Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ইহুদিপাড়ার শেষ দীর্ঘশ্বাস

পরিমল ভট্টাচার্য

 

সকালের পর ঝাপসা আকাশে সূর্যের চারদিকে রামধনুর এক অদ্ভুত বলয় ফুটেছিল। দুপুরের দিকে হঠাৎ দেয়ালে চোখ পড়তে দেখি অসংখ্য কালো পিঁপড়ে, ছোপ ছোপ মেঘের মতো। সেই মেঘটা ছড়িয়ে যেতে লাগল দ্রুত। তারপরে শুরু হল হাওয়া। আমাদের বাগানে কচি আম্রপালী গাছটা, এবছর যার প্রথম গুটি ধরেছে, পাঁচিলের গায়ে মাথা কুটতে লাগল ঝুমকো গয়নাপরা কনেবউয়ের মতো। ক্রমশ হাওয়ার তেজ বাড়ছে, সেই চেনা মিষ্টি শোঁ শোঁ শব্দটা শোনা যাচ্ছে, সুপুরি গাছের সারি মাথা দোলাচ্ছে যেন বুনো হাতির পাল, শুকনো বালদো খসিয়ে দিল কেউ কেউ। আকাশে লাট খেতে খেতে উড়ে গেল এক ঝাঁক বক, এক মুঠো ঝাউপাতা, ঘন শ্লেটরঙা মেঘের নিচে আসতেই ফটফটে সাদা হয়ে ফুটে উঠল বকের সারি। তারপরে শুরু হল। প্রথমে একটা দুটো বড় বড় ফোঁটা, গরম, অনেকদিনের বুকচাপা কান্নার মতো। সামনের বাড়ির রোয়াকে এলোঝেলো নিতু পাগলা চেঁচিয়ে উঠল— আয়! আয়! আয়! তার আগে অবশ্য একটা অম্ল গন্ধ ফুটেছিল আকাশের গায়ে। এবং তারপর ঝুমঝুম ঝমঝম, গরম অ্যাশফল্টে ধোঁয়া উঠছে ছাটের ধাক্কায়, লক্ষকোটি জলের ফুল ফুটছে দোপাটি চতুস্পাটি, বাঁধানো রাস্তার পাশে মাটি জল খাচ্ছে গুবগুব করে, জলের ওপরে বুদবুদগুলো যেন কিলবিল করছে ডাঁশমাছি। একসারি জলফোঁটা প্যারেড করে চলেছে ইলেকট্রিক তারের নিচ দিয়ে, যেখানে দাঁড়িয়ে ঝুপ্পুস ভিজছে তিনটে চড়াই। মাটির সোঁদা গন্ধ, কতদিন পর। জানলার ঠিক নিচে কার্নিশে এসে বসেছে একটা শালিখ— কতদিন পর। শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়ায় ওর ভিজে পালকগুলো খাড়া, ঘাড় বেঁকিয়ে হলুদ টানা বার্নল-রঙা চোখে দেখছে নিচে ড্রেনে খলবলানো জলস্রোত: ভেসে যাচ্ছে নিমপাতা, আইসক্রিমের চামচ, একটা কাগজের নৌকো… রুলটানা, হাতের লেখাটা চেনা। আমার বঙ্গলিপি অঙ্ক পাতা!

স্বপ্নটা ছিঁড়ে গেল। বাইরেটা কেমন ঘোলাটে, থমথমে। মাথার ওপর খড়কাটা মেশিনের মতো শব্দে পাখাটা কুচি কুচি করছে বিশুষ্ক বাতাস। তৃষিত গ্রীষ্মে কালবৈশাখীর দিবাস্বপ্ন, মধ্য বর্ষায় ছুটির দুপুরে কেন দেখলাম?  বেশ কিছুদিন হল এক ফোঁটা বৃষ্টি নেই শহরে, উত্তরবঙ্গে তাপপ্রবাহ চলেছে। খবরের কাগজের একটি শিরোনাম চোখ টেনেছিল, খবরটা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

কুলার এসি-র খোঁজ পড়েছে দার্জিলিঙে

তাপমাত্রার পারদ আচমকা ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় আচমকা বদলে গেল দার্জিলিঙের চেনা ছবি। শুক্রবার সকাল থেকে বিকেল অবধি তীব্র গরমে হাঁসফাঁস করছিল দার্জিলিং শহর। এদিন দার্জিলিঙের সর্বোচ্চ  তাপমাত্রা পৌঁছোয় ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে… (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২১ জুলাই ২০১৮, শনিবার)

ভবিষ্যতের ধারণা

কল্পনা করুন, আজ থেকে দু লক্ষ বছর আগে ভিন গ্যালেক্সি থেকে একদল জীববিজ্ঞানী ব্রম্ভাণ্ডের অন্যত্র প্রাণের সন্ধান করতে গিয়ে পৃথিবীকে আবিষ্কার করেছে। মহাকাশযানটি আফ্রিকার রিফ্ট ভ্যালির ওপর দাঁড় করিয়েছে তারা। আমাদের এই মানবপ্রজাতির জন্ম হচ্ছে যখন, সেইসময় ম্যামথ, ফলার মতো দাঁতওয়ালা বাঘ, অতিকায় মোয়া পাখি আর দৈত্যাকার স্লথরা এই গ্রহের পিঠে বিরাজ করছে। দূর গ্যালেক্সির পর্যটকেরা কী দেখতেন? দেখতেন আদিগন্ত ঘাসে ছাওয়া জমির ওপর আশ্চর্য সব উদ্ভিদ ও প্রাণী। এবং তাদের মধ্যে সদ্য উদ্ভুত একটি প্রজাতিও রয়েছে, তার নাম হোমোস্যাপিয়েন্স। এই যে ক্ষুদ্র ও খাড়া বানর গোত্রের প্রাণীটির ধূমকেতুর মতো উত্থান ঘটবে আগামী দু হাজার বছরের মধ্যে, আগন্তুক বিজ্ঞানী দল তাদের প্রতি বিশেষ নজর দিতেন বলে মনে হয় না। এই আদি মানবেরা ছোট ছোট পারিবারিক দলে থাকত, ওয়াইল্ডবিস্ট ও শিংওয়ালা হরিণ জাতীয় প্রাণীদের বিশাল বিশাল জেরার সঙ্গে তার কোনও তুলনাই চলে না। অন্যান্য প্রজাতির তুলনায় এরা যে খুব বড়সড়, বলশালী অথবা দ্রুতগতি ছিল, কিংবা ইন্দ্রিয়ের বিশেষ তীক্ষ্ণতা ছিল, এমনও নয়। কিন্তু এই আদি মানবদের টিকে থাকার জন্য একটি জিনিস ছিল যা চোখে দেখা যেত না। তার কারণ সেটি ছিল তাদের মাথার খুলির ভেতর, এবং তাদের আচার আচরণের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পেত। বিশাল আর জটিল  মস্তিষ্কের সুবাদে প্রখর বুদ্ধি ছিল তাদের, ছিল অমিত স্মৃতিধারণের ক্ষমতা, এবং সেইসঙ্গে অদম্য কৌতূহল আর বিস্ময়কর সৃজনশীলতা। এই বৈশিষ্ট্যগুলি তাদের শারীরিক আর ইন্দ্রিয়ের ঘাটতি মিটিয়ে দিয়েছিল অনেকগুণ।

বিবর্তিত মানব মস্তিষ্ক জন্ম দিয়েছিল এক নতুন ধারণার : তার নাম ‘ভবিষ্যৎ’। বাস্তবে বর্তমান আর আমাদের স্মৃতিতে ধরে রাখা অতীতেরই কেবল অস্তিত্ব রয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতের এই ধারণার জন্ম দিয়ে আমরাই হয়ে উঠলাম পৃথিবীতে একক প্রজাতি, যারা বুঝতে পারলাম যে বর্তমানের কর্ম দিয়ে আমরা এরপরে কী ঘটবে তাকে প্রভাবিত করতে পারি। এভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে আমরা সম্ভাব্য বিপদ অথবা সুযোগ আন্দাজ করতে পারি। এবং এই দূরদৃষ্টি এক মস্ত বড় সুবিধে, যা হোমোস্যাপিয়েন্সকে গ্রহের সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রজাতি করে তুলল।

–ডেভিড সুজুকি

গোটা উত্তরবঙ্গ যখন বৃষ্টিপাতের অভাবে পুড়ছে, দার্জিলিঙে গ্যাংটকে মানুষ এসি কুলারের জন্য দোকানে লাইন দিচ্ছে, ঠিক তখনই একটানা অবিরাম বর্ষণে বিপর্যস্ত কেরালা। এর অব্যবহিত পরেই সেখানে শুরু হল বিগত নব্বই বছরের ভয়ঙ্করতম বন্যা। ইতিমধ্যে চারশোর বেশি মানুষ মারা গিয়েছে, ঘরছাড়া দশ লক্ষেরও বেশি, গবাদি পশু ফসল সম্পত্তি ও অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অপরিমেয়। এই লাইনগুলো লিখছি যখন, বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে জল নামেনি, শরণার্থী শিবিরে বাস করছেন অসংখ্য মানুষ। এবারের বন্যার প্রভাব পড়েছে রাজ্যের চোদ্দটির মধ্যে দশটি জেলায়। এছাড়া সীমান্তবর্তী কর্নাটকের কুর্গ ও কোডাগু জেলাতেও বন্যার ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। জল বাড়ার কারণে প্রায় সাতাশটি জলাধার খুলে দেওয়া হয়, ফলে নদীনালায় প্রবল জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় বিস্তীর্ণ জনপদ। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ইডুক্কি বাঁধের লকগেটগুলি ষোল বছর পরে খোলা হল এই প্রথম। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে পার্বত্য অঞ্চলগুলিতে ভূমিধসের কারণে। কুড়ি হাজারের বেশি বাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে, ভেসে গিয়েছে দশ হাজার কিলোমিটারের মতো রাস্তা, অসংখ্য সেতু। সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ।

এই মাপের একটি বিপর্যয়ের জন্য প্রস্তুত ছিল না কেরালা ও কর্নাটকের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষ। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘটমান পরিস্থিতির ভিডিও ছবি দেখে শিউরে উঠেছে দেশবাসী। সুলভ মোবাইল ক্যামেরার এই যুগে কেরালার বন্যা হয়ে উঠেছে সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে ব্যাপকভাবে চলচ্চিত্রায়িত প্রাকৃতিক বিপর্যয়।

এবং সবচেয়ে স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় পূর্বঘোষিত বিপর্যয়।

লালসা আর ক্ষুধা

ভারত উপদ্বীপের রক্ষক, গোদাবরী কৃষ্ণা নেত্রাবতী কাবেরি কুন্তী ভাইগাই ও অন্যান্য অসংখ্য নদীর জননী এই পশ্চিমঘাটকে কালিদাস তুলনা করেছেন এক মোহময়ী নারীর সঙ্গে— অগস্ত্যমালাই হল এর মস্তক, আন্নামালাই ও নীলগিরি দুই বক্ষ, কন্নড় ও গোয়ার চওড়া পাহাড়শ্রেণি এর জঘনের বিস্তার, উত্তর সহ্যাদ্রি হল পা। একদা সবুজের নানা বর্ণের শাড়িতে আচ্ছাদিত ছিল এই রমণীর দেহ, আজ সেটি শতচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে। ধনীর লালসা তাকে ছিঁড়ে কুটিকুটি করেছে, টিকে থাকার জন্য দরিদ্রের ক্ষুধা তাকে কুরে খেয়েছে। এ হল এক বিপুল ট্র্যাজেডি, কারণ এই পর্বতমালা হল গোটা দক্ষিণ ভারতের পরিবেশ ও অর্থনীতির শিরদাঁড়া।

–ওয়েস্টার্ন ঘাটস ইকোলজি এক্সপার্ট প্যানেল রিপোর্ট

ওয়েস্টার্ন ঘাটস ইকোলজি এক্সপার্ট প্যানেল রিপোর্টের প্রস্তাবনায় ওপরের এই চিত্রকল্পটি আমার মনে পড়ে গেল মঞ্জরাবাদ কেল্লার মাথায় দাঁড়িয়ে। ঠিক দু বছর আগে মধ্য জুলাইয়ের দিকে একটি দিন, আকাশে ছেয়ে আছে জলভারাতুর মেঘ। তিনদিকে যতদূর চোখ যায় সবুজ অরণ্য আর পাহাড়শ্রেণির ঢেউ, বর্ষার জলে পুষ্ট হয়ে উজ্জ্বল হয়েছে। পশ্চিম দিকটায় পাহাড়শ্রেণি ধাপে ধাপে ক্রমশ নিচু হয়ে সমতলে মিশেছে। দুটি-তিনটি নদীর রুপোলি রেখা হারিয়ে গিয়েছে দিকচক্রবালে। ওদিকটা আবছা হয়ে আছে। স্বচ্ছ নির্মল দিনে এই মঞ্জরাবাদ কেল্লার মাথা থেকে নাকি পশ্চিমে আরব সাগরের নীল জলরাশি দেখা যায়। গভীর অরণ্য পাহাড়ের মাথায় টিপু সুলতান নক্ষত্রের আকারের এই কেল্লাটি গড়েছিলেন, যাতে এখান থেকে বিদেশি শত্রুর নৌবাহিনির ওপর নজর রাখা যায়। কিন্তু মধ্য বর্ষায় মেঘ আর বাষ্পে ভরা বায়ুমণ্ডল, সে উপায় ছিল না। তাছাড়া এখানে অরণ্য এখনও এত গভীর যে বছরের বেশিরভাগ সময় কুয়াশায় ঢাকা থাকে বিস্তীর্ণ অঞ্চল। মঞ্জর, অর্থাৎ কুয়াশা— সেই থেকেই টিপু সুলতান এই অঞ্চলের নামকরণ করেন মঞ্জরাবাদ। ব্রিটিশ শাসকেরাও সেই নামই ব্যবহার করেছে। যদিও এর স্থানীয় নাম হল সকলেশপুর। এটি কর্নাটকের হাসান জেলার অন্তর্গত। এ হল পশ্চিমঘাটের শেষ গহীন অঞ্চল : পাহাড়ের কোলে ছোট ছোট গ্রাম আর কফি ও এলাচের প্ল্যান্টেশান। তাকে ঘিরে আছে সজীব গভীর অরণ্য। এত বছর ধরে ধনীর লালসা আর গরীবের ক্ষুধা সত্ত্বেও যা এখনও সত্যিই বিস্ময়কর।

ঘোর বর্ষায় এই অরণ্য প্রকৃতির রূপ দেখব বলে এখানে এসেছি, আমার গাইডবই হল ওয়েস্টার্ন ঘাটস ইকোলজি এক্সপার্ট প্যানেলের ওই রিপোর্টটি। মুম্বাই থেকে কোঙ্কন রেলে চেপে দক্ষিণ গোয়ার মারগাঁও, সেখান থেকে পূর্বে ব্রাগাঞ্জাঘাট পেরিয়ে দান্ডেলি অভয়ারণ্য আর দুধসাগর ঝর্ণার বর্ষাপুষ্ট অবিস্মরণীয় রূপ, সেখান থেকে উপকূল ধরে কারোয়ার উডুপি হয়ে ম্যাঙ্গালোর, ও তারপর ফের পূর্বদিকে ঘন পাহাড় জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সুব্রমণ্য রোড হয়ে এই সকলেশপুরে। মুম্বাই থেকে গোটা পথটাই অনুসরণ করছে এই পশ্চিমঘাটকে—  অরণ্য পাহাড় নদী ঝর্ণা উপত্যকাভূমি আর পশ্চিমে আরবসাগর। এমন অপূর্ব সৌন্দর্য আর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের সমাহার আর কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। দক্ষিণ মহারাষ্ট্রের রত্নাগিরি অঞ্চল ছুঁয়ে কোঙ্কন রেলের পথ ক্রান্তীয় বনভূমিতে ছাওয়া পাহাড় ফুঁড়ে গোয়া উপকূলের বিস্তীর্ণ ম্যানগ্রোভের ওপর দিয়ে অসংখ্য সুউচ্চ সেতু আর সুড়ঙ্গ পার হয়ে চলেছে মালাবারের দিকে। তবে ম্যাঙ্গালোর থেকে সকলেশপুর আসার পথে, বিশেষত সুব্রমণ্য রোড পার হবার পর যে অরণ্য দেখেছি তার সত্যিই কোনও তুলনা নেই। বর্ষার জলে পুষ্ট অসংখ্য ঝর্ণা নামছে পাহাড়ের গা বেয়ে, তাদের রূপোলি নিঃস্বন ধ্বনিত হচ্ছে ঘন আদিম সুপ্রাচীন বনস্পতির ছায়াছন্ন অরণ্যে। কালিদাসের বর্ণনামাফিক যদি অগস্ত্যমালাই হয় মস্তক, আন্নামালাই ও নীলগিরি বক্ষ, কন্নড় ও গোয়ার পর্বতমালা হয় শ্রোণি এবং উত্তর সহ্যাদ্রি হয় পা, তাহলে এই হল পশ্চিমঘাটের গহীন হৃদয়।

বছরে পাঁচ হাজার মিলিমিটারেরও বেশি বৃষ্টিপাত হয় এখানে। এমন সব বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী রয়েছে, সারা বিশ্বে যাদের শুধুমাত্র দেখা মেলে এখানেই। ওয়েস্টার্ন ঘাটস ইকোলজি এক্সপার্ট প্যানেলের রিপোর্ট অনুযায়ী পশ্চিমঘাটের বিভিন্ন অঞ্চলে ৫৩% চিরসবুজ বৃক্ষ, ৭৬% ফড়িং, ৪০% প্রজাপতি, ৪১% মাছ ও ৭৮% ব্যাং হল এন্ডেমিক, অর্থাৎ আর কোথাও নেই। জীববৈচিত্র্যের এ এক বিপুল রত্নভাণ্ডার। পূর্বসূরিদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছ থেকে ধার নেওয়া— পরিবেশ সম্পর্কে এই চালু প্রবচনটি এখানে এক গভীর আর্তি নিয়ে বাঙ্‌ময় হয়ে ওঠে। আগামী দিনে নানা অজানা দুরারোগ্য রোগের ঔষধ থেকে শুরু করে পরিবর্তিত জলবায়ুতে নতুন অপ্রচলিত খাদ্যের উৎস, অর্থাৎ ভবিষ্যৎকালে জীবনের চাবিকাঠি রয়েছে এখানে। এই পশ্চিমঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা চিরতরে হারিয়ে যাবে, কারণ এইসব প্রজাতি যে বিশ্বে আর কোথাও নেই।

এই পশ্চিমঘাটকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে মাধব গ্যাডগিলের নেতৃত্বে এক বিশেষজ্ঞ কমিটি সংরক্ষণের যে রূপরেখা তৈরি করে, এক কথায় তা পথপ্রদর্শক। চারটি রাজ্যের (মহারাষ্ট্র, গোয়া, কর্নাটক ও কেরালা) মধ্যে ছড়িয়ে থাকা এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে বাস্তুতান্ত্রিক সংবেদনশীলতার দিক থেকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে— ইকোলজিকালি সেন্সিটিভ জোন ১, ২ ও ৩। এই প্রতিটি জোনে কোথায় কীভাবে কৃষিকাজ, পশুপালন, বনসৃজন, মাছচাষ ও অন্যান্য জীববৈচিত্র্যের ব্যবহার করা যাবে, কোন কোন অঞ্চলে খনি, পাথর ও বালি খাদান করা যাবে, পর্যটনের জন্য হোটেল রিসর্ট ইত্যাদি করা যাবে বা আদৌ যাবে কি না, তার স্পষ্ট নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে।

এক থেকে তিন, এই প্রতিটি ইকো-সেনসিটিভ জোনে কীভাবে, কোন প্রকারে জল, নিকাশি, বনসৃজন, মাছচাষ, জৈব বৈচিত্র্যর ব্যবহার, খনি, পাথর খাদান ও বালি খাদান, লাল ও কমলা তালিকাভুক্ত শিল্প (যেমন কয়লাচালিত বিদ্যুৎ), সবুজ ও নীল তালিকার (অর্থাৎ কম দূষণকারী) শিল্প, শক্তি, পরিবহন, পর্যটন, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও তার অধিকার— এসব কেমনভাবে কোন জোনে করা যাবে বা আদৌ যাবে কিনা, এবং কীভাবে যাবে, তার দিকনির্দেশ আছে এই রিপোর্টে। জাতীয় উদ্যান বা অভয়ারণ্যের মতো সংরক্ষিত বনগুলিকে এসবের বাইরে রাখা হয়। তবে সেই ঔপনিবেশিক কাল থেকে চলে আসা বহিষ্কারের নীতির মতো অরণ্যের আশেপাশে বসবাসকারী সাধারণ মানুষকে এই উন্নয়ন পরিকল্পনার বাইরে রাখা হয়নি। বরং স্থানীয় স্তরে গ্রামসভা করে স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, কমিউনিটি ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট ও বন অধিকার আইন নিবিড় রূপায়ণের কথা বলা হয়েছে।

রাষ্ট্রের উদ্যোগে তৈরি একটি রিপোর্ট, দেশের শ্রেষ্ঠ পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের দ্বারা রচিত, বিশ্বের অনন্যোপম একটি অঞ্চল, এবং ঘটনাচক্রে ভারতবর্ষের মধ্যে তুলনামূলকভাবে আর্থসামাজিক দিক দিয়ে উন্নত ও শিক্ষিত মানুষের বাস এমন এক অঞ্চলে। কিন্তু রিপোর্টটি প্রকাশিত হবার পর যা ঘটল তা অপ্রত্যাশিত। যে ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর কায়েমি স্বার্থের খপ্পর থেকে পশ্চিমঘাটকে বের করে তাকে রক্ষা করা, এবং গ্রামসভার মারফৎ সেখানে বসবাসকারী সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়নের প্রতিশ্রুতি ছিল, তার ওপর নেমে এল কর্পোরেট ব্যবসায়ী ও অন্যান্য কায়েমি গোষ্ঠীর আঘাত। তাতে সামিল হল রাজনৈতিক দলগুলি। সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে তোলা হল, বিক্ষোভের আগুন দাবানলের মতো ছড়িয়ে দেওয়া হল রাজ্যে রাজ্যে, এমনকি মাধব গ্যাডগিলের কুশপুতুলও পোড়ানো হল। (ভারতবর্ষের ইতিহাসে তিনিই বোধহয় একমাত্র বিজ্ঞানী যিনি শুধুমাত্র একটি রিপোর্ট লিখে কুশপুতুল হয়ে পোড়ার বিরল সম্মান অর্জন করলেন।) এবং সবচেয়ে বিস্ময়কর হল, মালাবারের ক্যাথলিক চার্চ ও বামপন্থীরা, যারা নাকি প্রান্তিক মানুষ ও চাষিদের স্বার্থরক্ষার জন্য কাজ করে, তারাও রিপোর্টের বিরোধিতায় পথে নামল।

এর পরের ঘটনাক্রম আমাদের জানা। ওয়েস্টার্ন ঘাটস ইকোলজি এক্সপার্ট প্যানেল রিপোর্ট নিক্ষিপ্ত হল বিস্মৃতির হিমঘরে। তড়িঘড়ি মহাকাশ বিজ্ঞানী কস্তুরীরঙ্গনকে দিয়ে তৈরি করা হল আরেকটি রিপোর্ট, যেখানে আগের রিপোর্টের রক্ষাকবচগুলি শিথিল করে দেওয়া হল।

বিজ্ঞানী কখন কুশপুতুল হন? যখন তাঁর জ্ঞানে এসে যুক্ত হয় ভবিষ্যৎদ্রষ্টার প্রজ্ঞা। পশ্চিমঘাটের ভঙ্গুর পাহাড় অঞ্চলে পাথরের খাদান ও পর্যটনের জন্য অপরিকল্পিত নির্মাণ বন্ধ না হলে, নির্বিচার অরণ্য নিধন চলতে থাকলে, ভয়ঙ্কর বিপর্যয় নেবে আসবে— এ কথা মাধব গ্যাডগিল একাধিকবার বলেছেন। মিডিয়ায় কেরালার ভয়াবহ বন্যার খবর আসছে যখন, একের পর এক বাঁধের জল ছাড়া হচ্ছে আর ভেসে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকা, সেই পরিচিত বিখ্যাত জায়গাগুলোর ছবি দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাচ্ছিল তাঁর কথাগুলো। এবার বুঝি প্রকৃতি কথা বলছে, এতদিন মুখ বুঝে অত্যাচার সহ্য করার পর : নদী পাহাড় বন কথা বলছে। পাখির কলতানে, ঝর্ণার নুপুর কিংবা নদীর মিঠে কলকল ধ্বনিতে নয়— মজ্জায় শীতল স্রোত বইয়ে দেওয়া জলের গর্জন আর গাছপালা বাড়িঘর সমেত সবকিছু হুড়মুড় করে ধসে পড়ার শব্দে। মানুষের যুদ্ধং দেহি ডাকে সাড়া দিয়েছে অবশেষে।

হোয়াটস্অ্যাপে কেরালার এক বন্ধুর পাঠানো একটি ভিডিওয় কোচি শহরের ওপর দিয়ে জল বয়ে যাওয়ার ছবি দেখতে দেখতে আমার মনে পড়ে গেল একটি ইন্সটলেশানের কথা। ২০১৬য় কোচি-মুজিরিস বিয়েনালেতে দেখেছিলাম। সম্প্রতি দুবছর অন্তর হয়ে চলেছে এই বিয়েনালে— ফোর্ট কোচি দ্বীপ জুড়ে নানা ধরনের ইন্সটলেশান শিল্পের প্রায় তিনমাসব্যাপী এক বিশাল উৎসব, প্রায় ষাটটির ওপর দেশের শতাধিক শিল্পীর কাজ নিয়ে প্রদর্শনী। ফোর্ট কোচির বন্দর ঘেঁষে প্রাচীন মশলার গুদাম আর ঔপনিবেশিক বণিক ও শাসকদের ছড়ানো হেরিটেজ ভিলা আর প্রাসাদগুলো ব্যবহার করা হয় এজন্য। এবারেও ডিসেম্বরে শুরু হবার কথা ছিল  কোচি-মুজিরিস বিয়েনালে।

মুজিরিস হল প্রাচীন ইতিহাসের বন্দরনগরী, যা চোদ্দ শতকে পেরিয়ার নদীতে বিধ্বংসী বন্যায় চিরকালের মতো হারিয়ে গিয়েছিল। তার আগে পর্যন্ত ভারত মহাসাগরে নৌবাণিজ্যের এক প্রধান কেন্দ্র ছিল এই মুজিরিস। রোমান মিশরীয় চিনা গ্রিক ও ফিনিশিয় বণিকেরা আসত, মশলা রত্ন রেশম কচ্ছপের খোল ইত্যাদি বিকিকিনি হত। মুজিরিস বন্দরের অবলুপ্তি আর কোচি বন্দরের উত্থান ঘটে প্রায় একই সঙ্গে। কিছুটা প্রকৃতির খামখেয়ালে, বাকিটা মানুষের উদ্যোগে। তারপরে কোচিতেও অচিরেই ডাচ পর্তুগিজ চিনা আরব এবং সর্বোপরি ইহুদিদের সমাগম হয়। বেশ কিছুকাল হল এই অঞ্চলে সেই মুজিরিস সভ্যতার পুরাতাত্ত্বিক খনন শুরু হয়েছে, উঠে আসছে বহুকাল আগে লুপ্ত এক সময়ের পদচিহ্ন।

শিল্পী ভিভান সুন্দরমের একটি ইন্সটলেশান দেখেছিলাম। তাতে দুহাজার বছর আগে মালাবার উপকূলে মুজিরিস সভ্যতার খনন থেকে উদ্ধার হওয়া অসংখ্য টেরাকোটার টুকরো মাটিতে সাজিয়ে তার ওপর দিয়ে বইয়ে দেওয়া হয়েছিল জল, তাতে ভাসমান জলজ গুল্ম। পোড়ামাটির খোলামকুচির ওপর দিয়ে জল বয়ে যাবার ক্ষীণ শব্দ, কবেকার মানুষের হাতে চিত্রিত মৃৎপাত্রের ওপর প্রতিফলিত লতাগুল্মের অপসৃয়মান ছায়া শুধু হারানো অতীত নয়, এক অনাগত ভবিষ্যতের কথাও বলে। শিল্পীর কাজটি দেখার সময়ে বুঝতে পারিনি সেটা।

মোবাইলে প্লাবিত কোচির চলচ্ছবি দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাচ্ছিল সে কথা। কল্পনা করছিলাম, ভাস্কো দা গামার সমাধি স্মারক বাঁ হাতে রেখে সান্তাক্রুজ ক্যাথিড্রাল ছাড়িয়ে কয়েক পা গেলে সময়ের বয়ামে বন্দি যে ইহুদিপাড়া, সেখানে কীভাবে ঢুকছে আরব সাগরের জল, পাঁচশো বছরের সেই পুরনো সিনাগগের নকশা-করা ফিনিশিয় টালির ওপর জলজ আগাছার ছায়া দুলছে, সিনাগগ লেনের দুপাশে অ্যান্টিক সামগ্রীর দোকানগুলোর দখল নিচ্ছে, জলপাই কাঠের টুল রেশমী ল্যাম্পশেড আর তারের বাদ্যযন্ত্রগুলো ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে মাত্তানচেরির দিকে। এককালে শ্বেতাঙ্গ ইহুদিদের একছত্র আধিপত্য ছিল যে দ্বীপে, যার বর্ণময় ইতিহাসের মালমশলা নিয়ে সলমন রুশদি লিখেছেন দ্য মুর্‌স লাস্ট সাই, সেই ইতিহাসের খোলসটা এবার ভেসে যাচ্ছে জীর্ণ পরিত্যক্ত নৌকোর মতো। তরুণ প্রজন্ম সকলে চলে গিয়েছে ইজরায়েলে; একটিমাত্র পরিবারের পাঁচজন টিকে আছেন দেখেছিলাম। তাঁরা সকলেই বয়স্ক, কাছেই গোরস্থানে প্লট কিনে অপেক্ষা করছিলেন। তাঁদের উদ্ধার করা গিয়েছিল কি? জানতে পারিনি।

—————————–

* David Suzuki, A David Suzuki Collection: A Lifetime of Ideas, Vancouver: Greystone Books  2003

* Report of the Western Ghats Ecology Expert Panel, Ministry of Environment and Forests, Government of India, 2011