Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

লক্ষ্মীর পাঁচালি ডিকোড করার বিপদ ও সম্পদ

যশোধরা রায়চৌধুরী 

 

দুর্গাপুজোর পর পর কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো আসে। দুটো পুজোর মধ্যে মিল বলতে এইটুকুই, যে দুটো পুজো পরস্পর জড়িয়ে থাকে, আসে পর পর। একটা বিশালতা, জাঁকজমক, তিনদিন ব্যাপী উৎসবের আদল, গোটা বাঙালি সংস্কৃতির প্রতীক হয়ে ওঠা, নতুন জামাকাপড় কেনার বাধ্যতা ইত্যাদি নিয়ে বিপুলকায়। প্রায় দুমাস আগে থেকে দুর্গাপুজো আসি আসি করতে করতে আসে। চলে যাবার পর বিজয়ার মিষ্টিমুখ আর কোলাকুলি প্রণাম ও গুরজনদের চিঠি লেখা এইসব সহই তার জের চলে আরও দু সপ্তাহ। আজকাল তো কার্নিভালের জাঁক দুর্গাপূজাকে দিয়েছে আরও এক বিশাল বড় প্রেক্ষিত। চালচিত্র। পারিবারিক আনন্দের, সামাজিক ব্যাপ্তির এক উপন্যাস লেখা হয়ে চলে যেন প্রায় দু মাস ধরেই। সর্বভারতীয় ক্যালেন্ডারে বাঙালির দুর্গাপুজা অহংকারের আলো।

পাশাপাশিই টুকুস করে আসা আর সেরে নেওয়া কোজাগরী পূর্ণিমার লক্ষ্মীপুজোটি, ঘরোয়া আর লাবণ্যময়, নারীকুলের বুকের কাছের লক্ষ্মীপুজো যেন ছোট গল্প। বড় প্যান্ডেলের মা দুর্গার বিসর্জনের পর খালি প্যান্ডেলে ছোট লক্ষ্মীঠাকুর হেলাফেলার মধ্যেই পূজিত হন দায়সারাভাবে। কিন্তু তারও চেয়ে অনেক বেশি কদর ঘরে ঘরে লক্ষ্মীপুজোর। প্রতি বেস্পতিবারের লক্ষ্মীপুজো করেন বেশ কিছু পুজোপ্রবণ বাঙালি হিন্দু মহিলারা নিষ্ঠা ভক্তি ও অভ্যাসে। তার চেয়েও বেশি ব্যাপ্তিতে, প্রতি গৃহে বাঙালি হিন্দুর কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো প্রায় যেন প্রশ্নহীন আনুগত্যে আমরা সাদরে গ্রহণ করি। প্যান্ডেলের দাঁড়ানো লক্ষ্মী সরস্বতীর সঙ্গে কম্পিটিশনে নামেন, মা উমার পাশটিতে। কিন্তু কোজাগরীর বসে থাকা লক্ষ্মী যাঁর কাঁখে টাকার ঝাঁপি আর হাতে ধানের ছড়া, একাই একশো। জিতে যান তিনি কয়েক মাইল এগিয়ে থেকে সরস্বতীর।

লক্ষ্মী নাকি ধনদাত্রী দেবী, কিন্তু বাঙালির চির দুর্ভিক্ষপ্রপীড়িত কালেকটিভ আনকনশাসের অন্তরে, ধনদাত্রীকে আমরা অন্নদাত্রী বলেই দেখতে শিখেছি। আর তাই, শরতের নতুন ফসলের সঙ্গে লক্ষ্মীপুজোর পুজোর ভোগ বা নৈবেদ্যর একটা নিবিড় সম্পর্ক লক্ষ করেছি।

কেন কেউ জানি না আমরা, ইতিহাস হারিয়েছি, কিন্তু ধর্মের থেকে সাংস্কৃতিক কারণ বেশি হয়ে উঠেছে এই ঘরোয়া লক্ষ্মীপুজো। কমিউনিস্ট হোন অথবা লিবারাল, বাড়িতে মা বৌদি বা গিন্নি যেন এই লক্ষ্মীপুজো করবেনই। আর অধিকাংশ পুজোর মূল আকর্ষণ থাকে ছোট্ট মাটির মূর্তি, ফুলের মালা, আর চারিদিক থেকে জুটিয়ে আনা একরাশ সুখাদ্য, যার মধ্যে মূলত নারকেল নাড়ু, মোয়া নিমকি গজা, চিনির মঠ ও চিনির বাতাসা, নকুলদানা, কদমা, খেজুর আখ পানিফল শশা আপেল বাতাবিলেবু ইত্যাদি ফল, মাখা নারকেল কোরানো ও মুগ ডাল ভেজানো, আতপ চাল ভেজানো, কলার অপরূপ এক নৈবিদ্যি, খিচুড়ি ও ভাজাভুজি, লুচি ও মোহনভোগ প্রায় অনিবার্যভাবে উপস্থিত। অনেক বাড়িতে পুরোহিত আসেন, অনেক বাড়িতে বাড়ির মহিলারাই পূজা করেন বই দেখে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সারাদিন উপোস করে সামগ্রী জড়ো করা হয়। পুজো হয় বিকেলের দিকে সূর্য পড়ে এলে। কেননা পূর্ণিমার সঙ্গে অখণ্ড যোগ আছে এ পুজোর। যেমন আছে শ্বেত প্যাঁচাটির সঙ্গে।

নানা ঘরে নানা মাপের, কম বেশি জাঁকজমকের পুজোয় অন্নদাত্রীই হোন আর ধনদাত্রীই হোন, মা লক্ষ্মীর নানারকমভাবে পুজো হলেও, একটি আশ্চর্য বিষয় হল, প্রতি পুজোতেই লক্ষ্মীর পাঁচালি পাঠ হয়ে থাকে। আশ্চর্য কারণ, দুর্গার পাঁচালি নেই। সরস্বতীর পাঁচালি নেই। আছে লক্ষ্মীর শুধু। আশ্চর্য কারণ, ‘লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়া’ নামক ঐতিহ্যবাহী ও কৌম বস্তুটি বাংলার সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অন্য অনেক আচরণের মতো উবে যায়নি… অন্য সব পুজো আচ্চা আচার আচরণ, নানা ধরনের তিথি ও ব্রত পালন, এটা ওটা লোক উৎসব ও পার্বণের বিলোপ ঘটেছে, নানা ধরনের মন্ত্র-ছড়া-পাঁচালি পড়া আর হয় না। অন্তত শহুরে মেয়েদের মধ্যে এমন কোনও অভ্যাস নেই দেখা যায়। কিন্তু লক্ষ্মীপুজোয় লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়া এখনও কনস্ট্যান্ট।

কে লেখেন বা লিখেছিলেন এই পাঁচালি? কীভাবে কিনি আমরা পাঁচালি? কেন পড়ি আমরা পাঁচালি? কবে থেকে শুরু হল হাতে লেখা পুঁথির বদলে এই ছাপা পাঁচালি কেনা ও পড়া?

কোনও প্রশ্নেরই সদুত্তর নেই আমার কাছে। বহু লোকশিল্প বা লোকব্যবহারের মতোই এ নিয়ে গবেষণার চিহ্ন খুঁজতে বসলে খড়ের গাদায় সূচ খোঁজা হবে। গৌতম ভদ্র মশায়ের আকর গ্রন্থে খোঁজা যেতে পারে।

সহস্র অজ্ঞান পেরিয়ে এটুকু বলতেই পারি যে বইয়ের দোকানে গিয়ে কেউ পাঁচালি কিনেছেন বলে শোনা যায়নি। অর্থাৎ মান্য বা স্ট্যান্ডার্ড বইয়ের সম্মান পায়নি বলেই মনে হয় এই পাঁচালি। যেন অনেকটাই ব্রাত্য অথচ অনিবার্য। আর তাই হয়ত এর কনটেন্ট সম্পর্কে আমাদের এত ঔদাসীন্য।

সচরাচর দশকর্ম ভাণ্ডারে নানা পূজাসামগ্রীর সঙ্গে সঙ্গে আসে পাঁচালিটি। একটি পাতলা ফিরফিরে কাগজে, সাদা বা ঘিয়ে রঙের ওপর লাল অক্ষরে ছাপা পাঁচালি, সচরাচর সেইসব প্রেসে বা প্রকাশকের ঘরে ছাপা হয় যাকে কথ্য বাংলায় বটতলা বলি। না আছে সম্মান না আছে অর্থবল, এইসব বইয়ের সামান্য দাম হয়, তেমনই এর লেখকরাও  নাম না জানা, অজ্ঞানের অন্ধকারে ডুবে থাকা কোনও কোনও পাঁচালি কবি। লেখক বলতে, পাঁচালির কোনও আদি বা মূল লেখক আমরা পাই না। কিন্তু এও আশ্চর্যের, যে একটিই পাঁচালির অন্য অনেকগুলি ভার্শান বা ভাষ্য পাওয়া যায়। মূল কাঠামো এক থাকে, তা বাদে ছোট ছোট ডিটেলে নানা তফাত থাকে।

কেউ কেউ ভাবছেন এই পাঁচালির উৎপত্তি ১৯৪২-এর আগে পরে। কেননা নিজেরা চরকা কাটার কথা আছে। কেউ বলতেও পারেন তেতাল্লিশের মন্বন্তরের পরের লেখা কেননা বার বার দুর্ভিক্ষের কথা আছে।

যাই হোক না মূলত মেয়েদের পাঠ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এই বইটিকে নিয়ে আমরা কেন পড়লাম তা বলি। মুদি দোকান বা দশকর্ম ভাণ্ডার থেকে এর চোরাগোপ্তা আক্রমণ জারি আছে এত এত বছর, অন্তত একশো বছর ধরে বদলে গেছে বাঙালি মেয়ের মুখের ভাষা, বদলে গেছে ব্রত পালন আর পুজো করার রীত। পাল্টায়নি শুধু লক্ষ্মীর পাঁচালির মূল সুর। যে সুর এখনও ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ। কী কী করলে লক্ষ্মী কুপিতা হন আর কী কী করতে থাকলে লক্ষ্মীকে ঘরে ধরে রাখা যাবে সেই তালিকায় কোনও পরিবর্তন চোখেই পড়ে না। মোটের ওপর, বলাই যায় লক্ষ্মীর পাঁচালি এত বছর ধরে ইভলভ করেনি, তার কোনও উন্নয়ন হয়নি।

এবং প্রায় পুরো ক্ষেত্রেই পাঁচালিটিতে যত কিছু অনাচার বা অসুবিধা, সবকিছুর দায় বা ওনাস মেয়েদের ওপরে। মেয়েরাই সংসারকে ধরে রাখবেন আর তাই সংসার রসাতলে যেতে বসলে মেয়েরাই ভুলচুকের শাস্তি মাথা পেতে নেবেন। নারীকেন্দ্রিক এই বয়ান সোজা কথায় রীতিমতো নারীস্বাধীনতা ও লিবারাল মূল্যবোধ বিরোধী। আর তাই আপত্তি।

কোনও এক কাল্পনিক অবন্তীনগরের এক ব্যবসায়ীর বৃহৎ সংসারে গোলমাল লাগা ও তার সমাধান হবে প্রতি পাঁচালিতেই, তবে উনিশ বিশ বাদ দিলে, শুরুর দিকটা প্রায় সব পাঁচালিতেই একইরকম—

দোল পূর্ণিমার নিশি নির্মল আকাশ।
ধীরে ধীরে বহিছে মলয় বাতাস।।
বৈকুণ্ঠেতে একাসনে লক্ষ্মী নারায়ণ।
করিতেছেন কত কথা হইয়া মগন।।
সৃষ্টিতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব কত কথা হয়।
শুনিয়া আনন্দিত দেবীর হৃদয়।।
অকস্মাৎ দেবর্ষি নারায়ণ নাম স্মরে।
আসিলেন বীণা হস্তে বৈকুণ্ঠ নগরে।।
প্রণাম করি দেবর্ষি কহেন বচন।
মর্তে সদাই দুর্ভিক্ষ অনল ভীষণ।।

এখানে লক্ষ করব, দুর্ভিক্ষের কথাটি বার বার ঘুরে ফিরে আসছে। আগেই বলছিলাম, ধনদাত্রীর চেয়েও লক্ষ্মী যেন আমাদের কালেকটিভ আনকনশাসে দরিদ্র অন্নহীন দুর্ভিক্ষপ্রপীড়িত বাঙালির অন্নদাত্রী। মাঠে মাঠে ধানের ক্ষেতের সবুজে হাওয়ার দোল দেওয়ার ছবি বাঙালি ভুলতে পারে না, তাই তো অনিল বিকম্পিত শ্যামল অঞ্চলের কথাও এসেই পড়ে বার বার দেশমাতৃকার কথা এলেই।

যাই হোক, নারদ এসে প্রবলেমটি লক্ষ্মীর কাছে স্থাপন করবেন, এটাই দস্তুর—

ঋষি বলে মা তুমি চঞ্চলা মন।
সর্বদা স্থিত এ ভবন ও ভবন।।
অন্নাভাবে মর্তবাসী কষ্ট পেয়ে ভোগে।
মরিছে অনাহারে কৃশকায় রোগে।।
ধর্মাধর্ম লোকে সবি ত্যাগ করি দেয়।
স্ত্রী কন্যা বিক্রি করে ক্ষুধার জ্বালায়।।
দুর্ভিক্ষে হইল শেষ মরে মনুষ্যগণ।
দয়া করি মা তুমি করো নিবারণ।।

এই অব্দি ঠিক ছিল। এর পর যেটা হয়, সেটাকেই ডিকোড করতে গিয়ে আমাদের গলদঘর্ম হতে হয়। যেহেতু আমরা জানি যে লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়বেন মূলত মহিলারাই, এটা একটা ঘরোয়া পুজো, এবং সবাই তামা তুলসি হাতে নিয়ে পাঁচালি শুনবেন এমত কৌম প্রথায় আবদ্ধ আমাদের পাঁচালি পাঠের নিয়তিটুকু, এই “সকলের” প্রায় প্রত্যেকেই নারী, ঘরের লক্ষ্মী বলতে যা বোঝায়… তাই মনে হয় যেন প্রবলেমটির প্রতি লক্ষ্মী যেই মুহূর্তে নজর করেন এবং অন্নহীনতার কারণ দর্শাতে শুরু করেন, সেটা হয়ে যায় প্রায় নারীদের একটি কোড অফ কনডাক্ট বা টু ডু লিস্ট। কী কী বিধি ও নিষেধ তার তালিকা। যেন মেয়েদের আচার আচরণের ওপরেই নির্ভরশীল দেশের অর্থনীতি, অন্ন শস্যের বাড়বৃদ্ধি।

নারদের বাক্য শুনি কহেন নারায়ণী।
বিশ্বমাতৃকা আমি জগৎের জননী।।
কারও প্রতি নাই আমরা ক্রোধানল।
ভুগিছে মর্তবাসী নিজ নিজ কর্মফল।।
মহামায়ার স্বরূপে নারী সত্য বচন।
মর্তবাসী না মানে এই কথন।।
নারীর পরমগতি স্বামী ভিন্ন কেবা।
ভুলেও না করে নারী স্বামী পদসেবা।।
যথায় স্বেচ্ছায় ঘুরিয়া বেরায়।
গুরুজনে অকারণে মন্দ বাক্য কয়।।
যে নারী সকালে না দেয় ছড়া।
করি তার সংসার আমি লক্ষ্মীছাড়া।।
অতিথি যদি উপস্থিত হয় দ্বারে।
দূর দূর করে বিতারিত করে তারে।।
গুরুদেবের প্রতি ভক্তি নাহি করে।
আমি যে থাকি না তাহার ঘরে।।
এঁয়োতি নারী সিঁদুর না দেয় কপালে।
মলিন বস্ত্রে যথা ইচ্ছা তথা ঘোরে।।
নিত্য যে না করে অবগাহন।
তারে ছাড়ি করি অন্যত্র গমন।।
দেব দ্বিজে কদাপি ভক্তি না করে।
সকলের সাথে মত্ত সদা কলহে।।
তিথিভেদে নিষিদ্ধ বস্তু যে বা খায়।
হই না কভু তার ওপর সহায়।।
যে মনুষ্য ভক্তিভরে একাদশী না করে।
নাহি হই প্রসন্ন তাহার ওপরে।।
উচ্চ হাসি হাসিয়া যে নারী ঘোরে।
ঘোমটা না টানে মস্তক উপরে।।
গুরুজন দেখি যারা প্রণাম নাহি করে।
সন্ধ্যাকালে ধূপ দীপ নাহি জ্বালে ঘরে।।
এমন নারী যে গৃহেতে করে অবস্থান।
কভু নাহি পায় তারা লক্ষ্মীর বরদান।।

এই একই বিধান বা নিদান যাই বলুন, পালটে পালটে যায় এক পাঁচালি থেকে আর এক পাঁচালিতে। দেখা যাক একবার আরেক পাঁচালির এই অংশ—

নারদের বাক্য শুনি কহেন হরিপ্রিয়া।
বিশ্বমাতা আমি দেবী বিষ্ণুজায়া।।
যে যেমন করে সে তেমন পায়।
সে দোষে কর্মফল, করে হায় হায়।।
মহামায়ার স্বরূপে নারী সত্যবচন।
মর্তবাসী না মানে এই কথন।।
সদাচার কুল শীল দিয়া বিসর্জন।
ঘরের লক্ষ্মীকে করে সদা বর্জন।।
এমন মনুষ্যজাতি মহাপাপ করে।
কর্মদোষে লক্ষ্মী ত্যাজে তাহারে।।
নারীর পরম গতি স্বামী ভিন্ন কেবা।
ভুলেও না করে নারী পতি পদসেবা।।
যথায় স্বেচ্ছায় ঘুরিয়া বেড়ায়।
গুরুজনে নানা কটুবাক্য শোনায়।।
সর্বদা হিংসা করে না মানে আচার।
হিংসাতে তার মজে সংসার।।
ছড়া নাহি দেয়, প্রভাতকালে।
লক্ষ্মী সে স্থান ছাড়িয়া চলে।।
অতিথি যদি উপস্থিত হয় দ্বারে।
দূর দূর করি তাড়ায় তাহারে।।
যেবা গুরু, ব্রাহ্মণ দেখি ভক্তি নাহি করে।
মম নিবাস কভু নহে সেই ঘরে।।
এঁয়োতির চিহ্ন সিঁদুর শাখা না দেয়।
বাসী কাপড়ে যথা তথা বেড়ায়।।
স্নান নিত্য নাহি করে যে মনুষ্যগণ।
ত্যাজিয়া তাহারে, করি অন্যত্র গমন।।
তিথিভেদে যেবা নিষিদ্ধ দ্রব্য খায়।
হই না কভু তার ওপর সহায়।।
যে মনুষ্য ভক্তিভাবে একদশী না করে।
কদাপি নাহি থাকি তাহার ঘরে।।
উচ্চহাসি হাসিয়া যে নারী ঘোরে।
গুরুজন দেখি ঘোমটা না টানে।।
বয়োজ্যেষ্ঠ দেখি যারা প্রণাম না করে।
সন্ধ্যাকালে ধূপ দীপ নাহি দেয় ঘরে।।
ঠাকুর দেবতা আদি কভু না পূজে।
সাধু সন্ন্যাসী দেখি হাসাহাসি করে।।
এমন নারী যে গৃহেতে বসতি রয়।
লক্ষ্মী ত্যাজে তাহাকে জানিবে নিশ্চয়।।

এই ভাষ্যের শুরুতে তাও পুরুষকেও খানিক দোষ দেওয়া হয়েছে এই বলে যে, সদাচার কুল শীল দিয়া বিসর্জন ।/ঘরের লক্ষ্মীকে করে সদা বর্জন।।… তা বাদে বাকিটা আবার সেই ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ।

আমার মতো অনেক মেয়ের স্মৃতিতেই, ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার পর্বে, দিদিমা বা জ্যেঠিমা বা মায়ের পড়া পাঁচালির এই সব অংশে এসে ঠোক্কর খাওয়া যেন অনিবার্য ছিল। আমরা এসব শুনতাম ও হাসতাম, পুজোআচ্চাকে বর্জন করার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মীর পাঁচালিকেও বর্জন করতাম। মানসিকভাবে অন্তত। আমাদের কাছে একটা হাস্যকর রিগ্রেসিভ বিষয় থেকে গেছে লক্ষ্মীর পাঁচালি।

কিন্তু আজও, ২০১৮-তেও ঘরে ঘরে আমাদেরই মতো বয়সিনীরাই, পারিবারিক প্রথাকে মান্যতা দিয়ে, যতটা না ধর্মীয় কারণে তারও চেয়ে বেশি সাংস্কৃতিক চিহ্ন হিসেবে লক্ষ্মীপুজো করছি। এবং সঙ্গে পাঁচালিটাকেও ফেলতে পারছি না। এই জায়গা থেকেই উঠছে একটা দাবি অথবা প্রশ্ন।

পাঁচালির নবীকরণ করা যায় না? আনা যায় না একটা নিউ অ্যান্ড ইমপ্রুভড পাঁচালি? এই চিন্তা আমাদের মধ্যে কিছু বছর ধরে চারিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে অবহেলা করা হচ্ছে লক্ষ্মীর পাঁচালিকে ছোট করে দেখে। কেননা কথাগুলি নয় নয় করেও আমাদের কৌম স্মৃতিতে বা অবচেতনে থেকেই যাচ্ছে। তথাকথিত এগিয়ে যাওয়া মেয়েরা বছরের এক দিনে এই বই পড়ছেন দায়সারাভাবে। এতে ডাবল স্ট্যান্ডার্ডই গেড়ে বসছে।

নারীবাদী মেয়েদের বেশ কয়েকজন অন্য লেখালেখি ফেলে, লক্ষ্মীর পাঁচালি পুনর্লিখন করেন যদি? সমসাময়িক সার্বিক সমস্যা বা মেয়েকেন্দ্রিক সমস্যাগুলোর দিকে নজর দিই যদি?

কতগুলো সেকশন ভাবছিলাম। সামাজিক, স্বাস্থ্য, প্রকৃতি-পরিবেশ সচেতনতা, মেয়েদের প্রতি অত্যাচার, গৃহকর্ম ভাগ করে নেওয়া এইসব। ম্যানুয়ালের মতো হোক নতুন পাঁচালি। কোনও ডাক্তার যদি স্বাস্থ্য নিয়ে পাঁচালি লেখেন, মেনস্ট্রুয়াল হেলথ, প্রজনন, বোন হেলথ এগুলোর ভুল ধরান বা মিথ ভাঙানো যায়। ডোমেস্টিক অ্যাবিউজের ক্ষেত্রে কিছু আইনের কথাও এই ছলে বলা যায়। এভাবে। সত্যি কাজের কাজ হয় তবে। গ্রামেগঞ্জেও প্রোমোট করা যাবে তা, কেননা পাঁচালির মাধ্যমেই লোকশিক্ষেও হয়।

যেহেতু এ পাঁচালি কোনও একজনের লেখা না, তাই এর ভাষ্য বদল করাও সম্ভব, এরকমই মনে হয়।

এইসব ভাবতে ভাবতেই বেশ কিছু আপটুডেট পাঁচালি হাতে আসে এই সোশ্যাল মিডিয়ার হাত ধরাধরি করেই। কয়েকটা এখানে রাখা গেল।

প্রথমেই চৈতালী চট্টোপাধ্যায়ের লেখা শ্লেষাত্মক প্যারডি আকারের পাঁচালি। বের হয়েছিল আনন্দবাজার পত্রিকায়।

বসন্ত ঋতুর নিশি, নির্মল আকাশ
ধীরে ধীরে বহিতেছে মলয় বাতাস
বলিলেন নারায়ণ, কহ দেখি প্রিয়া
কী বা অসন্তোষ তব, কাঁদে কেন হিয়া।

অনেক কুটিল কীট, বাহির ও ঘর
ওড়ে আর বসে যায় পুরুষ অন্তর।
তখন বৈকুণ্ঠ হতে লক্ষ্মী নারায়ণ
মানুষের যত খেলা দেখেন দিয়া মন।
কমলা কহেন ‘দেব, এ কেমন লীলা?
ধরাধামে নারীজাতি সত্য অবলা’।

স্বামী কন, ‘শুন দেবী তোমার আদেশে
নারীগণ সুগৃহিণী, সতী সাধ্বী বেশে।
ঘরে ও আপিসে, তবু যত বেটাছেলে
ফূর্তি লুটিছে নিত্যকর্ম অবহেলে।’

লক্ষ্মী বলিলেন, ‘প্রভু, অভিধানে কয়
সতী ও অসতী-বাস নারীতেই রয়।
তাই তো বিধান লিখি, নারী শান্ত হলে,
লক্ষ্মীও অচঞ্চলা, থাকি তেলে জলে।’

হেনকালে নারদ আসি ঘর্ম মুছিল
চংক্রমণের শেষে ঢেঁকিটি নামিল।
কমলা কহিলেন, প্রতি বৃহস্পতিবারে
চিত্ত আকুল শঙ্খধ্বনি শুনিবারে।

কাষ্ঠহাসি নারদের, ‘দেবী, ঘরে-ঘরে
লক্ষ্মীমতি রমণীরা ক্রন্দন করে।
বাংলা ব্যান্ডে আমার বীণা বিক্রি করেছি
এই তো সংবাদপত্র, মর্তে কিনেছি।’

লক্ষ্মী নারায়ণ তামা তুলসী লয়ে হাতে,
শুনিতে বসেন তাহা, খবর আছে যাতে।
মর্তলোকে, আইনত, পুলিশ সুরক্ষায়,
কিন্তু তরুণী পুলিশ হলে তাঁরও বাঁচা দায়।
স্বামীরা স্বেচ্ছায় করে একাধিক বিয়ে
অরাজি প্রথমাকে মারে বালিশ চাপা দিয়ে।
একা মেয়ে রাত অনেক, যাতায়াতকাল
শেয়াল কুকুর সম পুরুষের পাল
ছিঁড়ে খায়। ছোট ভাই আসি, বাধা দেন
কী ফল হইল? তার অবাধ নিধন
অসুস্থ পুত্র সহ জননী হাঁটেন,
তাকেও মদ্যপ যৌন লালসায় কাটে।
যে নারী ভিন্ন জাতের কারও গাড়িতে চাপে
বিবস্ত্রা ঘোরানো হয় অমন পাপে
প্রথমে ধর্ষণ আর তার পরে খুন
মর্তের আকাশে সদা চিল ও শকুন।
আরও আছে নিগ্রহের নানা প্রকরণ।
আগুনে পোড়ানো, বিষ, অ্যাসিডে জ্বলন।

জলে ভাসে লক্ষ্মী সরা, ব্ল্যাক অ্যান্ড ওয়াইট
ছবি দেখে শুধোন বিষ্ণু, ‘হোয়াট ইজ ইট?’
নারদ মুনি দীর্ঘশ্বাসে, অস্ফুটে কন
সদ্যোজাত শিশুকন্যা, হত্যা আয়োজন।

এ পর্যন্ত শুনে লক্ষ্মী কানে হাত দিয়া
কহেন, ‘পাঁচালি গাই, নতুন করিয়া।
যে সংসারে লক্ষ্মীমন্ত পুরুষ না রবে
সেই ঘর ধনে জনে নির্বংশ হবে।
নারী নিগ্রহ ধোও, লয়ে ঝাঁটা ও বুরুশ
লক্ষ্মীর প্রদীপ জ্বালো যতেক পুরুষ।
শঙ্খ বাজাইবে, স্বাদু রন্ধন করিবে
আপিস ফেরত গৃহিণীকে পত্নীসেবা দিবে
এই মতো চলো’— বাধা দেন নারায়ণ
‘থাক দেবী, এখন তব ঘরে প্রয়োজন’

কমলা শুধোন, এ কি পিতৃতান্ত্রিকতা?
জিভ কাটিলেন দেব, ‘সে তো মর্ত কথা’!

অকস্মাৎ মূর্তিমান নারদ প্রবেশ
একটি রসের কেচ্ছা ছাড়ি অবশেষ
যদ্যপি নারীর অসম্মানই রেওয়াজ
তথাপি নারীদিবস, জেনো, আটই মার্চ।

চমৎকার শ্লেষ সত্ত্বেও এ পাঁচালি মূলত প্যারডি। এখানে মেয়েদের জীবনের দুঃখ দুর্দশার বাইরে যাওয়া হয়নি, সেটা করেছেন আর এক লেখিকা। অনুরাধা কুন্ডা। এখন ওয়াটস্যাপে তুমুল হিট তাঁর এই পাঁচালি।

ক্যাফেতে বসিয়া যবে লক্ষ্মী নারায়ণ
মৃদুস্বরে কফি যোগে করে আলাপন।
হরি কহে কেন নারী নহে ভক্তিমতী?
কেন বা পতিসেবাতে নাহি আর মতি?
লক্ষ্মী হাসি উঠি কহে, শুনো নারায়ণ
অতীব বিরক্ত হইয়া পাল্টাইয়াছি মন।
বলো তুমি কেন নারী মার খেয়ে মরে?
কেন বা মনের দুঃখে আত্মহত্যা করে?
কেনই বা বিবাহতে পণ দিতে হয়?
উচিত জবাব তুমি দাও মহাশয়!
হরি কহে এসব হল জগতের নীতি
পতি হল রমণীর অগতির গতি!
জগতে হতেছে আজি যত অনাচার
নারীর অধোগতিতে করিব বিচার।
শুনিয়া লক্ষ্মীদেবী আঁচল বাঁধিয়া
বলিলেন শুনো হরি শুনো মন দিয়া।
নারী আর না সহিবে কোনও অত্যাচার
কাঁদিবে না গৃহকোণে বহি দুঃখভার।
জনম লগনে শুনো কেহ কম নয়
কর্মের বিচারে হবে বাকি পরিচয়।
বিদ্যা শিক্ষা করি নারী অর্থ উপার্জিবে
পরজীবী হইয়া আর নারী না রহিবে।
প্রথমত গৃহশ্রমে দিতে হবে দাম
বিনা অর্থে নারী আর করিবে না কাম।
হরি বলে লক্ষ্মী তুমি এ কী কথা বলো?
“লেবার অফ লাভ” তবে হইবে কি বিকল?
হাসি লক্ষ্মী বলে শুনো ধূর্ত শিরোমণি!
“লেবার অফ লাভ”কে আমি খুরে খুরে নমি!
মিষ্টি মুখে ভুলাইয়া করাইবে কাজ
কাজ শেষে বলি দিবে গৃহে যাও আজ!
নারী তো জানে না কোনটি নিজ গৃহ তার
এইসব বাড়াবাড়ি চলিবে না আর!
করিবে চাকুরি নারী, বানাইবে বাড়ি
দেখিয়া ছিঁড়িতে পারো নিজ চুল দাড়ি।
কর্মে রহিয়াছে নারীর পূর্ণ অধিকার
বেতনেও কারচুপি চলিবে না আর।
কন্যাভ্রূণ হননেতে চাহি সুবিচার
জগতে নারীরও আছে অধিকার বাঁচার।
অর্থ নিয়ন্ত্রণ হল সর্ব সেরা বল
সভা করিবার লাগি খুঁজিতেছি হল।
বিষণ্ণবদনে হরি বলিল হে প্রিয়ে
“স্বামী”ডাক তব মুখে জুড়াইত হিয়ে।
আজ তুমি নাম ধরি কেন ডাকো মোরে?
লক্ষ্মী কহে সাতটি কাণ্ড রামায়ণ পড়ে
না হইল আক্কেল, না হইল শিক্ষা
পদতলে বসি আর করিব না ভিক্ষা।
নাম ধরি ডাকিব হে প্রিয়তম মোর
ফিনান্স আমার হাতে, ছাড়িব না ডোর
তুমি আমি এক বৃন্তে দুইটি গোলাপ
কেহ কারও প্রভু নহে, কোরো না বিলাপ।
বাড়ি গিয়া করি আনো এক কাপ চা
চঞ্চলা বলিয়া আমার ব্যথা হইল পা।
আমি যদি আটা মাখি তুমি সেঁকো রুটি
হিট হইবে আমাদের নব্যযুগ জুটি।
রাঁধিয়া রাঁধিয়া আমার লাগিতেছে বোর
এবার হেঁশেল তুমি দেখো প্রিয় মোর।
বাজার করিব আমি, রাঁধিও খিচুড়ি
রন্ধনেতে প্রাণ দিয়া হইব না বুড়ি।
মর্তলোকে নারী ফলো করিবে আমারে
লক্ষ্মীপূজা এইরূপে প্রতি ঘরে ঘরে
ছড়াইবে কৃতী নারী, স্বাবলম্বী নর
লক্ষ্মী লক্ষ্মী বলো সবে বিশ্বচরাচর।

শুনো শুনো নারীগণ, হইয়া সবলা
ঘুচাও মনের খেদ, নহ তো অবলা।
সচলা হইয়া করো আপিস গমন
সর্বাগ্রে কর্ম, রাখো নিজের মনন।
যদিবা সংকট আসে, ধীর ধরো মনে
জানিও অনেক বাধা পাইবে জীবনে।
যে শ্রম দিতেছ গৃহে তাহা অতি দামী
মিটি মিটি হাসে দেখো ঐ অন্তর্যামী।
কাজেই নিজের স্বাস্থ্য না করিও হেলা
নচেৎ সময়মতো পেতে হবে ঠেলা।
সকালে উঠিয়া কোরো প্রাতঃভ্রমণ
খাইও মনের সুখে যা করিবে রন্ধন।
খাইও না শেষ পাতে সকলের পরে
নিজের যত্নটুকু করিবার পরে
সকলের দেখাশোনা করিয়া যতনে
দেখিবে রতন শুধু চিনেছে রতনে।
নিজস্ব সঞ্চয়টুকু বড় দরকারি
অসময়ে কাজে দেবে, আসিবে না হরি।
গাছের খুঁড়িয়া গোড়া জল দিও তাতে
ঐ গাছই ছায়া দিবে বিজনবেলাতে।
দিনক্ষণ দেখিও না, দেখিও মানুষ
নতুবা যতই করো হইবে ফানুস।
জিন্স, শর্টস, লং স্কার্ট না করিও ঘৃণা
শাড়িও পরিও, জেনো ইয়েহি হ্যায় জিনা।
পোশাক অধিক কোরো মনের যতন
পাইলে পাইতে পারো অমূল্য রতন।
অপরেরে বল দিও, নিজেরে শকতি
দেবতা অধিক করো কাজেরে ভকতি।
নিজের কাজের দাম করিও না কম
দেখিবে প্রবল জোরে বেড়ে যাবে দম।
লক্ষ্মীমতী নারী, যারা এই রূপ করে
প্রবলা হইয়া রাজে এই সংসারে।

তৃতীয় পাঁচালির লেখক একটি তরুণ যুবা, মঞ্জিস রায়। এটি দিয়েই শেষ করি। রিয়েল লাইফ স্টোরি এই, যে, সে তার মা’কে পুজো করতে অনুরোধ করে, তার মা বলে, পাঁচালির কথা তাঁর ভালো লাগে না। সে বলে, আমি যদি লিখি? মা বলে, লিখবি? আচ্ছা, লেখ তো আগে?

“আমার কল্পনায় লক্ষ্মী এবং নারায়ণের কথোপকথন। পাঁচালির ফর্মে লেখা— মঞ্জিস রায়।

কত গ্রীষ্ম বর্ষা যায় মনেতে ভাবনা।
কেমনে রচনা করি লক্ষ্মীর বর্ণনা।।
দেখিতে দেখিতে আসে আশ্বিন বেলা।
নদীকূলে দোলা দেয় কাশফুল মেলা।।
মর্তেতে হিংসার অগ্নিবরষণ।
তাহা হেরি কাঁদে দোহে লক্ষ্মীনারায়ণ।।
নারায়ণ কহে আজও কাটেনি আঁধার।
অযোগ্য পুরুষ যতেক করে অহঙ্কার।।
কমলা কহিলা কথা মৃদু মৃদু হেসে।
আমারে পূজিছে নারী আজও ভালোবেসে।।
নারীর গুণের কথা হয় না তো শেষ।
তাদের আলোতে আজ আলোকিত দেশ।।
শুনো তবে নারায়ণ শুনো দিয়া মন।
আজই আমি সে নারীর করিব বর্ণন।।

বাংলার উত্তরে তুমি যদি কভু যাও।
সে নারীর দেখা তুমি নিশ্চয় পাও।।
স্বর্ণপদক আনে স্বপ্নের মেয়ে।
ছেলেবেলা কাটে তার আধপেটা খেয়ে।।
নারীদের কাছে ধরা দিল মহাকাশ।
পূর্ণ হয়েছে আজ নারীর আকাশ।।
কত নারী গান গেয়ে মাতাল ভুবন।
কত জনা লেখনীতে আনিল জীবন।।
ম্লানমুখে শ্বাস ছাড়ি কহে নারায়ণ।
বন্ধ রহিল আজও কত বাতায়ন।।
দক্ষিণ ভারতে আছে এক দেবালয়।
দেবতা সেখানে বড় সঙ্কীর্ণ হয়।।
প্রবেশিতে নাহি পারে ঋতুমতী নারী।
পূজা করিবার তারা নহে অধিকারী।।
লক্ষ্মী বলে দেব তুমি ত্যাজ দুঃখশোক।
বিচিত্র মানুষে ভরা এই মর্তলোক।।
নদীকূলে ছিল এক শান্তিকুটির।
থাকিত মানবী সেথা মতি তার স্থির।।
পুতুল বানায়ে নিয়ে বেচিত সে হাটে।
মনের সুখেতে সে যে সারাদিন খাটে।।
কভুও সে ছলনার না লয় আশ্রয়।
সকলের সনে সে যে মিষ্ট কথা কয়।।
দেবালয় যাইবার কিবা প্রয়োজন।
থাকে যদি এইরূপ বড় তার মন।।
তবুও কহিব আমি শুন নারায়ণ।
দেবালয় নহে কারও আপনার ধন।।
নারীর প্রবেশপথ রুধিবে যাহারা।
কদাপি শান্তি যেন না পাবে তাহারা।।
দেবতার বেশে কত শত নরগণ।
শিকলে যে বাঁধে তারে যখন তখন।।
কভু আমি চাহি নাই নারীর বন্ধন।
পুরুষেরা ভালোবাসে তাহার ক্রন্দন।।
নারায়ণ কহিলা আর বিলম্ব নয়।
মর্তবাসীরা তব পথ চেয়ে রয়।।
হেনকালে লক্ষ্মী চলে মর্তের পানে।
মঞ্জিস আবাহন করে গানে গানে।।”