শতাব্দী দাশ
প্রসঙ্গ : সাউথ-সিটি
গত সপ্তাহের ঘটনাটি কমবেশি সবার জানা। দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুর থানা সন্নিকটস্থ সাউথ সিটি মল। মহার্ঘ্য সব বিপণি, মাল্টিপ্লেক্স, ফুড কোর্ট ইত্যাদির সমাহার সেখানে।বেহালার অভিলাষা দাস অধিকারী তাঁর সাত মাসের কন্যাসন্তানকে স্তন্যদান করতে গিয়েসেখানে প্রতিরোধের মুখে পড়েন। প্রকাশ্যে শিশুকে স্তন্যপান করাতে গেলে মলের নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁকে বারণ করেন। তাঁকে নোংরা টয়লেটে গিয়ে স্তন্যপান করানোর পরামর্শ দেন তাঁদের কেউ কেউ। অভিলাষার বক্তব্য অনুসারে, নিরাপত্তাকর্মী ও সাফাইকর্মী ছাড়াও, তিনি বিভিন্ন বিপণির কর্মচারীদের কাছেও সাহায্যের আবেদন জানান। শিশুকে স্তন্যপান করানোর একটু জায়গা দিতে অস্বীকার করেন সকলেই৷ তিনি ওয়াশ-রুমেও যান নিরাপত্তারক্ষীর পরামর্শ মতো৷ কিন্তু সেখানকার পরিবেশ শিশুর পক্ষে বড় স্বাস্থ্যকর মনে হয় না তাঁর। সাফাইকর্মীরাই নাকি তাঁকে জানান যে এই মলে কোনও বেবি-কেয়ার রুম নেই। মলের বিভিন্ন তলায় অনেক ঘোরাঘুরির পর শেষ পর্যন্ত মোটামুটি ফাঁকা এক পোষাক-বিপণির কর্মচারী তাঁদের ট্রায়াল-রুমটি অভিলাষাকে ব্যবহার করতে দেন। হতাশ অভিলাষা ফিরে এসে তাঁর অভিজ্ঞতা দু-এক লাইনে লেখেন সাউথসিটির ফেসবুক পেজের রিভিউ সেকশনে : “There is no place to breast feed… on top of it, yourstaff asked me to feed in the toilet… disgusting place….”
সাউথ সিটি মলের অ্যাকাউন্ট হ্যান্ডলার এরপর রূঢ় এক জবাব দিলেন ফেসবুক পেজেই : “Funny you found it to be an issue because breast-feeding is not allowedon the floor for a number of reasons…. with all due respect madam please make sure you do your home chores at your home and not in the mall, at least plan it beforehand. It’s not like your baby needs to be breast-fed at any moment so you need arrangements to be made for you at any public area to breast-feed your child anywhere you wish to? We cannot compromise the privacy of other people in public places, can we?”
অর্থাৎ, ‘একাধিক কারণে’ জনসমক্ষে বাচ্চাকে স্তন্যপান করানোর মতো ‘ঘরের কাজ’ (home chores) করা বারণ এই মলে। মল-কর্তৃপক্ষ কাস্টমারদের ‘প্রাইভেসি’ নিয়ে আপস করতে নারাজ, তাও জানা গেল। ক্ষুব্ধ অভিলাষা এবার সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের কথা লেখেন এবং মাত্র কয়েক ঘণ্টায় বিষয়টি ভাইরাল হয়ে যায়। সাউথ সিটি মলের বাইরে পরদিন কিছু বিক্ষোভ-সমাবেশ দেখা যায়। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনা হয় আরও বেশি। মলের অমানবিক আচরণের গল্প আগুনের মতো ছড়ানোর মুহূর্তে ড্যামেজ কন্ট্রোলে নামেন মল-কর্তৃপক্ষ৷ মলের ভাইস-প্রেসিডেন্ট মনমোহন বাগরি জানান, ফেসবুক-পেজের ওই জবার তাঁদের অনুমতি ছাড়াই লিখিত৷ যে এজেন্সিকে তাঁরা এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের নাকি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে নিরাপত্তারক্ষী অভিলাষাকে প্রকাশ্যে স্তন্যপান করাতে বারণ করেছিলেন, তাঁকেও চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে সাউথ সিটি মলের পক্ষ থেকে জানানো হয়। তাঁরা ক্ষমা চেয়ে একটি বিবৃতিও দিলেন ফেসবুক পেজে : “We at South City deeply apologise unconditionally for the reply to your feedback. We are deeply saddened by the reply made by our account handler.” আরও লেখা হল, মলটির পুনর্নিমাণ চলছে বলে সব ঘর খোলা নেই, কিন্তু বাচ্চার পরিচর্যার জন্য ঘর তাঁদের নাকি চিরকালই ছিল (যদিও সাফাই-কর্মীরা অভিলাষাকে উলটো কথাই বলেছিলেন)। আগে থাকুক না থাকুক, সোশ্যাল মিডিয়া সরগরম হওয়ার পর থেকে জরুরি ভিত্তিতে সাউথ সিটি মল ‘বেবিকেয়ার রুম’ নামক পরিষেবা চালু করে।
ব্যক্তিগত না রাজনৈতিক?
কৃষক মার্চ বা সাম্প্রদায়িক রথযাত্রা নিয়ে জাতীয় ডামাডোলের বাজারে আমরা কি উপরের বিষয়টিকে মল-কর্তৃপক্ষের মতোই একটি ‘প্রাইভেট’ বা ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে ‘পাবলিক’ ক্ষেত্রে অযথা শোরগোল ফেলার চেষ্টা হিসেবে দেখব? অনেকেই তেমন ভাবেন। এমনকি ক্ষুধার্ত শিশুও তার মায়ের প্রতি সমবেদনা ও সমর্থনও মূলত ব্যক্তিগত আবেগ-নির্ভর। আবেগকে অস্বীকার না করেও, এ’কথা না বলে উপায় নেই যে ব্রেস্টফিডিং একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিষয়ও বটে৷ ফেমিনিস্ট থিওরিতে বহু আগেই বলা হয়েছে ‘ব্যক্তিগতও রাজনৈতিক’ (The personal is political)। জানিয়ে রাখা ভালো, ইউরোপ এবং বিশেষত আমেরিকা ব্রেস্টফিডিং-এর অধিকার নিয়ে অনেক আন্দোলন দেখেছে৷ অভিনেত্রী মিলা কুনিস কিছুদিন আগে বলেছেন, এগারো বছর আগে প্লেনে ভ্রমণকালে বাচ্চাকে স্তন্যদান করানোর উদ্যোগ নিতেই এয়ারহোস্টেস তাঁকে রেস্টরুমে চলে যেতে বলেন। তিনি সেই পরামর্শ সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি সেলিব্রিটি হওয়ায় যত সহজে এই প্রত্যাখ্যান মেনে নেওয়া হয়েছিল, অন্যদের ক্ষেত্রে বিষয়টি ততটা সহজ কখনওই ছিল না। আজ যে অস্ট্রেলিয়ার সেনেটর বা কানাডার পার্লামেন্টেরিয়ান প্রকাশ্য পার্লামেন্টে শিশুকে স্তন্যপান করান, তা বেশ দীর্ঘ লড়াই-এর ফল। (কর্তব্যরত মায়েদের এই কর্মস্থলে স্তন্যদানের জনপ্রিয় ও ভাইরাল ইমেজেরও অবশ্য দ্বিমুখী অভিঘাত আছে। সে বিষয়ে পরে আলোকপাত করা যাবে।)
‘এক্সক্লুসিভ’ স্তন্যদান নিয়ে দু-এক কথা
বর্তমান দশকে মোটামুটি তাত্ত্বিকভাবে সকলেই এ’কথা জানেন ও মানেন যে মাতৃদুগ্ধই শিশুর স্বাস্থ্য ও পুষ্টির জন্য শ্রেষ্ঠ। হু (WHO) ও ইউনিসেফ (UNICEF)-এর সুপারিশ হল, শিশুকে জল বা অন্য কোনও খাবার ছাড়াই মাতৃদুগ্ধ পান করাতে হবে তার ছমাস বয়স পর্যন্ত, যাকে ‘এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং তত্ত্ব’ বলা হয়। তারপরেও, শিশুর দু’বছর বয়স পর্যন্ত অন্যান্য প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন খাবারের সঙ্গে সঙ্গে মাতৃদুগ্ধও পান করানো ভালো। হু আরও বলে, ব্রেস্টফিডিং শুরু করতে হবে জন্মের পর যত শীঘ্র সম্ভব। স্তন্যদান চালিয়ে যেতে হবে ‘অন ডিমান্ড’, অর্থাৎ যখন যখন শিশু চাইবে। সাধারণত দেখা যায় প্রতি দু ঘণ্টায় একবার দুগ্ধপানে শিশুর ক্ষুণ্ণিবৃত্তি হয়৷ এইসব নিদানের কারণগুলি শুধুমাত্র এই নয় যে মাতৃদুগ্ধ শিশুর জন্য ধনতান্ত্রিক নিক্তিতে বিনামূল্যের একটি পুষ্টি-উৎস। বরং কারণ হল, শিশুর দৈহিক ও বৌদ্ধিক বিকাশে মায়ের দুধের অমিত ইতিবাচক ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। যেহেতু চিকিৎসাবিজ্ঞান আমার বিষয় নয়, সুতরাং এর গুগল-নির্ভর বিশদ ব্যাখ্যা দেওয়ার চেয়ে বরং হু-এর বক্তব্যই হুবহু তুলে দেব :
Breast milk promotes sensory and cognitive development, and protects the infant against infectious and chronic diseases. Exclusive breastfeeding reduces infant mortality due to common childhood illnesses such as diarrhoea or pneumonia, and helps for a quicker recovery during illness.
ব্রেস্টফিডিং-এর মাধ্যমে মা-শিশুর সম্পর্ক দৃঢ় হয়, শিশু ইনটেকের ব্যাপারে স্বনির্ভর হয়, শিশুর বেশি খেয়ে ফেলার সম্ভাবনা কম থাকে, সে তার খাবারের উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত থাকে— এ’সবও বলে থাকেন চিকিৎসকরা। উপরিউক্ত বক্তব্যে অবশ্যই শিশুর স্বাস্থ্য, পুষ্টি, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হু-এর চিন্তার কেন্দ্রে রয়েছে, কিন্তু শুধুমাত্র শিশুর উপকার নিয়েই তার মাথাব্যথা, এমনটাও নয়৷ বক্তব্যের পরবর্তী অংশ হল :
Breastfeeding contributes to the health and well-being of mothers; it helps to space children, reduces the riskof ovarian cancer and breast cancer, increases family and national resources, is a secure way of feeding and is safe for the environment.
অর্থাৎ মায়ের স্বাস্থ্যর বিষয়েও স্তন্যদানের ভূমিকা ইতিবাচকই। এর সঙ্গে মায়েদের ‘মোটিভেট’ করার জন্য চিকিৎসকরা আজকাল প্রেগন্যান্সি-ওয়েট সহজে ঝরানোর উপায় হিসেবেও স্তন্যদানের কথা প্রচার করেন। আরও লক্ষণীয়, শেষদুটি পয়েন্ট সরাসরি রাষ্ট্রীয় ও পারিবারিক (রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রতম একক) সম্পদ তথা পরিবেশকল্যাণের সঙ্গে যুক্ত। সুতরাং নানা কারণেই স্তন্যদান একটি শুধুমাত্র ‘হোম চোরস’ নয়।
কিছু কিছু শারীরিক অসুবিধে থাকলে অবশ্য প্রতুল স্তন্যদান করতে মা অপারগ হন৷ ধরা যাক মায়ের হাইপোপ্লাস্টিক ব্রেস্ট আছে বা তিনি হাইপোথাইরয়েডিজমে ভুগছেন, বা ধরা যাক তাঁর বুকে কোনও প্রয়োজনীয় সার্জারি হয়েছে, ধরা যাক তাঁর ব্রেস্ট ক্যান্সার আছে, ধরা যাক মা দীর্ঘকাল ধরে ক্ষতিকর ড্রাগে আসক্ত, ধরা যাক পলিসিস্টিক ওভারির কারণে মায়ের দুধ কম উৎপন্ন হচ্ছে… এরকম নানা কারণে মা অপারগ হলে কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসক হয়ত বুকের দুধ-এর সঙ্গেই অন্য খাবার দিতে বলবেন, কিছু ক্ষেত্রে পাম্প করে বুকের দুধ বের করার পরামর্শ দেবেন, কিছুক্ষেত্রে শিশু বুকের দুধ থেকে একেবারেই বঞ্চিত হবে। কিছু ওষুধ গ্রহণকালে স্তন্যদান করা যায় না, আবার অনেক চিকিৎসকই স্তন্যদান কালে একইভাবে কার্যকরী বিকল্প ওষুধের ব্যবস্থা করেন। কেমোথেরাপির সময় বা ছোঁয়াচে রোগের প্রকোপে পড়লে স্তন্যদান করানো যায় না। এসব ক্ষেত্রে মায়ের অপারগতা নিয়ে তাঁকে হেয় করা, তাঁর মাতৃত্বের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবশ্যই অনুচিত৷ কিন্তু এছাড়া বাকি ক্ষেত্রগুলিতে? ঘটনা হল, ৯০ শতাংশেরও বেশি মা নিজের সন্তানের জন্য প্রয়োজনীয় খাবারটুকুর জোগান দিতে সক্ষম এবং ৯০ শতাংশেরও বেশি শিশুর সাকিং প্রবলেম থাকে না।
স্তন্যদান নিয়ে বহুমাত্রিক রাজনীতি ও তার বিবর্তন
শিশুকে দুধ খাওয়ানো প্রত্যেক মায়ের ‘অধিকার’, প্রো-ব্রেস্ট ফেমিনিজমের মতে। প্রকৃতপক্ষে, বুকের দুধ খাওয়ানো নিয়ে সঙ্কোচের বাহুল্যও আমাদের সংস্কৃতিতে ছিল না৷ এখনও আমাদের দেশে গ্রাম্য মহিলারা শাড়ি-টাড়ি দিয়ে আড়াল করে নির্দ্বিধায় দুধ খাওয়ান। সাউথসিটির মতো ভিক্টোরীয় সেন্স অফ ডিসেন্সি একটি ঔপনিবেশিক আমদানি, যা আমরা এখনও ছাড়তে পারিনি, কিন্তু যত তাড়াতাড়ি ছাড়ব তত মঙ্গল। ইউরোপে যেসময়ে নারীশরীরকে কম করে সাত-আটটি পরতে ঢেকে, বেঁধে-ছেঁদে জোর করে আওয়ার-গ্লাসের রূপ দেওয়া হত, সেই সময়ে ব্রেস্ট-ফিডিং-এর দৃশ্য খুব দৃষ্টি সুখকর ছিল না পিতৃতান্ত্রিক চোখে, তা বলাবাহুল্য। নারীর বক্ষ শুধুমাত্র একটি যৌন-উদ্দীপক বস্তু ছিল ‘মেল গেজ’ বা ‘পুংদৃষ্টি’ অনুসারে। তার যত্রতত্র উন্মোচন ছিল লজ্জার বিষয়৷ কিন্তু যে পশ্চিম থেকে এইসব সৌন্দর্যবোধ, শালীনতাবোধ ও নীতিবোধ এসেছে আমাদের দেশে, সেখানে মহিলারা শুধু নির্দিষ্ট বুথে নয়, প্রয়োজনে যত্রতত্র দুধ খাওয়ানোর দাবি তুলছেন বহুদিন যাবৎ।
শুধুমাত্র ভিক্টোরীয় নীতিবোধ নয়, ব্রেস্টফিডিং-বিরোধী সংস্কৃতির আরও কিছু দিক আছে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, পশ্চিমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মেয়েরা যত বেশি বাইরে বেরোতে লাগল, ততই জনপ্রিয় হতে লাগল ফর্মুলা মিল্ক। সত্তরের দশকের আগে পর্যন্ত স্তন্যদানের হার ক্রমশই কমল। এর ফলে পশ্চিমী দুনিয়ায় যেটুকু স্বাভাবিক স্বীকৃতি ছিল স্তন্যদানের, সেটুকুও হারিয়ে গেল৷ প্রশ্ন উঠল, স্তন্যদান কি একপ্রকার বাধ্যবাধকতা? নাকি তা একটি চয়েজ? নারীকে নিজ শরীরের উপর অধিকার কায়েম করতে দেওয়ার নারীবাদী দাবি থেকেই বলা হল, মায়েরই স্বাধীনতা থাকুক তিনি নিজের শরীর নিংড়ে দুধ খাওয়াবেন কিনা তা স্থির করার।
কিন্তু স্বাধীনতা বা চয়েজের প্রশ্নটি বোধ করি এত সরল নয়। এর পূর্ববর্তী আরেকটি ন্যায্য নারীবাদী দাবি ছিল : মা হওয়া যেন নারীর পক্ষে বাধ্যতামূলক না হয়৷ এমনকি, ‘সভ্যতা থমকে যাবে’ এই অজুহাতেও কোনও সভ্য দেশে কাউকে মা হতে বাধ্য করা যায় না। তাই অনেক নারীবাদী ধারাতেই সরাসরি মাতৃত্বের বিরোধিতা আছে। কিঞ্চিৎ নমনীয় ধারায় বলা হয়েছে, মাতৃত্ব একটি ‘চয়েজ’ হোক। নারীর অধিকার থাকুক মা হওয়া ও না-হওয়ার মধ্যে একটি পথ বেছে নেওয়ার। এই পর্যন্ত তেমন কোনও গরমিল নেই। প্রশ্ন হল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে স্তন্যদানকে ‘integral part of reproductive process’ বলছে, তাকে প্রজনন নামক সামগ্রিক প্রক্রিয়ারই একটি অংশ ধরব, এবং স্তন্যদানে আপত্তি থাকলে সামগ্রিকভাবে মাতৃত্বেও আপত্তি জানাব, নাকি প্রজনন প্রক্রিয়ায় অংশ নেব, অথচ তার কিছু কিছু অংশ বাদ দেব? এ নিয়ে বিতর্কথাকবে।
যাই হোক, সুযোগ বুঝে এই বিবর্তন ও বিতর্ককে ঘিরেই গড়ে উঠল একটি ক্যাপিটালিস্ট ব্যবসা। একটি বই আছে ‘পলিটিক্স অফ ব্রেস্টফিডিং’ নামে, যার সাবটাইটেল হল ‘হোয়েন ব্রেস্টস আর ব্যাড ফর বিজনেস’। এ’কথা সত্যি যে নানাভাবে মাতৃদুগ্ধ ব্যবসার ক্ষতি করে। সাপ্লিমেন্ট বেবি ফুড দুনিয়া জুড়ে একটি বৃহৎ ব্যবসা যা টিকেই আছে প্রায় অকারণে, কিছু ভুল ধারণা, কিছু মস্তিষ্ক-প্রক্ষালনের উপর ভিত্তি করে। ক্যাপিটালিজমের এমনই সর্বগ্রাসী ক্ষমতা যে তা ফেমিনিজমকেও একসময় সুচতুরভাবে ব্যবহার করেছে এই উদ্দেশ্যে৷ নিজের শরীরের উপর নিজের অধিকার কায়েম করতে ‘সচেতন’ মায়েরা ফর্মুলা ফিডিং করতে থাকলেন৷ ক্রমে বিকল্প-দুগ্ধ ব্যাবসায়ীদের সঙ্গে চিকিৎসাক্ষেত্রেরও যোগাযোগ বাড়ল। ডাক্তাররাও এইসময় ফর্মুলা ফিডিং-এর পরামর্শ দিতেন। ঊনবিংশ শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে স্তন্যদানের হার সঙ্কটজনকভাবে কমে গেল, বাড়ল শিশুমৃত্যুর হার।
অন্যদিকে অ-নারীবাদী মায়েদের প্রভাবিত করা হল খানিক অন্য পন্থায়। কখনও তাঁদের মনে পারিবারিক ক্ষেত্রে মা-শাশুড়িরা, কখনও আবার চিকিৎসকেরা এমনভাবে দুধ উৎপাদনের ক্ষমতা ও বাচ্চার স্বাস্থ্য নিয়ে ভয় ঢুকিয়ে দিলেন যে তাঁরা বিশ্বাস করতে থাকেন, ব্রেস্টফিডিং যথেষ্ট নয়৷ এখনও মাঝে মাঝেই শোনা যায়, বাচ্চা কাঁদছে মানেই তার পেট ভরছে না, তার ফর্মুলা দুধ প্রয়োজন… বাচ্চার জন্ডিস হয়েছে, সুতরাং তাকে ফর্মুলা ফিডিং করাও— এরকম নানা পরামর্শ। পারিবারিক স্বজনরা নিজেরাও জানেন না যে তাঁরা বিজ্ঞাপন-জ্ঞানে ধৌত হয়ে ক্যাপিটালিজমের এজেন্ট হিসেবেই কাজ করছেন ও বাচ্চার ক্ষতি করছেন। আমাদের দেশে চা বানানো হয় যে আমুলস্প্রে দিয়ে, তার প্যাকেটের গায়েও বাচ্চার ছবি থাকত। অনেক গরীব মহিলাই সবচেয়ে সস্তা বেবিফুড হিসেবে এটিই খাওয়াতেন এবং বাচ্চার পেটের অসুখ নিশ্চিত করতেন। মায়ের হীনম্মন্যতা ও ট্রমার কথা ছেড়েই দিলাম। ব্রেস্টফিড করিয়েছেন এরকম মায়েদের মধ্যে এমন একজনকেও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যিনি ‘বাচ্চা অভুক্ত থাকছে, যথেষ্ট সাপ্লাই দিতে পারছি না’ এই ট্রমায় ভোগেননি, নানা শুভাকাঙ্খী যাঁকে বাচ্চার ভালো চেয়েই ফর্মুলা-ফিড করানোর পরামর্শ দেননি৷
ক্রমে এই চিন্তাধারাও পাল্টাল। মানুষ যেহেতু শুধুমাত্র জৈবিক কারণে তাড়িত হয় না, যেহেতু মানুষের সিদ্ধান্ত তার দর্শন ও উপলব্ধি সঞ্জাত, সেইহেতু ‘অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণী স্তন্যদান করে’, শুধুমাত্র এই যুক্তি নিয়ে মানবীকে স্তন্যদানে অনুপ্রাণিত করা খানিক সমস্যাজনক। ইতিহাসের নানা ধাপে নানা সামাজিক শিক্ষা ও অর্থনৈতিক কারণ দ্বারা নারীর ব্রেস্টফিডিং-এর সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। সুতরাং মানবীকে স্তন্যদানে উৎসাহিত করতে হলে আবেদন রাখতে হয় তার মনন ও ধী-র প্রতি। সমাজ ও রাষ্ট্র স্তন্যদানকে কতটা গুরুত্ব ও মর্যাদা দিচ্ছে, নারী স্তন্যদানকালে কতটা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে, তার উপরেও নির্ভর করে তার সিদ্ধান্ত। প্রাকৃতিক হলেও, সুতরাং, মনুষ্যসমাজে স্তন্যদান একটি লার্নেড বিহেভিয়ারও বটে।
সে’কারণেই আশি ও নব্বই দশকে হু ও ইউনিসেফ শিশুকল্যাণের উদ্দেশ্যে স্তন্যদান নিয়ে ইতিবাচক প্রচারে তৎপর হয়। ফেমিনিজম এই পর্যায়ে এসে স্তন্যদানকে সমর্থনই করল। যা এতদিন ধরে কখনও একটি ‘বাধ্যবাধকতা’, কখনও একটি ‘চয়েজ’ বলে প্রচারিত হচ্ছিল, তাকে ‘মায়ের অধিকার’ বলে ঘোষণা করা হল। ১৯৮৯ সালে পেনি ভ্যান এস্টেরিক বললেন যে স্তন্যদানও একটি ‘ফেমিনিস্ট ইস্যু’ কারণ তার সঙ্গে সরাসরি জড়িত মায়ের অধিকার, তাঁর স্বাস্থ্য, শিশুর স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা। তিনি আরও বলেন, মা স্তন্যদানকালে একজন উপভোক্তা নয়, বরং একজন উৎপাদকের ভূমিকায় আত্মপ্রকাশ করেন। শুধুমাত্র যৌনবস্তু হিসেবে নিজেকে না দেখে স্বীয় ক্ষমতায় আরেকটি প্রাণ প্রতিপালন করেন। তাঁর মতো প্রো-ব্রেস্ট নারীবাদীরা দাবি করেন, স্তন্যদানের মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ভূমিকা পালন করছে নারী, যা শুধুমাত্র নারীর পক্ষেই করা সম্ভব৷ সুতরাং তাকে উৎসাহ দেওয়া, তার এই ভূমিকাকে স্বীকৃতি দেওয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য৷
অন্যদিকে হু ও ইউনিসেফ ১৯৯২ সালে একটি শিশুবান্ধব-মাতৃ-অভ্যাস সংক্রান্ত কার্যক্রম আয়োজন করে। প্রতি অগাস্ট মাসে শুরু হয় স্তন্যদান দিবস ও সপ্তাহ পালন। চল্লিশ ঘণ্টার এক ব্রেস্টফিডিং কাউন্সেলিং সেশনেরও আয়োজন করা হয় ওই বছর।
এককালে পিতৃতান্ত্রিক মা-মাসিরা বলতেন ‘ফিগার খারাপ হওয়ার ভয়ে’ মায়েরা শিশুকে দুধ খাওয়ান না। লক্ষণীয়, বর্তমানে কিন্তু চিকিৎসক বা ব্রেস্টফিডিং-সমর্থকরা ‘ফিগার’ বা অঙ্গসৌষ্ঠবের প্রতি যত্নশীল হওয়াকে আমাতৃসুলভ ইচ্ছা ধরছেন না৷ বরং বলছেন, স্তন্যদানও হতে পারে প্রেগন্যান্সি-কালের অতিরিক্ত মেদ ঝরানোর একটা উপায়। অর্থাৎ, ভাষ্য বদলাচ্ছেন এমনভাবে যাতে নিজের শরীর ও শরীরের সৌন্দর্যর উপর নারীর অধিকারও প্রতিষ্ঠা হয়, আবার তিনি স্তন্যদান করতেও উৎসাহিত হন।
অস্বীকার করার উপায় নেই, প্রয়োজনও নেই, যে প্রজনন মায়ের পক্ষে শারীরিকভাবে কষ্টসাধ্য ও শ্রমসাধ্য একটি প্রক্রিয়া এবং তার অব্যবহিত পরেই স্তন্যদান করাটা ‘প্রাকৃতিক’ হলেও তার কারণে মায়ের কষ্ট বাড়ে, বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটে। একমাত্র আহারের সংস্থান হিসেবে ‘অন ডিমান্ড’ শিশুকে দুধ দিয়ে যাওয়া মুখের কথা নয়। ধনতান্ত্রিক-পিতৃতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় এই শ্রম অবৈতনিক, সুতরাং গুরুত্বহীন। অ্যান্টি-ব্রেস্ট ফেমিনিস্টরা এই শোষণের দিকটি ন্যায্য কারণেই আলোচনা করতেন। বলতেন, ব্রেস্টফিডিং-এ বাধ্য করা মেয়েদের আবারও ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে ঠেলে দেওয়ার একটি চক্রান্ত।
নব্বই-এর দশক থেকে প্রো-ব্রেস্ট ফেমিনিস্টরা কিন্তু বললেন, রাষ্ট্রকেই নিজের গঠনতন্ত্র বদলে ফেলতে হবে। সমাজকে হতে হবে এমনভাবে বিন্যস্ত, কর্মজগতকে এমনভাবে নিজেকে গড়েপিটে নিতে হবে, যাতে নারী তার স্তন্যদানের অধিকার বজায় রাখতে পারে, আবার বহির্জগতের কর্মকাণ্ডেও অংশগ্রহণ করতে পারে। এই সব দাবি মেনেই কিন্তু দেশে দেশে এল দীর্ঘতর মেটারনিটি লিভ, এল চাইল্ড কেয়ার লিভও৷ আমাদের দেশের কথাই ধরা যাক। প্রথমে তিন মাস, তারপর সাড়ে চার মাস, তারপর ছ মাসের মেটারনিটি লিভ— এই বিবর্তন আমরা দেখেছি দুই দশকের মধ্যেই। এখন দু বছরের শিশুপ্রতিপালন ছুটিও মিলেছে। আরও অধিকার দাবি করতে হবে, করাই উচিত মায়ের স্বার্থে।
আবার বিশ্বের ধনীতম দেশ ইউনাইটেড স্টেটসে সাত থেকে পনেরো দিনের বেশি মাতৃত্বকালীন ছুটি আজও পাওয়া যায় না। ধনতান্ত্রিক মস্তিষ্ক প্রক্ষালন এই অধিকারের দাবিকে থিতিয়ে দেয়। তার জন্য পিতৃতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই নারীর মাল্টিটাস্কিং-এর ক্ষমতার জয়গান করা হয়, শুধু বহিরঙ্গে থাকে উওমেন এমপাওয়ারমেন্টের একটি মুখোশ। সন্তান প্রসব করার কয়েকদিনের মধ্যেই ফেসবুকের মতো একটি বহুজাতিক সংস্থা চালাচ্ছেন মহিলা সিইও, পার্লামেন্ট অ্যাটেন্ড করছেন পার্লামেন্টেরিয়ানরা— এসব ঘটনাকে আমাদের সামনে মডেল হিসেবে উপস্থিত করা হয়। প্রশ্ন হল, জন্মদানের ঠিক পরেই স্তন্যদান করতে বললে যতটা লঘু করা হয় মায়ের প্রসবকালীন কষ্টকে, তার চেয়েও বেশি লঘু করা হয় না কি মায়ের কষ্ট ও শিশুর প্রয়োজনকে, ক্যাপিটালিস্ট দাবি মেনে জন্মদানের পরে-পরেই মাকে কাজে টেনে আনলে?
আগেই বলেছিলাম, পার্লামেন্টেরিয়ান যখন পার্লামেন্টে বসে স্তন্যদান করেন, তখন সেই ছবির অভিঘাত দ্বিমুখী৷ একদিকে তা স্তন্যদানে উৎসাহ প্রদান করে, অন্যদিকে মাতৃত্বকে উপস্থাপিত করে এমনভাবে, যেন তা কতই সহজ! যেন মায়ের স্তন্যদানের জন্য ছুটি প্রয়োজন নেই, যেন তার নিজের শরীরের প্রতি যত্নবান হওয়ার প্রয়োজন নেই, যেন সাত-তাড়াতাড়ি কাজে ফেরাই একজন মায়ের মোক্ষ। একজন পার্লামেন্টারিয়ানের পক্ষে তা হয়ত অসম্ভব কিছু নয়, রাষ্ট্র তাঁকে বিবিধ সুযোগ-সুবিধা এমনিতেই দেয়। ফেসবুকের কর্ণধারের মতো ধনী মালিক শ্রেণির মহিলার পক্ষেও সাতদিনের মাতৃত্ব-ছুটির পর কাজে যোগ দেওয়া হয়ত সম্ভব৷ কিন্তু যে মহিলা সাধারণ কর্মচারী হিসেবে বেসরকারি সংস্থায় কাজ করে, তার কাছে এই মডেল হাজির করা হলে সেই মডেল মালিকের হাতে নিষ্পেষণ ও নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহৃত হবে। এ ধরনের প্রচারের প্রথম শিক্ষাটুকুই সুতরাং গ্রহণ করা ভালো। মাল্টি টাস্কিং-এর মহিমা প্রচারের অংশটি ক্যাপিটালিস্ট শোষণের অংশ কিনা তা ভেবে দেখা দরকার।
মার্ক্সীয় নারীবাদ, রিপ্রোডাক্টিভ লেবার ও স্তন্যদানের ব্যাখ্যা
কেন শিশু-পরিচর্যা বা স্তন্যদানের যথাযোগ্য মর্যাদার জন্য আজও লড়তে হয়? তা বুঝতে আমাদের কিছুটা এঙ্গেলসের ‘অরিজিন অফ ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রপার্টি অ্যান্ড দ্য স্টেট‘-এ ফিরতে হবে, কিছু ক্ষেত্রে মার্ক্সিস্ট ফেমিনিস্টদের দ্বারস্থ হতে হবে। শিকারবৃত্তি থেকে কৃষিবৃত্তিতে একসময় মানুষেরউত্তরণ ঘটেছে, শ্রমের বিভাজন হয়েছে কায়িক ক্ষমতারভিত্তিতে। কিন্তু কেউ গৃহকার্যে শ্রমদান করছে, না বহির্জগতে শ্রমদান করছে— তার ভিত্তিতে সামাজিক মর্যাদার বাড়া কমা হত না ততদিন পর্যন্ত, যতদিন না উৎপাদন বৃদ্ধি পেল এবং মানুষের হাতে উদ্বৃত্ত অর্থ, সম্পদ বা শস্য না জমতে শুরু করল। মানবীর হাতে সেই সারপ্লাস কখনওই এল না, কারণ গৃহশ্রমে উদ্বৃত্ত বলে কিছু হয় না। পুরুষ উদ্বৃত্ত দখল করল, ভোগ্যপণ্য দখল করল, সম্পত্তির একচ্ছত্র মালিক হল। নারীর গৃহশ্রমকে এরপর ধীরে ধীরে ‘প্রোডাক্টিভ’ কাজের আওতায় আনা বন্ধ করা হল। ধনতন্ত্র প্রোডাকশন পরিমাপ করল স্থূলতর অর্থনৈতিক নিক্তিতে৷ কৃষক ফসল না ফলালে যে নাগরিকজীবনের রাজনীতি, অর্থনীতি স্রেফ জৈব জ্বালানির অভাবে স্থগিত হয়ে যেত, তা আমরা ভুলে যেতে বসেছিলাম বলেই দিল্লি আজকৃষকের পদধ্বনিতে কেঁপে উঠছে। তেমনি নারী তথাকথিত ‘নন-প্রোডাক্টিভ’ গার্হস্থ্য শ্রম ও প্রজনন শ্রম না দিলে অন্য সকল ক্ষেত্রে মানুষ যে শ্রমদানের উপযুক্ত থাকত না, তা আমরা ভুলে যাই৷ তাই গৃহশ্রম এখনও নারীকে বেতন বা সম্মান কিছুই দিতে অপারগ, তাই প্রজনন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন কাজকে— তা সন্তানধারণ হোক, দুগ্ধপান করানো হোক বা সন্তানের পরিচর্যাই হোক— এ’সবকে আমরা এখনও শ্রমের যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে পারিনি।
পেগি মর্টন বা মার্গারেট বেন্সটনের মতো মার্ক্সীয় ফেমিনিস্টরাই প্রথম লেইবার বা শ্রমকে দুভাগে বিভক্ত করেন, প্রোডাক্টিভ ও রিপ্রোডাক্টিভ লেবার৷ তাদের পারস্পরিক নির্ভরতার উপর জোর দেন তাঁরা। বলেন, রিপ্রোডাক্টিভ লেবারের সঙ্গে যুক্ত যারা, তারাও শ্রমিক, তাদের নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করাও শ্রমিক-কল্যাণমুখী যে কোনও রাজনীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত৷ এই রিপ্রোডাক্টিভ লেবার বলতে কিন্তু শুধু প্রজনন-সংক্রান্ত শ্রমকে সূচিত করছেন না তাঁরা। রান্নাবান্না, ঘর পরিষ্কার রাখা, পরিবারের লোকজনের যত্ন— সবই বোঝাচ্ছেন। কালক্রমে এক লিঙ্গশ্রেণি তাদের সমগ্র রিপ্রোডাক্টিভ লেবার অন্য লিঙ্গশ্রেণির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে— এমনই তাঁদের বক্তব্য৷ এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন, হয় রিপ্রোডাক্টিভ বা পারিবারিক কাজ ভাগাভাগি করা, নয় সারাক্ষণের গৃহকর্মের জন্য বেতন কাঠামো। তেমনি আবার প্রয়োজন, যে সব কাজে শুধুমাত্র মেয়েরাই সক্ষম, সেগুলিকে তাদের প্রতিবন্ধকতা, দুর্বলতা বা কেরিয়ারে উন্নতির পথে অন্তরায় হিসেবে না দেখিয়ে, সেই কাজগুলির জন্যই তাদের যথাযোগ্য সম্মান, স্বীকৃতি ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া৷ শিশুপ্রসব বা স্তন্যদান এই রকমই কিছু কাজ৷
যা যা সংস্কার আশু প্রয়োজন
সুতরাং মাকে দুগ্ধদানে উৎসাহ দিতে গেলে তাঁর কর্মক্ষেত্রকে তথা রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে যে স্তন্যদান একটি ফুল-টাইম কাজের সমান। প্রথম ছ মাসের জন্য মেটারনিটি লিভ, তারপরও কিছু ওয়ার্ক ফ্রম হোম, কিছু ফ্লেক্সি লিভ, কিছু সহমর্মিতা দরকার মায়ের জন্য, এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং-এর লক্ষ্য-মাত্রা পূরণ করতে হলে। সেই সঙ্গে কর্মস্থলেই নার্সারি ও বেবিকেয়ার রুমের ব্যবস্থা করা দরকার, যাতে মা প্রয়োজনে শিশুকে নিয়ে কাজে যেতে পারেন৷ পাব্লিক ব্রেস্টফিডিং নিয়ে ছুৎমার্গ বর্জন করে দুগ্ধপানরত শিশু বা স্তন্যদানরত মায়ের দৃশ্যে চোখে সইয়ে নেওয়াও দরকার৷
ইউনাইটেড স্টেটসে কর্মরত মায়েদের কথা মাথায় রেখে অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার অ্যাক্ট এসেছিল, ১৯৩৮ সালের পুরনো ফেয়ার লেবার অ্যাক্টকে সংশোধন করে। নিউ ইয়র্কে আছে ব্রেস্টফিডিং মাদারস বিল অফ রাইটস। ৪৯টি আমেরিকান স্টেটে ব্রেস্টফিডিং-কে ‘ইন্ডিসেন্সি চার্জ’ থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জনসমক্ষে, রাস্তায়-ঘাটে স্তন্যদান এখনও আমেরিকার অনেক জায়গায় একটি ইস্যু (যে কারণে আইন করে কিছু স্টেট তাকে অশালীনতার দায় থেকে মুক্তি দিয়েছে)। অনেকেই এখনও স্তন্যদানের ঘটনা দেখলে আপত্তি জানান, বাচ্চাদের আড়াল করেন। অনেকেই একে মলমূত্র ত্যাগ বা যৌনতার মতোই একটি গোপন ও ব্যক্তিগত কাজ মনে করেন, যা ‘টয়লেটে’ করা যায়, বাসে-ট্রেনে-টিউবে নয়। ‘পাব্লিক ডিসপ্লে অফ ব্রেস্টফিডিং’ তাই দুনিয়া জুড়েই একটি আন্দোলনের বিষয় ও লক্ষ্য৷ শিশুর খিদে ও সেই খাবারের সংস্থান করে দেওয়া নিয়ে আর রাখঢাক করতে রাজি নন মহিলারা। শুধুমাত্র অনভ্যস্ত চোখের অস্বস্তি এড়াতে নিজেকে অনাবৃত না করা, বাচ্চাকে অভুক্ত রাখাকে মানবিকতা ও নারীবাদী নীতি– উভয়েরই বিরোধী মনে করছেন তাঁরা৷
আমাদের দেশে এধরনের আইন প্রয়োজন হয়নি, কারণ এখনও দেশের সর্বত্র স্তন্যদানরত মায়ের সঙ্গে সাউথ সিটির ঘটনার মতো দুর্ব্যবহার করা হয় না। মা হিসেবে আমি সত্যি শহর কলকাতায় কিছু হাসপাতাল বা পেডিয়াট্রিশিয়ানের চেম্বার ছাড়া কোথাও ফিডিং বুথ দেখিনি। আবার এটাও সত্যি যে শহর কলকাতায় রাস্তাঘাটে ব্রেস্টফিডিং করাতে আমার কোনও অসুবিধে হয়নি৷ মহিলারা জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন, আড়ালও দিয়েছেন নিজেদের সংস্কার মতো। সুতরাং সাউথ সিটির বোধবুদ্ধি দেখে আমি শঙ্কিত৷ কিছুদিন আগেও দক্ষিণী এক ম্যাগাজিনে স্তন্যদানের ছবি কভারে ছিল বলে বিক্ষোভ, মামলা-মোকদ্দমা দেখলাম। প্রতি-আন্দোলনও দেখলাম। আমরা কি তবে পিছিয়ে যাচ্ছি? আরও বছর পঞ্চাশ আমরা ইউরোপীয় ট্যাবু মেনে চলব দেশজ সংস্কৃতি ভুলে? তারপর আবার ইউরোপীয় কায়দায় পাব্লিক ব্রেস্টফিডিং আন্দোলন করব? স্তন্যদানের অভ্যাস আমাদের দেশে যখন আগে থেকেই ছিল, তা নষ্ট করে ফেলা খুব বুদ্ধিমানের কাজ নয় বলেই মনে হয়।
ভারতের মতো দেশে, সত্যি বলতে এশিয়া, আফ্রিকা ও আদি-অধিবাসী অধ্যুষিত দক্ষিণ আমেরিকার নানা জায়গাতেও জনসমক্ষে দুধ খাওয়ানো নিয়ে তেমন কোনও পিউরিটান সমস্যা ছিল না। সমস্যার রূপ সে’সব জায়গায় ভিন্নতর। এ’সব মহাদেশে মায়েরা ভোগেন অপুষ্টিতে, রোগে। মাতৃত্বকালীন যত্ন থেকে তাঁরা অনেক বেশি বঞ্চিত। সুষম আহারের অভাবে এঁরা নিজেরাও অসুস্থ হয়ে পড়েন, শিশুকেও প্রয়োজনীয় পুষ্টির জোগান দিতে পারেন না৷ কিন্তু তার সমাধানও ফর্মুলা দুধ নয়, সমাধান হল মা বা ভাবী মায়ের প্রতি পারিবারিক যত্ন, সামাজিক দায়িত্ববোধ।
পাব্লিক প্লেসে ব্রেস্টফিডিং না করতে দেওয়া, সুতরাং, কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়৷ এটি পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে চলা একটি ব্যবসায়িক ষড়যন্ত্র ও দার্শনিক দোলাচলের অংশমাত্র। আমাদের দোলাচল যেন কোনও ষড়যন্ত্রকে দৃঢ় না করে, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সাউথ সিটি-কর্তৃপক্ষর বক্তব্য যদি লক্ষ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, তাঁরা বলছেন, শিশুর যদি ঘন ঘন খিদে পায়, তাহলে মা কেন বিকল্প অ্যারেঞ্জমেন্ট রাখেন না? কীরকম অ্যারেঞ্জমেন্ট? ফর্মুলা ফিডিং নিঃসন্দেহে৷ অর্থাৎ মা ব্রেস্টফিড করাতে আগ্রহী হলেও তাঁকে বাইরে বেরোলে অন্তত ফর্মুলা-ফিডিং করাতেই হবে। পাম্পিং মেশিন দিয়ে আগে দুধ বের করে রাখা আরেকটা উপায়৷ মা নিজে সঙ্গে থাকলে আর শিশুর সাকিং প্রবলেম না থাকলে সেই যন্ত্রটিও বা কিনতে ও ব্যবহার করতে কেউ বাধ্য হবে কেন?
এ’কথা সত্য যে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে চড়া দামে ইন্টারনেটে মাতৃদুগ্ধ বিক্রয় হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যার বিশুদ্ধতা নিয়ে নিশ্চিত হওয়া মুশকিল। এ’কথাও সত্য যে ব্রেস্ট-পাম্পিং মেশিনের ব্যবসাও বেড়েছে হু হু করে। এতদসত্ত্বেও এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং-এর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অনস্বীকার্য। দুধের শিশুর খাবারের সর্বোৎকৃষ্ট ‘অ্যারেঞ্জমেন্ট’ মা নিজে। তাই নারীবাদী স্লোগানেও এখন স্তন্যদানের অধিকারের দাবি থাকে। তা থেকে মুক্তির দাবি এখন অতীত। কিন্তু শিশুপ্রসব ও স্তন্যদান নারীর শৃঙ্খল বা বোঝা হয়ে উঠবে না তখনই, যখন রাষ্ট্র এই কাজগুলিকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেবে, সুযোগ-সুবিধা-ছুটি দেবে মায়ের প্রয়োজন মতো, যখন প্রকাশ্যে দুগ্ধপান করাতে গেলে মাকে রক্তচক্ষু বা শেম-গেমের সম্মুখীন হতে হবে না। নারীর প্রতি দাক্ষিণ্য হিসেবে নয়, রাষ্ট্রের ও সমাজের এ’টুকু ব্যবস্থা করা উচিত স্রেফ মানবসভ্যতার অস্তিত্ব আরও কিছুদিন নিশ্চিত করতে। এ’টুকুআশা, এ’টুকু দাবি খুবই বাস্তবসম্মত ও রাজনৈতিক।