ঘুম আমার প্রিয়তম যাপন

ঘুম

সোমেন বসু

 

আসমত একজন নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিল।

ছিল শব্দটা অস্বস্তিকর। একটা গল্প শুরু হচ্ছে যার নাম দিয়ে তাকেই সেই গল্পের প্রোটাগনিস্ট আশা করা যেতে পারে। হ্যাঁ, রহস্য না রেখে, তাই-ই। আর তার সঙ্গেই ‘ছিল’-র মতো একটা অস্বস্তিকর ক্রিয়া। কী আর করা..! আসমত যদি না থাকে, সে দায় তো আমার নয়!

আমি দেখতাম আসমতকে। নিরীহ, গোল মুখ। নিরীহ মানুষদের মুখ গোল হয় বেশি। কেমন যেন। আমার দেখার সীমাবদ্ধতা নিশ্চয়ই। নইলে এরকম কোনও জৈব-রাসায়নিক কারণ থাকা তো সম্ভব নয়। অন্তত আমি জানি না।

দেখা যাচ্ছে অনেক কিছুই জানি না! এই এত্তটুকু জ্ঞান নিয়ে একটা গল্প বলতে বসে পড়া কি উচিত? কিন্তু আমার অসীমের গল্পটা বলতে ইচ্ছে করছে। অবশ্য এটাকে ঠিক অসীমের গল্প বলা যায় কিনা সেও আমি জানি না! দুত্তোরি…

…আসমতকে দেখতাম আমি। বাজার করত সকালে। গরমে পটল, ঢ্যাঁড়শ, ঝিঙে, চিচিঙ্গে…। শীতে ওলকপি, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলো…। মাছ। একদিন অন্তর। হঠাৎমটাৎ পরপর দুদিন। সবই অল্প অল্প। সবজি ওই দুশো-আড়াইশো। মাছ হলে তিনের গুণিতক। বেশিরভাগ ছ’টা, কখনও ন’টা। ছোট মাছ। বাটা, পার্শে, ভোলা, ছোট পমফ্রেট, ট্যাংরা…। আসমত ছোট মাছ পছন্দ করত। কাটাপোনা কি কিনত না কখনওই? এক-আধদিন দেখেছি মনে হচ্ছে। অল্প, কারণ, খাদক অল্প। দুই থেকে বছর দেড় দুই হল সোয়া দুই। আসমত, রাবেয়া, আর ওদের বছর দেড়-দুইয়ের মেয়ে। মেয়েটার নাম কী রেখেছিল ওরা? আবার জানি না! বা, জানতাম হয়তো, এখন মনে পড়ছে না।

এই মেয়েটা অসীমের নির্বিরোধী গোল মুখে একটা পরিবর্তন এনেছিল। নইলে ওর মুখ তো আর কী! ঐ ওর জীবনের মতোই একঘেয়ে। রেখা টেখা কম। তাই ভেতরের অনুভূতির পরিবর্তন বিম্বিত হত না ভালো। অনুভূতিও কি ছিল খুব পরিবর্তনশীল? না মনে হয়! ঐ যে বললাম, ওর জীবনটাই ছিল একঘেয়ে। থাক, জীবন অনেক বড় ব্যাপার, মুখের কথা বলি। ওটা থাকত গরমে ঘামের ফোঁটা আর শীতে ছোট ছোট চৌকো ফাটলওয়ালা খসখসে চামড়া দিয়ে সাজানো। কিন্তু বিরক্তিকর নয়। আর পাঁচটা একঘেয়ে জিনিস সচরাচর যা হয়ে থাকে। বরং অনেকটা গঙ্গার হাওয়ার মতো। একঘেয়েই, তবে আরামদায়ক। মেয়ে হওয়ার পর সেই একঘেয়ে মুখেই আমি একটু তেলের ছোপ লক্ষ করেছি। কপালে, গালে। এলোমেলো পায়ে হাঁটতে শেখা মেয়েটাকে নিয়ে আসমত বেরোত এই গলির মধ্যে। কখনও বিকেলে, কখনও সকালে। ওর ডিউটি অনুযায়ী। হাত ছেড়ে দিত। আর সতর্ক, স্নেহার্দ্র এবং কিছুটা বিস্মিত দৃষ্টি মেলে দেখত শিশুটির টলমলে পদক্ষেপ। মেয়েটা কারও বাড়ির অপরাজিতা, নয়নতারা গাছের কাছে যেত। নাগালে থাকা ফুলগুলো ছিঁড়তে চাইত। কখনও কারও দরজা খোলা থাকলে সিধে সেঁধিয়ে যেত ভেতরে। তখন ও হাঁ হাঁ করে আসত। না না বাবা… ফুল ছেঁড়ে না; যায় না যায় না বাবা… দাদীরা কাজ করছে এখন…। এসব বললেই ততোধিক জোরে হাঁ হাঁ আসত বাড়িগুলির ভেতর থেকে। নিক নিক… কেন বারন করো? কিচ্ছু কাজ করছে না… আয় তো মা…। এ পাড়ার মুসলিম মেয়ে বউ বাচ্চা এবং কিছু প্রৌঢ়ের কাছেও অসীমের মেয়ে একজন ভালো সঙ্গী হয়ে উঠেছে। কোনওদিন না দেখলে তাদের কেউ কেউ এমনকি রেবাদের ফ্ল্যাটে এসেও খোঁজ নিয়ে যায়।

এসবই দেখতাম আমি। যেমন দেখেছিলাম এই হিন্দু পাড়াটায় যখন আসমত ফ্ল্যাট পছন্দ করল তখন তার চাচা-চাচী ইয়ার-দোস্তরা সতর্ক করেছিল। আসমত গা করেনি। রাবেয়াও। রাবেয়া তো একান্তে আসমতকে হালকা ঠুকতেও ছাড়ত না এ নিয়ে।

–কোন যুগে পড়ে আছে বাবা তোমার চাচাচাচীরা…
–বয়স্ক মানুষদের অমন একটু হয়…
–হ্যাঁ, তোমার চাচাচাচীরই খালি বয়স হয়েছে! আমার আব্বু তো কলেজের ছোকরা…

রাবেয়াদের বাড়িতে এক হিন্দু পরিবার ভাড়া থাকে। ওদের সঙ্গে সুসম্পর্ক যথেষ্ট। শোনা যায় ওনাদের যখন ভাড়া দেওয়া হয়, তখন পাড়ায় টুকটাক নঞর্থক কথাবার্তা গরম ভাপের মতো এদিক সেদিক জমেছিল। রাবেয়ার বাবা যথেষ্ট দাপুটে মানুষ। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। ফলে সেসব কথা চরিত্রধর্ম বজায় রেখেই যথেষ্ট সরব হয়নি, আর ওটুকুকে তিনিও কোনও পাত্তা দেননি। রাবেয়ার এটা বেশ গর্বের জায়গা। বাপের বাড়ির গর্ব, বাপকে নিয়ে গর্ব, অসাম্প্রদায়িকতার গর্ব। দেশটা সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ হলেও এ বিষয়টা এখনও গর্বের বলেই গণ্য হয়।

অসীমের কাকা বলেছিল–

–আসলে কেমন একটা সন্দেহ যেন থাকে ভেতর ভেতর! ঠিকঠাক মিশ খায় না…
–চেষ্টাও যে খুব হয়, তা তো নয় কাকু…
–সেও কথা বটে! ওই সব মিলিয়েই আর কী…!
–না কাকু… আর কিছুই না। ওখানটায় দামটাও কম। ফ্ল্যাটটাও রেবার পছন্দ হয়েছে। দক্ষিণ-পুব খোলা। নিয়েই নিচ্ছি ওটা…
–ঠিক করেই ফেলেছিস? আচ্ছা… নে…। আর অসুবিধা হওয়ার কথা না। ওই পাড়াটুকুনই তো যা। এছাড়া চারপাশে তো পুরো আমরাই…

হেসেছিল দেখেছিলাম আসমত। গোলপনা শান্ত মুখে একটা আলগা হাসি।

–দেখেছ চাচা, তুমি রাজনীতি করা লোক। কম তো হিন্দু লোকজনের বাড়ি যাওয়া, তাদের বাড়িতে খাওয়া এমনকি দাঙ্গার সময়ে হিন্দু পাড়া পাহারা দেওয়া এসব করোনি! সেই তুমিও ওরা আমরা ছেড়ে বেরোতে পারছ না…

কুঁকড়ে যেতে পারত আসমতের চাচা, বিনা টিকিটে ধরা পড়ে গিয়ে স্টেশনভর্তি লোকের সামনে যেমন যায় কোনও ভদ্রবেশী লোক, বা জ্বলে উঠতে পারত তেলেবেগুনে ভাজতার এমত আস্পর্ধা দেখে, কী যে করেছিল দেখা হয়নি সেটা!

তারপর থেকে এই। এই ফ্ল্যাটবাড়ি, ফ্ল্যাটে রেবা আর মেয়ে, ফ্ল্যাটের বাইরে কানাগলি, ঢালাই করা, গলির দুপাশে দশ-পনেরোটা বাড়ি, বাড়িগুলিতে লোকজন, অসীম-রেবার মতোই, ছাপোষা, জীবনকাটানো, মোটের ওপর একঘেয়ে, বাড়িগুলিতে ছোট ছোট ফুলগাছ, অপরাজিতা, নয়নতারা, তাতে ফুল ফোটে, ঝরে।

আর আসমতের অফিস। অফিস না, জেল। রূপক না, আক্ষরিক। আসমত জেলপুলিশ, আবার, ছিল।

আমি দেখতাম আর ভাবতাম। ভাবতাম এগুলো স্ববিরোধ। আসমতের মতো নিরীহ গোলমুখের লোক কেন ছোট মাছ খাবে? বড় পাকা মাছ খাবে ও! পেটির পিস, কাঁটা বাছার ঝামেলা নেই। কিন্তু ছোট মাছে কাঁটা বেশি তো! সেরকমই, ও কেন জেলপুলিশ হবে? কেরানি কেন নয়? এটাও ভাবতাম, স্ববিরোধ নিয়েই তো মানুষ। ভাবতাম, এই বিরোধগুলো আসমত ওর চরিত্র অনুযায়ী মীমাংসাও করে নিয়েছে তো। ও ছোট মাছের কাঁটা বাছে না, সবশুদ্ধু চিবিয়ে নেয়। মাছের মাংসের মধ্যে ছোট ছোট লুকিয়ে থাকা কাঁটা একটা একটা করে বেছে বিদেয় করার স্বভাব ওর নয়, বরং ও যেন সেগুলোকেও আত্মস্থ করে নিতে উৎসাহী। চাকরিটাও অমনই। পুলিশ হলেও, জলপুলিশ স্থলপুলিশ রেলপুলিশ বা আরও যা যা হয়, তার মধ্যে এই জেলপুলিশদের জীবনটাই বোধহয় শান্ত সব চেয়ে, পুকুরের জলের মতন, বাইরের প্রকৃতি খুব খেপে না গেলে সেখানে ঢেউ ওঠে না।

ঠিক ভাবতাম কি? জানি না…

তবে দেখতাম। আমি দেখি সব…

যেমন মাঝেমাঝেই দেখি ঐ ছেলেটাকে। নতুন যে রোল-চাউমিনের দোকানটা হয়েছে, বিকেল থেকে রাত অব্দি বেচাকেনা চলে, ভালোই হচ্ছে বিক্রিবাটা, সেই দোকানটায় এই ছেলেটা একের পর এক রোল ভাজে। গাঁ গাঁ করে জ্বলতে থাকা পাম্প স্টোভ, তার ওপর বিশাল চাটু, সবই গনগনে, তার সামনে কয়েকঘণ্টা টানা দাঁড়িয়ে ঘামতে ঘামতে ছেলেটা রোল ভাজে। আমি দেখি ওর মুখটা। বিশেষ করে, এগ রোল ভাজার সময়। গোল পরটার একটা দিক গরম তেলে চেপে চেপে ভাজার পর পরটাটা উলটে দিয়ে তার সাদা দিকটায় কটাস করে একটা ডিম ফাটিয়ে ছেড়ে দেয় তার হলুদ কুসুমটাকে। তারপর হাতের ছান্তা দিয়ে কুসুমটাকে নাচাতে থাকে। আর এই গোটা প্রক্রিয়াটায় ওর মুখের, হ্যাঁ আমি মন দিয়ে খেয়াল করে দেখেছি, একটা রেখাও কাঁপে না! আরে ডিমের কুসুম… সে তো নিউক্লিয়াস! সেটাকে এরম খেলাচ্ছিস, নাচাচ্ছিস… তাতে তোর মুখে কোনও স্পন্দন ঘটবে না! ঘটে না…

আমি এটা জানি যে ঐ ছেলেটা নিউক্লিয়াস-ফিয়াস জানে না। এটাও জানি, যে একটা মৃত কোষের নিউক্লিয়াস নিয়ে আমার মতো অকাজের লোকেদেরই কেবল মাথা ঘামানো সম্ভব।

কিন্তু, ঐ যে মুখের সামান্যতম স্পন্দনও না ঘটা, এ আসমতের বস দুজনেরও ঘটেনি দেখেছি। কাছের বস, মানে জেলার সাহেব, আর দূরের বস বা বসের বস, মানে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব।

ওরা রোল ভাজে না। রোল ভাজা ছেলেটার সঙ্গে কোনও মিলই নেই।

আসমতের কাছে ফোনটা এসেছিল সকালবেলা। ও তখন সিমেন্ট-বাঁধানো গলিটার মধ্যে কিছুটা অবাক কিছুটা মুগ্ধ হয়ে আত্মজার টলমলে পদচারণা দেখছিল।

সচিব মশাই হঠাৎ হাজির হয়েছিলেন জেলে। জেলারসাহেব সহ বাকি গোটা জেলকে শশব্যস্ত করে।

ভেতরের সিপাইরা অবশ্য জানতে পারেনি সে সময়। পরে গেট সিপাইদের থেকে শুনে থাকতে পারে।

সকালের ফাইল হয়ে গেছিল তখন। কয়েদিদের সকালের বরাদ্দ আধঘণ্টা আকাশ দেখার সময়টা হল সকালের ফাইল জেলের পরিভাষায়, বিকেলেও আছে ওরম, সে বিকেলের ফাইল। ফাইল আসলে হাঁটু গেড়ে সারিবদ্ধ হয়ে বসে গুণতি দেওয়া। তা এই ছাড়া পাওয়ার সময়গুলোর আগে এবং পরে এই গুণতি দিতে হয় বলে সময়টার নামই ফাইল হয়ে গেছে। সে যাই হোক, সকালের ফাইল মিটে গেছিল তখন, ওয়ার্ড ডিউটির দুজন সিপাই উঠোনের বেদিটায় বসে খৈনি মলতে মলতে গল্প করছিল। এই উঠোনেই একটু আগে ঐ ওয়ার্ডগুলোর ভেতরে থাকা লোকগুলো লাইন করে দাঁড়িয়ে অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে এক ডাবু শুকনো চিঁড়ে, কয়েকটা করে ছোট ছোট পোকা আর এক ইঞ্চি গুড় নিয়ে গেছে। আর এই বড় উঠোনের পাশ দিয়ে ঢুকে যাওয়া সরু ব্যালকনিটার পাশে যে ছোট ছোট গোটাকয়েক খুপড়ি, ওগুলো সেল, ওখানে যারা থাকে তাদের এসব সকাল বিকেলের রুটিন নেই, ওদের আকাশ নেই, কারণ ওরা বিপজ্জনক। জেলের পক্ষে কেউ কেউ, মানে জেলের শান্তিশৃঙ্খলা নষ্ট করে, হইচই করে, অন্যদের সঙ্গে মারামারি, বা হয়তো কোনওদিন চিঁড়ের মধ্যে পোকার সংখ্যা একটু বেশি থাকলে বা দুপুরের ভাতডালের মধ্যেও সাদা সাদা কিছু জীবকে ভেসে বেড়াতে দেখলে চেঁচামেচি করে খাবার ছুঁড়ে ফেলে দেয়, তখন তাদের এই সেলে ঢুকিয়ে সবক্‌ শেখানো হয়ে থাকে। আর কাউকে কাউকে বাইরে থেকে রাষ্ট্রই বিপজ্জনক বলে দেগে পাঠায়। এখন আছে সেরকম একটা সেলে কয়েকজন বিপজ্জনক… লোক না, ছেলেই বলতে হবে। অসীম একদিন রেবাকে রাতে শুয়ে গল্প করছিল, ছেলেগুলো নাকি কলেজে পড়ে। কী একটা মাইনরিটি সন্ত্রাসবাদী ছাত্র সংগঠন করে। হ্যাঁ, মাইনরিটি। আসমতের প্রতিবেশীদের মতো। যারা ওর বাচ্চাটাকে একবেলা দেখতে না পেলে রাবেয়ার কাছে এসে খোঁজ নিয়ে যায়।

তখনও, বোধ করি, এরকম খোঁজখবরেরই পালা চলছিল। সেল ডিউটির সিপাইটা বসেছিল ওই সেলের গরাদটার বাইরে। আর কুটকুট কথা বলছিল ভেতরের বিপজ্জনক ছেলেগুলোর সঙ্গে। সাধারণ দৃশ্য। এই গল্পগুজব, খোঁজখবর, এমনকি কোনও সিপাইয়ের বাড়িতে বিশেষ কিছু রান্না হলে সেও এদের জন্য লুকিয়ে নিয়ে আসতে দেখেছি আমি। ওরা বোধহয় বিপজ্জনকতার মাত্রা বোঝে না।

ওখানেও খোঁজখবরই চলছিল। জেলারসাহেবের অফিস ঘরে, দরজা বন্ধ করে, রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব এবং জেলারসাহেব। বিপজ্জনকতারই খোঁজখবর। বা কম বিপজ্জনকতার। স্বরাষ্ট্রসচিব, তার নাম পারভেজ খান বা প্রশান্ত কুমার যা খুশি হতে পারে, তিনি জেলারসাহেবের কাছে তার জেলের সবচেয়ে নিরীহ, নির্বিরোধী সিপাইটার খোঁজ করছিলেন।

তারপরই ফোনটা গেছিল আসমতের কাছে।

–হ্যাঁ, অসীম… মর্নিং…
–হ্যাঁ… হ্যাঁ… গুড মর্নিং সার…
–শোনো, তোমার শিফটটা আজ একটু চেঞ্জ করা হচ্ছে বুঝলে? আজ মর্নিং-এর বদলে তুমি নাইটটা কোরো…
–ও… আচ্ছা… আচ্ছা…. ওকে সার…

আমি দেখেছিলাম এই গলি, তাতে পাশের দোতলা তিনতলার ফাঁক দিয়ে তেরছা হয়ে পড়া সকাল সোয়া সাতটার রোদ, গলির বাইরের বড় রাস্তা, তাতে ওই সকালের গাড়িঘোড়া-দোকানপাট, বা এই সবকিছুর ওপরে ঐ আকাশটা, তাতে ভেসে বেড়ানো কটা বাউণ্ডুলে মেঘ… সবকিছুই একইরকম ছিল! একইরকম বলতে এই ফোনটা আসার আগে যেরকম, পরেও অবিকল সেরকমই। কিছুই পাল্টায়নি!

বিকেলবেলা বেরিয়ে গেছিল আসমত। রাবেয়াকে টা টা করে, মেয়েটাকে আদর করে। আর দেখিনি ওকে।

দেখতে চাইওনি।

সব দেখতে ভালো লাগে না।

রাতটাকে দেখেছিলাম অবশ্য। আমার ফ্ল্যাটবাড়ির ব্যালকনি দিয়ে যেটুকু দেখা যায়। ঘোলাটে সাদা আলোগুলোর নিচে অলস লেটকে থাকা পিচরাস্তা, তাকে বিরক্ত করে মাঝে মাঝে চলে যাওয়া বিশ্রী ভ্যাটভ্যাট শব্দ করে কোনও উঠতি ক্ষমতার মোটরবাইক, এক-আধটা লরি, ট্যাক্সি, আকাশে আধখাওয়া ঘোলা চাঁদ, হঠাৎ ডেকে ওঠা কোনও কাক,… এই। বৈশিষ্ট্যহীন। স্থির।

পরদিন থেকে কাগজ আর টিভি দেখছিলাম। অব্যর্থ হরফ আর কণ্ঠস্বরগুলো নাগাড়ে বলে যাচ্ছিল, সেই স্থির স্থবির রাতটায় মাইনরিটি জঙ্গি ছাত্র সংগঠনের কয়েকজন বন্দি জেল ভেঙে পালায়। পুলিশ তাদের পিছু ধাওয়া করে এবং এক নির্জন প্রান্তরে তাদের সবাইকে গুলি করে মারে। না না গুলি করে মারে না, এনকাউন্টারে মারে। মোট পাঁচজন। ওদের কাছ থেকে বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। ওরা জেল ভেঙে বেরনোর সময় রাত পাহারায় থাকা একজন সিপাইকে মেরে ফেলে। বীরের মতো শহিদ হয়েছে সেই সিপাই। সরকার এবং রাষ্ট্র তার পরিবারের জন্য অনেক কিছু করবে।

আর দেখিনি। ঘুমোতে চলে গেছিলাম নিজের মেয়ের কাছে। ওকে গল্প শোনালাম। রূপকথার গল্প।

মেয়ে ঘুমোল। আমিও ঘুমোলাম।

আমি সব দেখতে পাই। ভাবিও অনেক কিছু। কিন্তু ঘুম আমার প্রিয়তম যাপন।

এরপর গ্রাম থেকে মিছিল আসতে দেখব বিশাল। মেয়েকে সে রাতে ভূতের গল্প বলে ঘুমিয়ে পড়ব।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

5 Comments

  1. ‘বড় বেদনার মতো’ বেজে গেলো…..
    ভীষণই ভালো লেখা সোমেনদা!

  2. শহিদ হল আসমত। যেন ঘোরের মধ্যে ছিলাম। তবে গ্রাম থেকে আসা মিছিলের আভাস বাস্তবে নিয়ে এল আবার। সত্যি তো নাসিক থেকে শুরু হচ্ছে তুমুল মিছিল। পরবর্তী প্রজন্মকে সেই গল্পে উদবুদ্ধ করবার কথা বলে গেল যে সে ঘুম ভাঙানিয়া। তাকে প্রণিপাত।

  3. আদ্যন্ত রাজনৈতিক এই গল্পে বিষয় ও নির্মাণ হাত ধরাধরি করে চলে। গল্পের শেষ হলে জড়িয়ে ধরে বিষাদ। সেই বিষাদের বুকের ওপর দিয়ে আবার একটা মিছিল এগোচ্ছে…।

Leave a Reply to নাহার তৃণা Cancel reply