চার নম্বর নিউজডেস্ক
ছেলেমেয়ে নাতিপুতিতে ভরা কোনও সংসার কত বড় হতে পারে দৈর্ঘ্যেপ্রস্থে? ফুট বা মিটারে দিব্যি মাপা যেতে পারে যে কোনও গৃহের পরিসর। কিন্তু কর্নাটকের হুলিকাল গ্রামের বৃদ্ধা থিম্মাক্কার গৃহপরিসর ফুট-মিটারে মাপা যাবে না। আদরের বাছাদের সবাইকে শুধু একবার ছুঁয়ে আসতে থিম্মাক্কাকে হাঁটতে হয় কমবেশি চার কিলোমিটার! কারণ হুলিকাল থেকে কুদুর– মানুষের এক বসতি থেকে আর এক বসতি অবধি– ছড়িয়ে আছে থিম্মাক্কার সন্তানেরা। এক সাথে তাদের নাম– সালুমারাদা। কন্নড় ভাষায় যার অর্থ বৃক্ষশ্রেণি। হ্যাঁ, একলা মানুষ থিম্মাক্কার অন্ধের নড়ি, সাধনার ধন হল প্রায় শ’চারেক বট আর পিপুল গাছ, শিকড়ে যাদের বিপুল প্রাণশক্তি। পঞ্চাশের আশেপাশে বয়স তাদের; বলা যায় সবে কৈশোরে পা রেখেছে। আশা করা যায় থিম্মাক্কা চোখ বোজার পর একশো বছর পরেও তার সন্তানদের মধ্যে বেঁচে থাকবে তার স্মৃতি, ছড়িয়ে যাবে ঝরা পাতার সাথে, বিছানো থাকবে নিবিড়তর হতে থাকা ছায়ায়, ধ্বনিত হবে পাখপাখালি আর ঝিঁঝিঁপোকার ডাকে।
শুধু থিম্মাক্কার একার নাম নিলে অবশ্য অর্ধেক কথা না বলা থেকে যাবে। চার কিলোমিটার পথের দুধারে ছড়ানো ‘সালুমারাদা’ একা থিম্মাক্কার স্নেহে লালিত হয়নি– তাদের বাবা চিক্কান্নার কথাও তারা মনে রাখবে নিশ্চয়। হুলিকালের বাসিন্দা চিক্কান্নার সাথে গুব্বি গ্রামের সদ্য কৈশোরে পা রাখা থিম্মাক্কার বিয়ে হয় তারিখ-বিস্মৃত এক অতীতে। তা বছর ষাট-পঁয়ষট্টি আগে তো বটেই। ভূমিহীন দিনমজুর এই দম্পতি কিছুদিনের মধ্যেই টের পায় তাদের ছেলেমেয়ে হবে না। নিজেদের সমাজেও যে খুব জনপ্রিয় ছিল তারা, এমনটা নয়। চিক্কান্নাকে তার পড়শিরা চিনত তোতলা চিক্কান্না নামে। তোতলামির কারণে স্বভাব-লাজুক চিক্কান্না আর থিম্মাক্কার সন্ধেগুলো অতএব ছিল বড় একলা আর বিষণ্ণ। সেইসব সন্ধেবেলা দুজনে ভাবত কিছু একটা করতে হবে। এমন কিছু যা তাদের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখবে, বয়ে নিয়ে যাবে সময়ের নদী বেয়ে উজানে।
এই ভাবনা থেকেই প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে এই দম্পতি ঠিক করে তারা অনেক গাছ লাগাবে, আর তাদেরই বড় করবে ছেলেমেয়ের মতো করে। এভাবেই মরণের সীমানা ছাড়িয়ে যেতে চায় তারা। কিন্তু আর দশজনের মতো নিজের জমিতে গাছ লাগানোর কথা ভাবেনি তারা। অত জমিই বা তারা পাবে কোথায়? তাই গ্রাম থেকে কুদুর যাওয়ার ছায়াহীন রুখা ধুলো-ওড়া পথের দু’পাশে তারা বট, পিপুলের চারা লাগাতে শুরু করে। প্রতি বছর পনেরো-কুড়িটা করে, বছরের পর বছর, যতদিন না পুরো চার কিলোমিটার পথের দু’দিক তারা ভরে দিতে পেরেছে। সংখ্যাটা বড় বলে মনে হচ্ছে না, কিন্তু শুধু চারা পুঁতে দিলেই তো আর হল না, তাদের দেখাশোনা দরকার। সপ্তাহে অন্তত দু’দিন প্রতিটা চারার গোড়ায় জল দিতে হবে, তাদের থেকে দূরে রাখতে হবে গরু-ছাগলদের। তাই প্রতিদিন ভোর ভোর কাঁখে কলসি নিয়ে থিম্মাক্কা, আর কাঁধে বাঁক নিয়ে চিক্কান্না বেরিয়ে পড়ত। রাস্তার পাশের পুকুর বা কুয়ো থেকে জল তুলে তুলে পৌঁছে যেত এক এক করে প্রতিটি চারার কাছে, দরকার মতো বেড়া দিয়ে ঘিরে দিত তাদের। একসময় এদের দেখাশোনার জন্য দিনমজুরির কাজও ছেড়ে দেয় চিক্কান্না। একা থিম্মাক্কার রোজগারেই তখন তখন চুলো জ্বলত তাদের সংসারে।
১৯৯০ বা ৯১ সালে মারা যায় চিক্কান্না। ততদিনে বেশ বড় হয়ে গেছে তাদের লাগানো গাছগুলো, ছায়ায় ঢেকে দিয়েছে রৌদ্রদগ্ধ প্রান্তরের শূন্যতা। আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে সালুমারাদার নাম। আরও বছর চারেক পরে থিম্মাক্কা পায় ন্যাশনাল সিটিজেন’স অ্যাওয়ার্ড। এর পর একাধিক পুরস্কার পেয়েছে থিম্মাক্কা, সালুমারাদা-র সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে গেছে তার নাম, কর্নাটক সরকার ভার নিয়েছে ঐ বৃক্ষশ্রেণি রক্ষণাবেক্ষণের।
কিন্তু এত সম্মান আর খ্যাতিতেও থিম্মাক্কা আজ অখুশি। স্বামীর সাথে হাত মিলিয়ে সৃজিত সালুমারাদার এক প্রান্তে নিজের ছোট্ট বাড়িতে বসে সে আক্ষেপ করে– কি হবে শুকনো সম্মানে, যদি কোনও অর্থাগম না ঘটে তার দ্বারা? সরকার তার থেকে একরকম কেড়েই নিয়েছে তার সন্তানদের। তাদের ওপর কোনও অধিকার আর থিম্মাক্কার নেই। এদিকে কোন সুদূর আমেরিকায় না কি তার নামে এক সংস্থা খোলা হয়েছে। তার নাম, তার ছেলেদের নাম ভাঙিয়ে এরা কী করতে চাইছে থিম্মাক্কার বোধগম্য হয় না। কেবল মনে হয় সবাই তাকে ঠকিয়ে নিচ্ছে, নইলে এত কিছুর পরেও দারিদ্র্য কেন তাড়া করে ফিরছে তাকে?
এ ঠিক বয়স্ক, অশক্ত থিম্মাক্কার অর্থলোভ নয়— বরং তার ভেতরের নিরাপত্তাহীনতার প্রকাশ। আপনার-আমার বাড়ির সব দরজা হাট করে খোলা থাকলে, আর যে কেউ যখন খুশি সেখানে ঢুকতে বেরোতে পারলে আমাদের যেমন ভয় হত, অনেকটা তেমন। সালুমারাদার সৃষ্টি অর্থলোভ থেকে নয়, থিম্মাক্কা-চিন্নাক্কা তাদের নিজেদের সন্তানজ্ঞানে বড় করেছে। আজ তাদের নিয়ে সবাই নাচানাচি করছে, এতে থিম্মাক্কার মনে হতেই পারে সন্তানরা বুঝি পর হয়ে যাচ্ছে। সেইজন্যই বোধহয় এখনও মাঝে মাঝে থিম্মাক্কা একা একা বেরিয়ে পড়ে কুদুরের পথে। ছুঁয়ে-ছেনে, গন্ধ শুঁকে নিশ্চিত হতে চায় তার কোলের ছেলেরা সব তারই আছে কি না।