Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ভবা

কৌশিক বাজারী

 

অল্প হাওয়া দিচ্ছিল। ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া। মাঠের ধান কেটে নেওয়া খোঁচা খোঁচা ধানের গোড়া শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে ধূসর রঙ নিয়েছে। হাওয়ায় সেই শুকনো স্যাঁতস্যাঁতে ধানের গোড়া থেকে অদ্ভুত এক গন্ধ ছড়াচ্ছিল এই ক্ষেতের পাশের রাস্তাটায়। সূর্য ডুবে যাওয়ার পর বহুদূর মাঠে মাঠে কেটে নেওয়া ধানের গোড়া আবছা আলোয় জেগে থাকে। ঠান্ডা হাওয়া অল্প শিউর জাগায় শরীরে। পতাকা লাগানো তিনটা মোটর বাইক তেলিপাড়াগ্রামের দিক থেকে এসে হাইরোডের দিকে চলে গেল। বহুদূর পর্যন্ত সেই ভুটভুট শব্দ ছড়িয়ে থাকে। হাওয়ায় পোড়া পেট্রলের গন্ধ মিশে যায়। ভবা একবার আকাশের দিকে চায়। দ্রুত অন্ধকার নেমে আসছে। বেলা ছোট হয়ে আসছে। সৌরচাকা দূরে সরে সরে যাচ্ছে। ভবা বাড়ির দিকে পা চালায়। সে তার বাড়ির কথা ভাবে। তিন বছরের ন্যাংটা ছেলেটার কথা ভাবে। তার বৌ ঝিনুকের কাঁচা মাটির মতো মুখ ভাবে। বাড়ির কাছাকাছি এসে দেখে পুরো পাড়া জুড়ে নেমে এসেছে অন্ধকারের ছাতা। তাদের বাগদিপাড়ার মাটির ঘরগুলোয় কেরোসিনের কুপি জ্বলছে। পাশেই তেলিপাড়াগ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে বছর দশেক। মাঝে একটা কুড়ি বিঘার মাঠ। গত পঞ্চায়েত ভোটের আগে সেখানে দুটা খুঁটি পোঁতা হয়েছিল। হয়তো এপাড়ার স্বভাব-দারিদ্র আর সামর্থহীনতার কথা ভেবেই, হয়তো বা তাকে সম্মান জানাতেই তারপর আর বিদ্যুতের তার বাঁধা হয়নি। শালিকের বাসা মাথায় নিয়ে নিঃসম্বল খুঁটিগুলো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভবা টিনের বেড়া ঠেলে উঠানে ঢুকতেই দেখে ছেলেটা উঠোনে বসা তার দাদুর কোল থেকে হামা দিয়ে সিঁড়ির কাছে ঝুঁকে আছে। ঝিনুক রান্নাঘরে কোনও কাজে ব্যস্ত হয়তো। উঠানের একধারে মাটির রান্নাঘর থেকে টুংটাং বাসনের শব্দ ভেসে আসে। তাদের মাটির ঘরের খড়ের চালের ওপর দিয়ে ঝুঁকে আসা নিমের ডালে একটা নিঃসঙ্গ শালিকের অল্প ডানা ঝাপটানো, এছাড়া ঘর চুপচাপ। তার হাবা ছেলেটা চুপচাপ ভবার দিকে চায় মিটিমিটি, হাসে। চার বছরের ছেলে, এখনও কথা বলতে শিখে নাই। ভবা গায়ের ঘেমো জামাটা খুলে ঘরে ভেতর-দেয়ালের পেরেকের উপরে ঝুলিয়ে রাখে। পিছনের দিকের খোলা জানলাটা দিয়ে অল্প অল্প বাতাস আসছে অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরের ভিতরে। ভবা জানলার সামনে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে বাইরে চেয়ে থাকে। ওরা কি এসে গেছে? ঐ অন্ধকার ঝোপটা একটু দুলে উঠল, নাকি তার মনের ভুল? তার পেটের ভিতরটা আবার মোচড় দিয়ে ওঠে। ন্যাতানো প্যান্টটা কোমর থেকে খুলে দড়িতে রাখে। লুঙ্গির গিঁট বাঁধতে বাঁধতে সে চৌকাঠের বাইরে আসে। ছেলেটা হামাগুড়ি দিয়ে কাছে আসতে চায়। ভবা একবার তার মাথায় হাত বুলিয়ে উঠোনে নেমে আসে। মাদার গাছের নিচে একটা খুব বড় পাথরের উপরে খোলা জলের বালতি রাখা আছে। পাথরের উপরে পা রেখে ভবা জল ঢালে। মুখ হাত ধোয়। দেখে তার বৌ বাটিতে মুড়ি এনে রাখে বারান্দায়। সন্ধ্যার অন্ধকার প্রগাঢ় করে মাদারের ডালে গোপন ঝিঁঝিঁ ডেকে ওঠে।

ভবার বৌ ঝিনুক কদিন ধরেই লক্ষ করছে তার স্বামীর চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে কেমন যেন। কথা বলছে না। কাজ থেকে বাড়ি ফিরে বার বার পুকুর যায়। পেট খারাপ লোকটার। একবার ওষুধ খাবার কথা বলেছিল। ভবা বলল — খাব। কিন্তু তার চোখ কেমন উদাস। লোকটা কম কথার লোক। চুপচাপ শান্ত স্বভাবের, কিন্তু এই কদিন যেন আরও চুপচাপ। আদর করে না রাত্তিরে। এমনকি ছোট ছেলাটার কথাও যেন ভুলে গেছে। কি হল কী লোকটার? ঝিনুক অন্ধকারের মধ্যে ভাবে এইসব। কুপিটা জ্বলতে জ্বলতে তেল শেষ হয়ে নিভে গেছে কখন। হাবা ছেলেটা ঘুমিয়ে কাদা। সে স্বামীর দিকে ফিরে শোয়। গায়ে হাত রাখে। ঠান্ডা। ঝিনুক শিউরে ওঠে, যেন মরা মানুষের গা। সে ভবার গায়ে হাত বুলায়, নাঃ কোনও সাড় নাই শরীরে। অথচ সে জেগে আছে বুঝা যায়।

–কি হয়চে তুমার? আমায় বলবেনি?
–কিছু লয়, তুই ঘুমা। শরীলটা ভাল নাই…
–শুধু শরীল খারাপ? আর কিছু লয়?
–আর কী হবেক? তুই ঘুমা…

ঝিনুক তার একদা ইস্কুলে পড়া স্বামীর গায়ে হাত রেখে চোখ মুদে। তার পুঁথিবিদ্যাহীন নিরক্ষর অনুভূতি দিয়ে বোঝে রাত গাঢ় হচ্ছে বাইরে। পাশে শুয়ে থাকা লোকটা তাকে লুকাচ্ছে কিছু। মাঝরাতের বাতাস বইছে বাগদিপাড়ার উপর দিয়ে। কোনও দুরারোগ্য ব্যাধির আশঙ্কায় তার ঘুম আসে না। শ্রীহীন, আলোহীন পশ্চিমবঙ্গীয় এক অন্ত্যজপল্লীর ঘরের দরজায় ঘুণপোকা সারারাত শব্দ করে যায়। মাঝরাতে ভবা একবার উঠে বসে বিছানায়। জানলা দিয়ে কিছুদূরে তেলিপাড়াগ্রামের বিদ্যুৎ-খুঁটির আলো গাছপালার ফাঁক দিয়ে আবছা দেখা যায়। সে জানলাটা বন্ধ করে দেয়। দেখে উপরে খড়ের চালের থেকে একটা লাল-পিঁপড়ের সারি মাটির দেওয়াল বেয়ে এসে মেঝেতে গর্ত খুঁড়ছে। মেঝেতে পাতা বিছানার অদূরে কপাটের পাশে মাটির কলসি থেকে জল ডুবিয়ে সে খায়। ফের শুয়ে পড়ে। কিছু দূরে তেলিপাড়ার দিকে মোটর বাইকের ভুটভুট শব্দ কান পেতে শোনে।

ভোরবেলা ঘুম-ভেঙে বিছানায় জেগে বসে ঝিনুক। ভবা নাই বিছানায়। কপাটের হুড়কো খোলা, ভেজানো। সে গায়ের কাপড় ঠিক করে বারান্দায় বেরিয়ে আসে। কদিন ধরেই লোকটার পেট খারাপ। এত ভোরে পুকুরে গেল কিনা ভাবে। পূব দিক ফর্সা হয়ে এসেছে। গাঁয়ে লোকজন কাজে বেরিয়েছে কেউ কেউ। দেওয়ালের ওপাশের খুড়শ্বশুর দীনু বাগদির ঘরে গান বাজছে রেডিওয়। ওদের রান্নাঘর থেকে ধোঁয়া উড়ছে পাতার জ্বালের। ঝিনুক উঠোনে গোবর-ছড়া দিতে শুরু করেতেই টিনের টাট ঠেলে ভবা ঢুকে আসে।

–চা দে, বেরাব এক্ষুণি…
–এত সকাল আইজকে?
–হ। মালিক আইজ সকাল সকাল যেতে বলেচ্যে…

ঝিনুক হাত ধুয়ে রান্নাঘরের দিকে যায়। কাঠের উনুনে জ্বাল দেয়। কাঁচা ঝাঁটি-কাঠের ধোঁয়ায় তার চোখ বেয়ে জল নেমে আসে…।

গড়বেতা বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস ধ’রে ভবা যখন বিষ্টুপুর বাসস্ট্যান্ডে এসে নামে তখন বেলা আটটা। নটার মধ্যে সে নব মল্লিকের বিড়ির কারখানায় পৌঁছে যাবেক। সেখান থেকে বিড়ির পাতার বস্তা সাইকেল ভ্যানে পৌঁছে দিতে হবেক স্টেশনে। কারখানায় বসে বসে বিড়ি বাঁধার কাজ তার ভাল্ লাগে নাই। বরং ভ্যানে করে মাল লিয়ে যাওয়া ভালো কাজ। যদিও মেয়াদের সঙ্গে অনেক মরদ মানুষও বিড়ি-বাঁধার কাজ করে কারখানায়। এইসব নানান ভাবনার মধ্যে হাঁটতে থাকে ভবা। রাস্তায় ইস্কুলের ছেলে মেয়েরা চলেছে সেজেগুজে। ভবার নিজের ইস্কুলে পড়ার কথা মনে পড়ে। তার বাপ গনু বাগদি তাকে বলত — ওরে ড্যাকরা, লেখা-পড়া শিকলে চোখ খুল্যে যাবেক। আমাদের মতন চোখ থাকতেও অন্ধ হতে হবেক নাই…। গনু বাগদি দিনমজুর। লোকের ঘরে মুনিষের কাজ করে। চাষের কাজ সে ভালো জানে নাই। মুনিষের ছ্যেলা ইস্কুলে যায়, এমনটা এ গাঁয়ে কেউ দেখে নাই তখনঅ। বাগদিপাড়ার ছেলারা কেউ ইস্কুলে যাই নাই। তবু গনু বাগদি তার ছ্যেলাটাকে তেলিপাড়া প্রাইমারিতে ভর্তি করে দেয়। তার পর গড়বেতা হাই ইস্কুলে ছ’ বছর। মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয় নাই সে। তখন মা মরে গেল। ঘরে তখন টালমাটাল অবস্থা। তারপর কাজ, বিয়া, সংসার, কত বছর পেরিয়ে গেল, তারপর এই আজ… এই আজকের কথা ভাবতেই সে অকস্মাৎ ঘটমান-বর্তমানের ভিতর এসে পড়ে, তার মাথা ঝমঝম করে ওঠে আবার। এতক্ষণ কি থাইলে ভুলে ছিল সে! আর সঙ্গে সঙ্গেই তার পেট মোচড় দিয়ে ওঠে আবার। ভবার মাথার ভেতর ঝিমঝিম করতে থাকে। ঘাম হয়। পা টলে ওঠে। ভবা উপরের দিকে চায়। অনেক উঁচু আঁকাবাঁকা একটা ইস্পাতের মোবাইল টাওয়ার তার মাথার উপর দুলতে থাকে। ঘাড়ের উপরেই ভেঙে পড়তে চায় অকস্মাৎ। তার চারদিকের মফস্বল-জটিল ঘিঞ্জি রাস্তার যানবাহন জঘন্য বাখনি করে চলে যায়। ভবা রাস্তার একপাশে সরে দাঁড়িয়ে শ্বাস নেয় একটু। সেই আঁশটে রক্তাক্ত ভয় আবার তাকে ঘিরে ধরে! সন্ধেবেলা তাকে ঘরে ফিরতেই হবে। ক্ষেতের আলপথ পেরিয়ে যেতে হবে বাস থেকে নেমে… একটা অনিশ্চিত বাঁকের দিকে চলে যাওয়া ভাবনা নিয়ে ভবা রাস্তা পেরিয়ে নব মল্লিকের কারখানার নির্জন গলির পথে ঢুকে পড়ে আর দেখে, একটা ভীষণ দর্শন হাঁ-করা কুকুর। তার দাঁতের উপরের লাল মাড়ি দেখা যায়। যার গলায় বাঁধা শেকল ধরা আছে সেই মহিলাটির হাতে। ভবা কুকুরের দেশি-বিদেশি বুঝতে পারে না। শুধু তার হিংস্রতাটুকু বোঝে, ভয় পায়, সে তার জীবনকে কেঁচোর মতো সরু করে বাকি রাস্তাটুকু পার হয়ে যায়।

ঝিনুক অপেক্ষা করছিল আজ বিকেল থেকেই। তার ভেতরের মানুষটা তাকে ঠেলছিল। একটা অজানা আশঙ্কায় সে ঘর-বার করছিল বারবার। তবু সন্ধ্যা অন্ধকার হয়ে যাবার পর সে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। তার বুড়া শ্বশুরকে ডেকে বলল — বাবা, সে এখনও এলনি যে…

তার শ্বশুর, ভবার বাপ, প্রায় বধির গনু বাগদি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। তার ছেলের বৌয়ের কথার মানে বুঝতে পারে না। ভবার তো কোনওদিন আরঅ দেরি হয় ফিরতে। রাত হয়ে যায়। আজ তবে কী হল! বৌটা অমন করচ্যে ক্যেনে? কী হল তবে? তার বধির জগতের আড়ালে তবে কি কিছু ঘটে গেছে? গনু বাগদি ভাবে।

এমন সময় লাল চোখ, উস্কোখুস্কো চুল, আধ পাগলের মতো ভবা এসে উঠানে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়েও থাকতে পারে না হয়তো, মাদার গাছের নিচের পাথরটার উপরে ধীরে বসে পড়ে। ক্ষণমুহূর্ত আগের দমক সামলে নিয়ে ঝিনুক বারান্দা থেকে উঠোনে নেমে আসে। বলে — দাঁড়াও, কুয়া থেকে জল এনে দিই। সে দড়ি আর বালতি নিয়ে হনহনিয়ে পঞ্চায়েতের কুয়ার দিকে চলে যায়। ঝুপসি মাদার গাছের নিচে অন্ধকারে বসে থাকে ভবা। খানিক পরে জল ভরা বালতি নিয়ে এসে পাথরের উপরে নামায় ঝিনুক। ভবার চোখের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে — কী গো? জ্বর নাকি? সে কপালে হাত রাখে স্বামীর। ঠান্ডা। অস্বাভাবিক শীতল সেই কপালে হাত রেখে ঝিনুক চমকে ওঠে আবার। স্বামীর ঘোলাটে-লাল চোখের দিকে তাকায় আর শোনে দূর থেকে একটা ভুটভুট ইঞ্জিনের শব্দ ক্রমশ নিকট হচ্ছে। ভবা হঠাৎ ঝিনুকের হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় ঝুপসি অন্ধকার ঘরের ভেতরে। দরজাটা টেনে ভেজিয়ে দিয়ে ঘামতে থাকে। জানলার বাইরের ঘন অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে — “শুন্, একটা কথা বলব তোকে”। ঝিনুকের ভিতর তোলপাড় করে খোড়ো চালের উপরে অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসে। মাথার উপরে কোনও ভয়ঙ্কর অজানা মেঘ ধোঁয়ার মতো জমে ওঠে — “কাউকে বলবি নাই কুনু দিন, এই আমার গা ছুঁয়ে বল…” — ভবার গলার স্বরে একটা কিছু ছিল। ঘরের কোনায় রাখা কেরোসিনের কুপিটা দপ দপ করে ওঠে। ঝিনুক থরথর করে পাখির বাসার মতো কেঁপে ওঠে — “না, বলব নাই কারুকে, বল…” ভবা লুঙ্গি পরতে পরতে বলে — “বলব দাঁড়া, সময় নাই বেশি, পেটে আবার মুচাড় দিচ্চে, পুকুর ঘাট থেকুন ঘুরে আসি আগে…” ভবা ঘরের পিছন দিকে দৌড়ে যায়, অন্ধকারে ঝোপজঙ্গলের আড়ালে তাকে আর দেখতে পায় না ঝিনুক।

লোকগুলো ঘন বাবলা ঝোপের অন্ধকারের ভিতর মিশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভবা পুকুরপাড় অব্দি যেতে পারে না আর। অন্ধকারের ভেতর থেকে হঠাৎ সামনে দুটো মূর্তি উঠে দাঁড়াতেই ভবা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। পেটের ভেতরের মোচড় তার অজান্তেই পায়ুপথে বার হয়ে আসে। শরীরের ভেতর একটা কিছু ঘটে যাচ্ছিল তার। মস্তিষ্কের নির্দেশ ছাড়াই সম্ভবত তার শরীরক্রিয়াজনিত অভ্যাস তাকে উল্টো দিকে দৌড় করায়। কারণ ভবার মস্তিষ্ক তখন তার দখলের বাইরে ছিল সম্ভবত। ভবা দৌড়তে থাকে খানা খন্দ জমির আল ভেঙে, বাগদিপাড়ার পিছনের ঝোপঝাড় ভেঙে ভাঙাশিমূলতলার দিকে। অন্ধকার বাগদিপাড়ার জিতেন বাগদির উঠোনের ভেতর দিয়ে সে দৌড়য়, পিছনে তাকাবার কোনও ফুরসৎ নেই, জিতেন বাগদি চিৎকার দেয় — “কে রে? কে যায় অন্ধকারে?” — “আমি ভবা, গনু বাগদির ব্যাটা…” — “অমন দৌড়াস ক্যেনে রে…?”… ভবার কানে গেলেও তার শ্বাসথলি তথা ফুসফুস প্রায় গলার কাছে এসে ঠেকায় উত্তর দেবার যন্ত্র ক্রমশ বিকল হয়ে আসছিল। সামনে ঝোপঝাড়-জোড়া একটা মাঠ পেরোলেই ভাঙাশিমূলতলার মোড়, ওখানে আলো, দোকান, লোকজন… ভবা দৌড়াতে থাকে, তার কপালের শিরা উপশিরা অন্ধকারে দপদপ করতে থাকে। পায়ের তলায় ধান কেটে নেওয়া মাঠের শূন্যতা । একটা ছোটো আল লাফিয়ে ডিঙোতে গিয়ে পায়ে হোঁচট খায় ভবা। লুঙ্গির গিঁট খুলে পায়ে জড়িয়ে যায়। দ্রুত দৌড়তে থাকা শরীরটা ক্ষণিকের জন্য সম্পূর্ণ শূন্যে ভাসমান হয়…

…সন্ধ্যার অন্ধকারে মাদার গাছের তলায় ঝিনুকের কাঁচা মাটির মতো মুখের উপরে চুলের গুছি হাওয়ায় উড়ছে, অন্ধকারের জন্য তার চোখের দৃষ্টি বোঝা যায় না। তার হাবা ছেলেটা হামা দিয়ে উঠোন পেরিয়ে যায়, তার কালা বুড়াবাপ উদাস বসে থাকে দাওয়ায়, মাদার তলার পাথর, পাথরের উপরে জলের বালতি খোলা অন্ধকার আকাশের দিকে চেয়ে থাকে, মাটির চৌকাঠ, চৌকাঠ পেরিয়ে ঝুপসি ঘর, মাটিতে পাতা বিছানা, বিছানার পাশে জলের কলসি, পিঁপড়ের সারি মাটির দেওয়াল বেয়ে দীর্ঘ সারি দিয়ে উঠে যাচ্ছে বাঁশের মদুনের দিকে… দত্তপুকুরের জলে ধ্রুবতারা তির তির করে কাঁপতে থাকে…

শূন্যে ভাসমান ভবা অন্ধকারের ভেতর মাটির উপর আছড়ে পড়ে…

***

কোনও নিউজ চ্যানেল বা সংবাদপত্রে খবরটা ছোট করেও কভারেজ না পাওয়ায় স্থানীয় থানার আইসি মনে মনে খানিকটা নিশ্চিত হয়। আইসি সাহেব ঝিনুকের সঙ্গে আর গনু বাগদির সঙ্গে দুদিন কথা বলে নিশ্চিত হয় এরা সত্যিই কিছু জানে না। নাঃ ঝিনুক কোনও কথাই বলে না। সে তার নিরক্ষর বুঝ দিয়ে বহুদূর বুঝে নিয়ে চুপ করে থাকে আর তার চোখ ভিজে ওঠে। প্রথমবার জ্ঞান হারানোর পর যখন তার জ্ঞান ফিরে আসে, সে উঠে বসে তার শাড়ি গাছকোমর করে বেঁধে নেয়। এখনো সেভাবেই আছে। বাচ্চাটা উঠোনে হামা দেয়। নুয়ে পড়া নিমগাছের ডাল থেকে হলুদ পাতা খসে পড়ে মাদার তলায় রাখা বালতির জলে। তবু আইসি সাহেবের নিজস্ব একটা খটকা থেকেই যায়। এরকম একটা কেসে সে কোনও দিকেই কোনও আন্দাজ পায় না। ভবার মতো একটা অতি নিরীহ লোয়ার কাস্ট হতদরিদ্রকে এমনভাবে মরতে হল কেন, সে নিজেও ভেবে পায় না। ওপরতলা, নিচতলা, পাবলিক, কোনও দিক থেকেই কোনও চাপ নেই কেসটাতে। আইসি সাহেব একটা অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করেন। সাক্ষী-হীন অন্ধকার ঘটনার মামলা। আর ঋতুপরিবর্তনের মেঘ বাগদিপাড়ার উপর দিয়ে ভেসে ভেসে যায়। পশ্চিমবঙ্গের আকাশে মৌসুমী বায়ু এসে পড়ে।

মৌসুমী বায়ু ফিরে যায়।

বছর ঘুরে যায়…

ঝিনুক তেলিপাড়ার দত্তদের বাড়ি খামারে ধান ঝাড়তে যায়। তার হাবা ছেলেটার বয়স প্রায় একবছর বেড়ে যায়। ঝিনুক ধান ভরা আঁটি দুহাতে ধরে শূন্যে তুলে আছাড় মারে নোয়ানো তক্তার উপর আর অসহায় স্বর্ণধান ঝরে ঝরে পড়ে। হাবা বাচ্ছাটা খামারের এক ধারে বসে জামবাটি থেকে মুড়ি খায়। -– কী বলতে চেয়েছিল সে? কী বলত, যদি ফিরে আসত একবার? ধান-শূন্য আঁটি খড়ের গাদায় জমা হয় একপাশে। ঝিনুক কতবার ভেবেছে, যখন সন্ধ্যাবেলা ঘরে ফিরে যায় ভাঙাশিমূলতলার পিছনের মাঠ দিয়ে। আল পেরিয়ে যায় যখন হাবা ছেলেটাকে, ভবার হাবা ছেলেটাকে কোলে নিয়ে, এত যে কথা, এত যে গাঁয়ের লোকের মুখে শোনা, ছোট থেকে শোনা ভয়ের কথা, কৈ, একবারও তো সে সামনে এসে দাঁড়ায় নাই। যদি অন্ধকারের ভিতর একবার এসে দাঁড়ায়? ঝিনুক ভাবে, সে কী বলবে? ঝিনুক ঝরে পড়া ধানের স্তুপের উপর কুলোর বাতাস দেয়। টুকরো খড়ের কুটি কুলোর বাতাসে উড়ে যায়…। সন্ধ্যার গোড়ায় সে ছেলেটাকে কোলে নিয়ে ঘরের পথে পা বাড়ায়।

***

বর্ষার শেষে তেলিপাড়া যাবার লালমাটির পথের দুধারে ধানক্ষেতগুলি ফনফনিয়ে উঠেছে। আদিগন্ত যেদিকে দুচোখ যায় — সবুজ। আলপথগুলিও সবুজ ঘাসে ঢেকে আছে। রাস্তার পাশে সরু খাল দিয়ে জল বয়ে যাছে জমিতে। দূরে দত্তপুকুরের দিক থেকে পাম্প মেশিনের অস্পষ্ট একটা ভুটভুট শব্দ হাওয়ায় ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। মাঠের আলপথ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে সে একবার দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ আগেই সূর্য অস্ত গেছে। সে ভাবে — এইবার অন্ধকার নেমে আসবে। ততক্ষণ এইখানে আলের উপরে বসে থাকা যাক। এই পথে ঝিনুক ফিরবে তার হাবা ছেলেটাকে কোলে করে। সে আপ্রাণ চেষ্টা করে তার বায়বীয় শরীরটাকে হাওয়ার মধ্যে একবার আগের চেহারায় ফুটিয়ে তোলার। ঐ ঝিনুক আসছে। কিছুদূর এসে একটা বাবলা গাছের নিচে থামকে দাঁড়িয়ে পড়ে ঝিনুক। তার হাবা ছেলেটা একবার কঁকিয়ে কেঁদে ওঠে। ওরা কি তাকে দেখতে পেয়েছে! সে চিৎকার করে ডাকার চেষ্টা করে কিন্তু বিগত জীবনের মূক স্বভাবে তার গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরোয় না। ঝিনুক হনহন করে সন্ধ্যার অন্ধকারে বাগদিপাড়ার দিকে মিলিয়ে যায়।

রাত্রি গভীর হওয়া পর্যন্ত সে অপেক্ষা করে প্রতিদিন। তেলিপাড়ার দিক থেকে তিনটে মোটর বাইক অন্ধকারে হেডলাইট জ্বালিয়ে ধীর গতিতে হাইরোডের দিকে চলে যায়। ওরা গভীর রাত্রে এই পথ দিয়ে ফিরে যাবে আবার। সে রোজ বসে বসে দেখে এইসব আর প্রতিদিন ঘটনার পুনর্নির্মাণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। মধ্যরাত্তিরে এই ফনফনিয়ে ওঠা আদিগন্ত সবুজ মাঠ ফসলহীন ফাঁকা ধু-ধু করে দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়িয়ে দেয় সে। ভাঙা চাঁদের ওপরে একটা ছেঁড়া ময়লা কাঁথার মতো মেঘ ঝুলিয়ে দিয়ে আরও অন্ধকার করে দেয় চরাচর। তারপর দৌড়তে থাকে। দৌড়তে থাকে খানা খন্দ জমির আল ভেঙে, বাগদিপাড়ার পিছনের ঝোপঝাড় ভেঙে ভাঙাশিমূলতলার দিকে। অন্ধকার বাগদিপাড়ার জিতেন বাগদির উঠোনের ভেতর দিয়ে সে দৌড়য়, পিছনে তাকাবার কোনও ফুরসৎ নেই, সামনে ঝোপঝাড়-জোড়া একটা মাঠ পেরোলেই ভাঙাশিমূলতলার মোড়। তার কপালের শিরা উপশিরা অন্ধকারে দপদপ করতে থাকে। পায়ের তলায় ধান কেটে নেওয়া মাঠের শূন্যতা। সে দৌড়ায়। আর গভীর রাত্তিরে হাইরোডের দিক থেকে ভুটভুট শব্দ ভেসে আসে। ভবা দৌড়ায়… আলের পর আল পেরিয়ে সে দৌড়তে থাকে হার্ডলের ঘোড়ার মতো। ভাঙাশিমূলতলার দিকে। তারপর হঠাৎ ম্যাজিকের মতো তার অশরীর শূন্যে ভাসমান হয়ে যায়। ভবা আবার — আবার ব্যর্থ হয়। শূন্যে ভেসে থেকে সে দেখে — চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে সুন্দর পৃথিবী। সুন্দর সবুজ শস্যখেত। ধানের উপর ঢেউ খেলে যাওয়া বাতাস। দত্তপুকুরের থেকে একটা পাম্প অদ্ভুত শব্দ করে জল তুলে যাচ্ছে সারা রাত। ভবা আলের উপরে বসে পড়ে। পুনরায় অপেক্ষা করে।

…সে উপরের দিকে চায়, দেখে অন্ধকার আকাশ আসলে অন্ধকার নয় ঠিক। সেখানে এক অন্যরকম আলো রয়েছে। সূর্য ডুবে যাওয়ার অনেক পরেও বহুদূর মাঠে মাঠে কেটে নেওয়া গতবছরের ধানের গোড়া সেই আবছা আলোয় জেগে আছে। একটা ঠান্ডা হাওয়া বয়ছে। ঠান্ডা হাওয়া অল্প শিউর জাগায় তার শরীরে। তার শরীর ধীরে ধীরে আরও ঠান্ডা হয়ে যায়। মানুষের শরীরের ভিতরে যে আগুন, যে বহ্নিমান অলৌকিক মেশিন, তা নিভে গেছে বহুদিন, সে দেখে, অনেক দূরে কোনও নক্ষত্রলোকের ওপারে ভাঙাশিমূলতলার আলোগুলো নিভে যাচ্ছে আবার… রাত গভীর হচ্ছে। ভবা ঘটনার পুনর্নির্মাণের জন্য পুনরায় প্রস্তুতি নেয়, উঠে দাঁড়ায়…