Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মোদিজির রাফাল ডিল— ডাল মেঁ কুছ কালা হায়!

অমিত দাশগুপ্ত

 

সূচনা : বোফর্স কেলেঙ্কারি

অন্য দেশের সঙ্গে পুরোদস্তুর যুদ্ধ লাগুক না লাগুক, যুদ্ধের অস্ত্র কেনা নিয়ে শাসক ও বিরোধী দলের বাগযুদ্ধ এদেশে গত ৩ দশকের বেশি সময়কাল ধরেই নিয়মে পরিণত হয়েছে। গত শতাব্দীর ৮০র দশকের মাঝামাঝি সময়ে শুরু হয়েছিল সুইডেনের বোফর্স কোম্পানির কাছ থেকে হাউইৎজার কামান কেনা নিয়ে রাজীব গান্ধির ঘুষ খাওযার অভিযোগ। শ্লোগান উঠেছিল, রাজীব গান্ধি চোর হায়। সেই বোফর্স কেলেঙ্কারি থেকেই পতন শুরু হয়েছিল কংগ্রেসের। ভাঙন ধরেছিল কংগ্রেসে, বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং সঙ্গ ছেড়েছিলেন রাজীবের। তখনও বিজেপির শক্তি নেই তেমন কোনও। কিন্তু বোফর্সের কামানের গোলাগুলির শব্দ পেতে যদিও কারগিল যুদ্ধ অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছিল, কামান কেনার দালালির সঙ্গে নাম জড়িয়ে রাজীব তথা কংগ্রেসের পতন ঘটেছিল অতি দ্রুত। বোফর্স পরবর্তীতে কংগ্রেস তিন তিন বার সরকার গড়লেও কখনওই সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। কেবল তাই নয, বোফর্স পরবর্তীতে ৮টি লোকসভা নির্বাচনের ৫টিতেই কংগ্রেস সরকার গড়তে পারেনি। অন্যদিকে বোফর্স পরবর্তীতে বিজেপির উত্থান হয়েছে দ্রুত। ওই ৮টি নির্বাচনেরর মধ্যে ৪টিতেই তারা বৃ্হত্তম দল হিসেবে উঠে আসে, তার মধ্যে সর্বশেষটিতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাও লাভ করে। ফলে ভারতীয় রাজনীতিতে বোফর্স কেলেঙ্কারিকে একটি জলবিভাজিকা রেখা হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।

ক্ষমতাবানদের সব ছাড় : ব্যতিক্রম লালুপ্রসাদ যাদব

কিন্তু বোফর্স কেলেঙ্কারিকে নিয়ে গলি গলি মে শোর হ্যায় রাজীব গান্ধি চোর হ্যায় আওয়াজ তোলার পরেও পাঁচ পাঁচটি অকংগ্রেসি সরকার এলেও সিবিআই তদন্ত করে কোনও কিছুই প্রমাণ করতে পারেনি, অবশ্য অপ্রমাণও কিছু হয়নি। ভারতীয় রাজনীতিকদের দুর্নীতির দায়ে শাস্তি দেওয়া খুবই কঠিন। কোনও কিছুই প্রমাণ হয় না, যদি শাসকের সঙ্গে একটু আপস করা যায়। বোফর্সে রাজীব, হাওলায় নরসিংহ রাও, সাংসদ কেনাবেচায় শিবু সোরেন, নারদা-সারদা-রোজভ্যালিতে তৃণমূল, কফিন কেলেঙ্কারিতে জর্জ ফার্নান্ডেজ, সঙ্গতিহীন সম্পদে মুলায়ম সিং বা মায়াবতী, ২জি কেলেঙ্কারিতে এ রাজা-কানিমোঝি, কমনওয়েলথ গেমস দুর্নীতিতে সুরেশ কালমাদি, গুজরাট গণহত্যায় নরেন্দ্র মোদি, সোহরাবুদ্দিন শেখ হত্যায় ও বিচারক লয়ার মৃত্যুতে অমিত শাহ, কেউই দোষী সাব্যস্ত হননি। সকলেই ধোয়া তুলসিপাতা। ব্যতিক্রম কেবল লালুপ্রসাদ যাদব। কারণ তিনি আদবানির রথ রুখেছিলেন ও সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে বিজেপির সঙ্গে আপস করেননি।

রাফাল যুদ্ধ বিমান কেনা— ডাল মেঁ কুছ কালা!

ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া হয়ে গেল। হচ্ছিল যুদ্ধাস্ত্র কেনা নিয়ে দুর্নীতির কথা। বোফর্সের পরে অগস্টা ওয়েস্টল্যান্ড হেলিকপ্টার কেনা নিয়ে মাঝে কিছু হৈচৈ হয়েছিল, এখনও মাঝে মাঝে সেই জুজু দেখানো হয়, কিন্তু পর্বত মূষিক প্রসব করে, যথারীতি। তাছাড়া সেসব তো অবিজেপি দলগুলির, বিশেষত কংগ্রেসের দুর্নীতি, যার বিরুদ্ধে সাধুসন্তরা, রামদেব-শ্রী শ্রী রবিশঙ্কর-আন্না হাজারে-কিরণ বেদি-কেজরিওয়ালরা রামলীলা ময়দানে যুদ্ধ করতেন। বিজেপি তো দুসরি কিসিমের পার্টি, তারা তো কোনও দুর্নীতি করে না (তবে জয় শাহ-র বিক্রি এক বছরে ১৬০০ গুণ বাড়ে)। ফলে মোদি-শাহ-জেটলিরা অস্ত্রশস্ত্র কিনলে দেশের কথা ভেবেই কেনেন, সেখানে অন্য কোনও স্বার্থ দেখা হতেই পারে না। ভারতের সামরিক শক্তিকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য ও ‘যুদ্ধবাজ’ দুই শত্রু প্রতিবেশীর সঙ্গে যুদ্ধে টক্কর দেওয়ার লক্ষ্যে আগেই যুদ্ধাস্ত্রে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ ৪৯% পর্যন্ত করার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল (যদিও তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য বিদেশি বিনিয়োগ হয়নি), পাশাপাশি যুদ্ধাস্ত্রও বিদেশ থেকে কেনা হচ্ছে। তেমনই এক যুদ্ধাস্ত্র, অত্যাধুনিক ফাইটার বিমান হল ‘রাফাল’, যা ফরাসি দেশের দাসাউ কোম্পানি তৈরি করে। ভারত সরকার তেমন ৩৬টি বিমান কেনার বরাত দিয়েছে ওই কোম্পানিকে, শোনা যাচ্ছে, মাত্র ৫৯/৬০ হাজার কোটি টাকার বিনিময়ে। অবশ্য যেহেতু দাম মেটাতে হবে ইউরো মুদ্রায় তাই টাকার দাম ক্রমাগত কমে গেলে টাকার অঙ্কে তা বাড়তেই থাকবে। সে যাক গিয়ে। ফলে প্রতিটি বিমানের দাম পড়ছে গড়ে ১৬৬০/১৬৭০ কোটি টাকা। ওই রাফাল বিমান কেনা নিয়েই তুমুল বাদবিতণ্ডা শুরু হয়েছে, প্রায় বোফর্সের মতোই। বিরোধী দলগুলি, বিশেষত কংগ্রেস পুরো বরাতটাকে নিয়ে, দাম, পদ্ধতি, আম্বানিদের সুবিধে সব কিছু নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। অবশ্য পুরো বিষয়টিকে খতিয়ে দেখলে মনেই হবে যে ডাল মেঁ কুছ কালা হ্যায়।

রাফাল বিমান ক্রয় সংক্রান্ত চুক্তির ঘটনাক্রম

১. ওই যুদ্ধ বিমান কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে, ২০০৭ সালের ২৭ আগস্ট। ভারতীয় বায়ুসেনার নির্দিষ্ট প্রয়োজন অনুযায়ী, তৎকালীন সরকার ১২৬টি মিডিয়াম মাল্টি রোল কমব্যাট বিমান (এমএমআরসিএ) কেনার উদ্দেশ্যে প্রস্তাবের অনুরোধ (আরএফপি) প্রকাশ করে। ওই আরএফপি অনুসারে দরের মধ্যে প্রাথমিক ক্রয়, প্রযুক্তি হস্তান্তর, উৎপাদনের অনুজ্ঞা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে বলে দেওয়া হয়েছিল। ৬টি বিক্রেতার মধ্যে উড়ানের ট্রায়াল ও কৃৎকৌশল বিবেচনা করে ভারতীয় বায়ুসেনা ইউরোফাইটার-এর টাইফুন ও দাসাউ-এর রাফালকে নির্দিষ্ট করে।

২. শেষে দামের দিক থেকে বিবেচনায ২০১২ সালে সিদ্ধান্ত হয় যে তুলনামূলকভাবে কম দামী রাফাল বিমান কেনা হবে ১২৬টি। ইতিমধ্যে ২০১৪ সালে ইউপিএ সরকার চলে গিয়ে এনডিএর মোদিজি ক্ষমতায় এসেছে। তবুও বিমান কেনার জন্য আলোচনা দরকষাকষি চলতে থাকে ও তা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়।

৩. ইতিমধ্যে ৪ জুলাই, ২০১৪ তারিখে ইউরোফাইটার তাদের পূর্বের প্রস্তাবিত মূল্যের থেকে ২০% কম দামে বিমান বিক্রির নুতন প্রস্তাব বিবেচনা করার জন্য তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী অরুণ জেটলির কাছে প্রস্তাব পাঠায়।

. ২০১৫ সালের মার্চ মাসের ২৫ তারিখে সংবাদ সংস্থার প্রতিনিধিদের দাসাউ-এর মুখ্য অধিকর্তা এরিক ট্রাপিয়ার বলেন যে, প্রতিযোগিতার সমস্ত নিয়ম অনুসরণ করে আরএফপির সঙ্গে সাযূজ্য বজায় রেখে হ্যাল-এর সঙ্গে দায়িত্ব বিভাজন সংক্রান্ত বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছে। অতি শীঘ্রই চুক্তি সম্পাদিত হবে। কিন্তু সেই চুক্তি সম্পাদিত হয় না। ওই কোম্পানির সঙ্গেই ওই রাফাল বিমান কেনার চুক্তিই হয়, তবে ১২৬টি নয়, ৩৬টি। পূর্বতন বোঝাপড়ায় দাসাউ ১৮টি সম্পূর্ণ বিমান বিক্রি করত, সাথে ১০৮টি বিমান তৈরি হত হিন্দুস্তান এয়ারোনটিকস লিমিটেড (হ্যাল)-এর কারখানায় প্রযুক্তি হস্তান্তর চুক্তির মাধ্যমে। এর ফলে হ্যাল উন্নত উৎপাদন ক্ষমতাও পেত যার দ্বারা অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান তৈরিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারত। পাশাপাশি রাফাল বিমানগুলিকে তাদের ৩০-৪০ বছরের জীবৎকালের পরিষেবা দেওয়ার সুযোগও পেত হ্যাল।

তবে ওই পূর্বতন বোঝাপড়ায় ২০০৭ সালে আরএফপি প্রকাশের সময়ে ৪২,০০০ কোটি টাকার কথা উল্লেখ থাকলেও, ২০১৫ সালের মার্চে তা কত টাকায় সম্পাদিত হত তা নির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়।

৫. যথাক্রমে ২৫ মার্চ ও ২৮ মার্চ, দুটি কোম্পানি নিবন্ধিকৃত হয়, আদানি ডিফেন্স সিস্টেম অ্যান্ড টেকনোলোজিস লিমিটেড (এ্যাডস্যাট লি.) ও অনিল আম্বানির রিলায়েন্স ডিফেন্স লিমিটেড (আরডিএল)।

৬. ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল ভারতের বিদেশসচিব এস জয়শঙ্কর সাংবাদিকদের বলেন যে, প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ফ্রান্স সফরের আলোচ্য সূচিতে রাফাল যুদ্ধবিমানের প্রসঙ্গ থাকার কোনও কারণ নেই কেননা, সে ব্যাপারে প্রতিরক্ষামন্ত্রক, হ্যাল ও ফরাসি কোম্পানির মধ্যে আলোচনা চলছে। বিদেশসচিবের বক্তব্যকে অনুসরণ করলে বলা যায় যে, রাফাল নিয়ে আসল আরএফপির ভিত্তিতে, হ্যালকে চুক্তির মধ্যে রেখে আলোচনা চলছে এবং প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে কোনও চুক্তি তো দূরের কথা আলোচনাও করবেন না।

৭. কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তার ২ দিন পরে প্রধানমন্ত্রী স্বতঃপ্রণোদিতভাবে ঘোষণা করলেন যে, সম্পূর্ণ নূতন বোঝাপড়া হতে চলেছে ও ৩৬টি সম্পূর্ণভাবে ফ্রান্সে তৈরি রাফাল বিমান কেনা হবে।

৮. ১০ এপ্রিল, ২০১৫-তে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি (অলাঁদ)-এর যৌথ বিবৃতি অনুযায়ী জানা যায় যে, অন্য যে প্রক্রিয়ায় দাসাউ ও ভারত সরকারের মধ্যে বিমান কেনার কথাবার্তা চলছিল তার থেকে উন্নত শর্তে বিমান যোগানের একটি আন্তর্সরকার চুক্তি হবে যেখানে ভারতীয় বায়ুসেনার কার্যকরী প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সামঞ্জস্যমূলক সময়সীমার মধ্যে বিমান সরবরাহ করা হবে এবং ভারতীয় বায়ুসেনা দ্বারা ইতিমধ্যে পরীক্ষিত ও অনুমোদিত বিমান, সহযোগী যন্ত্রপাতি এবং অস্ত্রসমূহ সমেত সরবরাহ করা হবে এবং রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে অধিক সময়কালীন দায়িত্ব থাকবে ফ্রান্সের।

সুতরাং, উপরোক্ত যৌথ বিবৃতি অনুযায়ী বিমানের দাম আগের থেকে কম থাকবে ও বিমান ও তার অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র বায়ুসেনা কর্তৃক আগেই অনুমোদিত হওয়া বন্দোবস্তের অনুরূপ হবে।

৯. কিন্তু, ২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল দূরদর্শনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকার বলেন যে ১২৬টি বিমান কিনলে তার দাম পড়বে প্রায় ৯০,০০০ কোটি টাকা। ফলে, প্রতি বিমানের দাম গড়ে ৭১৫ কোটি টাকার মতো। যদিও এর মধ্যে ১৮টি ফ্রান্সে তৈরি হত, আর ১০৮টি এদেশে। ফলে, এদেশের বিমানগুলির দাম বেশি পড়ত, কেননা উৎপাদনের বন্দোবস্ত, প্রযুক্তি হস্তান্তরের জন্য ব্যয় বেশি হত। সুতরাং, ওই সাক্ষাৎকারকে অনুসরণ করলে বলা যায় যে, ফ্রান্সে তৈরি প্রতিটি বিমানের দাম কিছুতেই ৭১৫ কোটি টাকার বেশি হতে পারে না। এবং পারিকারের কথা অনুযায়ী ওই দাম সব কিছু অন্তর্ভুক্ত করে।

১০. ২০১৬ সালের ১ এপ্রিল সরকার প্রতিরক্ষা খাতে বিদেশি অস্ত্র ক্রয় সংক্রান্ত নীতিতে মোট ব্যয়ের ৫০% দেশীয় অর্থনীতিতে ব্যয়ের (অফসেট) ক্ষেত্রে সমস্ত অফসেট প্রস্তাবে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর অনুমোদন বাধ্যতামূলক করেছে।

১১. ২০১৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ফরাসি ও ভারত সরকারের মধ্যে ৩৬টি রাফাল বিমান কেনার সরকারি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

১২. ২০১৬ সালের ১৮ নভেম্বর প্রতিরক্ষা দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী ড. সুভাষ খারে লোকসভায় একটি প্রশ্নের উত্তরে জানান যে, প্রতিটি ৬৭০ কোটি টাকা মূল্যে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, অস্ত্রশস্ত্র ও পরিষেবা সমেত ৩৬টি রাফাল বিমান কেনার জন্য ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ তারিখে একটি আন্তর্রাষ্ট্রীয় চুক্তি ফরাসি প্রচান্ত্রিক সরকারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত হয়েছে। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে সব কটি বিমান সরবরাহ করা হবে।

১৩. সরকারি স্তরে চুক্তি সই হওযার ৭ মাস বাদে, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭-য় দাসাউ ও রিলায়েন্স ডিফেন্স, দাসাউ রিলায়েন্স এয়ারোস্পেস লিমিটেড (দ্রাল) নামক একটি যৌথ উদ্যোগ নিবন্ধিকরণ করে, যেখানে রিলায়েন্স ডিফেন্সের ৫১% ও দাসাউ-এর ৪৯% মালিকানা থাকবে এবং অনিল আম্বানি মুখ্য অধিকর্তা হবেন। ফলে ভারতে যে অফসেট ব্যবসা করা হবে তার সিংহভাগ এই নতুন উদ্যোগের হাতে থাকবে।

১৪. ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখে রিলায়েন্স ডিফেন্স সংবাদমাধ্যমে জানায় যে, দাসাউ ও রিলায়েন্স ডিফেন্স, দাসাউ রিলায়েন্স এয়ারোস্পেস লিমিটেড (দ্রাল) নামক একটি যৌথ উদ্যোগ নিবন্ধিকরণ করেছে এবং ৭.৮৭ বিলিয়ন ইউরো বা ৬০০০০ কোটি টাকার যে ৩৬টি রাফাল বিমান সরবরাহের চুক্তি হয়েছে সেই চুক্তি থেকে উদ্ভুত ৩০,০০০ কোটি টাকার অফসেট কর্মসূচির নেতৃত্ব দেবে দ্রাল।

উপরোক্ত ঘটনাক্রমে বেশ কিছু অসঙ্গতি যা নিচের প্রশ্নগুলির জন্ম দিচ্ছে

ক. রাফাল বিমানের ক্রয়মূল্য কত? ঘটনাক্রমের ৯ নং অনুযায়ী তা ৭১৫ কোটি টাকার বেশি নয়। ঘটনাক্রমের ১২ নং অনুযায়ী তা ৬৭০ কোটি টাকা। ১৪ নং অনুযায়ী ১৬৭০ কোটি টাকা। কেবল তাই নয়, আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদের ভাষ্য অনুযায়ী বিমানের দাম ইউপিএ-র বোঝাপড়া থেকে ৯% কম, অরুণ জেটলির কথায় ২০% কম।

খ. প্রধানমন্ত্রী কিসের ভিত্তিতে ১০ এপ্রিল, ২০১৫-য় ৩৬টি রাফাল বিমান ক্রয় সংক্রান্ত যৌথ বিবৃতি (ঘটনাক্রম ৮) দিলেন? বিদেশসচিব ৮ এপ্রিল, ২০১৫ তারিখে সংবাদমাধ্যমকে যা বললেন (ঘটনাক্রম ৬) তা মিথ্যে না ভুল? প্রতিরক্ষামন্ত্রী কেন কিছু জানতেন না (ঘটনাক্রম ৯)? বিবৃতি প্রদানের আগে কি নিরাপত্তা সংক্রান্ত ক্যাবিনেট কমিটির অনুমোদন নেওযা হয়েছিল? ভারতীয় বায়ুসেনার প্রয়োজন ছিল ১২৬টি যুদ্ধবিমান, তার সংখ্যা কোন ভিত্তিতে কমে ৩৬টিতে দাঁড়াল?

গ. যেহেতু এটি একটি নূতন ক্রয় প্রকল্প, তাই নূতন করে দরপত্র কি চাওয়া হয়েছিল, অরুণ জেটলিকে ইউরোফাইটার যে ২০% দর কমিয়ে দরপত্র দিল (ঘটনাক্রম ৩) সেটি কি বিবেচনা করা হয়েছিল?

ঘ. পুরো চুক্তি থেকে হ্যালকে বাদ দেওয়া হল কেন, যখন দাসাউ-এর প্রধান বলেছিলেন যে, প্রতিযোগিতার সমস্ত নিয়ম অনুসরণ করে আরএফপির সঙ্গে সাযুজ্য বজায় রেখে হ্যাল-এর সঙ্গে দায়িত্ব বিভাজন সংক্রান্ত বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছে (ঘটনাক্রম ২)? হ্যালকে বাদ দেওয়ার মধ্য দিয়ে ভারত সরকারের একটি নবরত্ন সংস্থার থেকে প্রযুক্তি হস্তান্তর চুক্তির মাধ্যমে উন্নত উৎপাদন ক্ষমতা, যার দ্বারা হ্যাল অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান তৈরিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারত (ঘটনাক্রম ৪), পাওয়ার সম্ভাবনা কেড়ে নেওয়া হল কেন?

ঙ. অনিল আম্বানির রিলায়েন্স কী করে অফসেট কর্মসূচির সিংহভাগ বরাত পেতে চলেছে (ঘটনাক্রম ১৪)?

কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য, লোকসভা না অনিল আম্বানি?

উপরোক্ত প্রশ্নগুলির কোনও সদু্ত্তর পাওযা যাচ্ছে না মোদি সরকারের কাছ থেকে। উপরন্তু বিমানের দাম সংক্রান্ত প্রশ্নের ক্ষেত্রে সরকার প্রতিরক্ষা চুক্তিতে গোপনীয়তার কথা বলে যারা প্রশ্ন করছেন তাদের অ্যান্টি-ন্যাশনাল বলছেন ও তাদের বিরুদ্ধে দেশের প্রতিরক্ষা দুর্বল করার অভিযোগ আনছেন। বোঝা যাচ্ছে না কীভাবে বিমানের দাম প্রকাশ করলে বিমানের কারিগরি ও তার গোপনীয়তা জানা সম্ভব? উপরন্তু রিলায়েন্স ডিফেন্সের সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া বিবৃতিতে বিমানের মূল্য জানা যাচ্ছে কিন্তু লোকসভায় তা জানানো যবে না কেন তা বোঝা যাচ্ছে না ফলে মনেই হতে পারে মোদিজির কাছে অনিল আম্বানি লোকসভার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভরশীল।

চাবুকের দাম ঘোড়ার দামের দেড়গুণ

দ্বিতীয়ত, ৬৭০ কোটি টাকা দামের বিমান কোন ভিত্তিতে ১৬৭০ কোটি টাকায় রূপান্তরিত হল তাও বোঝা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে শাসক পক্ষের ব্যাখ্যা হল যে, বিমানে ভারতের চাহিদা অনুযায়ী অনেকগুলি বিশেষ অস্ত্রশস্ত্র ও বন্দোবস্ত রাখার জন্য দাম বেড়েছে। প্রথমত, ১০ এপ্রিল, ২০১৫-র ভারত-ফ্রান্স যৌথ বিবৃতি অনুযায়ী, বিমান ও তার অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র বায়ুসেনা কর্তৃক আগেই অনুমোদিত হওয়া বন্দোবস্তের অনুরূপ হবে (ঘটনাক্রম ৮) এবং ২০১৬ সালের ১৮ নভেম্বর প্রতিরক্ষা দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী ড. সুভাষ খারের লোকসভায় প্রদত্ত উত্তর অনুযায়ী, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, অস্ত্রশস্ত্র ও পরিষেবা সমেত প্রতিটি রাফাল বিমানের দাম ৬৭০ কোটি টাকা (ঘটনাক্রম ১২)। তাহলে অতিরিক্ত ‘বিশেষ’-এর কথা আসছে কোথা থেকে? এছাড়া ৬৭০ কোটি টাকা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, অস্ত্রশস্ত্র ও পরিষেবা সমেত বিমানের দাম আর তার ‘অতিরিক্ত বিশেষ’ এর দাম ১০০০ কোটি টাকা! চাবুকের দাম ঘোড়ার দামের দেড়গুণ?

প্রয়োজনীয় যুদ্ধবিমানের সংখ্যা সম্পর্কে কে বেশি ওয়াকিবহাল, বায়ুসেনা না প্রধানমন্ত্রী?

তৃতীয়ত, যে ২০০৭ সালের আরএফপির ভিত্তিতে বিমান কেনার পর্যায়টি শুরু হয়েছিল, সেটিকে অগ্রাহ্য করেই যখন বিমান কেনা হল তখন নূতন দরপত্র আ্হ্বান করা হল না কেন, যখন ইউরোফাইটার তাদের টাইফুন বিমানের দাম ২০% কমানোর কথা অনেক আগেই তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে জানিয়েছিল (ঘটনাক্রম ৩)। ২০১৪ সালের ৪ জুলাই যে প্রস্তাব সে সম্পর্কে কোনও বিবেচনা ছাড়াই, ৯ মাস পরে তড়িঘড়ি সরকারিভাবে কাউকে না জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী একক বিবেচনায় ভারতের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত এত বড় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেন। মনে হচ্ছে দেশে একনায়কতন্ত্র  চলছে। সেই দেড় জনের সরকার। মনে পড়ে যাচ্ছে একক সিদ্ধান্তে নোট বাতিলের কথা ও তার পরিণাম। এমনই প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনা যে, বায়ুসেনার বিমানের প্রয়োজন এক ধাক্কায় ১২৬ থেকে কমে ৩৬টি হয়ে গেল কেন এই তাড়াহুড়ো ও গোপনীয়তা? ডাল মেঁ কুছ কালা জরুর হ্যায়!

কোন কোম্পানি বেশি যোগ্য, ২০৭০ কোটি টাকা লাভের হ্যাল, না ৯৫৬ কোটি টাকা লোকসানের রিলায়েন্স ডিফেন্স?

হ্যালের মতো নবরত্ন, যে সংস্থা ২০১৭-১৮ সালে ২০৭০ কোটি টাকা লাভ করেছে, তাকে বদনাম করাও শুরু করে দিয়েছে রিলায়েন্সের শাগরেদরা। হ্যাল কত খারাপ তা নিয়ে চর্চা চলছে ইকোনোমিক টাইমস, ট্যুইটার, ফেসবুকে বিজেপির আইটি সেলের প্রচারে। আদতে ভারতের একমাত্র বিমান তৈরির সংস্থাকে খাটো করলেই তো বেসরকারি ও বিদেশি পুঁজির হাতে সেই ক্ষেত্রকে তুলে দেওয়া যাবে। হ্যালের সর্বনাশ করে যে সংস্থার পৌষমাসের বন্দোবস্ত করা হল সেই রিলায়েন্স ডিফেন্সের ২০১৭-১৮ সালের লোকসান হয়েছে ৯৫৬ কোটি টাকা, ২০১৬-১৭ সালে লোকসান ছিল ৫২৪ কোটি টাকা। পূর্বতন বছরগুলির হিসেবের আর প্রয়োজন কী? মনে রাখা দরকার দ্রালের শেয়ারের সর্বোচ্চ সম্ভব (বিদেশি বিনিয়োগের) ৪৯% দাসাউ-এর মালিকানায়, ৫১% অনিল আম্বানির কোম্পানির। এও মনে রাখা দরকার প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের সীমা বাড়িয়ে ৭৪% করার কথা বিবেচনায় আছে। তাহলে অচিরেই চড়া দামে অনিলের শেয়ার কিনবে দাসাউ। আম্বানির মুনাফা হবে। এও মনে রাখা দরকার অনিল আম্বানির  কোম্পানির বিপুল পরিমান ঋণ অকার্যকরী সম্পদে (এনপিএ) পরিণত হয়েছে। সুতরাং তাকে বাঁচানোর দায় তো মোদি-শাহদের নিতেই হবে।

কে মিথ্যে বলছে, শাসক দল-আম্বানি-দাসাউ না প্রাক্তন ফরাসি রাষ্ট্রপতি অলাঁদ?

যদিও শাসক দল বলছে যে, দাসাউ রিলায়েন্স ডিফেন্সকে যৌথ উদ্যোগের জন্য স্বেচ্ছায় বেছেছে। এক্ষেত্রে সরকারের কিছুই করার নেই। অফসেট কর্মসূচির জন্য দাসাউ যাকে খুশি বাছতে পারে। দাসাউ-এর প্রধান এরিক ট্রাপিয়ার ও অনিল আম্বানিও তেমনটাই বলছেন। অবশ্য ট্রাপিযারের কথার কোন গুরুত্বই বা আছে? ব্যবসা পাওয়াটাই তাদের মুখ্য, সত্য বলার কোনও দায় তার নেই। ওদিকে অনিলবাবু তো ঋণং কৃত্যং ঘৃতং পিবেত দর্শনের পথিক। তার কথাও বিবেচ্য নয়। কিন্তু রিলায়েন্স ডিফেন্সের ঘোষণা যে বলছে চুক্তি থেকে উদ্ভূত ৩০,০০০ কোটি টাকার অফসেট কর্মসূচির নেতৃত্ব দেবে দ্রাল (ঘটনাক্রম ১৪)। ওদিকে সরকারি বিধি অনুসারে সমস্ত অফসেট প্রস্তাবে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর অনুমোদন বাধ্যতামূলক (ঘটনাক্রম ১০)। তাহলে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর অজ্ঞাতেই কী করে এমন কথা সংবাদমাধ্যমকে জানাচ্ছে রিলায়েন্স ডিফেন্স? কেবল তাই নয়, ফ্রান্সের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ২১ সেপ্টেম্বর একটি সাক্ষাৎকারে বলেন যে ভারত সরকারের তরফ থেকেই অফসেট কার্যক্রমের সহযোগী হিসেবে রিলায়েন্সের (অনিল আম্বানির) নাম দেওযা হয়, এ ব্যাপারে ফ্রান্স সরকারের অন্য কোনও উপায় ছিল না। দাসাউ তাই রিলায়েন্সের সঙ্গেই চুক্তির দিকে এগিয়েছে।

রাফাল এক বিপুল কেলেঙ্কারি!

সব মিলিয়ে বলা যায় যে, এক বিপুল আর্থিক কেলেঙ্কারির দিকে ইঙ্গিত করছে রাফাল যুদ্ধবিমান কেনার প্রকল্পটি। বায়ুসেনার প্রয়োজন অগ্রাহ্য করা হচ্ছে (যদিও সরকারি চাটুকার হিসেবে বায়ুসেনার প্রধান সরকারের কাজকে সব ঠিক বলবেন), নিরাপত্তা সংক্রান্ত ক্যাবিনেট কমিটিকে অপাংক্তেয় করা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী নিজেকে সিজার হিসেবে সমস্ত নিয়মকানুনের ঊর্ধ্বে বলে মনে করছেন ও দেড়জনের সরকার হিসেবে সমস্ত গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে অগ্রাহ্য করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। যুদ্ধবিমান ক্রয়ে বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। অনিল আম্বানির রিলায়েন্স গোষ্ঠীকে বিপুল আর্থিক সুবিধে পাইয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করেছেন মোদি-শাহরা। অনিল আম্বানিকে সুবিধে দেওযার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত নবরত্ন সংস্থা হ্যালকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে রেয়াত করেনি তারা।