সুমন গুণ
চাবিটা রুদ্রর হাতে দিয়ে কেয়া বলল, খুব যত্ন করে রাখবেন।
রুদ্র কথাটা শুনল সামনের দিকে তাকিয়ে। পেছনে, মেয়েদের সিটে বসে আছে কেয়া। কেয়ার মুখের দিকে যে তাকাতে পারল না তখন, সেই আক্ষেপ তার যখনই এই মুহূর্তটি মনে পড়ে, সে টের পায়। মনে হয় মুহূর্তটি নষ্ট হয়ে গেল।
আবার, এই আক্ষেপের মধ্যেও যে আনন্দ আছে, সঞ্চিত এই আক্ষেপের যে গৌরব, সেটাও মনে মনে পুরো নিতে চায় সে।
কেয়ার ঘরের চাবি। নতুন দরজার তিনটি চাবি বানিয়েছে সে। রুদ্রর সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার পর থেকে মাস দুয়েক কেটে গিয়েছে। একই স্কুলে পড়ায় তারা। প্রায় রোজই একই বাসে যাতায়াত করে। পুরো পথের নানা মুহূর্তের শরিক তারা। একই বিকেল, বিকেলের দিঘল রোদ, ঘন-হয়ে-ওঠা একই সকালের আলো, একই সন্ধের আবছায়ার মধ্য দিয়ে তাদের যাতায়াত। একটু একটু করে ঘনিষ্ঠতার পরত পড়তে থাকে, হয়ত, দুজনেরই মনে। দুজনেরই হয়ত মনে হয় আরও একটু ঝুঁকে আসা যায়। কিন্তু দুজনই টের পায় সেই মুহূর্তের শীর্ষ তারা ছুঁতে পারছে না, যে মুহূর্তের ওপারে গেলেই ধরা যায় আকাশের ওপারে আকাশ, বাতাসের ওপারে সেই বাতাস। নানা কৌণিকে বসে থাকায় দু চোখের কথা খুব বেশি হয় না, কিন্তু এক একটি বিস্ময়কর কথার পরিসর দুজনেই বুঝে নিতে চায় দুজনের দিকে তাকিয়ে, সে মুহূর্তও হয়ত যাতায়াতের পথে খুব বেশি স্পর্শ করা হয় না তাদের। কিন্তু দুজনেই যে একটি নির্দিষ্ট সরণি ধরে চলছে, একটিই নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে যে তাদের যাত্রা, সেটা তারা নিঃশব্দে টের পায় বলেই মনে হয়। কিন্তু কিছুতেই তা চেনা চেহারা পাচ্ছে না। মাঝে মাঝে কবিতা আর গান দিয়ে সম্পর্কের ডানা ছড়াতে চায় রুদ্র এবং টের পায় এই গান এই কবিতা তাদের মধ্যে সেতু রচনা করছে। দুজনই বোঝে যে এই সম্পর্কের একটা দেয়াল ধরে তারা দাঁড়িয়ে আছে, সেই দেয়ালে কখনও তারা হেলান দিচ্ছে, কখনও দেয়ালে একটা হাত।
–আজ বিকেলে কি তুমি খুব ব্যস্ত?
–না, কেন বলুন।
–না কিছুই নয়, একটু বসতাম কোথাও।
–কোথায় বলুন।
–এই ধরো কোনও কফিশপে। আমাদের স্কুলের আশেপাশে তো অনেকগুলো হয়েছে নতুন। তুমি যদি চাও, তোমার অন্য ব্যস্ততা থাকলে আজ দরকার নেই, আমি তোমায় বলছি, এমনি বলছি আর কি, যদি পারো, যদি সময় থাকে, যদি খুব কাজ না থাকে…
এতগুলো কথা একটানা বলে সফলতার একটা অনুভূতি হল রুদ্রর।
–ঠিক আছে, আপনাকে জানাচ্ছি তাহলে, ফিরে একটু দেখে নিই কী কাজ আছে। জানাচ্ছি আপনাকে।
বলে, পরের স্টপে নেমে যায় কেয়া।
রুদ্র জানে আজ কোনও ফোনই আর আসবে না কেয়ার কাছ থেকে। জানে যে পরের দিন আবার তাদের দেখা হবে, আবার তারা নতুনতর প্রসঙ্গের মধ্যে ডানা মেলবে, কিন্তু পুরনো প্রসঙ্গের দিকে, অসমাপ্ত আহ্বানের দিকে তারা আর ফিরবে না। এই না-ফেরার বিভ্রান্তি থেকে বের হতে চায় রুদ্র। সে ভাঙতে চায় এই সচেতন উদাসীনতার আয়োজন।
একদিন তাই কেয়ার বাস থেকে নামার দুটো স্টপ আগে তাকে প্রশ্ন করল রুদ্র,
–তাহলে আজও তোমার কাজ আছে? আজও তোমার সিলেবাস আজও তোমার রুটিন আজও তোমার ডাউনলোড আজও তোমার ইন্টারনেট…
এতগুলো কথা বলে রুদ্রর মনে হল সে হয়তো আরও এগুল আরেকটু স্বচ্ছতার দিকে, আরেকটু সামর্থ্যের দিকে, আরেকটু সরলতার দিকে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল সে। তারপরে নিঃশব্দ হাসি হেসে কেয়া বলল,
–আসলে আজকেও না দিদি এমন একটা বড় কাজ দিয়েছে, আপনি তো জানেন আজকে তো নেট ছিল না, তাই আমাকে আবার আজ সারারাত ধরে, অন্তত মধ্যরাত পর্যন্ত জেগে থেকে অনেক কিছু ডাউনলোড করে কালকে দিদিকে দিতে হবে। কী করব বলুন।
এই উত্তরের মধ্যে যে অল্প হলেও, বা, বলা ভালো, অস্পষ্ট হলেও অসহায়তার স্পর্শ ছিল তা কিছুটা আলো দিল রুদ্রর মনে।
–ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোমার কাজ আছে, কাজ থাকলে তো তোমায় কাজ করতেই হবে। আমি অপেক্ষায় থাকব।
অপেক্ষার কথা এভাবে বলতে পেরে নিশ্চিন্ত হল রুদ্র। তার মনে হল সে দেখতে পাচ্ছে দূরের গন্তব্য। ওই যে দেখা যাচ্ছে একটি নতজানু টিলা, তার ওপরে একটি সহাস্য কুটির, সামনে ছড়ানো উঠোন, উঠোনে মেলা রয়েছে নানা রঙের কাপড়, নীল সবুজ হলুদ মেঘলা। দক্ষিণের হাওয়ায় উড়ছে। সেই দক্ষিণের হাওয়ার আশ্বাস জাগিয়ে কেয়া তার নির্দিষ্ট স্টপে নেমে গেল।
তারপর, সেদিন কেয়া তাকে ফেরার পথে পেছন থেকে মুখ সান্নিধ্যে এনে বলল,
–আমার বাড়ির তিনটে চাবি করিয়েছি জানেন।
–তিনটি কেন?
–দরকার। আমার বাড়ির তো একটাই দরজা। যদি কোনও কারণে একটা দরজার একটা চাবি হারিয়ে যায় কী বিপদ হবে বলুনতো।
–তাই বলে তিনটে?
–দুটো যথেষ্ট ছিল না। একটা আপনার কাছে রাখব।
–আমার কাছে?
–হ্যাঁ, রাখবেন না?
–নিশ্চয়ই রাখব।
কিন্তু তার পর থেকে আর কী কথোপকথন হয়েছিল সেটা আর এখন মনে নেই রুদ্রর। চাবি তার কাছে রাখার প্রস্তাবের স্পর্শের আস্বাদ নিতে নিতে তার সারাটা রাতদিন কেটে গেল।
চাবিটা বানানো হবার পর আজ রুদ্রকে চাবিটা দিয়ে কেয়া বলল,
–খুব যত্ন করে রাখবেন।
বাড়ি ফিরে ঘোর থাকতে থাকতে থাকতেই কেয়াকে মেসেজ করল রুদ্র :
চাবিটা নেবার সময় মনে হচ্ছিল, যেন তোমাকেই পেলাম! তখন বলতে পারিনি, এখনও খুব ভয়ে ভয়ে বললাম।
শক্তির ‘চাবি’ কবিতাটা, রুদ্র ভেবে রেখেছে, পরের দিন দেখা হবার পর বাড়ি ফিরে পাঠাবে।