গোলাম রাশিদ
মিনহা খলাকনাকুম, ওয়া ফিহা নুয়িদিকুম, ওয়া মিনহা নুখরিজুকুম তারাতান উখরা। এই মাটি থেকেই তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে, এই মাটিতেই তোমাকে ফিরিয়ে নেয়া হবে এবং এই মাটি থেকেই পুনরায় আবার তোমাকে জীবিত করা হবে।
তিন মুঠো মাটি তাঁর কবরে ছড়িয়ে দিয়ে ফেরত আসার সময় মনে হল, বছর কুড়ি-চৌত্রিশ পর, এদরাকপুরে তাঁর বাড়ি ‘ছায়ানট’-এর ঠিকানায় যখন লাইলি আপার চিঠি আসবে, তখন কি সেটা গ্রামের লোকের কাছে উড়োচিঠি হয়ে যাবে? না-কি তারা ঠিক বুঝে যাবে, এই চিঠি তো রাকিব মাস্টারের! ছায়ানটের নিকটে আমগাছের ছায়ায় যে ঘুমিয়ে আছে, সেই এদরাকপুরের রাকিব মাস্টারের চিঠি৷ তবে সেই চিঠি ঠিক ঠিকানায় পৌঁছলেও তিনি উত্তর দেবেন না৷ কারণ তাঁর লেখার কলম, চশমা, খাতা, টেবিল, চেয়ার ছেড়ে তিনি আমগাছের ছায়ায় গভীর নিদ্রায় শুয়ে আছেন৷ কোনও সাহিত্যসভায় সভাপতি, অতিথি হবার ডাক তিনি এখন ঠিক উপেক্ষা করবেন। শুধু অপেক্ষা করবেন শেষ বিচারের ডাক শোনার জন্য৷
আবদুর রাকিব যে বাংলার আপামর সাহিত্যপ্রেমী, সাধারণ মানুষ, চিন্তাশীল মানুষদের মন জুড়ে একান্তভাবে বিরাজ করতেন, তা আরও একবার প্রমাণ করে দিল ২১ নভেম্বরের দিনটি৷ তাঁর মরদেহ রবীন্দ্র সদনে আসেনি, কারণ শহুরে কেতাগিরিকে তিনি স্মিত হাসিতে ছুঁড়ে দিয়েছেন তাচ্ছিল্য, সুদূর মুরারই-এর এদরাকপুরে বসে লিখে গেছেন বাদশাহ ও বাবুইয়ের বৃত্তান্ত। সুদূর কেন? গ্রাম-বাংলার ছড়ানোছিটানো সৌন্দর্য, পল্লী-বাংলার যে ছোঁয়া, সেখান থেকে কলকাতা শহর সুদূর হতে পারে, কিন্তু আবদুর রাকিবের ‘ছায়ানট’ সেসবের একদম কাছে অবস্থিত। দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত, মাছের পুকুর, সারি সারি তালগাছ– সেসবের মধ্যে তিনি ছিলেন চারণকবি গুমানী দেওয়ানের মতোই সম্রাট, বেতাজ বাদশাহ৷ বাঁশলোই নদীর বহমানতা যতদিন থাকবে, ততদিন আবদুর রাকিব নামটিও এই রাঢ় বাংলায় তারাশঙ্কর, মুস্তাফা সিরাজদের সঙ্গে উচ্চারিত হবে গ্রামের মোড়ের জটলায়, পাকা ধানের শীষে বসে দোল খাওয়া বুলবুলির গানে, অনুরণিত হবে লিলুয়া বাতাসে৷
আবদুর রাকিব — এক জীবন
‘কাফেলা’ পত্রিকায় যারা লেখালেখি করতেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন তিনি৷ তিনি চলে যাওয়া মানে কাফেলা যুগের অবসান হল, এ বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়– রাকিবের শূন্যতা কেউ পূরণ করতে পারবে না৷ তাঁর লেখায় মূল্যবোধ, গ্রামীণ দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বজনীন স্তরে উত্তরণ– এই বৈশিষ্ট্য নিয়ে আর কেউ কি লেখালেখিতে অগ্রসর হবেন? আর কেউ দিয়াশালাই বাক্সের বাড়ি বানাতে পারবে? কে বহন করবে আবদুল আজীজ আল আমান, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, সোহারাব হোসেন, আফসার আমেদের উত্তরাধিকার? কে সে, যে সাহিত্য অনুষ্ঠানের মানপত্র লিখে দেবেন, তরুণদের উদ্বুদ্ধ করবেন গল্প লিখতে, ছাপানোর জন্য তাড়াহুড়ো করতে বারণ করবেন, হাতটি ধরে একান্তে বলবেন– যেদিন লেখা চেয়ে সম্পাদকের ফোন আসবে, সেদিন বুঝবে তুমি কিছুটা লিখতে পেরেছ৷ পুরোপুরি লেখক হওয়া চাট্টিখানি ব্যাপার নয়৷ এমন কথা তিনি বলতে পারেন। কারণ, সাহিত্য জীবনের হাফ সেঞ্চুরি করার পর তাঁকে যখন জিজ্ঞাসা করা হবে, রাকিব সাহেব, আপনার লেখা প্রথম গল্পটির নাম কী? উনি ঋজু হয়ে অপাপবিদ্ধ বালকের মতো সরল হাসিতে বলবেন, আমার প্রতিটি গল্পই আমার প্রথম গল্প!
এই কথার মধ্যে কোনও ভণিতা নেই, নেই কোনও লোকদেখানো অস্মিতাও৷ কারণ, তিনি একজন সাধক, শিক্ষক৷ আর এই জায়গায় আবদুর রাকিব বরাবরই সৎ৷ তাই তিনি অকপটে বলতে পারেন, শিক্ষকতাকে ফাঁকি দিয়ে আমি কখনও লিখিনি৷ সম্পাদকের তাগাদা আমাকে লেখক করেছে কিন্তু আমি তো আসলে একজন শিক্ষকই হতে চেয়েছি সারা জীবন৷ হ্যাঁ, তিনি পেরেছিলেন৷ তাই শিক্ষকদিবসের দিন ভুলে যাওয়া মুখগুলি ফিরে আসে তাঁর কাছে৷ আরও একবার চেয়ে নেয় প্রার্থনা৷
এই শিক্ষক একদিন স্কুলে গিয়ে দেখলেন ক্লাস এইটের ঘরের সামনে ছেলেমেয়েরা হুল্লোড় করছে। সহকর্মীরা চিন্তাগ্রস্ত। মেথর আনার তোড়জোড় হচ্ছে। কারণ, পাড়ার এক বখাটে ছেলে ভাঙা জানালা দিয়ে ক্লাসরুমে ঢুকে ‘অপকর্ম’ করেছিল। সব শোনার পর তিনি দু’মিনিট সময় নিলেন মেথরের এই কাজটি সম্পন্ন করতে। সবাই অবাক। মাস্টার হল মেথর! এমন নিরহংকার মানুষ আর আসবে বাংলা সাহিত্যে?
তিনি যেন সবার অভিভাবক৷ সালিশি মেটাতে তিনি কাজী, পারিবারিক বিবাদ মেটাতে তিনি মধ্যস্থতাকারী৷ একবার তার স্কুল ঘেরাও হয় বিক্ষুব্ধ অভিভাবকদের দ্বারা। তিনি খবর পান। আহবান করেন আলোচনার টেবিলে। কারণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই ধরণের ধর্না মানায় না। প্রতিপক্ষ পরাস্ত হয় তাঁর যুক্তি ও ব্যক্তিত্বের কাছে। স্কুল রেহাই পায় অপ্রীতিকর ঘটনার হাত থেকে।
এমন অসংখ্য ঘটনা জড়িয়ে আছে তাঁর জীবনে। এবং ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে শেষপর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, তিনি একজন প্রকৃত মানুষ। সাহিত্যিক, কিংবা সাহিত্যিক নন। কিন্তু অবশ্যই একজন শিক্ষক। তাই তিনি যখন আত্মজীবনী লিখলেন (আসলে সে তো লাইলি আপার চিঠির জবাব) সেখানে রাখলেন না সাহিত্যের কোনও হৃদয় মোচড়ানো ‘এক্সক্লুসিভ’ কারিকুরি। যদিও ভাষাতে সেই চির-পরিচিত মরমি ‘রাকিবীয়-গদ্য’, যা বুঁদ করে রাখে পাঠককে। আত্মজীবনী মানেই খুল্লমখুল্লা, কোনও নতুন বিতর্ক। সে-সব অতিকথনীয় আবেগকে একদম পাত্তা দেননি আবদুর রাকিব। বরঞ্চ, সদা সতর্ক থেকেছেন, আবেগ তাঁর সত্যকথনকে যেন মুহূর্তমাত্র দূর্বল করতে না পারে।
তাঁর গদ্য পড়তে বসলে শুধু হুমায়ূন আহমেদকেই মনে পড়ে। কারণ এই দুজনই বোধহয়, ভাষার মায়াজালে ধরে রাখেন পাঠককে। তবে আবদুর রাকিবের শব্দচয়ন, ভাষাসৌন্দর্য হার মানায় তাঁর সময়ের বাংলাভাষার যেকোনও লেখককে। অথচ তাঁকে যখন প্রশ্ন করি, বাংলার অসংখ্য পত্র-পত্রিকায় আপনি লিখে চলেছেন। অথচ বাণিজ্যিক পত্র-পত্রিকায় আপনাকে দেখা গেল না। অতৃপ্তি হয় না? স্বভাবসিদ্ধ হাসিতে বলে ওঠেন, অতৃপ্তির কোনও প্রশ্নই আসে না। রাস্তায় যেমন পসার সাজিয়ে পসারীরা বসে থাকে, আমি তেমনই সাহিত্যের পসরা সাজিয়েছি। মানুষজন এসে সেই পসরা নেড়ে-চেড়ে দেখে, পছন্দ হলে নেয়। আমি সাহিত্যের পথ-পসারী।
দৈনিক কলমের প্রথম সাহিত্য সম্পাদক
কেউ তাগাদা না দিলে তাঁর লেখা হত না। সম্পাদকদের চিঠি, ফোন তাঁকে লিখতে বাধ্য করেছে। যিনি তাগাদা দেন, তিনি সম্পাদক৷ আর এই চেয়ারেই জীবনের একটি বছর তিনি কাটিয়েছিলেন কলকাতায়৷ আহমদ হাসান ইমরানের সম্পাদনায় কলম দৈনিক হিসেবে প্রকাশিত হতে শুরু করে ২০১২-এর এপ্রিলে৷ সেই সময়েই কলমের ১৬ পাতার সাহিত্য ট্যাবলয়েডের প্রথম সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে তিনি যোগ দেন৷ তাঁর স্বল্প সময়ের সম্পাদনা জীবনে তিনি বহু তরুণকে তুলে আনেন, তাদের লেখা সম্পাদনা করে যত্ন করে ছেপে তাদেরকে লিখতে শেখান৷ তিনি বলেছিলেন, কলমের ওই চেয়ারটায় না বসলে আমার জীবনে অনেক কিছু দেখা বাকি থেকে যেত। মানুষের, তাও আবার যথেষ্ট স্বনামধন্য, লেখা ছাপানোর জন্য যে কী আকুলতা, আর কী বলব! গল্প-কবিতা ছাপতে একটু দেরি হলেই ফোন করে বা সশরীর এসে তাগাদা চলত। লেখা ছাপানোর এই তাড়না লেখার মান নষ্ট করে দেয়। আবার এমন অনেক নতুন প্রতিভাও পেয়েছি যারা মন দিয়ে শুনত ভুল-ত্রুটিগুলো, পরবর্তীতে শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করত।
সাহিত্যের শুরুয়াত
তিনি যখন কলেজে আই.এ পড়ছেন, তখন একটি কবিতা কলেজ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল। শরৎচন্দ্রের ওপর কবিতা লিখেছিলেন তিনি৷ তখন কি তিনি জানতেন, শরৎচন্দ্রের উত্তরাধিকার আগামীদিনে তিনি বহন করতে চলেছেন। সেই সময় ‘মংলু’ নামে একটি গল্পও লিখেছিলেন সেই ম্যাগাজিনে। সেটা বন্ধুর নামে প্রকাশিত হয়েছিল। এটা হচ্ছে সেই ১৯৫৮-র কথা। এরপর তিনি ধীরে ধীরে সাহিত্য জগতে প্রবেশ করলেন।
আই.এ পাশ করার পর সিনিয়র বেসিক ট্রেনিং নিলেন। সেখান থেকেই হাই স্কুলে চাকরি। এই বেসিক ট্রেনিংয়ের সময়ে ডি.আই বীরেন গুপ্ত পুজোর ছুটির কাজ হিসেবে প্রবন্ধ লিখতে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গোরায় প্রাচ্য বনাম পাশ্চাত্যের সংঘর্ষ, শরৎ-সাহিত্যে শিক্ষাপ্রসঙ্গ, আধুনিক ভারতের পথিকৃৎ রামমোহন। এই প্রবন্ধ আবদুর রাকিব ছাড়া আর দু-একজন লিখেছিলেন। প্রবন্ধগুলো পড়ার পর বীরেন গুপ্ত খাঁটি সোনা চিনতে ভুল করেননি৷ কে এই আশ্চর্য ছেলে! মুগ্ধ বীরেন গুপ্ত সেদিন প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন তাঁকে৷ তিনি সেগুলো কলকাতার ‘শিক্ষক’ পত্রিকায় পাঠাতে বলেছিলেন। তখন এর সম্পাদক ছিলেন মহীতোষ রায়চৌধুরী। ‘শিক্ষক’ সরকারের পয়সায় চলত। প্রত্যেক প্রাইমারি স্কুলে এর কপি যেত। রাকিব সাহেবের আব্বা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তাই তাঁদের বাড়িতেও এটা আসত।
‘শরৎ-সাহিত্যে শিক্ষাপ্রসঙ্গ’ প্রবন্ধটি তিনি খামে পুরে পাঠিয়ে দিলেন কলকাতার উদ্দেশে৷ সেই শুরু শহরে পেটমোটা খাম পাঠানোর৷ কিন্তু ছাপা হল না। তিনি তখন ভাবলেন, মুসলিম নাম দেখেই কি ছাপল না? এরপর ‘কাজল রায়’ ছদ্মনামে ‘শুকনো পাপড়ি’ নামে একটি গল্প পাঠালেন। সেটা ছাপা হল। এটি তাঁর বেনামে ছাপা প্রথম গল্প। এ্ররপর তাঁর বহু গল্প প্রকাশিত হবে। তবে সেসবই তাঁর প্রথম গল্প!
ইন্না লিল্লাহি…
বুধবার, বিশ্ব নবী দিবস, ২১ নভেম্বর, ২০১৮৷ আসসালাতু খাইরুম মিনান্নাওম…। ভোরবেলায় মুয়াজ্জিনের ডাক শুনে তাঁর ঘুম ভেঙেছিল৷ ফজরের নামায পড়ে রোজকার মতো লিখতে বসেছিলেন৷ লেখা সেরে রওনা দেবেন মহম্মদবাজারের উদ্দেশে৷ সেখানে তাঁর প্রিয় মানুষ হযরত মুহাম্মাদ সা.-কে নিয়ে রয়েছে আলোচনা৷ তিনি লেখা শেষ করে স্নান করে নিলেন৷ উঠোনে এসে দাঁড়ালেন৷ দেখলেন হেমন্তের সকালটাকে৷ উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা কুল গাছটায় ফুল এসেছে৷ সেদিকে চেয়েই বোধহয় তিনি কাপড় শুকোনোর দড়িতে মেলে দিলেন ভেজা গামছাটি৷ ঘাড়ে তখনও রয়েছে লুঙ্গি৷ সেটা আর মেলতে পারলেন না৷ মাথা ঘুরে গেল৷ তিনি পড়ে গেলেন সশব্দে৷ দৃষ্টি চলে গেল উঠোনের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা নারকেল গাছের পাতার দিকে৷ আকাশের দিকে৷ অসীমের দিকে৷ আবদুর রাকিব শেষবারের মতো চোখ বন্ধ করার আগে প্রকৃতি দেখেছিলেন, হেমন্তের সকাল দেখেছিলেন, আকাশ দেখেছিলেন, তিনি অসীমকে স্পর্শ করেছিলেন!
হাসপাতালে নিয়ে গেলেও গাড়ি থেকে তাঁকে নামাতে হয়নি৷ ডাক্তার দেখেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, আবদুর রাকিব আর নেই!
তাঁর মতোই তাঁর মৃত্যুও সরল, স্বাভাবিক, কোনও রকম আড়ম্বর ছাড়াই৷ এই আড়ম্বরহীনতা তাকে চির অম্লান করে রাখবে৷ তাঁর খাটে হ্যাঙারে ঝুলিয়ে রাখা পাঞ্জাবিটি তিনি আর পরবেন না, সেটি তার প্রিয় প্রভুর স্পর্শ আর পাবে না৷ ছায়ানটে আর তিনি নিঃশ্বাস নেবেন না৷ বসবেন না লেখার টেবিলে। লাইলি আপা নানা বিষয় জানতে চেয়ে চিঠি লিখেই যাবেন। শুধু সেসব চিঠির উত্তর দেওয়ার জন্য কোনও ‘পথ-পসারী’ থাকবে না!