Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

পুরনো আলোর আঁকশি

সহেলি দাস

 

এক একসময় মনে হয় এক প্রকাণ্ড ভূখণ্ডে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে। নিরাসক্ত, যেন মাধ্যাকর্ষণহীনতায় ততটাই হালকা, যতটায় যে কোন মুহূর্তে উড়ে যেতে পারে। কোথায় উড়তে চায়? কেন চায়? আট দশক অতিক্রান্ত একটা শরীর। মন। মন আরও বেশি সময় সঞ্চয় করে, পেরিয়ে যায়।

শৈশব, কৈশোরে যে গল্পগাথা, রূপকথারা ভয় পেতে, কাঁদতে, বিস্মিত হতে শেখাল তাদের অস্তিত্ব, প্রাচীনতার যোগফল তো মনের আয়ুকাল। মন রেকর্ডারের কাজ করছে অবিরত। আজ বয়সী যাপনে সে যখনতখন বায়স্কোপ দেখায়। কাঁদায়, আবার চোখের জল মুছিয়েও দেয়।

আচ্ছা, তোমরা কেন বুঝতে চাও না তাঁতিবাজার থেকে একটা ছাদের অংশ এসে ভবানীপুরের একটা সাবেক বাড়ির ছাদে মিলে গেল। এইভাবেই তো মিশে যায়, মিলেমিশে হাজারো অশান্তি, তর্কাতর্কির আস্তরণ সরিয়ে বন্ধুত্ব করে ফেলে দুটো জমির দুটো সিঁড়ি। ছাদে ওঠার শেষ যে দরজা ছিল সেই দরজা যদি ঢাকা থেকে কলকাতার বাড়িতে এসে ঠিক ওই জায়গায় বসে যেত আপনা আপনি! কে টের পেত!

ঠিক টের পেত সে! যার শরীরে আজও ঢাকার ধুলো মিশে আছে। ছোটবেলার বাসাবাড়ির উঠোন, কলের জলের শব্দ, পৌষের ঘুড়ি আকাশ, পাড়ার বড়বাড়ির মাঠ… এই সব কি ফ্রিজ শট হয়ে আছে? বোধহয় আছে। যে শুকতারা ঢাকার আকাশে, তাই কী এই মহানগরে! তা হয় না! নক্ষত্ররাজিরাও আলাদা আলাদা করে ফোটে। যিনি দেখেন, তার মনের মতো করে। এক আবার ভিন্ন। যা হারিয়ে গেছে… তা কি পুরোপুরিই হারিয়ে গেছে? বর্তমানের ভিতর জানালার ধারে, দরজার কোণে, বাঁধানো কথামৃতে রেখে দেয়া ময়ূরের পালকে চেতনে অচেতনে আভাসে স্পষ্টতায় ছায়া আবছায়ায় রয়ে গেছে। চোখের তারায়, কথার ফাঁকে তা আনন্দ অনুভবের মতো ধরা পড়ে যায়।

মনের ভিতর এই আনন্দ উজ্জয়িনীর আবাহন বেজে চলে। অতীত ফিরে আসে। বর্তমান তাকে আগলে রাখে। বর্তমানের দায়, দায়িত্বও বটে, পুরাতনের আদর ও কদর করা। নইলে কেবলমাত্র বর্তমান যে মরুভূমির মতো নির্মম ও অনিরাপদ৷ ফেলে আসা দিন ভাবতে ভাবতে কখন কার্তিক মাস এসে পড়ে। হেমন্তকালে কি আলো সবথেকে বেশি বদলায়? আলো! দরদিয়া আলো! ছোটকালে দেখা বাউল দরবেশ যেমন! একটা ধ্রুপদ ধরল, আর নিমেষে কোথায় যেন, কত পথ পেরিয়ে যাওয়া গেল। তাঁতিবাজার পাড়ার বৈষ্ণব বাতাবরণ কেমন সব হু হু করে মনে পড়ে যায়। একটা প্রাচীন বটের ঝুড়ি কেমন যেন মনে হয় মাটির তলা দিয়ে কাশী বৃন্দাবন ঘুরে এই কলকাতা শহরে নিমতলা ঘাট স্ট্রিটে ওই চেনা বটের ঝুরির সঙ্গে দোল খাচ্ছে। একটা পরিপূর্ণ আনন্দদায়ক শ্রাবণ বৃষ্টিবেলায় চারপাশটায় কুয়াশা নেমে এলে বুড়িগঙ্গা দেখা যায়। ওই তো দূরে ক্ষীণ মাঝিদের নৌকা। এ কী সাংঘাতিক অভিঘাত! কলকাতা ঢাকা কাটাকুটি খেলে অবিরত৷ এ যেন নিয়তি নির্ধারিত কোনও বৃহৎ এপিকের  খণ্ডচিত্রে অসহায় অবুঝের মকশো করা মাত্র।

কিছু করার নেই। ভাববারও। শুধু শ্রোতা হওয়া চলে। আর দর্শক। ময়দানের এক কোণে দাঁড়ালে এক আন্তর্জাতিক মানের সাবেক উদাসীনতা নির্মিত হয়৷ প্রশান্ত চিত্তে শুধুই প্রান্তিক হওয়া সাজে৷

এমন সাজের যে কোনও জুড়ি নেই। ঠিক সেই সব অলীক মাহেন্দ্রক্ষণ এক আশ্চর্য চরাচরের জন্ম দেয়। নির্ভার, অন্তহীন।

স্মৃতির অভিঘাত

দুই প্রাচীন

বানভাসি আলো

নিবিড় মাঠে দেশ এসে দাঁড়ায়। স্বজন তর্পণ।

বর্তমান স্মৃতির সংঘাত, কখনও বা অলীক বোঝাপড়া

ডালহৌসি স্কোয়ারে দাঁড়ানো ট্যাক্সি কি উড়ান দেবে রমনায়

শেষ চিঠি আজও অলিখিত