কণিষ্ক ভট্টাচার্য
ভারতের রাজ্য ভাগ বিষয়ে অনেকেই অনেক কিছু বলছেন। প্রত্যেকের নিজস্ব ভাবনা-চিন্তা আছে। যুক্তি-অপযুক্তি-কুযুক্তি আছে। রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং স্বার্থ আছে। আর সে সব যুক্তি-বিশ্বাস কিংবা কুযুক্তি-স্বার্থ মিলিয়ে গোটা বিষয়টা একটা গোলমেলে সান্ধ্য আলোআঁধারিতে ঢুকে যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে বিস্তৃতভাবে লেখার ইচ্ছা আছে, প্রাথমিক ভাবে এই কথা গুলো না বললেই নয়।
ভারতের ইতিহাস নিবিষ্টভাবে পাঠ করলে আমরা আজকের তথাকথিত “ভারত” বা “ভারতবর্ষ”কে কোথাও খুঁজে পাই না। কারণ সুপ্রাচীন ইতিহাস থেকে কোনও দিনই জাতিরাষ্ট্র ভারত বলে কিছু ছিল না। প্রাচীন গ্রিস থেকে যে রাষ্ট্র ধারণা গড়ে উঠেছে, ভারত সেই রাষ্ট্র ধারণার আস্বাদ পেয়েছে তাঁর ইতিহাসের সুপ্রাচীনতার দিক থেকে দেখলে অতি সম্প্রতি। সেই ইউরো-কেন্দ্রিক রাষ্ট্র ধারণা ভারতে এসেছে ইউরোপীয় শিক্ষার সঙ্গে। যার ইতিহাস মাত্র দুই শতকের। ভূগোলের সীমায় সাম্প্রতিক যে ভারত, যা মাত্র সত্তর বছর আগে ভাগ হয়েছে স্মরণীয় যে সেই ভারতে সভ্যতার ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের।
ইতিহাসের প্রেক্ষিতে ভারত কোনও জাতিরাষ্ট্র ছিল না কোনও দিন, বস্তুত হিমালয়-হিন্দুকুশ-আরবসাগর-ভারত মহাসাগর-বঙ্গোপসাগর-বার্মার পাহাড় ঘেরা এই ভূগোল-সীমা ছিল কতগুলি ছোটো ছোটো স্বাধীন রাষ্ট্র এবং সহজসাধ্য কৃষির কারণে প্রধানত আর্থিক দিক থেকে এবং সামাজিক বয়নে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে এই অঞ্চলগুলির ঘরানা যেমনভাবে গড়ে উঠেছিল বাহিরানা তেমন গড়ে ওঠেনি। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার থেকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উত্তরণের সময় বা প্রয়োজন তখনও আসেনি বলেই এই বাহিরানার বাস্তবিক প্রয়োজন দেখা দেয়নি। এই ছোটো ছোটো স্বাধীন রাষ্ট্র ভাষা সংস্কৃতির দিক থেকে ছিল বিভিন্ন। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার বিকাশ-পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার আঞ্চলিক সীমাও বদলাতে থাকে। দ্রাবিড় ভাষা অঞ্চলের বয়ান আবার আলাদা।
এরই মধ্যে কখনও কোনও ছোটো স্বাধীন রাষ্ট্র সমর কুশলী উচ্চাকাঙ্ক্ষী শাসক পেয়ে রাজ্য বিস্তার করতে চায়। সফল হলে তা কয়েক প্রজন্ম চলে। তারপর ধীরে ধীরে অযোগ্য শাসকের হাতে পড়ে তার প্রাধান্য নষ্ট হয়। ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক সহজতায় সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় সঞ্চিত সম্পদ এবং বহির্বিশ্বে সেই সম্পদ সম্পর্কে অতি লৌকিক ধারণার কারণে বৈদেশিক বহু সমর শক্তি বহুবার আক্রমণ করে এবং লুঠপাট করে চলে যায়। আবার বৈদেশিক বহু সমর শক্তি এই ছোটো ছোটো স্বাধীন রাষ্ট্র জয় করে নেয় এবং থেকে যায় এই বিজিত অঞ্চলে। তার সঙ্গে জড়িয়ে যায় ধর্ম এবং ধর্মভিত্তিক ও জাতিগত সংস্কৃতি। প্রসঙ্গত ভারতে কোনও নির্দিষ্ট ধর্ম বা সংস্কৃতি ছিল না, তার বহুত্ব বিচিত্র রকমের। আর্য জীবনচর্যার সঙ্গে যে হিন্দুত্বের যোগ তা কোনও আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম নয় তা মূলত ব্রাহ্মণ্যবাদ। এর কোনও অনুপূর্ব সার্বভারতিক রূপও ছিল না। অনেক পরবর্তী কালে সেই স্থিরকেন্দ্র পরিধিতে প্রসরমান ব্রাহ্মণ্যবাদের যে রূপ আমরা দেখি তা তার সামাজিক ধাঁচাকে কায়েম রাখার স্বার্থেই। আমাদের মনে রাখতে হবে, বিজিত অঞ্চলে থেকে যাওয়া বৈদেশিক সমরশক্তি এটিকেই তাদের দেশ করে নেয়, এবং তাদের মধ্যে সর্বাধিক রাজ্যবিস্তারকারী মুঘলরাও বর্তমান রাজনৈতিক ভারতের মানচিত্র প্রস্তুত করতে পারেনি।
বরং অপরাপর ইউরোপীয় শক্তির সঙ্গে সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ব্রিটিশরা জিতে যাওয়ায় তাদের শিল্পবিপ্লবের অর্থ জোগানের স্বার্থে তাদের প্রয়োজন ছিল এক কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে এই ভূগোল-সীমার সমস্ত কৃষি জমি, কুটির শিল্প ও বাণিজ্যকে আনার। তাইই রাজ্য বিস্তার, তাইই রেলপথ, তাইই তাদের প্রয়োজন মতো তথাকথিত “রাজ্য” তৈরি। এবং সেই সঙ্গে এল ইউরো-কেন্দ্রিক শিক্ষা-ধারণা, জাতিরাষ্ট্রের ধারণা। সাম্রাজ্যে এই শিল্পবিল্পবের কাঁচামাল যোগানদাতা কলোনির বহু দাবিই উপেক্ষিত হল স্বাভাবিকভাবেই।
ভারত তার বহু বিতর্কিত স্বাধীনতা পাওয়ার পর তাকে এক কেন্দ্রীয় শাসনের মধ্যে আনার ও রাখার কৃতিত্ব ইতিবাচক বা নেতিবাচক যে ভাবেই দেখা হোক না কেন নেহরু সরকারের। সেই দৃষ্টির মধ্যে একটা বাস্তববাদী ধারণা ছিল বলে অনেকের বিশ্বাস। কারণ হিসাবে তারা বলেন, নয়তো সদ্যোজাত রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখা যেত না। এর মধ্যেও বহু দাবি উপেক্ষিত হল সন্দেহ নেই। বোনা রইল বহু চতুর বিশ্বাসভঙ্গের ছক। কারণ শাসক সব সময়েই শাসক, যার প্রাথমিক লক্ষ্য সেই শাসন ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা। খণ্ডিত বাংলা থেকে নিজাম এবং গোয়া হয়ে কাশ্মীর পর্যন্ত তাকালে সেই ইতিহাস বহু বিস্তৃত। কিন্তু পরবর্তী কালে এই আইনি রাষ্ট্রে বহু ভুল-ভ্রান্তিসহ একটা ন্যূনতম গণতন্ত্র যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সে কথা অস্বীকার করা যায় না। ভোটে জেতা হারা যে রাজনৈতিক দলগুলোর মোক্ষ হয়ে উঠেছে তার থেকে এই বাক্য প্রমাণিত। কখনওই ভারত প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির মতো সেনাদের হাতে চলে যায়নি এবং নেহরু-কন্যা রাষ্ট্রপতি শাসনের ফল বুঝেছেন। বারবার যে ভোটের আগে প্যানডোরার বাক্স খোলা হয় নতুন রাজ্যের কথা বলে তাও একটা পর্যায় অবধি গণতন্ত্র বিকশিত হয়েছে বলেই।
আত্মপরিচয়ের রাজনীতি যে উত্তর আধুনিকতার প্রসাদপুষ্ট তা যে কোনও কেন্দ্রিকতার বিরোধিতা করে তার তত্ত্বগত দিক থেকে। কোনও মহাবাচনের অস্তিত্ব তা অস্বীকার করে। অস্বীকার করে শ্রেণি ও স্বাভাবিকভাবেই শ্রেণিসংগ্রামকে। এই বিষয়টাকে ঘুলিয়ে দেয় যে ভারতে আত্মপরিচয়ের রাজনীতিরও অন্দরে আছে শ্রেণিশোষণ।
স্পষ্টভাবে এই কথা বলা দরকার যে ছোটো রাজ্য বা ছোটো জেলা এক নির্দিষ্ট রাজনীতির বয়ান। বস্তুত তা এক বাচনের কথা বলে তার বিপরীত বাচনের স্বার্থসিদ্ধ করে। বিভাজিত ছোটো রাজ্য, ছোটো জেলা প্রশাসন ও প্রশাসনিক উন্নয়ন নামক ধারণাকে তখনই নাগরিকের আরও কাছে পৌঁছে দিতে পারে যখন সেই ছোটো রাজ্য বা জেলা আর্থিক দিক থেকে শক্তপোক্ত হয়, নয়তো তাকে সামগ্রিকভাবে দেশ বা রাজ্যের কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হয়। এই নির্ভরশীলতা শাসকের সর্বাঙ্গীণ নিয়ন্ত্রণের সহায়ক হয় সবসময়। ছোটো রাজ্য গড়ে যে তার সমাধান হবে না তার প্রমাণ ঝাড়খণ্ড। ভারতের সর্বাধিক খনিজ সমৃদ্ধ রাজ্য হয়েও তা দারিদ্রের অতলে তলিয়ে থেকেছে সত্তর বছর ধরে। টাটা-শোভিত বিহারের সঙ্গে থেকেও এবং না থেকেও। উত্তরপূর্বের এঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্রের হোস্টেলের কাবার্ডের পাল্লার ভিতরে হিটলারের ছবি দেখেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে, সে বলত “ইয়োর ইন্ডিয়া, ইয়োর ডেলহি…।” আমরা তাকে ঘরানায় আনতে না পেরে ঘরানায় বাঁধতে চেয়েছি জোর করে, শক্তি দিয়ে। আফস্পা দিয়ে।
গত শতকের আটের দশকে দার্জিলিং যখন আলাদা রাষ্ট্রের দাবি হিংস্র হয়ে ওঠে তখন প্রায় একহাজার বামপন্থীর প্রাণ যায় যেমন সত্য, সমতলে নেমে এসে প্রাণ বাঁচাতে হয় বহু বামপন্থীকে যেমন সত্য, তেমনি সত্য যখন এই আন্দোলন হিংস্র হয়ে ওঠে ততদিনে দার্জিলিঙে দশ বছর বামশাসন চলেছে কিন্তু ন্যূনতম জীবনযাপনের বহু সাধন কিন্তু উপলব্ধ হয়নি। পশ্চিমবঙ্গে সরকারে আসার বহু আগে থেকে ওই অঞ্চলের জনপ্রতিনিধি ছিলেন বামপন্থীরা।
বর্তমান শাসক দল কোনও মৌলিক নীতিহীন, পূর্বতন বাম শাসকের হাত থেকে ক্ষমতা কাড়তে তারা, যত রকম জোট সম্ভব তা করেছে। অতি বাম থেকে অতি দক্ষিণ অবধি পূর্ণ রামধনু। বামেদের উপর বিরক্ত মানুষ চোখ বুজে সমর্থন জানিয়েছে অকুণ্ঠিতভাবে। তারাই “গোর্খাল্যান্ড” শব্দবন্ধকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর আগে লোকসভা ভোটের সময় কেন্দ্রীয় শাসক দলের তেলেঙ্গানা ভোট রাজনীতির সুযোগ নিতে চাইছেন গোর্খা আন্দোলনকারীরা। রাজনৈতিক স্বার্থে নিজেদের সংগঠন দিয়ে কেন্দ্রীয় শাসক দলের প্রতিনিধিকে সংসদে পাঠিয়েছে। তাদের মূল দাবি কিন্তু পূরণ করেনি কোনও রাজনৈতিক দল। মনে রাখতে হবে এই মুহূর্তে ভারতে বাইশটি নতুন রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন উৎসাহ পেয়েছে।
আলাদা রাজ্যের যে আন্দোলন তা মূলত অনুন্নয়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন, এই অনুন্নয়নের কারণেই মূল হতাশা। অবশ্যই যুক্ত আছে ইতিহাস, জোর করে যুক্ত বা বিযুক্ত করার ইতিহাস, সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ববাদের ইতিহাস। কিন্তু সেই ছেষট্টি বা তৎপূর্ববর্তী দুশো বছরের ইতিহাসকে (নাকি ভুলকে), কি আজ সংশোধন করা সম্ভব! ইতিহাসকে আদৌ সংশোধন করা যায়? তাহলে নতুন ভবিষ্যৎ রচনা করতে হয়। বিপক্ষ বক্তব্যের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা নিয়েই বলি, আরেকটা ভুল করে? তার পরে যে বহু ইতিহাস বয়ে গেছে তিস্তা-রঙ্গিত-বিতস্তা দিয়ে। যাপনের প্রাথমিক চাহিদা পূরণ হওয়ার পর যদি এই আন্দোলন হত তখন রাষ্ট্রকে তাত্ত্বিকভাবে ভাবতে হত। এখন রাষ্ট্র (এখানে রাজ্য সরকার ও প্রধান শাসক দল) বাঙালি আবেগকে উশকে দিতে চাইছেন, বাঙালি নেপালি দ্বন্দ্ব হিসাবে দেখাতে চাইছে আর সেনা পাঠাচ্ছে। প্রাথমিক ভাবে “গোর্খাল্যান্ড” শব্দবন্ধকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল যে ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে সেই চুক্তিতে কিন্তু আন্দোলনকারীদের সর্বোচ্চ নেতা স্বাক্ষর করেননি। নিতান্ত রাজনীতির জন্য সাময়িক ধামাচাপা দিতে সেই চুক্তি সই করেছিল কেন রাজ্য, সেই প্রশ্ন উঠবে আজ। আবার লিখিত “গোর্খাল্যান্ড” স্বীকারের পরে দার্জিলিঙের বাকি আঞ্চলিক মানুষদের নামে নানা নাম কা ওয়াস্তে উন্নয়ন পর্ষদ গঠন করেই বা কী হল? উত্তর জানার আগ্রহ তো থাকবেই। মনে রাখতে হবে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহার এই শাসক দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল। আজকের জিও পলিটিক্যাল বাস্তবতার নিরিখে দার্জিলিঙের ভারতীয় সংবিধানের নিরিখে একটি আপাত সমাধান ছিল সিক্সথ শিডিউল। আজ যে উত্তেজিত দার্জিলিংকে দেখা যাচ্ছে সত্যিই কি তার পিছনে একদিকে গজামুম এবং অন্যদিকে শাসক দলের আসন্ন নির্বাচনে গদি দখলের রাজনীতির জাঁতায় পিষ্ট হচ্ছেন না সাধারণ মানুষ? বিভাজনের বদলে ঐক্যই কি প্রার্থিত ছিল না?
উত্তর কিন্তু আমাদেরই দিতে হবে ভাবীকালকে।