সত্যব্রত ঘোষ
দুর্গাপুজোর ভিড় ভারাক্রান্ত দশটা দিন প্রচণ্ড হুল্লোড়ে কাটতে না কাটতেই উৎসবমুখর কলকাতা আবার কল্লোলিনী। সাংস্কৃতিক পীঠস্থানের গৌরবে আলোকিত শহরবাসী আপাতত সিনেমার প্রেমে মজে আছেন। ঠগবেশী অমিতাভ বচ্চন এবং আমির খানের থেকে মুখ ফিরিয়ে তাদের নজর এখন দেশ-বিদেশের ‘সর্বোৎকৃষ্ট’ চলচ্চিত্রগুলির দিকে। সংস্কৃতির প্রতি জনসাধারণের এই দায়বদ্ধতাকে কিছু মানুষ শুভ লক্ষণ হিসেবেই দেখছেন। কিন্তু অনেকেই পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে পীড়িত এবং আশঙ্কিত।
পরিস্থিতি যে হঠাৎ পাল্টেছে, তা নয়। ক্রমিক এক অবক্ষয়ের সাক্ষী হতে হতে আমরা আজ এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি, যেখানে স্বাভাবিক অভিব্যক্তির সঙ্গে বিকৃতি মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। বামফ্রন্টের আমলে আমরা দেখেছি মূলস্রোতের সংস্কৃতির প্রতি শাসককূলের নিস্পৃহতা। উন্নততর এক বিকল্প সংস্কৃতিকে প্রতিস্থাপন করবার এক দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর জনগণের থেকে তো তাঁরা প্রায় বিচ্ছিন্নই হয়ে গেলেন।
বর্তমান শাসকদল প্রথম থেকেই তাই জনপ্রিয় সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের সংযোগকে দৃঢ় করবার কাজে মন দিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ আমরা শহরের ‘শ্রেষ্ঠ’ দুর্গাপুজোগুলিকে দেখতে পারি। কলকাতা শহর এবং শহরতলিতে প্রায় পাঁচ হাজার বারোয়ারি পুজোর আয়োজন হয়। এর অধিকাংশ কমিটিতেই রাজনৈতিক নেতৃস্থানীয়রা গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করতে পেরেছেন। এবং যে পুজোগুলির প্রতি বেশিরভাগ দর্শনার্থীরা আকৃষ্ট, সাধারণভাবে সেগুলি এলাকার রাজনৈতিক নেতার পুজো হিসেবেই বেশি পরিচিত। ইদানিং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় রেড রোডে জনপ্রিয়তম পুজোগুলিকে নিয়ে শোভাযাত্রা আয়োজন করা হচ্ছে। সেই ‘কার্নিভাল’-এ বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের চলমান বিজ্ঞাপনগুলি দৃষ্টিকটু হলেও শহরবাসী বরদাস্ত করে নিতে শিখেছে।
প্রচারসর্বস্ব এই মানসিকতা যে কলকাতা আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও প্রতিফলিত হবে, তাতে আমরা কেউই আশ্চর্য হইনি। তবে কষ্ট পেয়েছি। কারণ, আদিখ্যেতা সবসময়ই অস্বস্তিকর। স্থান ও কাল নির্বিশেষে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের এমন দ্বিধাহীন প্রচার যথেষ্ট পীড়াদায়ক। দেশ-বিদেশের ছবি নিয়ে আয়োজিত ফেস্টিভ্যালে জননেত্রীর অনুপ্রেরণা কী ভূমিকা নিয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তবুও এভাবে সর্বত্র বিরাজমান হওয়ার মধ্যে দিয়ে অসুরক্ষিত মনোভাবই প্রকট হয়। আসন্ন নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে যদি এই প্রচারের ব্যাপকতাকে দেখা যায়, তাহলে বুঝতে হবে সাংস্কৃতিক আয়োজন উপলক্ষ মাত্র। তার বেশি কিছু নয়। সেক্ষেত্রে আশঙ্কা বাড়ে বই কমে না।
প্রথা মেনে পঞ্চপ্রদীপ জ্বালিয়ে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের উদ্বোধন হল বিশাল এক জনসমারোহের সামনে। অথচ সেই জনগণের যাবতীয় উচ্ছাস কিন্তু শাহরুখ খানের সশরীর উপস্থিতি ঘিরে। রাজ্যের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসেবে তিনি বাৎসরিক দায় পালন করলেন। পাশাপাশি এই আক্ষেপও করলেন, তাঁর সিনেমা কোনও ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয় না। নিজের আগামী ছবির ট্রেলারটি এই সুযোগে দেখিয়েও দিলেন। কানফাটানো জনকলরবে মজিদ মাজিদি, ফিলিপ নয়েস, সাইমন বেকারদের মতো বিদেশি অতিথিরা বিভ্রান্ত হতেই পারেন। কারণ, চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এই বিপণনকেন্দ্রিকতা সত্যিই তুলনাবিহীন। অথচ এই বাণিজ্যিক আচরণটি এমনভাবে উপস্থাপন করা হল যেন আদরের ছোটভাইকে বড়দিদি প্রশ্রয় দিয়ে একটি অতি সাধারণ কাণ্ড ঘটালেন।
চলচ্চিত্র নির্মাণের নেপথ্যে সক্রিয় কলাকুশলীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বিষয়ে অমিতাভ বচ্চন নিজের তথ্যনিষ্ঠ বক্তৃতাটি দেওয়াকালীন বারবার শোনা যায় উপস্থিত দর্শকদের চিৎকার। জায়ান্ট স্ক্রিনগুলিতে লাইভ টেলিকাস্ট চলাকালীন ক্লোজ আপে শাহরুখ খানের অডিয়েন্স-ফ্রেন্ডলি আচরণ দেখানো হলেই তাদের আনন্দ বাঁধ ভেঙে পড়ে। বস্তুত, প্রকৃত চলচ্চিত্রপ্রেমীদের আনন্দ হওয়ার কথা ছিল অন্য একটি ফিল্ম-সম্পর্কিত ইতিবাচক সংবাদে। অমিতাভ বচ্চনের ঘোষণা থেকে জানা গেল যে শিবেন্দ্র সিং দুঙ্গারপুর এবং তাঁর ‘ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’ নামে সংস্থাটি এবার ১০০টি পুরনো বাংলা ছবির জীর্ণ নেগেটিভগুলিকে রেস্টোর করবার কাজে হাত দিয়েছেন। পুরনো বাংলা ছবির ৮০% নেগেটিভ ইতিমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। তবু যা কিছু অবশিষ্ট আছে, তা পুনরুদ্ধারের এই প্রচেষ্টাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সাধুবাদ জানাল না উপস্থিত দর্শকেরা। কারণ প্রকৃত চলচ্চিত্রপ্রেমীদের পরিবর্তে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং প্রশাসক শাহরুখ খানের ফ্যানেদেরই উদ্বোধন অনুষ্ঠানে জড়ো করতে পেরেছেন। এমন মানসিকতার জন্যই উদ্বোধনের মুহূর্ত থেকেই উৎসবের চলচ্চিত্রপ্রসঙ্গের গুরুত্ব যে অনেকাংশেই খেলো হয়ে যায়, সেই বোধ হয়তো বা তাঁদের নেই।
জানা গেল, বৈধ পাস থাকা সত্ত্বেও অনেকে নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে প্রবেশাধিকার পায়নি। শাহরুখ খানের ফ্যানেদের মতো দাদা-দিদিদের ধরে আগে থেকে জায়গা দখল করতে পারেননি এই মানুষগুলি। সত্যিই, সব মিলিয়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবার জন্য মানুষের যে অসীম আগ্রহ এবার কলকাতায় দেখা গেল তা সম্ভবত কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও কোনওদিন হয়নি।
শুধু কলকাতায় নয়, ভারতের অন্যান্য শহরে প্রকৃত চলচ্চিত্রপ্রেমীরাই কিন্তু ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের গোড়াপত্তন করে। দেশ ও বিদেশের গুণী চিত্রনির্মাতাদের ছবির ক্যানগুলি বিমানযোগে শহরে পৌঁছাত। তারপর বিভিন্ন এমব্যাসি থেকে প্রয়োজনীয় সইসাবুদ করে গাড়িতে নিয়ে আসা হত প্রেক্ষাগৃহের সামনে। সেখান থেকে প্রোজেকশন রুম অব্দি নিজেদের ঘাড়ে বহন করে আনতেন ফিল্ম সোসাইটির সদস্যরা। অর্থাভাব ছিল। তাই এই স্বেচ্ছাশ্রম ছাড়া গতিও ছিল না। তবে আন্তরিকতার অভাব ছিল না। উৎসাহেরও নয়। একের পর এক ছবি দেখা, তার বিষয় এবং উপস্থাপন পদ্ধতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা। এভাবেই নিজেদের সমৃদ্ধ করতেন তাঁরা। সেই সমৃদ্ধির পরশে তাঁদের চলচ্চিত্র ও লেখনীতে যে মেধা প্রকাশিত হয়েছে, দর্শক এবং পাঠক তার পরিচয় পেয়ে চলেছেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি মানসিকতাকেও বদলায়। চলচ্চিত্রপ্রেমীদের অনেকেই এখন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণে বিশেষ আগ্রহী নয়। কারণ, প্রথমত ইন্টারনেটের সুবাদে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের বিপুল এক ভাণ্ডার উন্মুক্ত হয়েছে। তাতে আবর্জনার ভাগই বেশি। কিন্তু প্রকৃত রত্নসন্ধানী তার থেকে মণিমুক্তো উদ্ধারে সক্ষম। শুধু তাই নয়। এই আবিষ্কারগুলিকে উদযাপন করে তাদের বিশেষত্বগুলিকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বিশ্লেষণাত্মক আলোচনার সুযোগও এখন যথেষ্ট। একান্ত এই চর্চায় হয়তো সাহচর্যের উষ্ণতার হেরফের হওয়া সম্ভব। কিন্তু নিজেকে সমৃদ্ধ করবার এই নির্জন উপায়টিকে তাঁরা অবহেলাও করতে পারছেন না।
ফেস্টিভ্যালগুলি থেকে দূরে থাকবার দ্বিতীয় কারণটি এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। ফিল্ম সোসাইটির সদস্যদের আগ্রহ এবং উৎসাহে যে চলচ্চিত্রোৎসবের উদ্ভব, তা প্রধানত আর্থিক কারণেই আজ সরকারের মুখাপেক্ষী। প্রশাসনযন্ত্রকে ব্যবহার করে আয়োজনের স্বাচ্ছন্দ্য আনা যায় বটে। কিন্তু প্রদর্শনের জন্য নির্ধারিত ছবিগুলির গুণমান নিশ্চিত করা যায় না। কারণ এই বিশেষ কাজটির জন্য যে নির্বাচন কমিটি গঠন করা হয়, তাতে এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি, যারা এটিকে সরকারি এক অনুষ্ঠান ছাড়া আর কিছুই মনে করেন না। শাসককুলের সন্তুষ্টি এবং নিয়মাবলী অনুসরণের যান্ত্রিকতার বাইরে যার কোনও শৈল্পিক সত্তা নেই। মুশকিল হল, এ নিয়ে সমালোচনা করা হলে তা ‘শাসকবিরোধী’ তকমা পাবে। সেই ভয় নিয়েই পরবর্তীকালে তাঁদের নিজস্ব কাজে বিভিন্নরকম বাধারও সম্মুখীন হওয়া সম্ভব।
আমরা এখন এমন এক শাসনব্যবস্থার অধীন যা সংস্কৃতিবোধ বললে শুধুমাত্র সংখ্যাগত সাফল্যকেই বোঝায়। তাই অন্যদের টেক্কা দেওয়ার অভিপ্রায় এখানে প্রকট। আয়োজকরা লোক জড়ো করবার দিকে মনোযোগী হওয়ার ফলে এই সংস্কৃতিবোধের গুণমানের দিকগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবহেলিতই রয়ে যায়। কিন্তু ভিড় হলেই যে তা উৎকৃষ্টতার প্রমাণ হবে তার কোনও মানে নেই। তবে ভিড় জড়ো করবার শক্তি অর্জন করলে অহংকারের জন্ম স্বাভাবিক। এই অহংকারকে ইন্ধন জোগাতে বহু সুবিধাবাদী মানুষের সমাহার ঘটবে ক্ষমতার বৃত্তটিতে, তা অস্বাভাবিক নয়। এদের সংকীর্ণ স্বার্থ চরিতার্থ করবার তীব্র আকাঙ্খার কারণেই বৃত্তটি থেকে আরও কিছু বৃত্ত রচনা অদূর ভবিষ্যতে যে ঘটবে না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
বারো মাসে তেরো পার্বণের এই বাংলা। আর্থিক সাহায্যের পরিবর্তে সম্পূর্ণ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এই ফিল্মোৎসব উদযাপনের যৌক্তিকতা কতটা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়। বস্তুত, কলকাতা তথা বঙ্গে সাম্প্রতিক কালে যাবতীয় উৎসব পালনে সরকারি উদ্যোগের যে পরম্পরা ইদানিং তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে কিন্তু ক্ষোভ জাগছে মানুষের। সারা বছর ধরে একের পর এক মোচ্ছব চলবার ফলে সরকারি কর্মদিবসের সংখ্যার পাশাপাশি রাজ্যের উৎপাদনশীলতা কমছে। রাজস্বে টান পড়লে রাজ্যের অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়াটা স্বাভাবিক। হুজুগসর্বস্বতার দিকে কেন্দ্রীভূত এই প্রবণতাকে অনেকেই ভেবেচিন্তে নেওয়া একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। কারণ, অস্বাভাবিক হারে মূল্যবৃদ্ধি, দৈনন্দিন অভাব-অনটন ইত্যাদি নানা অভিযোগের ভার বয়ে চলা সাধারণ মানুষদের ভুলিয়ে রাখবার উপায় হিসেবে এই ধারাবাহিক উৎসব আপাতত ফলপ্রসূ। আমাদের জানা নেই, পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে পৌঁছালে সরকার উপলব্ধি করবেন যে জনমোহিনী এই উৎসব পালনের মানসিকতা বস্তুত জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী।
প্রদর্শিত সিনেমা নির্বাচনের মাপদণ্ড নির্ণয়ের ব্যাপারে দীর্ঘকালের এক বিতর্ক রয়েই গেছে। এই প্রশ্ন বিশেষ করে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে যখন ছবি দেখানোর জন্যই ছবির সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে শেষ মুহূর্তে তালিকাভুক্ত নির্দিষ্ট সিনেমাটি না দেখানো এবং সাবটাইটেল ছাড়া ছবি দেখানো বিষয়ে অভিযোগও উঠেছে। তবুও এবারের চলচ্চিত্র উৎসবে কিছু উল্লেখযোগ্য ছবি প্রদর্শিত হল। যেমন, নির্জন দ্বীপে বাবার ফেরার জন্য অপেক্ষারতা তেরো বছরের একটি মেয়ের সঙ্গে অপরিচিত এক পুরুষের সম্পর্কের গল্প বলা ব্রাজিলিয়ান ছবি ‘ইউনিকর্নিও’ (এডুয়ার্ডো নুনে), পাম ডি’অর পুরস্কারের তালিকায় অন্যতম ইজিপসিয়ান পরিচালক আবু বকর নির্মিত এক কুষ্ঠরোগীর শিকড় খোঁজার গল্প ‘ইয়োমেড্ডিন’ এবং কাশ্মিরের প্রবীণ মোর্ছালের উর্দু ছবি ‘উইডো অফ সাইলেন্স’ ছবিটি, যেখানে আর্শিয়া নামে এক বিবাহিতা কাশ্মিরী মহিলার গল্প বলা হয়েছে যিনি বিভিন্ন সরকারি দপ্তর থেকে তাঁর স্বামীর ডেথ সার্টিফিকেটটি জোগাড় করবার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন। এছাড়া ছিল আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্তর বহু প্রতীক্ষিত দ্বিতীয় বাংলা ছবি ‘জোনাকি’ এবং কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘নগর সংকীর্তন’, সান্ত্বনা বরদলুইয়ের অসমীয়া ছবি ‘মাঝ রাতি কেতকি’, কন্নড় ছবি ‘রিজার্ভেশন’, রাজীব শিণ্ডের কোঙ্কনি ছবি ‘কে সেরা সেরা’, দিলীশ পোথানের মালয়লাম ছবি ‘মহেশিন্তে প্রাথিকারম’, মিখিল মুসালের গুজরাটি ছবি ‘রং সাইড রাজু’, তরুণ ভাস্করের তেলেগু ছবি ‘পেল্লি চুপুলু’ এবং ‘জোকার’ নামে রাজু মুরুগানের বহু আলোচিত তামিল ছবিটি।
আইসল্যান্ডের ছবি ‘দ্য সোয়ান’-এর জন্য চিত্রপরিচালিকা আসা হেলগা যরলেইফডট্টির এবং ফ্রান্স-চিলির যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত ‘ল্য পেরোস’ নামে ছবিটির জন্য চিত্রপরিচালিকা মার্সেলো সৈদকে যুগ্মভাবে এই ফেস্টিভ্যালে গোল্ডেন রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার পুরস্কার এবং ২১ লক্ষ টাকা দেওয়া হল।
যাই হোক, এবারের ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে শোনা গেল বাংলা চলচ্চিত্রের নাকি শতবর্ষ পূর্তি হল। কিন্তু হীরালাল সেন (যার নামে একটি প্রেক্ষণ তাঁবুও খাটানো হচ্ছে কয়েক বছর নন্দন চত্বরে) ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে চলচ্চিত্রায়িত করেছিলেন এবং টাউন হলে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৯১৭ সালে তাঁর নির্মিত ছবির নেগেটিভগুলি এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত হয়। ১৯১৮ সালটিকে বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম বছর বলে চিহ্নিত করে ইতিহাসবিমুখ ফেস্টিভ্যাল কর্তৃপক্ষ অস্ট্রেলিয়ার ফিল্ম ইতিহাসের সঙ্গে সমাপতন ঘটালেন বটে। এবং ‘বই’ দেখা বাঙালিকে আশ্বাস দিলেন সিনেমা বলতে আমরা কাহিনীচিত্রকেই বেশি গুরুত্ব দিই তথ্যচিত্রের তুলনায়। সেই কারণে শিবেন্দ্র সিং দুঙ্গারপুরের সাত ঘণ্টার ছবি ‘চেকমেট’ প্রায় দর্শকশূন্য প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হল। অন্যথায় জিরি মেনজেল এবং চেকোস্লোভাকিয়ার প্রমুখ চলচ্চিত্রনির্মাতাদের সাক্ষাৎ, স্মৃতিচারণ এবং তাঁদের নির্মিত ছবি ও বাস্তবজগতের সম্পর্কের এই অপূর্ব বিবরণ প্রকৃত অর্থে চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিকতারই উদযাপন। চলচ্চিত্র তথা কৃষ্টি যদি বাংলায় সত্যিই সমাদৃত হত, তাহলে এবারের কলকাতা চলচ্চিত্রোৎসবের পরম পাথেয় হতে পারত ‘চেকমেট’। কিন্তু তার পরিবর্তে হাওড়া পুরসভার পৌরমাতা নির্মিত প্রচারচিত্র নিয়ে বিতর্কই এবারের কলকাতা ফিল্মোৎসবের অন্যতম পাওনা বললে ভুল হয় না। বলা বাহুল্য, আট দিন ধরে ৬৩টি দেশের ১৮৯টি ছবি দেখানোর সন্তুষ্টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ এবং হাসিভরা মুখে নানারূপ মুখভঙ্গির সেলফি তোলাতে মত্ত দর্শকবৃন্দ নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকলেন এবার। উৎসবের ২৫তম উদযাপনেও থাকবেন।