Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

গুণবতী ভাই আমার, মন কেমন করে

প্রগতি বৈরাগী

 

সখী, মরিলে বান্ধিয়া রেখো তমালেরই ডালে
জীয়ন্তে জ্বলিয়া মরি বিচ্ছেদ অনলে…
শ্যাম আমার…

তুমি কখনও প্ল্যাটফর্মে পড়ে থাকা গোলাপফুল দেখেছ, মালেকজান? ভোর সাড়ে চারটের লোকালে চাঁদপাড়া, মছলন্দপুর থেকে আসা ফুলচাষিরা তিরিশ-চল্লিশ কেজি ওজনের ফুলের ঝুড়ি নামান ভেন্ডার থেকে, তারপর মাথায় নিয়ে দৌড়, দৌড়! ঝাঁকুনিতে, দু-একটা ফুল অমনি খসে পড়ে ঝুড়ির গা গড়িয়ে, হাজার পায়ের একটা এসে পিষে দিল তো দিল, নইলে কেমন ধকধকে লাল জিন্দেগি নিয়ে নরম বিছিয়ে রাখে শ্লেট রঙের কঠিনে। তারপর আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায় বাসি লাল, মরচে, কালোয়… কেবল ভিতরের বীজবাটিটুকু বিবর্ণ সাদা নিয়ে বেঁচে থাকে, যতক্ষণ পারা যায়!

তুমি মাথায় করে নিয়েছিলে তোমার আর আমার ‘আমাদের’ হয়ে ওঠাকে আর আমি দ্যাখো, ইচ্ছাবশে খসে পড়ার নিদান বেছে নিলাম। সমস্ত নরম মরে যাচ্ছে আমাদের। এই যে তুমি অনেকটা অশান্তি করার পর প্রতিক্রিয়ায় এক গরাস ভালোবাসা না পেয়ে ক্রমশ সেঁধিয়ে যাচ্ছ খড়খড়ি আঁটা মনখারাপ, হলুদ গোলঘরে। দেওয়ালে দেওয়ালে ঘুরঘুর করছ, তারপর উপায়ন্তর না দেখে টিউবের ফ্যাটফেটে সাদা আলোয় এক পা এক পা… ডিপ্রেশনের সরাৎ জিভ, হাঁমুখে।

এ-উৎসবে আমি তোমাকে অন্ধকার দিয়েছি, আর তুমি আমায় “এবার ‘আমিহীন’ আপনার ভালোথাকা হোক।”

কাল জোড়াঘাটে গিয়েছিলাম অন্ধকার হয়ে এলে। কবে যেন তুমি এখানে এসেছিলে বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়িতে, যখন চুঁচুড়া বলতেই তোমার ‘আমি’ মনে আসত না, আর বেলঘরিয়া বলতেই আমার তোমাকে। জলে পা ডুবিয়েছিলাম, পাশের অন্য ছায়াটি আজকাল অনেক তরল, আদরমুখী, তবু… মাঝখানটুকু ঘুলিয়ে উঠছিল আর একটি স্রোত, তাতে মাজাধলা দোহারা এক গড়ন। আমার পা ভিজিয়ে জলের প্রজাপতিরা কি পৌঁছেছিল ওপারে?

“ওপারেতে বৃষ্টি এলো ঝমঝম করে
গুণবতী ভাই আমার মন কেমন করে!”

গৌরাঙ্গ, ও গৌরাঙ্গ, গুণবতী ভাই আমার! এসো না আমরা আর একখান নিক্তিহারানো জন্ম লিখি!

তোমার থাইয়ে থুতনি ঠেকিয়ে আর একখান বিকেলের খোয়াব গাঢ় হোক, আমার কপালের চুল গোছ করে দিতে দিতে তুমি শোনাচ্ছ মণীন্দ্র-দেবারতি, বিনয়-গায়ত্রী, জয়-কাবেরীর পরণকথা। কতদিন তোমার পুরুষবৃন্তে ঠোঁট বসিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি, মাঝরাতে কুঁকড়ে থাকা আমার গায়ে চাদর টেনে দিয়ে গড়িয়ে আসা লালা মুছিয়ে দিয়েছ। কবে এমন বাবা হতে শিখলে তুমি, কবুতর?

খুব ছোটবেলায় কাজের দিদার কাছে রূপবানের গল্প শুনেছিলাম, মন্ত্রীকন্যা আটবছরের রূপবানের বিয়ে হয়েছিল সদ্য জন্মানো রাজপুত্তুরের সাথে, খোকাকে বাঁচাবার ওই ছিল একমাত্র নিদান। তারপর আঁতুড়ে স্বামীকে কোলে নিয়ে নদীর পাড়ে জঙ্গলে দিন কাটে রূপবানের, কাঠ কুড়িয়ে, শুকনো পাতা বেচে। আটবছুরে রাজপুত্তুরকে ভাই পরিচয়ে পাঠশালায় দেয়, কাঠের কাঁকই দিয়ে চুল আঁচড়ে পাঠায় গুরুমশায়ের কাছে। হিসেব করে দেখেছি, তোমার আটবছরে আমি হাইস্কুল পেরোচ্ছি। তোমার ভেজা মাথা মুছিয়ে দিতে দিতে, গাল ধরে চুল আঁচড়ানোর সময় আমার মাতৃভাব জাগে, বাইল্যকাল মনে ভাসে, রাজপুত্তুর!

কে যাস রে, ভাঁটিগাঙ বাইয়া…

কখনও মাঝদরিয়ায় সাঁতার দিয়েছ, বর্শিকুড়ার ছেলে? আমার বড়িশাইল্যা মা, খুলনার বাপ! রহস্য করে ঈষৎ পৃথুলা আমার ভারী পিছনের নাম দিয়েছ তুমি “বড়িশাইল্যা কুমড়া” আর আমার ডাগর ঊরু ডাক পেয়েছে, “বাগেরহাটের কদু”। তোমার শরীরে ডুবতে ডুবতে ভাসতে ভাসতে আমি সাঁতার দিই, তোমার নোনতা সমুদ্দুরের তেলেজেলে, শ্যামলা মৎস্যকইন্যা! ডুবন্ত আমার মুখে তুমি শ্বাস ভরে দাও, নিকোটিনসুবাস অক্সিজেন। এবার তোমাকে ডোবাতে ইচ্ছা করে, একখান গহীন গাং হব, লি লি সবুজ পাড়ওয়ালা কলোনির ঝিলপাড়!

আর সেই টুকটুকে রঙের, তরতরে মুখের ষষ্ঠীঠাকরুণের মতো বুড়ো মানুষটি! তাঁর মতোই তোমার রোদ থেকে ফিরে আসা লালচে মুখ থানের আঁচলে মুছে দিয়ে, ঠোঁটের গোড়ায় ধরতে মন চায় জলবাতাসা, মাঝকপালে ভাইদ্বিতীয়ার চন্দনের আহ্লাদ, কাজলের গহীন মায়া। শিরওঠা শীতলপাটির মতো মিঠা দুই হাতে সিনায় জড়িয়ে, “আহা, ভাই আমার!”

এই দেখো, আমি কেমন তাঁর মতন ছোট্ট, নরম, ফুটফুটেটি হয়ে যাচ্ছি। আমার আঙুলের ডগায় ফুটে উঠছে বীজবাটির সাদা, শুকিয়ে ওঠা গোলাপের কালো, ঠোঁটের কোল থেকে ঝরে পড়ছে, সুবাতাসে টলমল করছে প্রদীপের মতো অক্ষর,

“ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা”

চেয়েছিলে আমার আঙুল বেয়ে শুশ্রূষা নামুক চন্দন কাজল আর আজীবনের আগুন হয়ে, গাছের পাতায় গাঙের জলে ভাসিয়ে দিয়ে এসেছি তাদের, আমার পাতার ফোঁটা গাঙ পার হোক, ছুঁয়ে যাক তোমার গৌর কপাল। যেভাবে বাতাস, জল, আগুন, মাটি আর মহাশূন্যের কসম,… আমি তোমায় ছুঁয়ে থাকব বেঁচে থাকা পর্যন্ত।

“আমাদের কিছু নেই, একসঙ্গে ভেসে যাওয়া হোক।”

বেশরম, বেহিসাব,… বহুজন্মে, কলিজা আমার!