প্রিয়ক মিত্র
গত সংখ্যার পর
হীরেটার খবর ইমানি জানল না! ইমানির দলের মাতব্বর গোছের একজনের জামানতে রইল সেটা! সাপটাকে যারা কাটছিল তারা কেউই মাহাত্ম্য বুঝতে পারল না হীরেটার। ফলত সেই মাতব্বর, আবদাল্লার সম্পত্তি হয়েই রয়ে গেল সেটা।
ইতিমধ্যে ইমানি খানিক স্নেহবৎসল হয়েছিল পঁয়ত্রিশ নম্বরের প্রতি। ওকে নাম দেওয়া হল ওমান!
পঁয়ত্রিশ নম্বর নিজের নাম জানত না! ছোট থেকেই সে দাসত্বের শৃঙ্খলে ছিল। অন্যের দেওয়া নাম তার সম্বল ছিল, সে নামও বারবার হারিয়ে গেছে! আজ ওমান— এই নামটাকে সে আঁকড়ে ধরল!
জাহাজ ছাড়ল, জাহাজের পেটে ঠাসা ক্রীতদাস! তারা এই কাফ্রি কিশোরটিকে ঘৃণা করত! তাদেরই একজন হয়ে সে কী করে শয়তান মনিবদের দলে ভিড়ল?
ওমান এসব পরোয়া করত না! এখন সে স্বাধীন!
জাহাজ রওনা দিল ভারতের উদ্দেশ্যে!
একদিন বিকেলে কাজ সেরে ওমান দাঁড়িয়েছে ডেকে! আকাশ লাল হয়ে রয়েছে। আলোআঁধারিতে মেশা অস্পষ্ট দৃশ্য! আচমকা ফিসফাস কানে এল তার। সচকিত হল ওমান! কোনও ক্রীতদাস পালাচ্ছে না তো? পালানোর চেষ্টা করলে একশো ঘা চাবুক! কী করবে সে কোনও পলায়নরত কাফ্রি দেখলে? জানাবে ইমানিকে? তাহলে বখশিশ মিলবে তার! ইমানির আরও খানিকটা নেকনজরে আসবে সে! না কি ওদের বুঝিয়েসুঝিয়ে বাঁচাবে ইমানির দৈত্যদের থেকে? না কি পালাতে সাহায্য করবে? দ্বিতীয় এবং তৃতীয়টা ঝুঁকিপূর্ণ ওমানের জন্য!
সে ঘাপটি মেরে এগিয়ে গেল ফিসফাসের উৎসের দিকে। ডেকের এককোণ থেকে ভেসে আসছে ফিসফাসটা। আবছা অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে সে এগিয়ে গেল কয়েককদম!
এ তো আবদাল্লার গলা। আবদাল্লা ইমানির আরেক বিশ্বস্ত অনুচর! আবদাল্লা কথা বলছে তার স্ত্রী কলিফা-র সঙ্গে, জাহাজের রান্নাবান্নার দায়িত্ব যার!
ওমান শোনার চেষ্টা করল ওদের কথা। অস্ফুট স্বরে বলা হলেও কিছু কথা এসে পৌঁছল ওমানের কানে! শিরদাঁড়া ঠান্ডা হয়ে গেল তার!
একটা হীরে খুঁজে পেয়েছে আবদাল্লা ওই ভয়ঙ্কর ময়ালটার পেট থেকে। হীরেটা তার নিজের জিম্মায় রেখেছে সে! ওই হীরের ওপর নির্ভর করে সে তার স্ত্রীর সঙ্গে পালানোর ধান্দা করছে…
একটু ভাবার সময় নিল ওমান! আবদাল্লা কম নিষ্ঠুর নয়। ক্রীতদাসদের চাবুক মারার মূল দায়িত্বটা তারই! এর আগে ওমানও চাবুক খেয়েছে তার হাতে!
সেই চাবুকের ঘা মনে পড়তেই শিরদাঁড়া শক্ত হল ওমানের। সঙ্গে সঙ্গে শক্ত হল তার চোয়ালও! সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে, কী করা উচিত এরপর!
ইমানি তার কেবিনের ভেতর একটি চারচৌকো বাক্সের ওপর বসে লাল চোখে তাকিয়ে আছে ওমানের দিকে। তার আশেপাশে তার বাকি শাগরেদরা তেরচা চোখে দেখছে ওমানকে! জাহাজ দুলছে, ওরাও দুলছে!
ইমানি উঠে এসে শক্ত করে চেপে ধরল ওমানের কচি দুটো কাঁধ! সোয়াহিলি ভাষায় সে প্রশ্ন করল, “বেটা, তুই যা বলছিস তা সত্যি?”
ইমানি শুধু আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে হ্যাঁসূচক মাথা নাড়াল।
“আমার দিকে তাকিয়ে বল!” ইমানির কর্কশ গলা বেজে উঠল!
ইমানির দিকে তাকিয়ে আবারও মাথা নাড়াল ওমান।
আর একমুহূর্ত দেরি না করে ইমানি তার দশাসই চেহারার শাগরেদদের নিয়ে সশব্দে এগিয়ে গেল আবদাল্লার ঘরের দিকে।
পালিয়ে যাওয়ার মোহে উন্মত্ত হয়ে আবদাল্লা তখন কলিফার সঙ্গে সম্ভোগে ব্যস্ত! তার যৌনাঙ্গ আস্তে আস্তে ঢুকছে কলিফার মুখে। তার স্ত্রীর চুলের মুঠি আবদাল্লার হাতে শক্ত করে ধরা! আবদাল্লার চোখেমুখে হিংস্র যৌনসুখ!
এরকম চরম মুহূর্তে কেবিনের বন্ধ দরজা পদাঘাতে খুলে ফেলে ইমানি আর দলবল ছোট্ট ঘরটার মধ্যে ঢুকে পড়ল।
সচকিত হয়ে অর্ধনগ্ন আবদাল্লা আর কলিফা উঠে দাঁড়াল। আবদাল্লা হতভম্ব! সে কল্পনাও করেনি এমন পরিস্থিতি!
বিনা বাক্যব্যয়ে ঘর তছনছ করে হীরেটা খুঁজতে শুরু করল ইমানির লোকেরা। ইমানি দাঁড়িয়ে রইল কোমরে হাত দিয়ে! ইমানির পাশে ওমানকে রক্তচক্ষুতে দেখল আবদাল্লা! সে বুঝতে পারল যা ঘটছে তার পেছনে ওমানের অবদান আছে যথেষ্ট!
ঘর তছনছ করে কিচ্ছু না পেয়ে ইমানির লোকজন সোজা তাকাল আবদাল্লার দিকে। আবদাল্লা এবং কলিফা দুজনেই বাকরুদ্ধ! দুজনেরই চোখেমুখে আতঙ্ক!
ইমানির লোকজন ঝাঁপিয়ে পড়ল আবদাল্লার ওপর। আবদাল্লার নিচের পোশাক থেকে অনায়াসে বেরিয়ে এল হীরেটা!
কলিফাকে ছিঁড়ে খেত ইমানির লোকজন, যদি ইমানি বারণ না করত! ধর্ষিতা হতে হল না কলিফাকে! কিন্তু আবদাল্লার সঙ্গে কলিফাকে পিছমোড়া করে বাঁধা হল, এবং রাতের অন্ধকারে ভাসিয়ে দেওয়া হল ভারত মহাসাগরের জলে, জ্যান্ত! হাঙরদের সে রাতে শিকারের অভাব হল না!
হীরে জমা হল ইমানির সিন্দুকে। সেই সিন্দুক পাহারা দেওয়ার কাজ পেল ওমান!
তার পরের রাতে ভয়াবহ সামুদ্রিক ঝড় উঠল! জাহাজ প্রায় ডুবে যায়! কাপ্তেন আর মাল্লারা জান লড়িয়ে দিল জাহাজ বাঁচাতে! অতজন ক্রীতদাস একটা চৌখুপ্পি ঘরের মধ্যে ওলটপালট হতে লাগল। ইমানির মুখেচোখে চিন্তার ছাপ!
যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধে হবেই! বিপদ একসঙ্গে জোট বেঁধে আসে। সেই ঝড়ের মধ্যেই পর্তুগিজ হার্মাদরা আক্রমণ করে বসল ইমানির জাহাজ!
ইমানি তলোয়ার বার করে বাকিদের সঙ্গেই লড়াইয়ে মাতল। একজন পর্তুগিজের তলোয়ার তার পাকস্থলী এফোঁড়ওফোঁড় করে দিল লহমায়!
কেটেকুটে সাফ করে দেওয়া হল ইমানির দলবলকে, জাহাজের সব খালাসির লাশ পড়ল! মরল না ক্রীতদাসরা, আর মরল না ওমান! সুযোগ বুঝে সেও ভিড়ে গিয়েছিল ক্রীতদাসদের সঙ্গে। বাকিদের সঙ্গে সেও চালান হল পর্তুগিজদের জাহাজে! ক্রীতদাস লুঠ হল, লুঠ হল জাহাজের যাবতীয় সম্পত্তি এবং মেয়েরা। সব যুদ্ধেই যারা অবশ্যম্ভাবী শিকার!
ওমান পর্তুগিজদের জাহাজে যখন এল, তখন কেউ ওর খানাতল্লাশি করেনি! করলে দেখতে পাওয়া যেত, ওমানের সঙ্গে ছিল ময়ালসাপের পেট থেকে উদ্ধার হওয়া আকাশি রঙের হীরে!
পর্তুগিজদের জাহাজ প্রথমে ভিড়ল বোম্বাই-তে, তারপর মাদ্রাজে! ক্রীতদাসের বোঝা হালকা করতে করতে জাহাজ এসে পৌঁছল কলকাতার বজবজ বন্দরে! হীরেসমেত ওমানও পা রাখল কলকাতায়।
পর্তুগিজ আর মগে ছেয়ে গিয়েছে শহর! আর কাফ্রি ক্রীতদাস হাতবদল হচ্ছে শহরজুড়ে। সাহেবদের পছন্দের বাদ্যযন্ত্র ফ্রেঞ্চ হর্ন বাজাতে জানত যারা সেসব কাফ্রির দর বেশি।
ওমান ছিল দক্ষ নাপিত! তার সঙ্গে আরেকটি কাফ্রি কিশোর, যে ফ্রেঞ্চ হর্ন বাজাতে পারত চমৎকার! এই দুজনকে একসঙ্গে কিনলেন গোল্ডস্মিথ সাহেব!
ওমানের জীবনের মোড় ঘুরল, মোড় ঘুরল এই আংটির গল্পেরও।
ওমানকে পর্তুগিজরা যখন জাহাজে ক্রীতদাসদের দলে ভিড়িয়ে দিয়েছিল আবার তখন ওমানের দমবন্ধ লেগেছিল। কটা দিন আরামের জীবন কাটিয়েছিল সে!
যে মুহূর্তে বাদবাকি কাফ্রিদের সঙ্গে ঘরে আটক হয়েছিল ওমান, সে মুহূর্তে সে প্রমাদ গুনেছিল। প্রায় সমস্ত কাফ্রি একজোট হয়ে হাড়হিম করা দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল তার দিকে।
কাফ্রিদের কোনও ভয় ছিল না। তারা দাস হয়েই ছিল। তারা জানত পর্তুগিজরা তাদের লুঠ করতে এসেছে, মারতে নয়। নতুন করে ক্রীতদাস হয়ে ওঠার আতঙ্কও কাজ করেনি তাদের মধ্যে।
ওমান এতদিন দিব্যি জলে ভাসছিল। শ্বাস নিচ্ছিল। এবার আবার জলের বাইরের মাছ হয়ে মরো মরো অবস্থা হল তার।
কাফ্রিরা তার ওপর অত্যাচার করেনি বিন্দুমাত্র। শুধু সময়বিশেষে তার দিকে কঠিন দৃষ্টি হেনেছে।
ওমান হীরেটা যেভাবে লুকিয়ে রেখেছিল তা তার পক্ষে স্বস্তিদায়ক ছিল না আদৌ!
ওমানের শিরদাঁড়ার ঠিক নিচে গুঁজে রাখা ছিল হীরেটা। তার নিচের ঢোলা পোষাকের ভেতরে তৈরি করা গুপ্ত পকেটে।
দৈবক্রমে গোল্ডস্মিথ সাহেব ছিলেন চোরাকারবারি সোনারুপোর ব্যাপারী। শহরে তখন ডাকাতদের দাপাদাপি। সাহেবসুবো থেকে শহরের দাগী আসামী সবাই ছিল ডাকাতদের দলে। এই ডাকাতদের কোনও শ্মশানকালী ছিল না। মায়ের পায়ে সমর্পণ করে, মাথায় লাল টীকা লাগিয়ে, ঘোড়ায় চেপে বা খাঁড়া হাতে হুঙ্কার ছেড়ে এরা ডাকাতি করতে আসত না। এদের পদ্ধতি ছিল গোপন, মসৃণ। তবে রক্তপাত এড়ানো যেত না ক্ষেত্রবিশেষে। আর ডাকাতি করা সব ধনসম্পত্তি যেত গোল্ডস্মিথ সাহেবের সিন্দুকে। চড়া দামে বিক্রি হত সেসব।
সে সময় ডাকাতরা ঠিক করল চৈতন শীলের বাড়িতে ডাকাতি করবে। চৈতন শীল ছিলেন শহরের নামকরা ধনী বাবু। তার বাড়িভর্তি ধনসম্পদ, মোহরের ছড়াছড়ি।
প্রায় দুশো জনের একটি ডাকাতদল প্রস্তুত হল চৈতন শীলের বাড়িতে ডাকাতি করবে বলে।
সেই দুশো জনের মধ্যে ছিল বিভিন্ন ধরনের লোক। তার মধ্যেও চালচুলোহীন ইউরোপিয়ানদের সংখ্যাই ছিল বেশি। কলকাতা শহরে তখন অনেক ইউরোপীয় ভাগ্যান্বেষী অ্যারাক নামক একটি বিশেষ মদ বিক্রি করত। এই অ্যারাক মদটিই ছিল এইসব সাহেবসুবোদের ডাকাতি করতে যাওয়ার আগের কারণসুধা। আর এই অ্যারাক মদের কারবারের সঙ্গে ডাকাতির গভীর যোগাযোগ ছিল। অ্যারাকের কারবারির সূত্রেই যোগাযোগ বাড়ত, এই কারবারির আড়ালেই যাবতীয় ষড়যন্ত্রের ছক কষা হত। চৈতন শীলের বাড়িতে অভিযান করেছিল যে দুশো জনের দল, তা সংগঠিত হয়েছিল অ্যারাক কেনাবেচার বাজারেই।
গভীর রাত। পাঁচটি দলে ভাগ হয়েছে ডাকাতদল। প্রতি দলে চল্লিশজন। পথ দেখাচ্ছে দুই বাঙালি দুর্বৃত্ত। তার মধ্যে একজনের সঙ্গে চৈতন শীলের বাড়ির দারোয়ানের সাঁট রয়েছে। চৈতন শীলের বাড়িতে কড়া প্রহরা। চাকর, বেয়ারা, খাস খানসামা সবাই সবসময় সতর্ক। বাবুর নিজেরও ঘুম পাতলা। টাকার কুমীর চৈতন শীল। তাকে তো সাবধান থাকতেই হবে।
রাত্রি দুটোর সময় চৈতন শীলের চিৎপুরের বাড়ির চারপাশে জড়ো হল শদুয়েক ডাকাত। একশো ষাটজন চারভাগে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে চড়েছে বাড়ির চারদিকে। আর মূল ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে চল্লিশজনের আরেকটি দল, যাকে নেতৃত্ব দিচ্ছে দুই বাঙালি। দারোয়ান মূল ফটক খুলে দিল। চল্লিশজন নুড়িপাথর বিছোনো রাস্তা মারিয়ে প্রবেশ করল বাগানের ভেতর। বাড়ির চারপাশের পাঁচিল টপকে ঝুপ ঝুপ করে নেমে পড়ছে ডাকাতের দল।
সদর দরজার সামনে যেতেই দুটো বল্লম উঁচিয়ে পাগড়িপরা মোটা পুরুষ্টু গোঁফসমেত দুটো লোক সামনে এসে দাঁড়াল।
একটা গ্যাসলণ্ঠন জ্বালিয়ে একজন সাহেব সামনে এগিয়ে গেল।
সাহেবকে দেখেও কোনও তাপউত্তাপ নেই বল্লমধারীদের। তারা বল্লম সমান ভঙ্গিতে উঁচিয়ে রেখেছে।
সামনে এগিয়ে যাওয়া সাহেব মুহূর্তের মধ্যে একটি পিস্তল বার করে তাক করল বল্লমধারীদের দিকে। আর বল্লমধারীরা ততোধিক সপ্রতিভ ভঙ্গিতে বল্লমের ঘায়ে দূরে ছিটকে দিল পিস্তল। লোহার পিস্তলে বল্লম লেগে ঠং করে শব্দ হল।
সঙ্গে সঙ্গে আর এক সাহেবের হাতে উঠে এল একটি দোনলা পিস্তল। এবং সামান্য সময় নষ্ট না করেই সেই পিস্তল গর্জে উঠল। একজন বল্লমধারী পড়ে গেল মাটিতে।
বাড়ির অন্দরে জ্বলে উঠল আলো। চৈতন শীলেরও ঘুম ভেঙে গেছে ততক্ষণে।
কানাই, এই দলের গুপ্তচরকে চিনতে পেরেছিল বল্লমধারীদের একজন। দাঁতে দাঁত চেপে ঘ্যাসঘ্যাসে গলায় সে বলল, “কানাই! ব্যাটা লেংটি ইঁদুর! সিংহের গুহায় ঢুকেছিস কোন সাহসে!”
কানাই বিশ্রীভাবে হেসে উঠল। তারপর আরেক জখম হওয়া বল্লমধারীকে দেখিয়ে বলল, “ই কী! সিংহের গুহার মুখে একটা ভোঁদড়কে পাহারা দিতে বসিয়েছে গো।”
বল্লমটা কানাইয়ের পেটে প্রায় ঢুকে যাচ্ছিল, দুজন এগিয়ে এসে চেপে ধরল বল্লমটাকে।
বাড়ির ভেতরে ততক্ষণে ঢুকে পড়েছে ডাকাতের দল। মারামারি কাটাকাটি করে একদল পৌঁছে গেছে চৈতন শীলের মূল সিন্দুকের ঘরে। স্যামুয়েল বলে এক সাহেব গোটা বিষয়টির তদারক করছিল। এমন সময় কাঁধের কাছে একটা শীতল ধাতব খোঁচা খেয়ে বিস্মিত হয়ে ঘুরে তাকাল স্যামুয়েল।
চৈতন শীল দাঁড়িয়ে হাতে একখানা গাদাবন্দুক নিয়ে। পাশে লণ্ঠন আর বল্লম হাতে তার এক অনুচর।
স্যামুয়েলের হাতে একটা মোটা পিতলের লাঠি। নানান মণিমুক্তোখচিত।
আচমকা লাঠিটা দুভাগ হয়ে গেল। একটি শাণিত তরবারি বেরিয়ে এল লাঠির শরীর থেকে।
লণ্ঠন নামিয়ে রেখে চৈতন শীলের অনুচর বল্লম তাক করল স্যামুয়েলের দিকে। বল্লমে তরবারিতে এক আশ্চর্য সংঘর্ষ শুরু হল।
চৈতন শীল বন্দুক হাতে নিয়ে এগোচ্ছিলেন বাকি লুঠেরাদের দিকে। এমন সময় অন্ধকারে কে একজন ঝাঁপিয়ে পড়ল চৈতন শীলের ওপর। পেছন থেকে। বাঘের মতন। চৈতন শীলকে চার পাঁচজন মিলে বেঁধে ফেলল লহমায়।
চৈতন শীলের অনুচরের হাতের কনুইয়ে স্যামুয়েলের তরবারির এক ঘা তার হাত থেকে খসিয়ে দিল বল্লম।
চৈতন শীলের বাড়িতে সেদিন যে লক্ষ লক্ষ টাকার ধনসম্পদ ডাকাতি হল তার ভাগবাঁটোয়ারা হল গোল্ডস্মিথ সাহেবের বাড়িতে। চৈতন শীলের সোনারুপোহীরেজহরতের ভাণ্ডার উজার করে নিয়ে এসেছে শহুরে ডাকাতের দল।
কানাই আর হরেন— এই দুই বাঙালির ডাক পড়ল সবশেষে। ওদের কোনও ভাগ না দিলেও চলে এমন ভাব ছিল সকলের। শেষমেষ গোল্ডস্মিথ সাহেব তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ছাব্বিশটি করে টাকা গুঁজে দিলেন দুজনের হাতে।
জ্বলে উঠল কানাই। সে না থাকলে এই সাদা ডাকাতগুলো চৈতন শীলের বাড়ি ঢুকতে পারত? তার চোরাকুঠুরি থেকে মূল সিন্দুক খুঁজে পেত?
তার কপালে মোটে ছাব্বিশ টাকা!
এর শোধ কানাই পরে নিয়েছিল ডাকাতদের বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়ে।
কিন্তু মাঝে ঘটেছিল সম্পূর্ণ অন্য একটি ঘটনা যা কানাইয়ের কপাল খুলে দেয় কিছুদিনের জন্য।
(আবার আগামী সংখ্যায়)