সোনালি মুখোপাধ্যায়
ছোটবেলায় দুর্গাপুরে গ্যামন ব্রিজের কাছে কুমোরপাড়া দিয়ে যাওয়ার সময় খুব ইচ্ছে করত একবার উঁকি মেরে দেখি কুমোররা কী করছেন। পাড়ার জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রতিমা তৈরি হত ওখানেই। ঠাকুর মণ্ডপে রওনা করিয়ে দেওয়ার আগে পরম মমতায় প্রতিমার চোখে তুলি বুলিয়ে দিতেন শিল্পী। তারপর পরিবারের সকলে এসে দাঁড়াতেন মাকে বিদায় দিতে। আমরা যেমন দশমীতে বলি, “আবার এসো মা।” শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে পুজোর আগেই তা আওড়াতেন কুমোরপাড়ার মহিলারা। বাবার সাথে ঠাকুর আনতে গিয়ে সেই বিদায় দৃশ্য দেখে আমারই চোখ প্রায় জলে ভরে যেত। বুঝতে পেরে আমার ইঞ্জিনিয়ার বাবা হাতটা চেপে ধরে বলতেন কোনও কিছু নিজে হাতে তৈরি করার মজাই আলাদা। কুমোরপাড়ার বড় থেকে ছোট সকলেরই কোনও না কোনও ভূমিকা থাকত মূর্তি তৈরির পেছনে।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে এই নিজে হাতে কোনও কিছু তৈরির আনন্দটাই যেন হারিয়ে গেছে ব্রিটেনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে। কল-কারখানা বন্ধ। ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট বা আমরা বাংলায় যাকে বলি শিল্প তালুক, সেগুলো বছরের পর বছর ধুঁকতে ধুঁকতে এখন প্রায় মাটিতে মিশে গেছে। বড় ছোট প্রায় সব কারখানার গা বেয়ে বৃষ্টির জলের মোটা দাগ, দেওয়ালের খাঁজে শ্যাওলা জমে প্রায় কালো হয়ে গেছে। ঘরের বন্ধ শাটারে হেলান দিয়ে নেশাখোর নেশা করে। ভবঘুরে কার্ডবোর্ডের ওপর স্লিপিং ব্যাগ পেতে ঘুমোয়।
আমি বিয়ে হয়ে লন্ডনে পাড়ি দিয়েছি ১৮ বছর হয়ে গেল। শহর লন্ডনের আভিজাত্যপূর্ণ গাম্ভীর্য যেমন আমাকে মুগ্ধ করেছে, ঠিক তেমনি বিষণ্ণ হয়েছি ব্রিটিশ অর্থনীতির এই অন্ধকারময় এই দিকটি দেখে। যে দেশ কৃষি বিপ্লব, শিল্প বিপ্লবের পথিকৃৎ সেই দেশেই এখন আর শিল্প নেই। মোটরওয়ে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যেতে যেতে দেখি দুপাশে বিস্তীর্ণ সবুজের হাতছানি। কিন্তু সেখানে তেমন কিছু চাষ হয় না। দৈনন্দিন খাবারের বেশিরভাগটাই আসে বাইরে থেকে। শিল্প বলতে অত্যন্ত দক্ষ কাজে লাগে এমন সব প্রিশিসন গুডসই বেশি তৈরি হয় ব্রিটেনে। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে এদেশে আসা আমরা শিল্প বলতে কল-কারখানা, লোহা-লক্কর বলতে যা বুঝি, গত প্রায় দু’দশকে তার একটাও চোখে পড়েনি।
কয়েক মাস আগে ম্যাঞ্চেস্টারে গিয়ে দেখলাম সাবেকি কল-কারখানার বাইরেটা ধরে রেখে ভেতরে শপিং মলের ছড়াছড়ি। পশ্চিম ইংল্যান্ডের ডোভার থেকে শুরু করে দক্ষিণের কেন্ট সর্বত্রই শপিং মল, রেস্তোরা, সিনেমা হল, ক্যাসিনো শোভিত এলাকার বাইরে জীবনযাত্রার কেমন ক্ষয়িষ্ণু চেহারা। যাদের কাছে উচ্চকিত উল্লাসের জায়গায় গিয়ে আমোদ করার রেস্ত আছে তারা সেখানে যান সানন্দে। বাকিরা পিছিয়ে পড়া জীবন আর থমকে থাকা একাকিত্ব থেকে সাময়িক মুক্তিলাভের আশায়।
সাংবাদিক ফরিদ জাকারিয়ার শিক্ষক, ঐতিহাসিক পল কেনেডি এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত। সামরিক শক্তিকে অর্থনৈতিক ক্ষমতা কীভাবে প্রভাবিত করে তা নিয়ে গবেষণার জন্যই উনি বিখ্যাত। বছর কয়েক আগে বক্তৃতা দিতে এসেছিলেন ইংল্যান্ডে। তখন গিয়েছিলেন ওঁর জন্মস্থান ওয়ালসেন্ডে। স্কটল্যান্ড পেরিয়ে ইংল্যান্ডে ঢোকার পরে দেশের একটু উত্তর-পশ্চিম দিক ঘেঁষে যে অঞ্চল তা পরিচিত নিউ ক্যাসেল আপন-টাইন নামে। এই টাইনসাইডেই অবস্থিত ওয়ালসেন্ড। টাইন নদী যেখানে নর্থ সিতে গিয়ে মিশেছে ওয়ালসেন্ড তার থেকে বেশি দূরে নয়।
অধ্যাপক কেনেডির বাবা আর কাকা বয়লার বানাতেন। তিনি তার বক্তৃতায় বলছিলেন, কীভাবে স্থানীয় জনগণ ওখানকার সোয়ান হান্টার জাহাজ কারখানার সাথে পরতে পরতে জড়িয়ে থাকতেন। যখন কোনও নতুন জাহাজ চালু হত তখন ছোট বড় সকলে সেখানে গিয়ে জড়ো হতেন। স্কুল থেকে বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়া হত আর তারা সেখানে গিয়ে ঐ জাহাজের মধ্যেই নিজেদের বাবা-কাকাদের খুঁজত। স্থানীয় শিল্পের সাথে এই আত্মিক যোগাযোগই কারখানার উৎপাদনশীলতাকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করত।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকেই এই ব্যাপারটা এখানে উঠে গেছে। শিল্প বন্ধ হয়ে বেড়ে উঠেছে পরিষেবা। ম্যানুফ্যাকচারিং-এর জায়গা নিয়ে ফাইনান্স। কারখানা বন্ধ হয়ে যারা কর্মচ্যুত হয়েছেন তারা কাজের সাথে সাথে নিজেদের আত্মসম্মানও হারিয়েছেন। আর তাদের জায়গা নিয়েছে এক নতুন শ্রেণি যাদের সাথে দৈনন্দিন উৎপাদনশীলতার যোগাযোগ খুবই কম। এই প্রযুক্তি-নির্ভর শ্রেণিই ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যাদের সাথে স্থানীয় অর্থনীতি, সমাজ কোনও কিছুর সঙ্গেই কোনও আত্মিক যোগাযোগ নেই। প্রযুক্তি-নির্ভর বিশ্বায়ন এই প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করেছে। আর তাতে পিছিয়ে পড়েছেন সেইসব লোক যারা কল-কারখানায় কাজ করতেন। এরা কাজের পর কাজ বদলেছেন টিঁকে থাকতে কিন্তু নিজেদের হারানো আত্মমর্যাদা আর ফিরে পাননি।
ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটে এরাই ফোঁস করেছেন। রাষ্ট্রশক্তির ধারক এবং বাহক শ্রেণিকে এই বার্তা দিতে চেয়েছেন যে তাদের ক্রমাগত উপেক্ষা করে চললে তারাও প্রভাবশালীদের বাড়া ভাতে ছাই দিতে দ্বিধা করবেন না। উপক্ষিত এই শ্রেণি ছড়িয়ে আছে ইংল্যান্ডের প্রতিটি আনাচে কানাচে। লন্ডনের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত ড্যাগেনহ্যাম কাউন্সিল। একসময় স্থানীয় অর্থনীতি ভীষণভাবে স্থানীয় ফোর্ড কারখানার ওপর নির্ভরশীল ছিল। কালের নিয়মে তাদের সেই সুদিন গেছে। কাজ আর প্রতিপত্তি হারিয়ে তারা ব্রেক্সিটকে বেছে নিয়েছেন বিপক্ষকে আক্রমণ করার পথ হিসেবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার সুবাদে অন্যান্য যেসব দেশের কর্মীরা গাড়ি কারখানায় গিয়ে কাজ নিয়েছেন, স্থানীয়দের রাগ গিয়ে পড়েছে ঐ অভিবাসীদের ওপরে। একটু তলিয়ে ভাবলে দেখা যাবে এরা হয়ত বর্ণবাদী বা জাতি-বিদ্বেষী নন। নিজেদের অস্তিত্বের তাগিদেই এদের এত মরিয়া ভাব। কিন্তু রাজনীতিক আর প্রভাবশালীরা তা বুঝতে চাননি। তারা দুয়ে দুয়ে চার করার সহজ পথকেই বেছে নিয়েছেন। মানুষের ক্ষোভটাকে না বুঝে তারা এই প্রতিবাদকে নেতিবাচক হিসেবে অভিহিত করেছেন। প্রতিবাদীদের চিহ্নিত করেছেন প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে।
পশ্চিমের ডোভার কাউন্টির জেলেদের গ্রাম ব্রিক্সেম। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে ইংল্যান্ডের মধ্যে ব্রিক্সেমেই সবচেয়ে বেশি মাছ ধরা হত। সপ্তাহে গড়ে ১৫০ টন। প্রায় তিনশো মাছ ধরার নৌকা আর দেড় হাজারেরও বেশি জেলে।
“তারপরে রেললাইন বসল”, স্মৃতির সরণি বেয়ে বংশ পরম্পরায় জানা কথা বলে চলেন ফিলিপ হ্যানাফোর্ড। প্রৌঢ়ত্ব ছুঁয়েছেন কিন্তু স্মৃতিশক্তি এখনও প্রবল। “তখন শোল, প্লেইস, হেরিং, হুইটিং-ই আসত বেশি। আর তার মধ্যে ভালোগুলো পাঠানো হত লন্ডন, বাথ, ব্রিস্টল, এক্সেটার-এ। রেলের সুবাদে আট ঘণ্টায় সেরা মাছগুলো পৌছে যেত লন্ডনের বিলিংসগেট মাছ বাজারে।”
নানা চড়াই উতরাই-এর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে ব্রিক্সেমের জেলেদের। প্রযুক্তির নানান ওঠানামার সাথে নিজেদের মানিয়েও নিয়েছেন ওখানকার জেলেরা। ইংল্যান্ডের মধ্যে নিজেদের অবস্থান এবং গুরুত্ব বজায় রাখতে পারলেও ইউরোপের মধ্যে অন্যান্য দেশের প্রবল প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয় ব্রিক্সেম।
“এর প্রধান কারণ হল সবটাই ঠিক হত ব্রাসেলস থেকে। ওঁরাই ঠিক করে দিত সমুদ্রের মধ্যে কতটা জায়গাজুড়ে ব্রিটিশ জেলেরা মাছ ধরতে পারবেন,” বলে চলেন ফিলিপ হ্যানাফোর্ড। “আমরা আমাদের জলসীমা ফিরে পেতে চাই, যেখানে শুধুমাত্র আমাদেরই অধিকার থাকবে।”
মাছ ব্যবসা ছেড়ে ব্রিক্সেমের অনেকেই এখন ক্যাফে-দোকান খুলে ব্যবসা শুরু করেছেন। তৈরি হয়েছে মেরিনা। প্রমোদবিহারের জায়গার সামনেই নীরবে দাঁড়িয়ে সারি সারি মাছ ধরার ট্রলার।
এর প্রতিবাদ হিসেবেই ব্রিক্সেমবাসী ব্রেক্সিট গণভোটকে বেছে নিয়েছেন। কিন্তু সমাজের প্রভাবশালীরা তা বুঝেও না বোঝার ভান করছেন। ব্রেক্সিট চালু হলে কী হবে তা নিয়ে রাজনীতিকদের যত মাথাব্যথা বঞ্চিত জনগণের ক্ষোভ নিরসনে তার ছিঁটেফোঁটাও নেই। তাই যতই প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যা দেওয়া হোক না কেন সামগ্রিক ক্ষোভ আরও বাড়ছে। অনেকেই দাবি করছেন নতুন করে গণভোট নেওয়ার। উদ্দেশ্য যদি আগের ফলাফলকে উল্টে দেওয়া যায়। বিবিসি’র জনপ্রিয় কোয়েশ্চন টাইম অনুষ্ঠানে এই ব্যাপারটা উঠতেই উপস্থিত বিরাট সংখ্যক দর্শক প্রায় রে রে করে উঠলেন। অনেকে এমনও বললেন, প্রথমবারের রায়কে উপেক্ষা করে দ্বিতীয় গণভোট হলে আরও বেশি ব্যবধানে ব্রেক্সিটের পক্ষে রায় যাবে।
আমরা যারা সংবাদমাধ্যমের ভাষ্য দেখে বা রাজনীতিকদের কূটকচালি শুনে বা যারা সুবিধাভোগী তাদের যুক্তির বিন্যাস শুনে অবস্থাটা অনুধাবনের চেষ্টা করছি তারা বোধহয় একটা কথা ভুলে যাচ্ছি যে যারা ভালো আছেন তারা কোনওকালেই অবস্থা বদলের পক্ষপাতী নন। বদল তারাই চান যাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।