ঈশ্বর চক্রবর্তী
'ওকা ওড়ি কথা' (১৯৭৭) মৃণাল সেন পরিচালিত তেলেগু চলচ্চিত্র যা নিয়ে স্বভাবতই তাঁর অন্যান্য বাংলা ছবির তুলনায় আলোচনা কমই হয়েছে। অথচ ওকা ওড়ি কথা সে বছরের সেরা তেলেগু ছবি হিসেবে জাতীয় পুরষ্কার জিতে নিয়েছিল। বিদেশেও বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি উচ্চপ্রশংসিত ও পুরষ্কৃত হয়েছিল। মুগ্ধতা জ্ঞাপন করেছিলেন সত্যজিৎ রায় স্বয়ং। এবারের হুইলার্স স্টলে রইল 'চলচ্চিত্র চর্চা' পত্রিকার মৃণাল সেন বিষয়ক বিশেষ সংখ্যা থেকে 'ওকা ওড়ি কথা' সমালোচনার নির্বাচিত অংশ।
চলচ্চিত্র চর্চা
চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা
প্রসঙ্গ: মৃণাল সেন
চলচ্চিত্র সমালোচনা
সম্পাদক: বিভাস মুখোপাধ্যায়
প্রকাশকাল : ১৪ মে, ২০১৭
ভোর হচ্ছে।
ভোর হচ্ছে? ভোর হবে কেন! ওদের জীবনের অন্ধকার কি কেটে গেল যে ভোর হবে। অসমতল ভূমি আর চতুর্দিকে অসংখ্য বাধা-বিপত্তির মতো ছড়িয়ে আছে বড় বড় সব পাথর, মাঝে ছোট্ট কুঁড়েটি, সেখানে ভোর হয় – এক মনোরম প্রত্যুষ। প্রকৃতি মুক্ত-স্বভাব, তার আলোটুকু বাবুদের ভাঁড়ারে বন্দি হয়নি; ভেঙ্কায়ার অতি দুঃস্থ আস্তানাটির মধ্যে ভোরের আলো পৌঁছে যায়। ঘুম ভাঙ্গে ভেঙ্কায়ার, শুরু হয় আরেকটি অন্ধকার দিন। প্রকৃতিতে ভোর হওয়ার কারণ বুঝতে পারি ভেঙ্কায়া ঘুম থেকে উঠেই যখন বিরক্ত হয়। এক বিকট চপেটাঘাতে গায়ে-বসা কোনও মশা বা মাছিকে সে পিষ্ট করে দেয়। ঘুম থেকে উঠেই বিরক্ত কেন ভেঙ্কায়া? আরেকটা দিন – রাতের চেয়েও অন্ধকার যা, সমাজের সাথে আরেকটা দিনের লড়াই, নিয়ম শাসন ও বঞ্চনার সমাজের আরও একটা দিনের বাঁচার চেষ্টা। ঘেন্না ধরে গেছে ভেঙ্কায়ার। এই সমাজের মুখে (ক্যামেরার দিকে সরাসরি তাকিয়ে) সে পেচ্ছাপ করে।
“নে শুয়ে পড়, শুয়ে পড়”। কিংবা “ঘুম ভাঙলো তো আবার ঘুমো”। ছেলেকে বলে ভেঙ্কায়া। জেগে থাকলেই যে ‘কামের কলে’ ধরা দিতে হবে।
কামের ‘কল’ কেন? কাম – কর্ম, সে তো যজ্ঞ। সে যজ্ঞে নিজেকে নিষ্কাম – অর্থাৎ ফল কামনা না করে, সঁপে দিতে হবে; এ-ই তো ভারতীয় সমাজ ও ধর্মের বাণী। অশিক্ষিত ও গ্রাম্য ভেঙ্কায়া সমাজের প্রচার ও ধর্মের অনুশাসন দ্বারা প্রভাবিত হবে এবং বুদ্ধিহীন ও অপারগ বিচারে আজীবন কাজ করে যাবে ও ঠকে যাবে – এ-ই তো হওয়া উচিত। কিন্তু ভেঙ্কায়া হঠাৎ অন্য কথা বলে কেন?
বলে; কারণ ছবির পরিচালক মৃণাল সেন।
১৯৬৯ সালে মৃণাল সেন গ্রামে গিয়ে তুলেছিলেন ‘ভুবন সোম’। তার আগে ১৯৫৯-এ যিনি ‘বাইশে শ্রাবণ’ করেছেন – যে ছবিকে একটা রাজনৈতিক চরিত্র দিতে পেরেছেন, তিনি হঠাৎ তুললেন ‘ভুবন সোম’। সমাসাময়িক কলকাতায় তখন চলেছে রাজনৈতিক উত্তেজনা। এবং একই সময়ে ‘ভুবন সোম’ পেল ভূয়সী প্রশংসা। বিশেষ মহল থেকে তখন মৃণাল সেনের তৈরি একটি অরাজনৈতিক ছবি প্রশংসিত হয়, তখন তা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মৃণাল সেনও চিন্তিত হলেন, একজন সংগ্রামী পরিচালক নিজের সাময়িক অসতর্কতায় আহত হলেন, কারণ তাঁর কলকাতায় যখন রাজনৈতিক এক চরম উত্তেজনা চলেছে তখন তিনি কোনও ‘রসঘন মিষ্টি ছবি’ তৈরি করে রসের কারবারিদের কাছ থেকে বাহবা পাবার জন্য ছবি করতে আসেননি। তাই তিনি ঘোষণা করলেন, “আর ভুবন সোম নয়, আসুক অন্য কিছু”।
সুতরাং তৈরি হল ‘ইন্টার্ভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘পদাতিক’, ‘কোরাস’। শহর জীবনের রাজনৈতিক ছবি করতে গিয়ে তাঁকে সমস্যার নাভিমূলে – অর্থাৎ গ্রামে, যেতে হয়েছে বারবার। শহর-জীবনের ফাঁকে ফাঁকে ছবিতে এসেছে গ্রাম – শোষণের মূল বীজ যেখানে প্রোথিত। গ্রাম আর শহর মিশেছে সঙ্গত ভাবেই; গ্রামে শহরে শোষণের অভিন্ন রূপ ধরে ফেলেছেন তিনি। কৃষিভিত্তিক দেশে শোষণ ইন্দাস্ট্রিয়ালাইজেশনের পথ ধরে শহরে এসে পৌঁছয়, মূলত এক হলেও বাহ্যত স্থান ভেদে শোষণ ভিন্ন রূপ ধারন করে শহরে। রাজনৈতিক আন্দোলনে শহরের ভূমিকা থাকে অগ্রণী, সুতরাং আন্দোলন শহরে দানা বাঁধলে একজন রাজনৈতিক চলচ্চিত্রকার সে আন্দোলনের ব্যাখ্যা দিতে বসে গ্রামের দিকে চোখ রাখবেনই, কারণ সমস্যার স্থানিক আলোচনা সেরে তিনি ক্ষান্ত হতে পারেন না, বরং একটি বৃহত্তর পর্যালোচনা কিংবা তার ইঙ্গিত তিনি রাখবেন। সমস্যার গভীরে নাড়া দেবার পথটি তাঁকে জানতে হয়ই। সমস্যার গভীরতা – যা ভাববাদী শিল্পীদের কাছে অব্যক্ত মায়াময় অজাগতিক, বস্তুবাদী শিল্পীর কাছে সমস্যার মূল কারণ। রাজনৈতিক শিল্পী যদি মার্কসবাদী হন, তবে সমস্যার মূলে পৌঁছতে তার সামাজিক বিচার করেন, রাজনৈতিক অর্থনীতি দিয়ে বিচার করেন। সে ক্ষেত্রে গ্রামই হয়ে ওঠে তাঁর ছবির জন্মভূমি, শহর শুধু প্রয়োজনবোধে সে ছবির বাসস্থান। …’ইন্টারভিউ থেকে ‘পদাতিক’ এই তিনটি ছবিতে পটভূমি হিসেবে কাজ করেছে কলকাতা। কলকাতা এই তিনটি ছবিতে শারীরিক ভাবে উপস্থিত আগাগোড়া। কিন্তু তিনটি ছবিতেই, অন্তত আমি এই ভাবেই দেখেছি, “কলকাতার শারীরিক উপস্থিতি এসেছে নেহাতই একটা excuse হিসেবে। চেষ্টা করেছি কলকাতার এই শারীরিক উপস্থিতির মধ্য দিয়ে গোটা দেশের সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক চেহারার আন্দাজ করার, বিশ্লেষণ করার এবং ব্যআখ্যা করার এবং ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে দেশের এই realityকে এক সঠিক perspective-এ এনে দাঁড় করানোর (-মৃণাল সেন)”। অর্থাৎ রাজনৈতিক পরিচালক হিসেবে এবার তিনি তাঁর কর্তব্যের কথা ঘোষণা করলেন। বারেবারে গ্রামে ফিরে যাওয়ার প্রবণতায় বোঝা যায়, রাজনৈতিক চেহারাটার একটা সামাজিক চরিত্র (যা থেকে গোটা দেশের সামাজিক চরিত্র বোঝা যাবে, কেননা ভারতবর্ষ গ্রামপ্রধান ও কৃষিভিত্তিক দেশ) তুলে ধরতে চান। সামাজিক চরিত্র প্রতিষ্ঠিত হলে, তার বিচার হবে অর্থনৈতিক। এই ছবি – ‘ওকা উড়ি কথা’র বিচার করেছেন পরিচালক অর্থনীতি দিয়ে।
রাজনীতি সচেতন এক পরিচালকের ছবি যখন অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষিত এবং পরিচালক যখন কর্তব্যপরায়ণ, তখন তাঁর ছবির একটি প্রধান চরিত্র তো ও-কথা বলতেই পারে। ভেঙ্কায়া ‘কাম’কে বলতে পারে ‘কল’।
আমরা এবার দেখব, ভেঙ্কায়া এ কথা বলতে পারল কেন।
এই ছবির পটভূমি গ্রাম। কাহিনী শোষণের। সুতরাং ব্যাখ্যা সাধারণভাবেই অর্থনৈতিক। শোষণের যন্ত্র শ্রম আর লক্ষ্য শ্রমিক। ভেঙ্কায়া একজন শ্রমিক – কৃষিশ্রমিক। সে শোষিত, ভয়ঙ্কর শোষণে বিধ্বস্ত। যে সমাজে সে বাস করে তা আধাসামন্ততান্ত্রিক এবং কুৎসিত সংস্কারগ্রস্ত। সামন্ততান্ত্রিক ও বুর্জোয়া সমাজে ভাববাদী দর্শন ও ধর্মের আফিম সাধারণ মানুষকে তার শোষিতাবস্থার কারণ নির্ণয়ে অপারগ করে রাখে। বুর্জোয়া সমাজে শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হতে শেখে, সেক্ষেত্রে তারা রাজনৈতিক শিক্ষা পায়; ফলে সে তার শোষিতাবস্থার কারণ বোঝে এবং তার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য অন্তত মানসিক প্রস্তুত হতে পারে। কিন্তু ভেঙ্কায়া, সে যে সামাজিক অবস্থায় বাস করে সেখানে বসে সে কী করে অর্থনৈতিক বিচার বাঁ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করতে পারে? হয়তো পারে না, যদি সে একজন শ্রমিক মাত্র হয়। এখানে, ভেঙ্কায়া একজন শ্রমিক হলেও, তার এক অতিরিক্ত বিশেষণ আছে, সর্বহারা। সুতরাং সামাজিক সংযোগ থেকে সে বিচ্ছিন্ন। শ্রম-ব্যবসা তার জীবিকা। শ্রমিক হিসেবে সে দাস-শ্রমিক নয়, স্বাধীন শ্রমিক। শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত সে শ্রম দিয়েছে, “শ্রম – যা জৈব দেহের – মস্তিষ্ক, স্নায়ু, পেশি প্রভৃতির কার্যকলাপ”। বঞ্চিত হয়েছে সে একইসাথে চিরকাল। একজন মুক্ত শ্রমিক, যে সমাজের যাবতীয় আচার থেকে বিচ্ছিন্ন অথচ যুক্ত সেক্ষেত্রেই যেক্ষেত্রে সে উদ্ভট ভাবরসে তথা ভাগ্যের পরিহাসের রহস্যে শান্তি খোঁজে না। তা যদি হত, তবে একজন রাজনৈতিক পরিচালকের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হত; পরিচালকের partisan হবার সুযোগ ও মার্কসীয় শিক্ষা ব্যর্থ হত। বরং ভেঙ্কায়া কিংবা তার মতো একজন লক্ষ্য করবে বঞ্চনার “উদ্বৃত্ত মূল্য শ্রমিকের শ্রম-সময়ের জমাট রূপমাত্র”। “… যেখানেই সমাজের একটি অংশ উৎপাদনের উপকরণগুলির একচেটিয়া মালিক হয়, সেখানে শ্রমিক স্বাধীন কিংবা গোলাম যা-ই হোক না কেন, তাকে নিজের ভরণপোষণের জন্য আবশ্যক শ্রম-সময়ের সঙ্গে উৎপাদনের উপকরণের মালিকদের প্রয়োজন পূরণের জন্য কিছু বাড়তি শ্রম-সময় দিতে হয়।” শ্রমিকের শ্রম থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে পুঁজি। কেননা “প্রাকৃতিক সম্পদের কোনো নিজস্ব মূলধন নেই। অর্থাৎ…. স্থির মূলধন শূন্য।…. উৎপন্ন মূল্য = শ্রমমূল্য + উদ্বৃত্ত।” অর্থাৎ শোষণের এই কুৎসিত রূপ সে ধরে ফেলবে। কাম- শ্রম তার কাছে হবে এক ভয়ঙ্কর কল, যে কলে সে তথা একজন শ্রমিক নিদারুণভাবে নিষ্পেষিত। এই কলে ধরা দিতে ঘৃণা হবে ভেঙ্কায়ায়; তাই তার ছেলে কিষ্টাকে সে অভিজ্ঞস্বরে সাবধানে করে দেবে, “কামের কল পাতা আছে সংসারে, এমন কল – ঢুকলি কি মরলি।”
যাকে দিয়ে পরিচালক সমাজজীবনের শোষণের এক গূঢ় রহস্য উদঘাটন করিয়েছেন, তাকে দিয়ে পরিচালক তার প্রতিবাদও করাতে পারেন। না-ও করাতে পারেন। না-করালে পরিচালকের চরিত্র কিছু কলুষিত হয় না। কিন্তু এক্ষেত্রে করিয়েছেন। করাতেই হয়েছে, কারণ এখানে প্রতিবাদই গল্পের প্রাণ, শোষণের যে-রহস্যের ভেঙ্কায়ার মুখে শুনি তা এই গল্পের শরীর – সেটা আগে থেকেই ছিল। তাই ছবির শুরুতেই সেকথা শুনি। পরে যেটা আসছে, সেটাই আসল। অর্থাৎ প্রতিবাদ।
বঞ্চনার এই জঘন্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে ভেঙ্কায়া প্রতিবাদ জানায় কাজে যোগদান না করে। পারতপক্ষে কাজ করতে চায় না সে৷ তার এই প্রতিবাদে শামিল হয় তার ছেলে- যে তার মন্ত্রশিষ্য, কিষ্টা। কাজ না করে প্রতিবাদ জানানো যায়, কিন্তু খাদ্য জোটে না। খিদে পাবে, জৈবিক নিয়ম এটা। আর তাহলেই আবার ছুটতে হবে খাদ্যের সন্ধানে অর্থাৎ যোগ দিতে হবে কাজে। কাজে যোগ দিতে চরম ঘৃণা তার। অতএব, যতক্ষণ পারো ঘুমিয়ে থাকো, কিংবা “জোয়ান-মরদ কিষ্টাকে খিদে জয় করা শিখতে হবে।” কিন্তু তবু কাজে যোগ দিতে হয়, দিতে হয় বাঁচার তাগিদে। বিস্তৃত মরুভূমির মতো এক মাঠ, শেষ হয় না মাঠ- যা এদের বঞ্চনার জীবনের মতো, এদের অসহায়তা আর রিক্ততার মতো; তার মধ্য দিয়ে হেঁটে চলে বাপ-বেটা কাজের খোঁজে। অর্থাৎ শোষণের ফাঁদে পা বাড়ায় বাধ্য হয়েই। শোষণ এবং প্রতিবাদ পাশাপাশি চলে। এ-নিয়েই তো গল্প, এখান থেকেই তো কাহিনীর শুরু। এই দৃশ্যেই পরিচয় লিপির ব্যবহার, সুতরাং, অনিবার্য।
(১৯৭৯)