Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

দাদাপুরাণের টিপ্পনি : কালচারপাড়ার দাদারা

মৌমিতা সেন

 

ও মা, সেকি? দাদাপুরাণের নাম শোনেননি? দাদাপুরাণের পাঠ ও প্রচলন তো বাংলার সর্বত্র!

দাদার একই অঙ্গে অনেক রূপ, বিশ্লেষণে বছর ঘুরে যাবে। আপনার বাড়ির ঠিক পাশের চায়ের দোকানটা থেকে শুরু করে নবান্ন অবধি, দাদার নানা অবতার দেশের দশের ভবিষ্যতটা গন্ধমাদন পর্বতের মতন কড়ে আঙুলে তুলে ধরে বহন করছেন।

দাদাপুরাণের যে অংশটা আজ আমরা এখানে পাঠ করব তাতে দাদার এক বিশেষ রূপের বন্দনা করা হয়েছে। সহজ ভাষায় দাদার সেই রূপকে বলা যেতে পারে কালচার দাদা। কালচার দাদার নিস্তরঙ্গ জগতে আজ #মিটু নামক ঢেউ আছড়ে পড়ে যে লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে রেখেছে, আমরা তারই হালকা আলাপ-আলোচনা করব।

*
কলকাতা শহরের কলেজ স্ট্রিট, একাডেমি, যাদবপুর কফি হাউস​, ব্রডওয়ে বার— এই সব চত্বরে বিকেল থেকে রাত্তির আবধি দাদার কালচার অবতারের নানা রূপে আবির্ভাব ঘটে। নিন্দুকে তাঁদের আঁতেল বলে থাকে। দাদার এই অবতারে তিনি কালো কফি বা চা, মদ, গাঁজা ইত্যাদি সেবন করে থাকেন, এবং বহু বিষয়ে জটিল তাত্ত্বিক আলোচনা অতি পারদর্শিতার সাথে করেন। এই যেমন ধরুন মধ্যবিত্ত সমাজের জাঁতাকলে মানুষের জীবন-যৌবনের অবক্ষয়, নয়াদিল্লির আর্টের জগতে সাম্রাজ্যবাদ ও শিল্পচেতনার অবক্ষয়, ঋত্বিকের পর বাংলা সিনেমার অবক্ষয়, বা বাম রাজনীতির অবক্ষয়… এরকম হেন বিষয় নেই যা নিয়ে দাদার বাণী পাওয়া যাবে না।

১৬ ডিসেম্বর ২০১২-র পর আরও অনেকের মতন দাদাও মানতে বাধ্য হয়েছেন যে ভারতবর্ষে লিঙ্গবৈষম্য বলে কিছু একটা আছে। হরিয়ানার তাউজিদের চাউমিন-মোবাইলফোন ম্যানিয়া এখন দাদার খিল্লির বিষয় হয়েছে। অধ্যাপক অবতারে দাদা এখন রীতিমতন প্রকৃত নারীবাদ নিয়ে এক-আধটা লেখা নামিয়ে ফেলেছেন, আর্টিস্টরূপী দাদা মেয়েমানুষের ব্যথায় প্রবল ইন্সপিরেশন পাচ্ছেন, ঋ সঠিক কায়দায় জামা খুললেই প্রকৃত নারী যৌনতার বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে! দাদার উদ্দেশ্য সর্বদাই মহান, দাদার মাথা থিওরি-পোক্ত।

অবশ্য নারীবাদ তো শুধু থিওরি নয়, নারীবাদ প্র্যাক্টিস। নারীবাদ শুধু লিটল ম্যাগাজিনের পাতায়, বা ক্লাসরুমে হয় না। নারীবাদ রান্নাঘরে, শোওয়ার ঘরে, লেকের ধারে, এমনকি রাত বারোটার ওয়াটসঅ্যাপ মেসেজেও হয়। কিন্তু দাদা বড় কঠিন ঠাঁই— নিজের ব্যক্তিগত ও সর্বজনীন জীবনের মধ্যে অলঙ্ঘ্য একটি লক্ষণরেখা টেনে দিতে দাদা সর্বদাই নিপুণ। রোমান পোলান্সকির অনবদ্য কাজ দেখুন, ওনার ব্যাক্তিগত জীবনে কোন পরিস্থিতিতে উনি কী করেছেন সেটার আলোচনা নোংরা গসিপ (দাদা উবাচ), শিল্পের সাথে তার কোনও সম্পর্ক থাকতেই পারে না। উডি এ্যালেনের ছবি নিয়ে আলোচনা হোক (দাদা উবাচ), ওনার প্রেমিকার বয়স-নির্ধারণ করাটা দাদার এক্তিয়ারের বাইরে, ওটা ওনার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যর ব্যাপার। সেই একই হিসেবে দাদার প্রেমজীবন নিয়ে অন্য দাদারা কখনওই প্রশ্ন তুলবেন না। ধরুন জনৈক মহিলা এক দাদার কাছে আরেক দাদার নালিশ করতে গিয়েছেন, জনসমক্ষে দাদা বলবেন, “আহা, এটা তোমাদের ভিতরকার ব্যাপার, এতে আমি কী করতে পারি?” আড়ালে দাদা বলবেন, “ও যেমন দ্যাবা, তেমনি দেবী, ও মেয়েটার কেচ্ছা জানি না নাকি? এখন ভিক্টিম সাজলে হবে?” ব্যক্তিগত জীবনের কেচ্ছাগুলো নিয়ে আবার রাজনৈতিক আন্দোলন হয় নাকি, আপনিই বলুন?

মহিলা সহকর্মীদের সাথে দাদার হিসেবটাও খুব সহজ— সবার আগে তাদের পুরুষকে আকৃষ্ট করার যৌন ক্ষমতা, অর্থাৎ ইরোটিক ক্যাপিটালের হিসেব করা হবে। খেলার মাঠ দাদার। মামণিরা সেখানে খেলতে নামতেই পারে, ইরোটিক ক্যাপিটালের জোরে যতটা পারে দৌড়েও নিতে পারে, বেশি ট্যাঁ-ফো করলে আউট। দাদারা তাত্ত্বিক আলোচনা করবেন, মামণিরা চা এনে দেবে। দাদারা মাসের পর মাস স্নান না করে থাকবেন কারণ তাতে মাথাটা আরও পরিষ্কার হবে, মামণিরা ঠিক জামার সাথে ঠিক কানের দুলটা পরলে তবেই দাদা পাত্তা দেবেন। যৌন আকর্ষণের দুষ্টু-মিষ্টি খেলায় মামণিরা অবশ্যই আছে, আর বাকি সময়টা দুধ-ভাত।

এইবার সমস্যা হয়ে গেছে #মিটু হয়ে। #মিটুর বাজারে এই খেলাটায় হঠাৎ আব্বুলিশ হয়েছে। দাদার জগতের এই অলিখিত নিয়মগুলোর বিরুদ্ধে কেন জানি না অর্বাচীন মেয়েগুলো রুখে দাঁড়াচ্ছে।

এ কথা আমাদের মনে রাখতে হবে যে কালচারের বাজারটা অনেকটা অসংগঠিত ক্ষেত্রের নিয়মে চলে। নাটক-সিনেমা-আর্ট এমনকি অ্যাকাডেমিক্সের জগতে একধরনের যজমানি প্রথা চলে— কোনও এক দাদাস্থানীয় ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে সে বাজারে করে খাওয়া খুবই দুরূহ। তাই কোনও এক দাদার ছত্রছায়ায় আসতে হবে, তাঁর ইগোটাকে পুজোর ভিড়ে আদরের বেলুনের মতো রক্ষা করতে হবে, আর ধৈর্য ধরে সুযোগের অপেক্ষা করতে হবে। এটা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকেই করতে হয়। পুরুষ চ্যালা জানে যে তাকে দাদাগিরির মই বেয়ে উঠতে হবে। যে যত নিচে তার তত বেশি র‍্যাগিং হবে, এবং যদি তাকে এই মই বেয়ে উঠতে হয় তাহলে এমন ভাব করতে হবে যে হাজার দাদাজনিত অপমান সত্ত্বেও তার কান্না পায় না। আস্তে আস্তে অপমানের বদলায় দ্বিগুণ অপমান করতে শিখতে হবে। ট্রেনিংটা ধরতে পারলেই সে একদিন নিজেও চ্যালা থেকে দাদায় উত্তীর্ণ হবে। জেন্ডার তত্ত্ব যারা স্বল্প পাঠ করেছেন তাঁরা বলবেন যে এইভাবেই এক সদ্য যুবক ‘পুরুষ’ হয়ে উঠতে শেখে। অবশ্য এতে দাদার কিছু এসে যায় না, কারণ তিনি বলবেন, “আহা, এইটুকু ঠাট্টা সহ্য করতে না পারলে ও বাড়ি বসে মেয়েদের মতন ফ্যাঁচ-ফ্যাঁচ করে কাঁদুক তাহলে!”

একজন সদ্য যুবতীর পক্ষে এই দাদা-চ্যালা হায়ারার্কির কর্মক্ষেত্রে ঢুকতে পারা ও সেখানে উন্নতি করাটা ভয়ানক কঠিন। ধরুন দাদা-চ্যালারা যখন অন্য এক মহিলার ন্যাকামি, বা চরিত্র, বা উন্নত বক্ষ, বা ধ্যাবরা পাছা নিয়ে উচ্চমানের জোকস করবেন, তখন মহিলাটি হাসিতে যোগ না দিতে পারলে সকলে বলবেন, “তুম সে না হো পায়েগা”।

যে মহিলারা এই পরিবেশে কাজ করেছেন তাঁরা জানেন যে আর পাঁচটা পুরুষের সমান দক্ষতা তাঁদের থাকলেও দাদা-চ্যালাদের বাজারে সেটা প্রমাণ করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। এটার মূল কারণ, আমি মনে করি, এই যে কালচারের কর্মক্ষেত্রে মহিলারা এখনও পুরুষমানুষের চোখে— মেরী ডগলাসের ভাষায়— “ম্যাটার আউট অফ প্লেস”। এ কথা অবশ্য দাদা থিওরিতে কদাচ মানবেন না। তিনি কেবল প্র্যাকটিসে সেটা আচ্ছা করে বুঝিয়ে দেবেন। নারী পুরুষ যে আসলে সমান নয়, সে বিশ্বাসে দাদা অনড়।

এদিকে আস্তে-আস্তে মেয়েরা তাঁদেরই লীলাক্ষেত্রে (পড়ুন, কর্মক্ষেত্রে) ঢুকে পড়ছেন, এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমান অধিকার দাবি করছেন। দাদা এখন যাবেন কোথায়?

*

দাদার কালচার অবতারকে বুঝতে হলে প্রথমেই কালচারপাড়া ও তার আকর্ষণকে বুঝতে হবে। মেয়েদের জন্য কালচারপাড়ার টান নেহাত কম নয়!

দেশের তথাকথিত ‘ভালো’ স্কুল-কলেজগুলোতে মধ্যবিত্ত পরিবারের যে মেয়েগুলো সাম্যবাদের, নারীবাদের কথা শিখছে, তাদের বেশিরভাগই কিন্তু বাড়িতে বাবা-কাকা-দাদার মধ্যে বা বাড়ির আশেপাশে কারও মধ্যে সেই চিন্তার লেশমাত্র খুঁজে পাচ্ছে না। বাড়ির মধ্যে সিগারেট খেলে বাবার হার্ট-এ্যাটাক হবে, পঁচিশ হলেই মা অমুক মাসির ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সাথে দেখা করতে বলবেন— সে নাকি সিডনি থেকে স্রেফ বিয়ে করতে এসেছে! যাদবপুরের ঝিলপাড় বা অ্যাকাডেমি চত্বরের বাইরের জগতটায় রাখঢাক নেই। এ কথা মনে হওয়াটা তাই স্বাভাবিক যে বাড়ি-সমাজ-পরিবারে সর্বত্র মেয়েরা পিতৃতন্ত্রের শৃঙ্খলে বাঁধা, মুক্তি রয়েছে কেবল কালচারপাড়ার মরূদ্যানে। এ কথা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে কালচারপাড়ার দাদারা সিডনির ইঞ্জিনিয়ারদের থেকে একদম আলাদা। তারা মোদিকে ভোট দেয় না, তারা ভার্জিনিটি নিয়ে মাথা ঘামায় না, তারা গাড়ি, মোবাইল ফোন, বা ক্রিকেট নিয়ে অনর্গল কথা বলে না। তাদের ঢুলু-ঢুলু চোখ, সবসময় একটা বিদ্রোহ-বিদ্রোহ ভাব। এ কথা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে দাদারা আমাদেরই মতন নারীবাদী, এরা আমাদের কমরেড।

কালচার দাদার কথাবার্তা একদম অন্যরকম, যাকে বলে সফিস্টিকেটেড। নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর গেরুয়াধারী সাঙ্গপাঙ্গদের মতন, অথবা গ্রাম্য বহুজন নেতার মতন, দাদারা নারী-অধিকারের কথা বলতে অযথা “মা-বোন মা-বোন” করেন না। তাঁরা বোঝেন যে মেয়েদের শান্তিতে রাস্তায়-ঘাটে হাঁটতে হলে, বা চাকরি করতে হলে খামোখা অচেনা লোকজনের মা-বেহেন হতেই হবে, নইলে তারা শীলা-মুন্নি— এটা অত্যন্ত রক্ষণশীল কথা। এরকম কথা তাঁদের মুখে কক্ষনও শুনতে পাবেন না। কিন্তু মা-বোন বলছেন না বলেই যদি একুশ বছরের চুমকিকে পঁচিশের বাপ্পার মতন একইরকমভাবে সোজাসাপ্টা কমরেড বা সহকর্মী বলে মেনে নিতেন, তাহলে হয়তো এ লেখার প্রয়োজন থাকত না।

এ কথা সত্য যে কালচারপাড়ার দাদার বচনে মধ্যবিত্ত সমাজের প্রেম ও যৌনতা প্রসঙ্গে রক্ষণশীল রাখঢাকের বিরুদ্ধে প্রবল বিদ্রোহ বারে বারে প্রকাশ পায়। এই বিদ্রোহী চেতনা দাদাদের প্রেমজীবনেও পাবেন। কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে দাদা বিবাহিত ব্যাচেলর, এবং বৌদি  সুপার​ওম্যান— তিনি সংসার, চাকরি, বিগ বস​, গ্যাস বিল সব পারেন​। সুপার​ওম্যান বৌদিকে আচ্ছা করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে পুরুষমানুষ আসলে বোকা ও দুর্বল​, এবং প্রকৃত প্রেম মানে পুরুষমানুষের ত্যাঁদড়ামো সহ্য করা। নারী তো সর্বংসহা, দাদা আপন মনে না করলে কি আর বৌদিকে গালিগালাজ করতেন?

ওদিকে কালচারপাড়ার আরেক আকর্ষণ ব্যাচেলর দাদা। এঁরা অনেকে একটু বেশি মদ খান​… বলতে পারেন সিরিয়াল কিলারের মতন সিরিয়াল দেবদাস​। কলেজফেরত কচি মেয়েরা শহরের বাইরে পড়তে যাওয়ার আগে অথবা ইঞ্জিনিয়ার বিয়ে করবার আগে অনেক সময়েই দুঃখী দেবদাস দাদার প্রেমে পড়ে। দেবদাস দাদার স্টোরি হামেশা রেডি। অল্পবয়সে প্রেমে ভয়ঙ্কর দাগা খেয়ে দাদার মনটা কার্ল মার্ক্স প্লাস সালভাদর দালি ইন্টু নবারুণ মাইনাস অ্যান্টি-মোদি হয়েছে। দাদার এই অবতার আবার সেক্সি-টাইপের নারী-বিদ্বেষী— শুধু কাজলটানা বড় বড় চোখের ফেমিনিস্ট, আর্টিস্ট, বা স্কলারদের সাথেই প্রথমে তাঁর তর্ক হয়, তারপর গুরু বা দাদার সম্পর্কস্থাপন হয়, এবং শেষমেশ সেই সম্পর্কের প্রত্যাশিত উপসংহার হিসেবে দাদা ইন্টু-মিন্টু করেন। তারপর চিল-চিৎকার, জীবনানন্দ​, ফোনের বিল​!

এই ধরনের দাদা অবতারের মাথার উপরে সম্পন্ন ‘মধ্যবিত্ত’ বাবা অবশ্যই বটগাছের মতন ছায়া মেলে থাকেন। চ্যাটার্জি-ব্যানার্জি পাড়ায় একটা পৈতৃক বসতবাড়ি না হলে লাডলার কালচারচর্চার সামর্থ খুব কম বাবা-মারই থাকে। লাডলা-দা রাত্তিরে কোনওরকমে বাড়ি ফিরে এলে লক্ষীমাসি বা সাধনদা ভাত বেড়ে দেয়​। তারপর আবার কলেজ-সুন্দরীদের নতুন ব্যাচ, মোদির নতুন ক্যাও, আলোচনা আর রেভোলিউশন! দেবদাসরূপী দাদা আবারও ভাবেন এই মেয়েটা… ফাইনালি এই মেয়েটা… আমাকে বুঝবে, আমাকে আমার মতো থাকতে দেবে!

এ সমস্ত আকর্ষণের নরম-গরম নাটকের মাঝে— তা তিনি কালচার দাদার যে অবতারই হন না কেন— মেয়েদের একটা কথা ভুলতে দেওয়া হয় না কালচারপাড়ায় : যৌনতা বা প্রেম ছাড়া বিপ্লব হয় না।

দাদার সাথে, হ্যাঁ একমাত্র দাদার সাথেই পলিঅ্যামরিতে নিযুক্ত হতে পারলে আপনি মুক্ত! নাহলে আপনার শরীরে-মনে মধ্যবিত্ত নৈতিকতার জট, রক্ষণশীলতা আপনি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। রায়া সরকারের স্বনামধন্য তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পরে ফেসবুকের এক আলোচনাসূতায় অধ্যাপক উদিতি সেন এই বিশেষ দাদা কালচারের নাম দিয়েছিলেন— পাঠক ভাষা মার্জনা করবেন— “লিবারেশন বাই ডিক”। অর্থাৎ, দাদা-সঙ্গমেই নারীমুক্তির নতুন সূর্য উদয় হবে, এ ছাড়া পথ নাই!

কয়েক ভলিউম মার্ক্স পড়ে দাদা বুর্জোয়া প্রেমের বিরুদ্ধে কোমর বেঁধেছেন বটে, কিন্তু নারীমুক্তির যে শর্তাবলী তিনি পেশ করেছেন, সেটাও যে সেই মার্ক্সের ভাষাতেই নারী-শরীরের পণ্যীকরণ হয়ে দাড়াচ্ছে, সেটা কেন জানি দাদা বুঝতে পারছেন না! অতএব সেলুলয়েডে ঋর সাহসে দাদা মুগ্ধ, গদগদ, অথচ রক্ত-মাংসের প্রেমিকার ব্লাউজের পিঠটা একটু বেশি কাটা হলে কিংবা তিনি রাইভাল দাদার জোকসে একটু বেশি হাসলে পলিঅ্যামরাস দাদা ’৬৮র পারীর কম্যুন ভুলে এক্কেবারে ডরের সারূখ খান হয়ে যান।

আপনি কালচার দাদাকে বলতেই পারেন, সব পক্ষের সম্মতি থাকলে পলিঅ্যামরি খাসা জিনিস, কিন্তু সেটা কি নারী-পুরুষের এই ভয়ঙ্কর অসাম্যের মধ্যে আদৌ সম্ভব? কালচার দাদার কাছে এর কোনও কালচারড উত্তর পাওয়া সম্ভব নয়। দাদা জানেন যে বিবাহিত ব্যাচেলার হোক বা বৌদিবাজ ব্যাচেলার হোক​, শহরের মানুষজন অন্তত মেনেই নেয়। ওদিকে ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ মহিলা যদি অবিবাহিত থাকবার অথবা স্বাধীনচেতা হওয়ার পণ করে বসেন তাহলে বাড়িওয়ালা থেকে অটোওয়ালা, সক্কলের মরাল প্যানিক আরম্ভ হ​য়​, এ কথাও কি দাদার অজানা? দাদা বিদ্রোহী হলেও সংসারে-সমাজে চিরাচরিত পিতৃতন্ত্রের সব ফায়দাগুলো কোনওভাবেই ছাড়তে পারবেন না, আবার ’৬৮র প্যারিসের স্বাদটাও তাঁর চাই! এই বাজারে আর কেউ মুক্ত হোক না হোক, দাদার আরও মুক্তি চাই। আরও আরও মুক্তি চাই! কীসের থেকে মুক্তি চাই? কেন, ওই যে দাদার জ্যেঠুরা যে গৃহস্থ জীবন কাটিয়েছেন, সেই বস্তাপচা মধ্যবিত্ত জীবনের নিয়মগুলো থেকে মুক্তি!

এইখানেতেই দাদার বিষম বিপাক।

যে কোনও দুজন মানুষ একসাথে আনেকদিন থাকলে, একে অপরকে একটু মেজেঘষে গড়েপিটে নেওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দাদার ডিকশনারিতে সেইসব নেই। দাদাকে দাদার মতন থাকতে দিতে হবে, এবং কালচার দাদার ‘জিনিয়াস’ সত্তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য মেনে অপর পক্ষকে আজীবন লুঙ্গি-ডান্স দিতে হবে। আর না হলে? যদি রক্ত-মাংসের স্ত্রী/প্রেমিকার তাড়নায় পুরনো চিঠি, আধভোলা মুখ আর শেষ-হওয়া গল্পের সীমিত গণ্ডির রোম্যান্স নষ্ট হয়ে যায়? যদি দাদার জিনিয়াসে সংসারের তুচ্ছ জিনিসের ছোঁয়া লাগে? সংসারের ছোঁয়া লাগলে কি আর কালচার হয় স্যার?

কালচারপাড়ার দাদার চাহিদা ও ভয় একাধারে নারীদেহে এসে আটকা পড়েছে। নারী তাঁর যৌনমুক্তির ন্যারেটিভের পটভূমি, আবার সেই নারীই সাধারণ মধ্যবিত্ত গৃহস্থ জীবনের ফাঁদ!

কমেডিয়ান হ্যানা গ্যাডসবি এই চাহিদা-ভয়ের টানাপোড়েনকে এক ধরনের মানসিক রোগ বলেছেন। তার নামটা খুব চেনা— মিসোজিনি, অথবা স্ত্রী-বিদ্বেষ।

মরূদ্যানের সন্ধানে যেই মেয়েটি কালচারপাড়ায় এসে পড়ে, দাদার নারী-চেতনার এই দিকটা তার যে সবসময় জানা থাকে না, এটা বলাই বাহুল্য।

*

#মিটু আন্দোলনের ঢেউ (তারও আগে, রায়া সরকারের তালিকা) বাংলার কালচারপাড়াতেও শেষমেশ এসে পৌঁছেছে, নিজের নিয়মে। চাহিদা-ভয়ের টানাপোড়েনে সন্ত্রস্ত দাদা হয় ব্যাপারটাকে নেহাতই অগ্রাহ্য করছেন, বা নিজেকে #নটঅলমেনের তালিকায় রাখছেন।

আসলে ছাপোষা মধ্যবিত্ত সমাজ থেকে উঠে এসে কালচারপাড়ার আঙিনায় দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে সমান অধিকার চাইছে— এই সহজ বিষয়টা বাংলার আর্ট-সিনেমা-নাটক-অ্যাকাডেমিক্স জগতের কালচার দাদাদের পক্ষে সহজে মেনে নেওয়া সম্ভব না। বরং বিপক্ষে নানারকম তত্ত্ব শোনা যায়। এই যেমন, নারী তো প্রকৃতি, তার সাথে পুরুষের সূক্ষ্ম এবং জটিল একটা ভারসাম্য আছে— পাশ্চাত্য ফেমিনিজমের গোদা লজিকে কি তা বোঝা যায়? যৌনতা কি সহজ সাদা-কালো দিয়ে বোঝা সম্ভব? সবটাই তো ফিফটি শেডস অফ গ্রে!

যৌনমুক্তি যে চাই, এ কথা দাদা মেনে নেবেন, কিন্তু ওই যে আগেই বলেছি, মুক্তি আর অমুক্তি এই দুইয়েরই প্রতীক হল নারী। অতএব পিরীতি যেই কাঁঠালের আঁঠা হবে, অমনি সর্বনাশ।

কালচার দাদার নারী-চেতনাটা একটু ঘেঁটে দেখলে আপনি পুরাণের সেই অধ্যায়ে পৌঁছে যাবেন যেখানে মেনকা সেক্সি স্ট্রিপটিজ করে বিশ্বামিত্রের ধ্যানভঙ্গ করছেন। দাদাপুরাণে বলা আছে যে একেক দাদার একেক মোক্ষ থাকে, সে দাদাইজম হোক বা সাম্যবাদ। মোক্ষের রাস্তায় প্রলোভন আসে— বিশেষত ছলনাময়ী নারীরূপে। বেশি কাছে গেলেই মোহের বশে সব মোক্ষ ভুলিয়ে দেবে, দাদা হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখবেন ডাইপারের সুপার-সাইজ প্যাক আর ঢ্যাঁড়সের দাম নিয়ে বৌদির সঙ্গে তারও কপালে ভাঁজ পড়ছে। এই যে মহৎ উদ্দেশ্যগুলো, এই যে আটটা-নটার সূর্যের মতো দৃপ্ত যুবকের দল— সব যাবে ইন দ্য ভোগ অফ মা!

গৃহস্থ জীবনের প্রতি এই ঘৃণা-ভয়ে বিদ্রোহী কালচার দাদা আর সংসারত্যাগী ‘ফকির’ নরেন্দ্র মোদি কেমন করে যেন একই প্ল্যাটফর্মে এসে পৌঁছন। ছাত্রনেতা কানহাইয়া কুমারের দিন কয়েক আগে বলা একটি বক্তব্য ধার করে বলা যায় এই অদ্ভুত একতা ভারতবর্ষের সমগ্র রাজনৈতিক জগতের নারী-বিদ্বেষের প্রমাণ, তা সে যেই মেরুতেই আপনার অবস্থান হোক না কেন।

#মিটুর বাজারে কিছু (#নটঅলমেন) দাদা ভীত-সন্ত্রস্তও বটে— আগে যেমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনও বান্ধবীর সাথে ইয়ার্কি-ঠাট্টা বা নির্ভেজাল একটু ইয়ে করতেন, সেটা এই মেয়েগুলো এখন কেমনভাবে নেবে সেটা আর ঠাহর করতে পারছেন না। এত অযথা চিন্তা করতে তাত্ত্বিক দাদার কষ্ট হচ্ছে। হওয়াটাও স্বাভাবিক। চিরকাল একদিকে শূর্পনখাদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রেম নিবেদনের মর্যাদা লক্ষণদারা কড়ায়-গণ্ডায় হিসেব করে দিয়েছেন, সীতা বৌদির জন্য লক্ষণরেখা এঁকে দিয়েছেন। আর অন্যদিকে কালচারপাড়ার দাদা বারোয়ারিতলার রিক্সাওয়ালা ভাই আর সুনীল-শক্তির সাথে বাংলা খেয়ে ধর্মতলার মোড়ে এসে হ্যালু খেয়েছেন, স্বতঃস্ফূর্তভাবে দাদার ফ্যাতারু-ডানা গজিয়েছে। হয়তো সেই সময়েই কোনও এক ঝিঙ্কু মামনি বাড়িতে বসে উদাস হয়ে শুনেছে,

“আমি কখনও যাইনি জলে কখনও ভাসিনি নীলে/আবার যেদিন তুমি সমুদ্র স্নানে যাবে/আমাকেও সাথে নিও নেবে তো আমায়/বলো নেবে তো আমায়”

বাড়ির গেটে ততক্ষণে বাবা তালা দিয়ে দিয়েছেন। কালচারের যাদু বাস্তবে তার প্রবেশ নিষেধ।

তৃপ্তি বারে কালচার-পিপাসু মামণিদের ঢুকতে দেওয়া হল কি হল না, তা নিয়ে দাদা কোনওদিন বিশেষ মাথা ঘামাননি। সব রঙের দাদাদের মধ্যেই একটা ঊহ্য চুক্তি আছে— ফুটবল মাঠে মেয়ে নিয়ে ঢুকবে না, বেকার ঝামেলা!

কালচারের যাদু বাস্তব থেকে হঠাৎ করেই #মিটুর বাস্তবের সম্মুখীন হতে অসুবিধা হবে, এ আশ্চর্য কী? দাদার পৃথিবীতে প্রকৃতপক্ষে রক্ত-মাংসের নারীর কোনও অস্তিত্ব নেই— কোনওদিনই ছিল না। তারা চৈত্র মাসে নীরা, ভাদ্র মাসে মেনকা, আবার সংক্রান্তিতে পায়েস-হাতে দুঃখী মা। চিরকাল সাপোর্টিং রোলে থেকে হঠাৎ করে নায়িকা হতে চাইলে নায়ক অবাক হবেন না?

*

কমেডিয়ান হ্যানা গ্যাডসবি তাঁর শ্বেতাঙ্গ পুরুষ সহকর্মীদের একটা প্রশ্ন করেছিলেন— তাঁদের এত রাগ কেন হয়? কমেডি জগতের পিরামিডের শীর্ষে বসেও অপ্রাপ্তির এত আক্ষেপ কেন তাঁদের?

কালচারপাড়ার দাদাকেও আজ এই প্রশ্ন করবার প্রয়োজন আছে। যেখানে মা-বউ-কাজের মাসি রেঁধে-বেড়ে-কাপড় কেচে দিচ্ছেন, দাদা খাচ্ছেন শুচ্ছেন দশটা-পাঁচটার মেট্রোটা এড়িয়ে যাচ্ছেন, চাদ্দিকের পঙ্কিল নিওলিবারালাজিমের মাঝখানে তাঁর বিদ্রোহী অঁতারপ্রনিয়ারশিপ পদ্মফুলের মতো ফুটছে, তারপরেও তাঁর এত অপ্রাপ্তির হতাশা কেন?

দাদা হয়তো এখনও ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার না হওয়ার জন্য তাঁর মায়ের সেই মন ভেঙে যাওয়াটা ভুলতে পারেননি। তাঁরই পিসতুতো ভাই যখন লম্বা লাল গাড়িতে, দুধে-আলতা রঙের সুন্দরী বউকে নিয়ে আসেন, আর সঙ্গে খাঁটি স্কচের বীভৎস দামী বোতল আনেন, তখন সব মার্ক্স ছাপিয়ে দাদার বুকে একটা চিনচিন ব্যথা হতেই পারে। আরেক দাদার সিনেমা যখন বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভালে সাড়া ফেলে, তখন দাদার মনে হতেই পারে যে এই জালিম দুনিয়া তার শিল্পের কদর করল না! শ্রমের অবমূল্যায়ন বড় ভয়ংকর জিনিস, তাই কি এত তিক্ততা?

আসলে এটা যে কোনও হায়ারার্কির গোড়ার কথা। মানুষ ওপরতলার দিকে তাকিয়ে নিজের দেনাপাওনাগুলোর হিসেব করে, অথচ একমাত্র নিচের দিকে তাকালেই বোঝা সম্ভব নিজের অবস্থানগত প্রিভিলেজ কার ঘাড়ের ওপর বসে কর্তৃত্ব করার ফল।

#মিটুর ঢেউ সময়ের নিয়মে কালচারপাড়াতেও যখন এসে পৌঁছেছে, দাদাকেও এখন এই সকল প্রশ্নের সম্মুখীন হতেই হবে। হায়ারার্কিতে একটু নিচের দিকে, একটু নিজের দিকে, ওই একই ‘জিনিয়াস’ ক্ষুরধার বুদ্ধি নিয়ে তাকাতে হবে। এবং তাকালেই বোঝা সম্ভব হবে যে এখানেও দাবি সাম্যের— খালি দাদার অবস্থানটা একটু অন্য। এখানে দাদার অবমূল্যায়ন হয় না, বরং তিনি তাঁর লিখিত-অলিখিত শর্তাবলী ও চাহিদা-ভয়ের জটিল লীলায় নারীর শ্রমের অবমূল্যায়ন করেন। এবং যেই অর্বাচীনেরা অকারণে #মিটু #মিটু করে বাজার গরম করে রেখেছে, তাদের চাহিদার সাথে আদপে দাদার চাহিদার অনেক মিল আছে। তারাও তাদের কাজের সঠিক মূল্যায়ন, তাদের মানবসত্তার স্বীকৃতি চাইছে। দাদার লীলাক্ষেত্রে ঢোকবার মাশুল হিসেবে প্রেম বা যৌনসম্পর্ক দান না করে শান্তিতে স্রেফ কাজ করবার অধিকার চাইছে। স্বেচ্ছায়, নির্ভয়ে প্রেম ও যৌনসম্পর্ক গড়বার অধিকার চাইছে।

যে জগতে রক্ত-মাংসের নারী ছিলই না কোনওদিন, সেখানে আজ তারা প্রবেশ করে দাবিদাওয়া তুললে কী হবে? মধ্যবিত্ত জীবন থেকে যেই মুক্তির সন্ধানে দাদা গুমরে গুমরে মরেন, মিসোজিনি নামক চাহিদা-ভয়ের উদ্ভট টানাপোড়েন কাটিয়ে একসাথে পথ হাঁটতে পারলে কি অবশেষে সেই মুক্তির সন্ধান পাওয়া যাবে?

দাদাপুরাণের শেষ অধ্যায়ে এ নিয়ে বিশেষ লেখা নেই, কয়েকটা পাতা এখনও ফাঁকা।