প্রিয়ক মিত্র
গত সংখ্যার পর
ওমান শুরু করল তার কাহিনী বলা। উগান্ডার জঙ্গলের ময়ালের পেট থেকে ওই আকাশি রঙের হীরে কীভাবে এসে পৌঁছল ডায়মন্ডের খাঁচায়।
গোল্ডস্মিথের চোখ লাল হয়ে উঠেছিল একইসঙ্গে উত্তেজনায় এবং রাগে।
এত বড় সাহস এই কালো মানুষের বাচ্চার! এরকম একটা অমূল্য সম্পদ সে নিজের জিম্মায় রেখে দিয়েছে? তার থেকে আড়াল করে? তাও আবার ডায়মন্ডের খাঁচায়!
গোল্ডস্মিথের ইচ্ছে হচ্ছিল এক্ষুনি চাবুকটা বার করে উচিত শিক্ষা দেয় ওমানকে। অকৃতজ্ঞ নিগার!
কিন্তু এবার বোমাটা ফাটাল ওমান, সে বলে বসল যে এই হীরে যদি গোল্ডস্মিথ ন্যায্য দামে কেনে, তাহলে সে বিক্রি করতে রাজি।
গোল্ডস্মিথের মাথায় রক্ত চড়ে গেল।
এত বড় সাহস ওমানের? সে ভেবেছিল এটা ওমানের স্বীকারোক্তি! কিন্তু তা তো আদৌ নয়। ওমান তার সঙ্গে ব্যবসা করতে চায়।
আর চাবুক নয়, এবার দেওয়ালে টাঙানো বন্দুকটা নামিয়ে সোজা ওমানকে ঝাঁঝরা করে দিতে প্রাণ চাইল গোল্ডস্মিথের।
কিন্তু থমকাল সে।
এত সহজে মাথা গরম করলে হবে না। গোল্ডস্মিথকে আগে স্বচক্ষে দেখতে হবে যে এমন কোন হীরের সন্ধান তাকে দিতে চলেছে ওমান।
“আমায় হীরেটা দেখাবি বেটা?” ওমানের কাঁধে হাত রেখে নরম স্বরে জুলু ভাষায় বলল গোল্ডস্মিথ।
ওমান সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।
গোল্ডস্মিথ হেঁটে চলেছে সুড়ঙ্গপথ ধরে। ওমান তাকে নিয়ে চলেছে। তার পোষ্য বনবেড়ালকে ওমান বশ করেছে, তার থেকে লুকিয়ে রেখেছে হীরেটার খবর। এর শাস্তি ওমানকে পেতেই হবে।
ডায়মন্ডের খাঁচার সামনে এসে দাঁড়াল গোল্ডস্মিথ।
শুয়েছিল ডায়মন্ড। ওমান এবং গোল্ডস্মিথ দুজনকেই সামনাসামনি দেখে ডায়মন্ড উঠে দাঁড়াল। পায়চারি করতে লাগল খাঁচার গরাদের গা ঘেঁষে। আদুরে ফোঁসফোঁস এবং খাঁচার গরাদে মাথা ঘষা। গোল্ডস্মিথ তাকিয়ে থাকল ডায়মন্ডের দিকে। ডায়মন্ড যেন বেশি আগ্রহী ওমানকে নিয়ে।
গোল্ডস্মিথের ভেতরে ধিকিধিকি আগুন জ্বলতে শুরু করল।
হাতল ঘুরিয়ে খাঁচার দরজা খুলল ওমান।
ডায়মন্ড এসে একবার তার লম্বা কান ঘষল ওমানের পায়ে। ডায়মন্ডকে খানিক আদর করে খাঁচার কোণে এগিয়ে গেল ওমান। ডায়মন্ড গোল্ডস্মিথের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ওমানের পিছু পিছু হাঁটল।
গোল্ডস্মিথের আর ডায়মন্ডের দিকে নজর নেই। তার চোখ পড়ল ওমানের হাতে।
খাঁচার কোণ থেকে ওমান হাতে তুলে নিয়েছে মুরগির ডিমের সাইজের একটা আকাশি রঙের হীরে।
গোল্ডস্মিথের মাথা ঘুরে গেল। এমন হীরে সে কখনও দেখেছে?
সাহেবরা বলত ‘হোয়াইট টাউন’। বড়লোক সাহেবদের জায়গা। জমিদার, বেনেবাবুরা থাকত ‘ব্ল্যাক টাউন’-এ। ‘ব্ল্যাক টাউন’ যে যাবতীয় পাপ এবং অনাচারের আখড়া সে কথা সবাই জানত। কিন্তু ‘হোয়াইট টাউন’-ও কম যেত না। পাপের প্রকাশ্য কারবার সেখানেও চলত। এসব কারবারের মধ্যে একটা ছিল অ্যারাকের কারবার। অ্যারাক নামক পানীয়টি দেদার বিক্রি হত, আর এই অ্যারাকই ছিল উনিশ শতকের কলকাতার হোয়াইট টাউনের অন্ধকার জগতের সূত্র। অ্যারাক বেচত মূলত ইটালিয়ানরা। চৈতন শীলের বাড়িতে সেদিন যারা ডাকাতি করতে গিয়েছিল তাদের অনেকেই যুক্ত ছিল অ্যারাক কেনাবেচার সঙ্গে।
লালবাজার সংলগ্ন রাস্তাটির নাম ছিল ফ্ল্যাগ স্ট্রিট। খাবার দোকান এবং সস্তা অ্যারাকের দোকানে ছয়লাপ ছিল এই রাস্তা। প্রতিটা দোকানের চূড়োয় লাগানো নিশান। সেই নিশানের জন্য রাস্তার নাম ফ্ল্যাগ স্ট্রিট। পরবর্তীতে গোয়েন্দারা এই রাস্তায় হানা দিয়ে অনেককে গ্রেফতার করেছিল। সেই রাস্তার এক অ্যারাকের ঠেকে বসেছিল স্যামুয়েল ও মার্কোস।
সেদিনকার ডাকাতদলের মধ্যে সবথেকে দুর্ধর্ষ এবং খতরনাক যে, তার নাম স্যামুয়েল। ফোর্ট উইলিয়ামে প্রশিক্ষণরত এই ব্রিটিশ সেনার চোখ দেখলেই হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠতে পারে যে কারুর। গালে একটা কাটা দাগ, যে দাগটা সে উপহার পেয়েছিল এক পোষ্য হাউন্ডের থেকে। নেহাৎ আদরের ছলেই আঁচড়টা কেটেছিল হাউন্ডটি। তাতে স্যামুয়েল খুশি হয়নি বিশেষ। হাউন্ডটির চোয়ালের খানিকটা মাংস ঝুলে থাকতে দেখা যায় পরেরদিন। কীভাবে এই ঘটনা ঘটল কেউ জানতে পারেনি।
মার্কোস পর্তুগিজ। শিশুদের দেখলেই তার ভেতরে জেগে ওঠে রাগ, লালসা। ছোটবেলা থেকে অনাথ মার্কোস বড় হয়েছে এক বৃদ্ধের আশ্রয়ে। সেই বৃদ্ধ তাকে কোনওরকম নির্যাতন করতে ছাড়েনি। যত বড় হয়েছে সে, তত হিংস্র হয়ে উঠেছে ভেতর থেকে। এবং নিজের ভয়াবহ ছোটবেলা তাকে শিশুদের প্রতি করে তুলেছে নির্দয়।
এই দুই মক্কেল অ্যারাকের নেশায় বুঁদ হয়ে বসে, এমন সময় কানাই গিয়ে হাজির হল অকুস্থলে।
স্যামুয়েল কানাইকে দেখেই খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠল।
“কী রে নিগার? আবার কার বাড়িতে ডাকাতি করতে যাবি?”
মার্কোসও হেসে উঠল।
গোল্ডস্মিথের বাড়িতে কানাই-এর অপমানের সাক্ষী এরা সকলে। কানাই মনে মনে হাসল; এই সাহেব ভূতগুলোকে সেইই তো পৌঁছে দিয়েছিল চৈতন শীলের বাড়িতে। সে না থাকলে এত সহজে ডাকাতির কাজ সম্পন্ন করতে পারত এরা?
কানাই হেঁ হেঁ করে হেসে খানিক প্রশ্রয় দিল ওদের মস্করায়। সে জানে কী বিস্ফোরক খবর সে দিতে চলেছে এদের।
স্যামুয়েলের পায়ের কাছে বসল কানাই। তারপর ফিসফিস করে কথা বলা শুরু করল। সব শুনতে শুনতে কান গরম হয়ে গেল স্যামুয়েলের। চোখে জ্বলে উঠল লোভ।
ওমান চুপচাপ বসেছিল ডায়মন্ডের সঙ্গে। এই একবগ্গা খাঁচাটার ভেতর টানা বসে থাকা ডায়মন্ডের পক্ষে কতটা কষ্টকর সে ভেবে চলে! অরণ্যের স্বাধীনতা ফেলে, শিকার ফেলে, লোহার গরাদে বন্দি থাকতে হয় তাকে, মানুষের বশ হয়ে। অথচ খাঁচার বাইরে থাকলে এই প্রাণীকে বশ করা কি মুখের কথা।
তার কোঁচড় থেকে হীরেটা বার করল ওমান, দেখতে থাকল হীরেটাকে।
ঢং ঢং করে ঘড়িতে রাত নটা বাজল। শহরের পাপাচারের রং একফোঁটাও ফিকে নয়। কোথাও কোনও বাবু হাতে ফুলের মালা জড়িয়েছেন, আতরগন্ধে ভুরভুর হয়ে নিজের রাঁঢ়-এর বাড়িতে ঢুকছেন। তখন এত লোকলজ্জার ভয় কোথায়? কোথাও কোনও বাবুর ছুরি চমকাচ্ছে। এক বেশ্যার ঘরে ডাকাতি হয়েছে আজ, সেই বেশ্যার বাঁধা বাবু কোত্থেকে চার পাঁচজন রোগাভোগা লোককে ধরে এনেছে। তার পাইকরা সেই নির্দোষ লোকগুলোর ওপর চাবুক চালাচ্ছে।
পলাশীর ষড়যন্ত্রকারীরা আর হেস্টিংসের দালালরা বড়লোক হয়ে চেপে বসেছে কলকাতা শহরের মাথার ওপর। কলকাতা ক্রমে রঙিন হচ্ছে। আঠারো শতকের কলকাতা উপনিবেশ হিসেবে তৈরি হচ্ছে ধীরে ধীরে।
গোল্ডস্মিথের বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্যামুয়েল, মার্কোস আর কানাই। ঝিঁঝি ডাকছে কাছেই।
এবার ওদের ঢুকতে হবে ওই সুড়ঙ্গপথে।
কিন্তু সদর দরজাটা পার হবে কী করে তারা? গোল্ডস্মিথের নিজস্ব দারোয়ানরা কেউ এদেশীয় নয়। তাদের সঙ্গে টক্কর দেওয়া এমনকি স্যামুয়েলের পক্ষেও মুশকিল। তাছাড়া গোল্ডস্মিথের নিজের কাছেও বন্দুক আছে। কাজেই বিষয়টা নিঃশব্দে সারলে ভালো হয়।
এ বিষয়ে কানাই-ই তাদের শেষ ভরসা।
হীরেটার দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে গেল ওমান। মনকেমন হলেই ওমান চলে আসে এই খাঁচায়। বহুদিন পরে সে ডায়মন্ডের মতন একজনকে পেয়েছে, যে তার সত্যিকারের সঙ্গী। তার স্বাধীন থাকার জেহাদ, তার মুক্তিকামিতা, এই দাসত্বের, এই শৃঙ্খলের জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে— এসব সে খুঁজে পায় ডায়মন্ডের মধ্যে।
ডায়মন্ড একমনে পায়চারি করে চলেছে খাঁচার ভেতর।
হীরেটা গোল্ডস্মিথ তার দেরাজে রাখতে চেয়েছিল। ওমান রাজি হয়নি। সে আপাতত হীরেটা তার নিজের জিম্মাতেই রেখেছে।
গোল্ডস্মিথেরও নিশ্চয় মনে হয়েছিল ডায়মন্ডের খাঁচাটাই এক্ষেত্রে সবথেকে নিরাপদ জায়গা হীরেটা রাখার।
ওমান প্রতিশ্রুতি চেয়েছে গোল্ডস্মিথের কাছে, এই হীরেটার পরিবর্তে সে তার স্বাধীনতা কিনবে। তবে হীরে বিক্রির ন্যায্য দামও সে চায়। এটা তার অর্জন, তার অধিকার।
এই কথা শুনে গোল্ডস্মিথ অদ্ভুতভাবে হেসেছে তার দিকে তাকিয়ে।
হাসিটা বিশেষ ভালো লাগেনি ওমানের।
হীরেটা আদৌ নিরাপদ তো?
কানাই নিশ্চিত ছিল যে সুড়ঙ্গে ঢোকার রাস্তা বাড়ির ভেতর হলেও বাইরে যাওয়ার রাস্তা থাকবে বাইরের দিকেই।
গোল্ডস্মিথের বাড়ির গলিটা স্যাঁতস্যাঁতে, অন্ধকার। একটা কুপি জ্বালিয়ে ওরা এগিয়ে চলেছে।
আচমকা থমকে দাঁড়াল কানাই।
গলির মাঝে দেওয়ালের গায়ে একটা অর্ধচন্দ্রাকৃতি গর্ত, যার মুখে একটা লাল গরাদ আটকানো।
এটাই নিশ্চিতভাবে গোল্ডস্মিথের সুড়ঙ্গে ঢোকার রাস্তা। গরাদটা টেনে খুললেই…
ওমান হঠাৎ একটা গরাদ খোলার শব্দ পেল।
গোল্ডস্মিথ আসছে এদিকে নিশ্চয়।
হীরেটা আবার লুকিয়ে ফেলল ওমান।
হ্যাঁ, গোল্ডস্মিথ আর তার সঙ্গে আরেকজন তাগড়াই লোক। এ লোকটাকেও কাফ্রি বলেই মনে হয়।
গোল্ডস্মিথ আর ওই লোকটা গটগট করে হেঁটে এসে দাঁড়াল খাঁচার সামনে।
“খাঁচা খোল!”
হুকুম করল গোল্ডস্মিথ।
ওমানের ভুরু একটু কুঁচকোল। এই গলায় কেন কথা বলছে গোল্ডস্মিথ ঠাহর করতে পারল না সে।
তবু সে খাঁচার গরাদ খুলল।
খোলার সঙ্গে সঙ্গেই তাগড়াই লোকটা ওমানের জামার কলার ধরে টেনে তুলে ধরল শূন্যে।
“হীরেটা কোথায় রেখেছিস?”
দাঁতে দাঁত ঘষে প্রশ্ন করল গোল্ডস্মিথ।
এই পরিস্থিতি আগে থেকেই আঁচ করা উচিত ছিল ওমানের।
সে পরিত্রাহি চিৎকার করতে লাগল গোল্ডস্মিথের কথার উত্তর না দিয়ে।
এই ঘটনা ঘটার সময় খাঁচা খোলা ছিল। আর খাঁচার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়েছিল ওই তাগড়াই লোকটা।
এই সুযোগ নিয়ে ডায়মন্ড ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটার ঘাড়ে।
আর মুহূর্তের মধ্যেই গর্জে উঠল গোল্ডস্মিথের পিস্তল।
ডায়মন্ড লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে।
গরাদটা আঁকশি দিয়ে টেনে খুলতে খানিক শব্দ হল। স্যামুয়েলরা খানিক থমকাল, শব্দটা ভেতরে গেল না তো!
কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অদূরে, যেন সুড়ঙ্গের ভেতরেই একটা গুলির শব্দ চমকে দিল স্যামুয়েলদের।
আর গুলির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটা চামচিকে স্যামুয়েল, মার্কোস এবং কানাইয়ের মুখের সামনে দিয়ে উড়ে গেল।
ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তারপর বিনা বাক্যব্যয়ে এক এক করে ঢুকতে শুরু করল সুড়ঙ্গের ভেতর।
ঘটনার আকস্মিকতায় ওমান থমকে ছিল। তার চোখ দিয়ে আপনাআপনি গড়িয়ে পড়ল কয়েকফোঁটা জল।
পরমুহূর্তেই প্রবল আক্রোশে সে কামড়ে ধরল ওই তাগড়াই লোকটার কাঁধ। ওমানের জংলি দাঁতের কামড়ে লোকটা যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠল।
গোল্ডস্মিথ ওমানকে টেনে আছড়ে ফেলল মাটিতে।
তারপর নিজেই চেপে বসল ওর বুকে।
“বল কোথায় রেখেছিস ওই হীরেটা!”
গর্জে উঠল গোল্ডস্মিথ।
ওমান কিছু বলার আগেই গোল্ডস্মিথের হাতে কঠিন কিছু একটা ঠেকল। ওমানের জামার ঠিক যে জায়গাটা সে খামচে ধরেছিল সেখানটাই।
গোল্ডস্মিথ প্রচণ্ড হিংস্রতায় টেনে ছিঁড়ে ফেলল ওমানের জামার ওই অংশটা।
হীরেটা ঝকমক করে উঠল গোল্ডস্মিথের চোখে। প্রবল লালসা নিয়ে গোল্ডস্মিথ হাত বাড়াতে গেল হীরেটার দিকে।
আচমকা একটা আর্তনাদ।
গোল্ডস্মিথ বিস্মিত হয়ে চোখ ফেরাল। কাফ্রি তাগড়াই লোকটা উঠে দাঁড়িয়েছিল ওমানের কামড় সহ্য করে।
লোকটার পেটে একটা লম্বা ছুরি গেঁথে গেছে। ওই আর্তনাদটাই লোকটার কন্ঠনালীতে উৎপাদিত হওয়া শেষ শব্দ।
লোকটা লুটিয়ে পড়ল। দেখা গেল মার্কোস দাঁড়িয়ে পেছনে।
এই দৃশ্য দেখতে দেখতেই ঘাড়ে একটা শীতল ধাতব খোঁচা খেয়ে সচেতন হল গোল্ডস্মিথ।
ওমানের আগেই চোখ পড়েছিল।
সেই এদেশি লোকটা কুপি হাতে দাঁড়িয়েছে এসে গোল্ডস্মিথের পেছনে।
তার সঙ্গে আরও দুজন সাহেব। দুজনেরই হাতে বন্দুক, যেটা তাক করা গোল্ডস্মিথের ঘাড়ে।
স্যামুয়েলের হাতে ধরা একটা কোল্ট ড্র্যাগুন বন্দুক। ঠোঁটের কোণা থেকে ঝুলছে লম্বা চুরুট।
মার্কোসের একটা চোখ ঢাকা জলদস্যুদের মতন। শোনা যায় যে বৃদ্ধের আশ্রয়ে সে ছিল ছোটবেলায়, সে নাকি গরম সেঁক দিয়ে নষ্ট করে ফেলেছিল মার্কোসের ওই একটা চোখ। মার্কোসের হাতেও একটা ছোট পিস্তল।
গোল্ডস্মিথ ঘাড় ঘুরিয়ে সক্রোধে দেখল এই তিনজনকে।
দাঁত কিড়মিড় করে সে বলে উঠল, “বেজন্মার দল!”
তার পিস্তলটা সে ঘুরিয়েছিল স্যামুয়েলের দিকে, সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল স্যামুয়েলের বন্দুক। গোল্ডস্মিথের কবজি ভেদ করে ঢুকে গেল গুলি। একটা চাপা আর্তনাদ করে উঠল গোল্ডস্মিথ।
কানাই চেপে ধরে তুলল গোল্ডস্মিথকে। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ওমান উঠে দাঁড়াল। ডায়মন্ডকে মাংস খাওয়ানোর জন্য মাংস কাটার একটা ছুরি থাকত ওমানের কাছে। তার কোমর থেকে সেই ছুরিটা বার করে সে গেঁথে দিল গোল্ডস্মিথের কাঁধে, এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে টেনে বার করে নিল ছুরিটা।
ডায়মন্ডকে মারার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আরও কয়েকবার ছুরি দিয়ে আঘাত করতে চাইছিল ওমান।
গোল্ডস্মিথ বিস্ময়ে, যন্ত্রণায় কাতরাতেও ভুলে গেছে। আর অন্যদিকে মার্কোস এবং স্যামুয়েলের বন্দুক ঘুরে গেছে ওমানের দিকে। ওমানের এই চেহারা সবাইকেই আতঙ্কিত করছে।
কানাইয়ের চোখ চলে গেছে ওমানের পায়ের কাছে। ওই তো হীরেটা।
কিন্তু তার সঙ্গে অন্য একটা বিষয়ও কানাইকে বিস্মিত করছে। সেটা ডায়মন্ডের মৃতদেহ। গোল্ডস্মিথের পোষ্য এই জানোয়ারটিকে নিয়ে কত জল্পনা ছিল। এখন সেটির মৃতদেহ পড়ে রয়েছে শুধু।
দাপুটে গোল্ডস্মিথও ধুঁকছে আহত অবস্থায়।
কানাইয়ের একটা অদ্ভুত পরিতৃপ্তি হল। ওর প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে গেছে।
এসবের ফাঁকেই মার্কোস ঝাঁপিয়ে পড়ল ওমানের ওপর। তার ছুরিটা ছিটকে পড়ল। মার্কোস অদ্ভুত আক্রোশে চেপে ধরল তার গলা। এবং অমানবিকভাবে ঘুষি চালাতে লাগল। ওমান ব্যর্থ চেষ্টা করে গেল চিৎকার করবার।
শিশুদের দেখলেই মার্কোসের এই পৈশাচিক সত্তাটা জেগে ওঠে।
স্যামুয়েল ততক্ষণে কুড়িয়ে নিয়েছে হীরেটা।
ওমানের স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন বৃথা গেল। তাকে ক্রীতদাস করে নিয়ে গেল মার্কোস। দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় সে কাজ করত। বাদবাকি সময় শেকলে বেঁধে চলত নারকীয় নির্যাতন। দিবারাত্র অত্যাচারে ওমান ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছিল। চাবুকপেটা, যখনতখন অকারণে গরম লোহার সেঁক দেওয়া এসব মার্কোসের কাছে ছিল তামাশা। ওমান বেদনায় কাতরালে খ্যাকখ্যাক করে হেসে উঠত মার্কোস। মার্কোস মানুষ না পিশাচ তা বোঝা দায়।
ওমানের নাপিত হিসেবে দক্ষতা ছিলই। একদিন সকালে মার্কোস ফরমাশ করল তার চুল কাটার।
ওমান এই সুযোগটা ব্যবহার করল। সে চুল কাটার ফাঁকেই তার খুরটা নিখুঁতভাবে চালিয়ে দিল মার্কোসের গলায়।
তারপর ওমান পালাল। হীরে তার হাতছাড়া হয়েছে ঠিকই। কিন্তু পালাতে কোনও বাধা নেই তার।
ওমানের খবর তারপর আর কেউ পায়নি।
হীরেটা বিক্রি হল ঠিকই। কিন্তু কানাই এবারে কানাকড়িও পেল না। আর পুলিশও তদন্ত চালিয়ে চৈতন শীলের বাড়িতে ডাকাতির জন্য ডাকাতদলের অর্ধেকের বেশি লোককে গ্রেফতার করল। স্যামুয়েলকেও। আহত গোল্ডস্মিথকেও।
কানাই ওরফে রামমোহন, চিরকাল প্রতারিত হয়ে এল যে, সে হল এই মামলায় রাজসাক্ষী।
হীরেটা যার কাছে বিক্রি করা হয়েছিল তার নাম রাজা প্রতাপকমল সিংহ। হেস্টিংসের বশংবদ হয়ে রাজা উপাধি সে পেয়েছিল ঠিকই। কিন্তু তার যাবতীয় সামাজিক প্রতিপত্তি সে অর্জন করেছিল এই হীরেটা তার হাতে আসার পর। সেই থেকে এই হীরে সিংহ পরিবারের পারিবারিক অভিজ্ঞান।
রাজা প্রতাপকমল সিংহের প্রপৌত্র রাজা ইন্দ্রকমল সিংহ কোনওদিনই ভাগ্যে বিশ্বাস করেননি। এই হীরে তার কাছে বাড়তি অলংকার মাত্র। এমনকি এই হীরের অভিনব আকাশি রং-ও তাকে টানে না।
একজন মূক যুবতীর জন্য এই হীরে, তার পারিবারিক অভিজ্ঞান সে তুলে দিল রমাকান্ত রায়ের হাতে!
এরপর আগামী সংখ্যায়