছি, পল্লীর দুই ধারে নূতন নূতন দৃশ্য দর্শন কোচ্ছি, নয়ন পুলকিত হোচ্ছে। নূতন দৃশ্যাবলীর মধ্যে এক দৃশ্য আমার কাছে খুব নূতন…।”
এইটুকুই শুধু বলব এই যে, যা হরিদাস দর্শন ‘কোল্লেন’ তা হল নানা জাতের কাঁচুলি শোভিত হিন্দু বাইজি আর যা তিনি বাকি বইয়ে কোল্লেন তা ঘুলঘুলি দিয়ে বাবু পাঠকরা দেখতে পেলেন বই কি!
বটতলা খানিক ঘুরেছি। ‘গুপ্তকথা’র মত আর একটি ধারা দেখেছি প্রহসনের। ১৮৯৮-এ বাবু রাখালদাস ভট্টাচার্যর ‘সুরুচির ধ্বজা’-তে এক বাবুকে দেখলাম। তিনি সেই ইংরিজি বিলাসী বাবু, যাঁকে আমরা অশ্লীল বই পড়তে দেখেছিলেম বঙ্কিমের ‘লোকরহস্য’-তে। তিনি তাঁর এক ইয়ারের কাছে দুঃখ কচ্ছেন যে তাঁর স্ত্রী হল damn nasty creature। না পারে নাচতে, না পারে গাইতে, না পারে ইংরাজিতে দুটো কথা কইতে। Gentleman-এর society-তে move করতে জানে না। তিনি পরিত্রাণের উপায় খুঁজছেন। তার ইয়ার তাঁকে আশ্বাস দিচ্ছেন, একজন enlightened, a mere girl of twenty five তাঁদের সমাজে join করেছে। সে আবার very beautiful। তিনি তাকে “যোগাড়” করবেন। সমাজটি যে ব্রাহ্ম সমাজ তা আশা করি পাঠক বুঝবেন।
অলমিতি বিস্তারেণ।
Epilogue
(Belarauser আঁকা তরুণ রবীন্দ্রনাথ)
১৮০০ থেকে ১৯০০’র এইসব জঞ্জাল ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছিল, ঐ একই যুগে, ১৮৭৯-তে একটি তরুণ, “মেঘলাদিনের ছায়াঘন অবকাশের আনন্দে”, অন্তঃপুরের কোণার ঘরে শ্লেটের ওপর উপুড় হয়ে লিখেছিলেন “গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে…”। তিনিই সে যুগের সেরা বাবু। তিনি এলে সূর্যোদয় হয়। তাঁর গান বুঝে না বুঝে গলায় তুলে নেন আশ্চর্যময়ী দাসী, মানদাসুন্দরী, পূর্ণকুমারী দাসীরা… কিন্তু সে আর এক ভাব, আর এক সময়ে।
বটতলা তখনও হাজারো বাবুকে ছায়া দিয়ে চলছে।
Featured Image: https://www.google.ca/search?q=Babu+Kalighat&tbm=isch&tbo=u&source=univ&sa=X&ved= Tagore: A rare painting of Young Tagore by Belarus https://www.pinterest.com/pin/317644579947327661/