Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

দ্য আদার সাইড অফ দ্য উইন্ড

সত্যব্রত ঘোষ

 

একজন দক্ষ অভিনেতা হিসেবে অরসন ওয়েলস নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। শুধু তা না হয়ে বিশ্বমানসে নিজের প্রতিভার সাক্ষর রেখে গেলেন পরিচালনায়— প্রথমে একের পর এক সফল মঞ্চায়নে, চমকপ্রদ রেডিও অনুষ্ঠানে এবং অনন্য কয়েকটি সিনেমায়। জাতশিল্পী মাত্রই এই আকাঙ্খা থাকে, অন্যের অভিব্যক্তির এক মাধ্যম হিসেবে সীমাবদ্ধ না থেকে নিজস্ব সৃজনে মাতব। এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখব আমার নিজের হাতে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন অর্থের নিশ্চিত যোগান। পাশাপাশি চাই নীতি ও বিবেকবোধের গণ্ডি অতিক্রম করার সাহসও। এছাড়া, শৃঙ্খলহীনতার প্রতি তীব্র তাড়নাও অনুভব করা দরকার। যা অরসন ওয়েলস তারুণ্যের তেজে এবং মেধার জোরে করে দেখিয়ে ছিলেন। বেপরোয়ার মতো নিজের নিয়ম নিজেই ভাঙবার ক্ষমতা তিনি প্রমাণ করেছিলেন তাঁর পরিচালিত নাটক ও রেডিও অনুষ্ঠানে। তা পূর্ণমাত্রায় বিকশিত করবার আত্মবিশ্বাস নিয়েই তিনি হলিউডের স্টুডিও ফিল্মগুলির ব্যাকরণ-মানা প্রথাসর্বস্বতায় একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন আঁকতে পেরেছিলেন।

হলিউড মধ্যপন্থায় বিশ্বাসী। কাহিনী ও চরিত্রের সাযুজ্য বজায় রেখে এক সরলরৈখিক বিন্যাসে গল্প বলবার দিকেই তার ঝোঁক। সিংহভাগ টাকাই সেখানে ব্যয় হয় তারকা নির্মাণে আর চোখ-ধাঁধানো দৃশ্য রচনায়, হলিউডের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘মাউন্টিং’। যার মাঝে জন ফোর্ডের মতো পরিচালককে স্বকীয় এক নিবিড় ভাষায় ছবি বানানোর জন্য রীতিমতো লড়াই চালাতে হয়। কারণ, সিনেমা তৈরির এই কারখানায় উৎপাদিত পণ্যসমূহের স্ট্যান্ডার্ডাইজেশনে রীতির প্রতি মান্যতা, অন্তর্লীন রাজনৈতিক অভিপ্রায় এবং বাণিজ্যমুখীনতার যে মানদণ্ডের ব্যবহার প্রচলিত, সেখানে চিত্রপরিচালকদের সঙ্গে কারখানার সুপারভাইজারদের ভূমিকায় খুব বেশি ফারাক থাকে না। একজন ‘বহিরাগত’ হিসেবে স্টুডিও প্রোডাকশনের এই ব্যবস্থাকে নস্যাৎ করবার স্পর্ধা নিয়েই ‘সিটিজেন কেন’ (১৯৪১) নির্মাণ করেন অরসন ওয়েলস। যার বিষয় ও আঙ্গিক বহু আলোচিত।

সম্প্রতি নেটফ্লিক্স-এর উদ্যোগে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি অরসন ওয়েলসের শেষতম ছবি ‘দ্য আদার সাইড অফ দ্য উইন্ড’ দেখাকালীন তাঁর প্রথম ছবি ‘সিটিজেন কেন’-এর অনুষঙ্গ এসে পড়াটা স্বাভাবিক। কারণ, এখানে জেক হ্যানফোর্ড নামে এক কিংবদন্তিসম বর্ষীয়ান চিত্রপরিচালককে নির্মাণ করেছেন অরসন ওয়েলস। চিত্রজগতে যার প্রভাব, প্রতিপত্তি, আত্মকেন্দ্রিকতা, দম্ভ এবং অসহায়তা চার্লস ফস্টার কেন-এর মতোই বিশাল। এবং মানসিকতার দিক থেকেও সে চরমপন্থায় বিশ্বাসী। জীবনের উপান্তে পৌঁছে হ্যানফোর্ড নিজের নির্মীয়মাণ ছবিটির জন্য অর্থবিনিয়োগকারীর সন্ধানে রত।

অরসন ওয়েলসের ইচ্ছে ছিল তিনি তাঁর সুদীর্ঘ পেশাদারী অভিজ্ঞতাগুলিকে দুই মলাটের মাঝে এনে একটি আত্মজীবনী রচনা করবেন। তার প্রস্তুতি হিসেবে তিনি চিত্রপ্রযোজক ও অভিনেতা পিটার বোগোডানোভিচ-এর কাছে সুদীর্ঘ সময় ধরে নিজের বৈচিত্রপূর্ণ সৃজনশীল জীবনের বিভিন্ন পর্ব মেলে ধরেন। সেই আত্মজীবনী আর তাঁর লেখা হয়ে ওঠেনি। তবে, হলিউডের প্রভা থেকে প্রায় দুই দশক নিজেকে দূরে রাখবার পর যখন তিনি ১৯৭০-এ ‘দ্য আদার সাইড অফ দ্য উইন্ড’ নির্মাণে উদ্যোগী হলেন, তখন নিজের অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধিগুলিও সেই আখ্যানের অংশ হয়ে উঠল। একই সঙ্গে, তৎকালীন হলিউডের সিনেমা ব্যবস্থার পরিবর্তন ও বিবর্তনকে ঘিরে তাঁর ভাবনাগুলিও ‘দ্য আদার সাইড অফ দ্য উইন্ড’-এ প্রতিফলিত। সাদা-কালো ১৬ মিলিমিটার ফিল্ম আর রঙিন ৩৫ মিলিমিটার ওয়াইডস্ক্রিনের মিশ্রিত প্রয়োগে ‘দ্য আদার সাইড অফ দ্য উইন্ড’ দোষেগুণে ভরা এক চিত্রপরিচালকের ক্ষমতা এবং ব্যর্থতার অনুভূতিগুলিকে ক্যালাইডোস্কোপের মতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। ৭০তম জন্মদিনের পার্টিতে সুদূর তেপান্তরে অবস্থিত র‍্যাঞ্চটিতে নিমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য জেক হ্যানফোর্ড (জন হিউস্টন) তার অসমাপ্ত ছবিটি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছে। যা মূলত অল্পবয়সী এক সুদর্শন বাইকচালক (রবার্ট র‍্যানডম)-এর সঙ্গে এক অপরিচিত নারী (ওজা কোডার) শারীরিক সংলগ্নতার কিছু সংলাপহীন দৃশ্য। ভানসর্বস্ব এই দুর্বল চিত্রপ্রয়োগ নিয়ে সরাসরি সমালোচনা করবার ক্ষমতা উপস্থিত অতিথিদের কারও নেই। শুধুমাত্র স্টুডিওর তরুণ কর্মাধ্যক্ষ (জিওফ্রে ল্যান্ড) দৃশ্যগুলি দেখবার পর ছবিটি সম্পূর্ণ করবার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ যোগানের প্রস্তাব নাকচ করে। কারণ, হ্যানফোর্ডের দীর্ঘসময়ের সহকারী (নর্মান ফস্টার) দৃশ্যগুলির যৌক্তিকতা বোঝাতে অক্ষম। পার্টিতে আমরা ওটারলেক (পিটার বোগোডানোভিচ)-কে দেখি। হ্যানফোর্ডের উত্তরসূরির দাবি নিয়ে এই তরুণ চিত্রপরিচালক হ্যানফোর্ডের জীবনীচিত্র বানাচ্ছে। তাই র‍্যাঞ্চের সর্বত্র ক্যামেরা লাগিয়ে অনবরত চিত্রগ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলিকেও লেন্সবন্দি করবার এই প্রবণতাটি যে পরবর্তীকালে মিডিয়া এবং সেলফোনের দৌরাত্মে বিরক্তিকর অসুখের মতো তথাকথিত সেলিব্রিটিদের জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়াবে, সেই বিষয়ে অরসন ওয়েলস যেন প্রায় নিশ্চিত ছিলেন। পার্টিতে উপস্থিত আছে হ্যানফোর্ডের একদা বান্ধবী (লিলি পামার) এবং এক ফিল্ম সমালোচক (সুসান স্ট্র্যাসবার্গ)। যারা ব্যক্তি ও শিল্পী হ্যানফোর্ডকে ঘৃণা করলেও তা প্রকাশ্যে আনতে দ্বিধান্বিত। শুধু একজন চিত্রবোদ্ধা (জোসেফ ম্যাকব্রাইড)-র সঙ্গে কথোপকথনের সূত্রে তাদের বিষে দর্শকরা দংশিত হয়। বাকি সময়টায় পার্টিতে নিমন্ত্রিত অতিথিরা পরনিন্দা পরচর্চায় এবং তির্যক মন্তব্যে আমাদের বুঝিয়ে দেয় হ্যানফোর্ডের যুগটির অবসান ঘটেছে।

যে রুক্ষ ভাষা এবং ঔদ্ধত্য নিয়ে বেপরোয়া হ্যানফোর্ড পার্টির এই শত্রুসঙ্কুল পরিবেশে নিজেকে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখে তা কি অরসন ওয়েলসেরই দমনকারী সত্তা? হ্যানফোর্ডের অসমাপ্ত ছবির নায়িকা যে অমোঘ শিকারীর মতো তরুণ নায়কটিকে গ্রাস করতে চায়, যার থেকে পালিয়ে বাঁচবার মুহূর্তটিকেও হ্যানফোর্ড যে নির্বিকারত্ব নিয়ে চিত্রায়িত করে— তা কি অরসন ওয়েলসেরই নেতিবাচক জীবন দর্শন? ‘দ্য আদার সাইড অফ দ্য উইন্ড’ এমন কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়।

‘ফিল্ম উইদিন ফিল্ম’-এর মাধ্যমে ব্যক্তিচরিত্রের বিবরণ দেওয়ার প্রক্রিয়াটি শুধু জটিলই নয়। এর মাধ্যমে ব্যক্তিচরিত্র এবং সিনেমায় দেখানো চরিত্রগুলিকে ফারাক করতে না পেরে দর্শকদের মনে ধোঁয়াশা তৈরি হওয়াটাও সম্ভব। যেমন, জেক হ্যানফোর্ড কেন এমন প্রতীকী, নাট্যরসবিহীন যৌনপীড়িত ছবিটি বানাচ্ছেন, তা শেষ অবধি উহ্য রয়ে যায়। যদি তা অরসন ওয়েলসের সচেতন উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে প্রশ্ন জাগে। ক্ষমতার দর্প মানুষকে যদি নীতিহীন বানায়, তার স্বেচ্ছাচারিতা যদি অন্যের কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে, তার পরিণামে মানুষটির যে যন্ত্রণাদগ্ধ একাকিত্ববোধ— এই বিন্যাসের মধ্যে ট্র্যাজেডির সন্ধানই কি অরসন ওয়েলস জীবনভর করে গেলেন? হয়তো তাই। সামাজিক প্রতিষ্ঠা এবং আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য থেকে যে নিরাপত্তাবোধের জন্ম, তা দুঃখবিলাসের আকাঙ্খাকে তীব্রতর করে। পাশ্চাত্যের এই জীবনবোধের বিপ্রতীপে গুরু দত্তের ‘কাগজ কে ফুল’ (১৯৬৯) দেখলে, দেখা যাবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র বিকাশে সামাজিক ও পারিবারিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সংবেদনশীল চিত্রপরিচালকটি ক্রমশ সর্বস্বান্ত হচ্ছে। তার বিবরণ মর্মস্পর্শী হয়ে আমাদের কাছে পৌঁছায়। ভারতীয় দর্শক হিসেবে আমরা সেই আখ্যানকে ট্র্যাজেডি বলতে দ্বিধান্বিত নই।

মোহ, পরিচিতি, স্মৃতি এবং বিশ্বাসঘাতকতা— অরসন ওয়েলসের ছবিগুলিতে এই থিমগুলি বারবার ফিরে এসেছে। ১৯৩৮-এ স্থাপিত হাউস কমিটি অন আন-আমেরিকান অ্যাক্টিভিটি (HUAC)-র কম্যুনিস্ট বিরোধী কার্যকলাপের ভয়ার্ত প্রভাবের ছায়াও একই সঙ্গে ‘দ্য আদার সাইড অফ দ্য উইন্ড’-এ উপস্থিত। যা চার্লি চ্যাপলিনের মতো শিল্পীকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কমিটির কাঠগড়ায় টেনে আনে। ম্যাককার্থির এই কম্যুনিস্ট বিরোধী জমানাতেই তরুণ অরসন ওয়েলস এক উদ্ধত শিল্পীর চোখ দিয়ে ‘সিটিজেন কেন’-এ রোসবাড রহস্য উন্মোচন করছেন। এবং ১৯৭৫ অবধি কার্যকরী (HUAC)-র নিরীক্ষণেই প্রৌঢ় মানুষটি ‘দ্য আদার সাইড অফ দ্য উইন্ড’ নির্মাণে রত ছিলেন। সেই দিক দেখলে জেক হ্যানফোর্ডের চরিত্রটির মধ্যে অরসন ওয়েলস কিছুটা নিজত্ব নিশ্চয়ই আরোপ করেছেন।

ছবিটিতে প্রসিদ্ধ হলিউড চিত্রপরিচালক জন হিউস্টন অরসন অয়েলসের ভূমিকা পালন করছেন কিনা, তা স্পষ্ট বলা যায় না বটে। তবে, শেষ অবধি আত্মজৈবনিক না হলেও ‘দ্য আদার সাইড অফ দ্য উইন্ড’-এর চরিত্র জেক হ্যানফোর্ডের মতোই অরসন ওয়েলসকে এই ছবিটির কারণে নানা অশান্তি এবং অনিশ্চয়তা ভোগ করতে হয়। ৫৫ বছর বয়সে ইউরোপ থেকে হলিউডে ফিরে ‘দ্য আদার সাইড অফ দ্য উইন্ড’ নির্মাণে হাত দেন অরসন ওয়েলস। ছবিটির কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই ১৯৮৫ সালের ১০ই অক্টোবর তিনি মারা গেলেন।

তাঁর মৃত্যুর ৪৩ বছর পর যে ‘দ্য আদার সাইড অফ দ্য উইন্ড’ মুক্তির মূল কৃতিত্ব প্রযোজকদ্বয় ফ্র্যাঙ্ক মার্শাল এবং ফিলিপ য়ান রিয়ামসযারের। উৎসাহী দর্শকরা ‘সিটিজেন কেন’ এবং অরসন অয়েলসের সঙ্গে চিত্রগ্রাহক গ্রেগ টোল্যান্ড-এর নাম একযোগে উচ্চারণ করে থাকেন। কারণ, অরসন ওয়েলসের প্রথম ছবির অপূর্ব দৃশ্যসৌষ্ঠবের অভিঘাত আমরা কোনদিনও ভুলব না। সেই অভিঘাতের তুলনায় ‘দ্য আদার সাইড অফ দ্য উইন্ড’-এর চিত্রগ্রাহক গ্যারি ক্যাভার একেবারেই ম্রিয়মাণ। চিত্রপরিচালকের দৃশ্যকল্পনা এবং তার বিন্যাসকে যথাযথ অনুসরণ করে তিনি ওয়াইডস্ক্রিনের দৃশ্যগুলি চিত্রায়িত করেছেন। ১৬ মিমি. ৩৫ মিমি এবং ওয়াইডস্ক্রিনের এই ‘মকুমেন্টারি’ ঘরানার ছবির জটিল বিন্যাসটি জনসমক্ষে এসেছে বিশ্বস্ত বব মুরাউসস্কি-র সাবলীল চিত্রসম্পাদনা এবং মাইকেল ল্যগ্রাঁড-এর শব্দানুষঙ্গ যোজনার কারণে। এই অসম্ভব কঠিন প্রকল্পটি রুপায়নে নেটফ্লিক্স পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এই তথ্যটি নিশ্চিতভাবে সিনেমার ভবিষ্যতের প্রতি আস্থা বাড়ায়।