সৈকত সাহা
“অনন্ত,সানাই কোথায় বাজছে রে?”— গুরুগম্ভীর গলায় ছবি বিশ্বাসের এই সংলাপ আমাদের আজও মোহিত করে। সত্যজিৎ রায়ের চতুর্থ ছবি ‘জলসাঘর’। জমিদার বিশ্বম্ভর রায় বা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মতোই এই ছবির অন্যতম চরিত্র হয়ে উঠেছিল ‘জলসাঘর’ সহ জমিদার বাড়িটি। এই জমিদার বাড়ির প্রতিটি দেওয়াল সার্বিকভাবে নির্মাণ করেছিল ‘জলসাঘর’ ছবির স্বকীয়তা, তার রূপায়ণ। আজ এই কালজয়ী চলচ্চিত্রের হীরক জয়ন্তীতে এসে দেখা যাক সেই প্রাসাদসম বাড়িটি কেমন আছে।
নিমতিতা! মুর্শিদাবাদের উত্তর-পূর্বে গঙ্গার তীরবর্তী গ্রাম নিমতিতা। নিমতিতা নামটি জনমানসে প্রথম দাগ কাটে পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের সূত্র ধরে। ‘জলসাঘর’, ‘দেবী’, ‘তিন কন্যা’র ‘সমাপ্তি’— এই তিনটি চলচ্চিত্রের শুটিং হয় নিমতিতার বিখ্যাত চৌধুরী পরিবারের জমিদার বাড়িতে। এছাড়াও ‘রবীন্দ্রনাথ’ তথ্যচ্চিত্রের জন্যও তিনি সেট হিসাবে বেছেছিলেন এই জমিদার বাড়িকেই। চোখ বন্ধ করলে এখনও আমাদের সামনে ভেসে ওঠে সেই জলসাঘর, দালান, দোতলার বারান্দা কিম্বা ছাদ থেকে দৃশ্যমান অদূরেই প্রবাহিত গঙ্গার ছবি। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল আজ এগুলোর অধিকাংশই আর নেই। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাড়িটির মূল ভবনটি আজ মূলত খণ্ডহর।
নিমতিতা জমিদারির আনুমানিক পত্তন হয় ১২০০ বঙ্গাব্দের দ্বিতীয় ভাগে (১২৭২ ব.)। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গৌরসুন্দর চৌধুরী ও দ্বারিকানাথ চৌধুরী। তাঁদের আদি বাস ছিল অধুনা বাংলাদেশের পাবনা জেলার অষ্টমুনিশা গ্রামে। ১৯২ কাঠা জমির ওপর নির্মিত মূল ভবনটিতে ছিল পাঁচ উঠোন আর প্রায় ১৫০টি ঘর। ভবনটির একটি সুন্দর বর্ণনা আমরা পাই নলিনীকান্ত সরকারের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আসা যাওয়ার মাঝখানে’র প্রথম খণ্ডে।
… জমিদার বাড়িটি রাজপ্রাসাদেরই সমতুল্য। প্রাকৃতিক পরিবেশও সুন্দর। সম্মুখে অনতিদূরে প্রবহমনা ভাগীরথী। মাঝখানে দুটি খেলার মাঠের পর নদীতীর পর্যন্ত শ্যামল শস্যক্ষেত্র।
… দোতলা বাড়ি। দুই মহল। বহির্বাটী ও অন্তঃপুর। বহির্বাটীর প্রকাণ্ড প্রাঙ্গণ। প্রাঙ্গনের পূর্বদিকে চণ্ডীমণ্ডপ, উচ্চতায় দোতলার সমান। প্রাঙ্গণ থেকে অনেকগুলি সিঁড়ি অতিক্রম করে মন্দিরে পৌঁছতে হয়। প্রাঙ্গনের অন্য তিনদিকে সুপ্রশস্ত বারান্দা। পশ্চিমের বারান্দাটি সুবৃহৎ কাছারি কক্ষের সম্মুখে। উত্তর-দক্ষিণ দুদিকের বারান্দার পার্শ্বে জমিদারি সংক্রান্ত বিভিন্ন বিভাগীয় দপ্তর এবং অন্যবিধ ব্যবহারের জন্য একাধিক কক্ষ। দক্ষিণ-পশ্চিম বারান্দার নৈঋত কোণে দোতলায় উঠবার সিঁড়ি। দোতলাটি একতলার অনুরূপ পরিকল্পনায় নির্মিত। দোতলায়, একতলার কাছারি কক্ষের ঠিক উপরে মূল্যবান আসবাবে সুসজ্জিত একটি সুরম্য প্রকোষ্ঠ। আমরা বলতাম পেইন্টিং হল। চারিদিকের দেওয়াল নয়নাভিরাম রঙে রঞ্জিত ও সুরুচিসম্মত চিত্রাঙ্কনে সুশভিত। পারস্য দেশীয় গালিচা বিছানো কক্ষতল। বেলোয়ারি কাঁচের একাধিক ঝাড় লণ্ঠন। খানদানি আভিজাত্যপূর্ণ বাতাবরণ। জমিদার বাড়িতে তখন সর্বত্র কার্বাইড গ্যাসের আলো জ্বলত। বেলোয়ারি কাঁচের ঝুলন্ত দীপাধারগুলি গ্যাসের আলোয় প্রদীপ্ত হয়ে উঠলে এক অবিস্মরণীয় সুষমায় সমুজ্জ্বল হয়ে উঠত হলঘরটি। এই হলঘরটিই তারাশঙ্করের গল্পের ‘জলসাঘর’….।
তবে নিমতিতা জমিদার বাড়ি বা জমিদারির মুকুটে আরও অনেক পালক সুসজ্জিত ছিল। সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে এই জমিদার পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই ভবনে সাংস্কৃতিক জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্রদের সমাগম ছিল নিয়মিত। এত ব্যাক্তিত্বের আগমন জেলার অন্য কোনও জমিদার বাড়িতে হয়েছে কিনা, তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। ১৩০৪ বঙ্গাব্দে জমিদার মহেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে ‘নিমতিতা হিন্দু থিয়েটার’। কলকাতার সাধারণ রঙ্গালয়ের আদলে তৈরি হয় থিয়েটারের রঙ্গমঞ্চ। এখানে মঞ্চস্থ হওয়া প্রথম নাটক ‘চাঁদ বিবি’, তাতে ব্যবহৃত হয়েছিল শব্দহীন জেনারেটর। এই মঞ্চেই শিশির ভাদুরির ‘আলমগীর’, ক্ষীরোদপ্রসাদের ‘আলিবাবা’, ‘নর নারায়ণ’, ‘সীতা’, অপরেশবাবুর ‘কর্ণার্জুন’— এসব নাটক একাধিকবার মঞ্চস্থ হয়েছে। উল্লেখ্য, এই ভবনে বসেই ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ লিখেছিলেন পূর্বে উল্লেখিত ঐতিহাসিক দুই নাটক ‘আলিবাবা’ ও ‘নর নারায়ণ’। এই হিন্দু থিয়েটারকে ঘিরে নাট্যচর্চার এক ঐতিহ্যশালী পরিমণ্ডল গড়ে ওঠে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, স্বয়ং তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই নিমতিতা জমিদার বাড়ির কথা ভেবেই ‘জলসাঘর’ গল্পটি লিখেছিলেন।
রায়বাহাদুর জ্ঞানেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর কন্যা রেণুকা রায়ের বিয়েতে নজরুল ইসলাম আসেন। এছাড়াও বিভিন্ন সময় এ রাজবাড়িতে আপ্যায়িত হয়েছেন মন্মথ মোহন বসু, ডা. উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী, অন্নদাশঙ্কর রায়, লীলা রায়, দাদাঠাকুর, ডেভিড ম্যাকাচ্চন, হেমন্ত বসু, অশোক মিত্রর মতো ব্যাক্তিত্ব। তাছাড়া দোল উৎসব ও দুর্গোৎসবের সময় মেলা বসত। আর্য অপেরা, ভোলানাথ অপেরার মতো যাত্রাদল আসত রাজবাড়িতে। ১৯৬৯ সালে ইন্দো-পাক চুক্তির সময় এই বাড়িতেই কমিশনের বৈঠক বসে। সে সময় পদ্মজা নাইডুও এখানে এসেছিলেন।
কিন্তু, এ সমস্ত কিছুই আজ শুধুই ইতিহাস। জমিদার বাড়ির ক্ষয় শুরু হয় অনেক আগেই। ১৯৪৩ সালের গঙ্গা-পদ্মার ভাঙনে গ্রামের অনেকখানি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। বন্যা আর ভাঙন গ্রাস করেছিল হিন্দু থিয়েটার, অতিথিশালা, ঠাকুরবাড়ির ফুলবাগান, টেনিস কোর্ট, ফুটবল মাঠ, গৌরসুন্দর দ্বারকানাথ ইন্সটিটিউশন, ব্রজগোপী বালিকা বিদ্যালয়, পোস্ট অফিস, রেজিস্ট্রি অফিস। পরবর্তী সময়ে অবশ্য গৌরসুন্দর স্কুল, পোস্ট অফিস, রেজিস্ট্রি অফিস গড়ে তোলা হয়। পরবর্তীকালে জমিদারি প্রথা অবসানের ফলে নিমতিতা ভবন বহুলাংশে তার জৌলুস হারাতে থাকে।
এই জমিদার বাড়ির ১০০ গজের মধ্যে বয়ে চলা গঙ্গার রূপ অসামান্য। ওপারে ক্ষীণ রেখার মতো বাংলাদেশের ভুমিখণ্ড— তাদের কাছে একই নদী পদ্মা নামে প্রবাহিত। সাদা বালির বিস্তীর্ণ পাড়ে বি.এস.এফের ছাউনি লক্ষণীয়। মূল বাড়ীর একাংশে বি.এস.এফের ক্যাম্প। বর্তমানে বাড়িটিতে কেয়ারটেকারেরে পরিবার ছাড়া আর কেউই সে অর্থে বসবাস করেন না। রবীন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী সহ পরিবারের বাকি লোকজন এখন কলকাতাবাসী। তবে, দুর্গাপুজোর সময় এখনও ভাঙা বুকে সেজে ওঠে নিমতিতা রাজবাড়ি, মিলিত হন সকলে।
এহেন ঐতিহ্যের কী কঙ্কালসার অবস্থা তা রচনাটির সাথে সংযুক্ত ছবিগুলি থেকেই স্পষ্ট। বহু ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী এই বাড়িটি আজও অবহেলা আর উদাসীনতার ভার বহন করে চলেছে। ক্ষত বিক্ষত দেওয়াল, ভেঙে পড়া ছাদ, পলেস্তার খসে পড়া বিশাল বিশাল থাম, দেওয়ালের গা বেয়ে গজিয়ে ওঠা গাছগাছালি কি আমাদের দিকে বারবার আঙুল তোলে না? আমরা কি পারতাম না এই ইতিহাসকে জীবন্ত রাখতে? সরকারি বা প্রশাসনিক দপ্তরের আধিকারিকদের বহুবার প্রতিশ্রুতি দিতে দেখা গেলেও সংস্কারের প্রসঙ্গে ঐটুকুই সার। জনপ্রতিনিধিরাও পরিদর্শন করেই নিজেদের দায় ঝেড়ে ফেলেছেন। ‘হেরিটেজ’ তকমা তো দূর অস্ত, সামান্য সংস্কারের জন্যও কোনও সাহায্যের হাত এগিয়ে আসেনি আজ অব্দি। INTACH তাদের মুখপত্র VIRASAT-এ (JULY-SEPTEMBER, 2013) নিমতিতা রাজবাড়ি নিয়ে আলোচনা করলেও, তাদের তরফেও সে অর্থে কোনও লক্ষণীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আমরা চাইলেই হয়তো পারতাম সত্যজিৎ রায়ের স্মৃতিবিজরিত এই ভবনে একটা মিউজিয়াম তৈরি করতে, হয়তো পারতাম শতাব্দী প্রাচীন এই ভবনকে মেরামত করে তাকে পর্যটনের অন্যতম গন্তব্য হিসেবে গড়ে তুলতে। কিন্তু, না! আমরা করলাম না। নিজের প্রায় ভেঙে পড়া অস্তিত্ব নিয়ে দণ্ডায়মান এই ভবনটি আজও ইতিহাসের অনেক অধ্যায়কে বাঁচিয়ে রেখেছে তার অন্দরে। হাওড়া থেকে মালদা যাওয়ার পথে আজিমগঞ্জের কিছুটা দূরেই ছোট্ট স্টেশন নিমতিতা। সেখান থেকে হেঁটে বা টোটো-তে নিমতিতা রাজবাড়ি। অবহেলা আর উপেক্ষার শিকার হতে হতে সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ার আগে একবার ঘুরে আসা যেতেই পারে সত্যজিতের সেই জলসাঘর। ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে গঙ্গার নীল জলে প্রবাহিত সময়ের কাছে শুনতে চাওয়া সেই সানাই-এর সুর।