Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

“ন্যুনতম সহায়ক মূল্য নিয়ে মোদি সরকার ডাহা মিথ্যা বলেছে”

সাইনাথ

পড়গুম্মি সাইনাথ

 

পিপলস আর্কাইভ অফ রুরাল ইন্ডিয়া-র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এবং কৃষি বিশেষজ্ঞ পি সাইনাথ জানালেন ভারতবর্ষের কৃষকদের ক্রমবর্ধমান সংকট নিয়ে জাতীয় স্তরে বিস্তারিত আলোচনা একান্ত জরুরি। এই লক্ষ্য নিয়েই দিল্লিতে দুই-দিন ব্যাপী কিষাণ মুক্তি পদযাত্রা (২৯-৩০ নভেম্বর)-র আয়োজন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সাংবাদিক শালিনী শর্মার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে পি সাইনাথ ভারতীয় কৃষিব্যবস্থার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করলেন। ৩০শে নভেম্বর সংবাদপত্রে প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকারের ভাষান্তর ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মের পাঠকদের জন্য। তর্জমা— সত্যব্রত ঘোষ।

শালিনী শর্মা : ঋণ মকুব এবং ফসলের সার্বিক মূল্য নির্ণয়ের গ্যারান্টি— এই দুটি বিষয়ে বিল পাস হওয়ার পাশাপাশি কিষাণ মুক্তি মোর্চা এই পদযাত্রা থেকে আর কী আশা করতে পারে?

পি সাইনাথ : দুটি বিলই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এগুলি প্রথম ধাপ। এগুলি পাশ হলেই যে কৃষিক্ষেত্রে সংকট ঘুচবে, তা নয়। আরও অনেক দূর যেতে হবে। কৃষি সংকট কিছুতেই মিটবে না যতক্ষণ আপনি মহিলা কৃষকদের অধিকার এবং মালিকানার প্রসঙ্গগুলিকে আলোচনার থেকে সরিয়ে রাখবেন। কারণ, চাষের কাজে মহিলারাই সবচেয়ে বেশি শ্রম দেন। ২০১১ সালে (অধ্যাপক) এম এস স্বামীনাথন (কৃষিবিজ্ঞানী এবং অর্থনীতিবিদ) যে প্রাইভেট মেম্বার বিলটি (রাজ্যসভায়) পেশ করেন (মহিলা কৃষকদের জল, ঋণ এবং তাঁদের শ্রমের স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে), তার মেয়াদ ইতিমধ্যেই ফুরিয়েছে। আপনি কোনওভাবেই বলতে পারেন না মহিলাদের অন্তর্ভুক্ত না করে আমি এই (কৃষকদের) সংকট ঘোচাব। কারণ, কৃষিক্ষেত্রে যে শ্রমের ভাগ, তার ৬০ শতাংশই আমরা পাই মহিলাদের থেকে। আপনি কোনওভাবেই বলতে পারেন না দলিত কৃষকদের জমির মালিকানা, জঙ্গলে আদিবাসী কৃষকদের চাষের অধিকার অথবা ভাড়াটে চাষিদের অধিকার বিষয়ে প্রশ্নগুলির উত্তর না দিয়ে আপনি সংকট ঘোচাবেন। কারণ, যে অভাবনীয় শোষণ চলছে কৃষিক্ষেত্রে, সেখানে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে এরাই।

এদের সবাইকে প্রাপ্যটুকু দিতে হবে এবং জাতীয় স্তরের আলোচনায় এদের প্রসঙ্গ আনতে হবে। দিল্লির পদযাত্রায় কৃষকদের সমর্থনে মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি বড় অংশকে এগিয়ে আসতে দেখেছি। এটা দিয়ে কিন্তু (আন্দোলনের) শুরু হল, শেষ নয়। আশা রাখি, (এই পদযাত্রা)-টির মাধ্যমে একটি ঐতিহাসিক সূচনা ঘটবে।

শালিনী শর্মা : এই পদযাত্রার মধ্যে অন্য কোন ইস্যুগুলিকে নির্দিষ্টভাবে লক্ষ্যবিন্দু করা হয়েছে?

পি সাইনাথ : (লোকসভার শীতকালীন অধিবেশন)-এ যেন ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (MSP) এবং কৃষকদের ঋণ সংক্রান্ত বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা হয়। এছাড়াও দেশে এখন মারাত্মক আকারে জলসংকট চলছে। জল লুঠ হচ্ছে। বেসরকারিকরণ করা হচ্ছে। মারাঠাওয়ারায় তীব্র জলসংকট হলে সেখানকার মহিলারা ৪৫ পয়সা দিয়ে এক লিটার জল কেনেন। সেই জল মদের কোম্পানিগুলি কিনছে ৪ পয়সা প্রতি লিটার। তিরিশ বছর আগে কিনত লিটার প্রতি এক পয়সা দিয়ে। এখন কেনে চার পয়সা দিয়ে। তারপর প্লাস্টিক বোতলে ভরে কুড়ি টাকা দামে আপনাকে বিক্রি করে।

জলের সংকট এখন এমন বিশাল আকার নিতে বসেছে যে সারা দেশটাকেই গিলে ফেলতে পারে। তুলনায়, খরাসমস্যাও এতটা বড় নয়। জলকে মূলত পাঁচটি উপায়ে স্থানান্তর করা হয় : দরিদ্রদের থেকে ধনীদের কাছে, গ্রাম থেকে শহরে, খাদ্যশস্য থেকে অর্থকরী শস্যে, জীবনধারণ থেকে জীবনশৈলীতে এবং কৃষিক্ষেত্র থেকে শিল্পোদ্যোগে। এই ধরনের হাতবদলি ঘটেই চলেছে। এতে যারা বঞ্চিত হচ্ছে, তাদের কথা কেউ শুনছে না।

শালিনী শর্মা : কৃষকরা যে তাদের দাবিগুলির নিষ্পত্তি ঘটাতে নীতি নির্ধারণের জন্য যে তিন-সপ্তাহ ব্যাপী সংসদ অধিবেশনের দাবি রেখেছে, তার থেকে আপনি কী প্রত্যাশা করেন?

পি সাইনাথ : কৃষিক্ষেত্রে পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট-এর তলানিটুকু ব্যবহারের প্রচলিত ধারাটি অনুসরণ করে দেশের কৃষি সংকটকে আপনি কোনওভাবেই ঘোচাতে পারবেন না। শুধুমাত্র তিন বছরের সময়সীমার জন্য UPA-1-এর আমলে এই প্রচলিত ব্যবস্থাটি সংরক্ষিত ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়োগে ভাটা পড়ে। এই ইস্যুগুলি নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন।

তাছাড়া, এখন থেকে ২০-৩০ বছর পরে আমরা কী ধরনের কৃষিকর্ম চাইব, তা নিয়ে জাতীয় স্তরে একটি বিতর্ক হোক। আমরা কি কর্পোরেট-চালিত কৃষিকাজ চাই, না গোষ্ঠী-মালিকানাধীন চাষ, যা ভারতীয়ত্বের ভিত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত? আপনি কি রাসায়নিক পদ্ধতিতে ফসল ফলাতে চাইবেন, যাতে ক্লাইমেট চেঞ্জের প্রভাব পড়বে না? না কি, কৃষি ও পরিবেশভিত্তিক নীতি (agro-ecological principle) মেনে চাষ করতে চাইবেন? সংসদ ভবনের সেন্ট্রাল হলে কৃষি সংকটে আক্রান্তদের সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে দেশের মানুষদের কাছে ব্যাখা করতে হবে কৃষি সংকট কাকে বলে এবং তাতে আক্রান্ত মানুষগুলি কেমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

শালিনী শর্মা : মহিলা, দলিত আদিবাসী এবং ভাড়াটিয়া কৃষকদের উপর লক্ষ্যবিন্দু স্থির করবার উপর গুরুত্ব নিয়ে বলছিলেন। একটু বিশদে বলবেন ব্যাপারটা নিয়ে?

পি সাইনাথ : এই দেশের ৮ শতাংশের কম মহিলার নিজের নামে জমি রেজিস্টার্ড করা রয়েছে। এর থেকে প্রমাণিত হয় আপনি তাঁদের (মহিলাদের) প্রপার্টি রাইটস স্বীকার করেন না। এমনকি তাঁরা যে চাষবাসে নিযুক্ত, তাও মানতে চান না। আপনি তাঁদের চেনেন চাষার বৌ, চাষার মেয়ে অথবা চাষার মা হিসেবে। অথচ তাঁরাই কৃষিকাজের সিংহভাগ সামলায়। চাষির ছবিটা ভাবলেই আপনার চোখের সামনে ভেসে ওঠে লাঙল কাঁধে একটি পুরুষ, অথবা পাঞ্জাব হলে ট্র্যাক্টর চড়া এক কিষাণ। ছবিটা ভুল বার্তা দেয় কারণ, চাষবাসের অধিকাংশটাই মহিলাদের দ্বারাই হয়ে এসেছে। জমির অধিকারে তাঁদের স্বীকৃতি কতটুকু?

জমি একটা বিরাট ইস্যু। এই গোষ্ঠীগুলির চোখ দিয়ে জমি সংক্রান্ত ইস্যুগুলি না দেখতে পারলে আপনি কোনওভাবেই সংকট ঘোচাতে পারবেন না। ভাড়াটিয়া চাষিদের অধিকার রক্ষার জন্য আইন প্রণয়নের ব্যাপারে কী ঘটেছে? কেউ একটা পা এগিয়ে আসেননি। এমনকি ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ দেওয়া হয় না তাঁদের। আর আদিবাসী কৃষকের কথা বলছেন? একটি নির্দিষ্ট জায়গায় পুরুষানুক্রমে বসবাস করবার পর রাষ্ট্র যখন তাঁদের জিজ্ঞাসা করে “তোমাদের পাট্টা কোথায়? তুমি এখানে এনক্রোচার”, তাঁরা তো চমকে একেবারে আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে। ফরেস্ট রাইটস অ্যাক্ট অনুযায়ী তাঁদের অধিকারের প্রশ্নটিকে যথাযথভাবে কার্যকর করতে হবে।

শালিনী শর্মা : একুশটি রাজনৈতিক দল অল ইন্ডিয়া কিষাণ সংঘর্ষ কোঅর্ডিনেশন কমিটির খসড়া প্রাইভেট মেম্বারস’ বিলটিতে সমর্থন জানিয়েছে। বিজেপি-র অবস্থানটা কোথায়?

পি সাইনাথ : দুটি বিল দুই দিনেই পাস হয়ে যাওয়া সম্ভব। কারণ, ২১টি রাজনৈতিক পার্টি তাঁদের সমর্থন ঘোষণা করেছে। কিন্তু বাকি ইস্যুগুলি নিয়ে আলোচনা করবার জন্য আমাদের তিন সপ্তাহ ব্যাপী অধিবেশন চাই। গত ছয় বছরে বিজেপি বারবার নিজের অবস্থান বদলেছে। ওরা নির্বাচনে জিতেছিল এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে উৎপাদনের খরচের পাশাপাশি ৫০ শতাংশ (ন্যূনতম সহায়ক মূল্য, স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী) দেবে। তারপরে গত দুই বছরে ওরা পাঁচ-ছয়বার অবস্থান বদলেছে। এবং MSP-র ব্যাপারে ডাহা মিথ্যে কথা বলেছে। বিলটিতে সম্মতি দিয়ে যদি কার্যকর করে, তাহলে ভালো।

নেশন ফর ফার্মারস-এর পিটিশনটিতে সাক্ষর করবার জন্য সংসদের সব সদস্যদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। “দিল্লি চলো” ওয়েবসাইটে পিটিশনটি আপলোড করা হয়েছে। দেশের রাষ্ট্রপতিকে এই বিশেষ অধিবেশনটি আহ্বান করবার জন্য আবেদন জানাচ্ছি আমরা।

শালিনী শর্মা : দিল্লির পদযাত্রা কি তেমন সাড়া ফেলেছে, যা মুম্বাইতে নাসিক থেকে কৃষকদের ‘লং মার্চ’ ফেলেছিল?

পি সাইনাথ : এত বিভিন্ন ধরনের মানুষ পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করেছিল যে আমরা বিস্মিত। বৈজ্ঞানিক, ব্যুরোক্র্যাট, ডাক্তার, শিক্ষকদের পাশাপাশি ছাত্র স্বেচ্ছাসেবীরাও ছিলেন। অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই এসেছিলেন প্রাক্তন সেন্ট্রাল ইনফরমেশন কমিশনার শ্রীধর আচারিয়ুলুর প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের বিজাতীয় মনোভাব (Strategic Lawsuits Against Public Participation বা SLAPP-এর আন্তর্জাতিক ধারা মেনে মামলার হুমকি দেওয়া)-এর বিরুদ্ধে ঐকমত্য জানানোর জন্য। নাসিক থেকে মুম্বাই পদযাত্রা আমাদের প্রেরণা দিয়েছে।  সেদিন জে জে হসপিটাল থেকে ডাক্তাররা এসে কৃষক, শিক্ষকদের চিকিৎসা করেছেন। কলেজের ছাত্ররা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছে। সাধারণ মানুষরা অংশগ্রহণকারীদের জন্য খাবার এবং জলের প্যাকেট বিলি করেছেন। সেই মুহূর্তে আমি কৃষকদের প্রতি সমর্পিত একটি জাতিকে চোখের সামনে দেখি। এভাবেই ওখানে ফোরামের ভাবনাটার জন্ম।

প্রত্যেকটি শহর নিজের মতো করে নেশন ফর ফার্মারস-এর প্রচারে নেমেছে। ২০টি রাজ্যের মানুষ দিল্লিতে এই পদযাত্রায় অংশ নিতে এসেছেন। এই বিরোধিতা কিছুটা সাড়া ফেলেছে কারণ এই সময়ে মধ্যপ্রদেশ এবং রাজস্থানে বিধানসভা নির্বাচন ছিল। রাজস্থানে বহু কৃষক নেতা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মধ্যপ্রদেশের বহু কৃষক বুধবার নিজেদের ভোট দিয়েই ট্রেনে চেপে দিল্লিতে চলে এসেছেন। দিল্লি সরকারের থেকে আমরা যথেষ্ট সাহায্য পেয়েছি। মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল আমাকে বলেছেন তিনি নিজে এসে কৃষকদের স্বাগতম জানাবেন দেশের রাজধানীতে। এই দেশ তাঁদেরই, এই শহরও তাঁদের। দিল্লি সরকারের পক্ষ থেকে অ্যাম্বুলেন্স, জল সরবরাহ, টয়লেট ইত্যাদি জরুরি পরিষেবার আয়োজন করা হয়েছে।