প্রতিদ্বন্দ্বী

অলোকপর্ণা

 

 

এমন অনেক মানুষ আছে যারা বাসে বা গাড়িতে উঠলে তাদের গা গোলায়। অনেক মানুষ এমনও আছে— লিফটে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বা এরোপ্লেনে যাদের দম আটকে আসে। আবার অনেক মানুষ পথচলতি গু দেখে ঘেন্না পেয়ে আগে রাস্তায় থুতু ফেলে, তারপর পাশ কাটিয়ে হেঁটে চলে যায়। একইভাবে আমার সামনে যে লোকটা এখন বসে আছে তাকে দেখে আমার পা থেকে মাথা অবধি রাগে দাউদাউ করে জ্বলছে।

ঘণ্টা দেড়েক হল লোকটা আমার ঠিক উল্টোদিকে রাখা চেয়ারগুলোর একটা দখল করে বসে আছে। বাকি চেয়ারের মানুষেরা আসছে এবং যাচ্ছে। শুধু আমরা অনড়। গত দেড় ঘণ্টা ব্যাপী। গত দেড় ঘণ্টায় আমি দু বোতল জল খেয়েছি। একবার বাথরুম ব্যবহার করেছি। দুজন বন্ধুকে ফোন করেছি— একজনের থেকে চন্দনকাঠের দাম ও অপরজনের থেকে কোষ্ঠকাঠিন্যে আমলকির রস কোনও উপকার করতে পারে কিনা জানার জন্য। লোকটা কাউকে ফোন করেনি গত দেড় ঘণ্টায়, এমনকি বুকপকেট থেকে উঁকি মারা ফোনটা একবারের জন্যে বের করেও আনেনি— একটুও জল খায়নি, অতএব একবারও বাথরুমে যায়নি গত দেড় ঘণ্টায়। লোকটাকে দেখামাত্র আমার সারা গা হাত পা চিড়বিড়চিড়বিড় জ্বলছে। কেন— জানি না।

আমার আশেপাশে অনেকগুলো চেয়ার এখন খালি, তবু ঠিক আমার পাশের চেয়ারে এসে বসল আরেকজন মানুষ। একে দেখে আমার কোনও রাগ হল না, বিরক্তি এল না, ঘেন্না পেল না, দুঃখ, বিষাদ, তৃষ্ণা, জিগীষা, জিজীবিষা, তিতিক্ষা, বিবমিষা কিছুই হল না। আমি নিশ্চুপ বসে থাকলাম। সাদাটে মানুষটা আমায় জিজ্ঞাসা করল, “বাঙালি?”

মাথা নাড়লাম।

উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে মানুষটা বলল, “আমিও! শুনলামআপনিফোনেবাংলায়কথাবলছেন তাইনাএসেপারলামনা।”

মাথা নাড়লাম।

“কতক্ষণবসতেবলেছেআপনাকে? আমিতোসেইসকালথেকেএসেবসা। বাড়িতেলুচিমাংসআলুপোস্তকরেরেখেগেছে রান্নারমাসি, সবগরমবলেফ্রিজেঢোকাইনি, চলেএসেছি, কাছেরথেকেকাছে… ভাবলামইন্টার্ভিউয়েরপরেফিরেসবফ্রিজেঢোকাব, কিন্তুদেখুনএখনওবসিয়েরেখেছে, কোনওমানেহয়! সবনষ্টহয়েগেল! শনিবারএকটুআরামকরেলুচিমাংসনাখেলেচলে বলুন! বাঙালিরছেলেবলেকথা! তাআপনিকোথায়থাকেন?”

“এই কাছেই…”

“আচ্ছাখুবভালো, খেয়েএসেছেনতো?”

“হ্যাঁ”, মাথা নাড়লাম আবার।

“এখানেতোমাছইপাওয়াযায়না। মাছখানতো, মাছ?”

“হ্যাঁ”, যদিও খাই না।

“কীভালোমাছপাওয়াযায়বলুনআমাদেরওখানে! এখানেকীসবম্যাকারেলশার্ক। শার্কআবারমাছনাকি! চিংড়িভাবুন! উফ, বলতেইজিভেজলআসছে, হাহা, কি আসছেনা?”

“আসছে”, যদিও জিভ শুকনো।

“আরমিষ্টি! এইসবকীছাঁইপাশমাইসোরপাক! ছোঃ! মুখেদেওয়াযায়না, ছিঃ! আমাদেরনলেনগুড়েরসন্দেশ, বাচমচম, বাছানারজিলিপি, খেলেবলুনএদেরকীঅবস্থাহবে! বামিষ্টিদই!”

চোখ গোল গোল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে সাদা মানুষটা।

অতএব হাসতে হল, সম্মতিসূচক। মানুষটা নিশ্চিন্ত হল সমর্থন পেয়ে। তারপর হঠাৎ করে আমার কানের কাছে এসে বলল, “দেখুনদেখুন সামনেরলোকটারগায়েকোনওলোমনেই! অদ্ভুতনা?!”

আমার চোখে একশো ওয়াটের আলো জ্বলে উঠল। সত্যিই উল্টোদিকে বসে থাকা রাগ উদ্রেককারী লোকটার গায়ে কোথাও কোনও লোম নেই। এমনকি ভ্রূও প্রায় আবছা। শুকনো কবজিতে হাতঘড়ি লেগে আছে। শার্টের প্রথম বন্ধ বোতাম উপড়ে কোনও রোম জেগে নেই। লোকটার কোনও জুলপি নেই। গোঁফের রেখা নেই। দাড়ির হদিশ নেই। মাথায় রয়েছে অবিন্যস্ত অনেকটা চুল, ইন্টারভিউ দিতে আসার আগে যার বিন্যাস আবশ্যক ছিল। তবে কি লোকটার গায়ে কোনও লোম না থাকায় তাকে দেখে আমার গা জ্বলছে?

ইন্টারভিউ রুম থেকে নাম ধরে ডাকা হয়, “সুতনু হালদার…”

“এইডাকছে! দেখিগে কীবলে!” সাদাটে মানুষটা উঠে যায়।

আবার চেয়ারসমূহে আমি আর লোমহীন লোকটা। গত দেড় ঘণ্টায় লোকটা কারও সাথে কোনও কথা বলেনি। ব্যাগ থেকে ফাইল বের করে মার্কশিট সব এনেছে কিনা মিলিয়ে দেখেনি। কবজিতে লেগে থাকা হাতঘড়িতে ঝুঁকে পড়ে একবারও সময় দেখেনি। লোকটা চুপ করে আমার উল্টোদিকে রাখা চেয়ারগুলোর একটা দখল করে বসে আছে তো বসেই আছে। লোকটা গত দেড় ঘণ্টায় নিজের চেয়ারও বদলায়নি। বসার কায়দাও না। লোকটা কি মরে গেছে? লোকটা কি বেঁচে আছে?

ঠিক তখনই লোকটা চেয়ারে বসে বসে পা নাচাতে লাগল।

বেঁচে আছে।

আমার পায়ের নখ থেকে মাথার চুল অবধি দপদপ করে জ্বলে উঠল তার পা নাচানো দেখে।

সুতনু হালদার ফিরে এসেছে। একটু মনমরা দেখাচ্ছে তাকে। জিজ্ঞেস করলাম, “এখানে গন্ধলেবু কোথায় পাওয়া যায় জানেন?”

“নাতো! আমিতোকোলকাতাগেলেনিয়েআসিসাথেকরে, পাতিলেবুসবজায়গায়পাবেন, গন্ধলেবুশুধুআমাদেরওখানেই!” সুতনু হালদার তার হারানো উচ্ছ্বাস ফিরে পেয়েছে।

“আচ্ছাবলুনতো এইচাকরিটাহয়েগেলেআমায়কিকোলকাতাপাঠিয়েদিতেপারে?”

“আলবাত পারে”, মিথ্যে বললাম।

“বলছেনতো?!”

“অবশ্যই!” সুতনু হালদারকে মিছে আশ্বাস দিতেই একটা অদ্ভুত তিরতিরে আনন্দ তৈরি হল আমার ভিতরে ভিতরে।

মনের সুখে সুতনু হালদার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে গভীর শ্বাস নিতে লাগল।

তারপর হঠাৎ সোজা হয়ে বসে আড়চোখে উল্টোদিকের লোকটাকে দেখতে দেখতে আমায় বলল, “আচ্ছা লোকটারচুলনকলনয়তো?”

“মানে পরচুল?”

“হ্যাঁ! হ্যাঁ!”

আড়চোখে আমিও উল্টোদিকের লোকটার দিকে তাকালাম। একশো ওয়াটের আলো জ্বলে উঠল আমার চোখে। অবশ্যই লোকটার চুল নকল। এই কারণেই তা অবিন্যস্ত! লোকটার গায়ে সত্যিই তাহলে একফোঁটা রোম নেই। যৌনচুলও নেই… নেই? সজাগ হয়ে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। সুতনু হালদারও পাশে বসে কিছু বলছে না। উল্টোদিকের লোকটা পা নাচাচ্ছে ধীরে ধীরে। বুঝতে চাইলাম লোকটা মনে মনে কোনও গান আওড়ে পা নাচাচ্ছে। অথবা কোনও গান নয়, এমনিই হয়তো কোনও তালের সাথে তাল মিলিয়ে পা নাচাচ্ছে। কিন্তু পা নাচাচ্ছেই। পা নাচিয়েই যাচ্ছে। এক নাগাড়ে। নির্বিকার মুখে। হাত নড়ছে না। চেয়ারটাও নড়ছে না। শুধু পা দুটো নড়ছে। প্রকাণ্ড রাগে আমার পা থেকে মাথা অবধি গরম হয়ে উঠছে। আমার ইচ্ছে করছে উঠে গিয়ে লোকটার অবিন্যস্ত চুল সব খামচে ধরে মাথা থেকে উপড়ে ছিঁড়ে নিয়ে আসি।

কিন্তু লোকটা পরচুল পরে আছে। অতএব চুলে টান পড়লে তা সহজেই হাতে উঠে আসবে বুঝে ভিতরে ভিতরে আমার রাগ আরও ঘনীভূত হচ্ছে।

“বাড়িশেষকবেগিয়েছিলেন?”

সুতনু হালদারের প্রশ্নে ঘোর কাটে, “বাড়ি… গত বছর…”

“ওমাসেতোঅনেকদিনহল! বাড়িতেকেউনেই?”

“আছে, বাবা মা দাদা বৌদি আর দুজন বিড়াল।”

“মনখারাপকরেনাবাড়িরজন্য? পুজোরসময়?”

“তেমন করে না, এখানে বন্ধুরা আছে”, কোনও বন্ধু নেই— মিথ্যে বললাম।

সুতনু হালদার সন্তুষ্ট হল না। “আমিতোবছরেচারপাচঁবারকোলকাতাযাবই যাব! কেউআমায়আটকাতেপারবেনা। কোলকাতারসঙ্গেকিছুরতুলনাহয়নাকি, বলুন? হাহা! তাইতোএইসুযোগছাড়তেপারলামনা।”

এরপর সুতনু হালদার সুযোগ সম্পর্কে সন্ধান করল ও নিজের মতামত জানাল।

জানলাম সুতনু হালদার অন্য একটা পদে চাকরির আবেদন করেছে। আমি যে পদে আবেদন করেছি তার জন্য বিশেষ অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন নয়। শরীরে লোমহীন লোকটাও কি একই পদের জন্য ইন্টারভিউ দিতে এসেছে? শরীরে ক্রোধ উদ্রেককারী লোকটা কি আমার প্রতিদ্বন্দ্বী? তাই কি আমার এত ক্রোধ তার প্রতি?! একশো ওয়াটের আলো জ্বলে উঠল আমার চোখে। লোকটা তখনও পা নাচিয়ে চলেছে একনাগাড়ে। লোকটার চোখে চশমা!

এই প্রথম আমি লোকটার চোখের দিকে তাকালাম। তার চোখদুটো এখন মাটিতে কিছু একটা দেখছে। চোখের ওপরে যে চশমা তার ফ্রেমের রঙ মেরুন। কাঁচ বেশ মোটা। আমার ইচ্ছে হল উঠে গিয়ে লোকটার চোখ থেকে চশমাটা একটানে খুলে ফেলে মেঝেতে ছুঁড়ে মারি। আর কাঁচ ভেঙে খানখান হয়ে যাক! দৃশ্যটা ভাবতেই নিজের ভিতরে একতিল শান্তি বয়ে গেল।

সুতনু হালদারকে জিজ্ঞেস করলাম, “সিনেমা দেখেন?”

“হ্যাঁ দেখিতো! হান্ড্রেটপার্সেন্টলাভসিনেমাটাদেখলামকালকেরাতে, বউয়েরসঙ্গেবসে। কীমজারসিনেমা! দেখেছেন?”

“না… দা এক্সপেরিমেন্ট নামে একটা সিনেমা হয়েছিল বেশ কিছু বছর আগে, দেখেছেন?”

“নাতো… আমিআসলেবাংলাসিনেমাইদেখিখালি… তা কীছিলতাতে?”

“একদল মানুষকে নিয়ে একটা নিরীক্ষা করা হয়… একদলকে জেলে বন্দি করে রাখা হয় আর আরেকদল মানুষকে পাহারাদারির দায়িত্ব দেওয়া হয়। এবং বেশ কিছু দিন ধরে তাদের ব্যবহারের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করা হয়।”

“তারপরকীহল?”

“কিছু না… জীবন যেমন হয় আর কি… আচ্ছা আপনার কি মনে হয়, যদি আমাকে ক্ষমতা দেওয়া হত, যদি আমাকে নিষেধ করা না হত, তবে কি আমি উঠে গিয়ে ওই লোকটাকে খুন করে ফেলতে পারতাম?”

“কেন! কেনখুনকরবেন!?” সুতনু হালদার ভয় পেয়ে গেছে।

হেসে বললাম, “এমনিই, ওকে দেখে সেই সকাল থেকে আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে, তাই আর কী…”

সুতনু হালদার চুপ করে গেল। আমি সুতনু হালদারের গা থেকে ভয়ের গন্ধ পাচ্ছি। উল্টোদিকের লোকটা তখনও পা নাচিয়ে যাচ্ছে।

টের পেলাম, অদ্ভুতভাবে ভয়ের গন্ধটা আমার রাগ প্রশমিত করে দিচ্ছে। আমি সুতনু হালদারের কোল ঘেঁষে বসলাম। গভীরভাবে তার গা থেকে বেরোনো ভয়ের গন্ধ নিয়ে আমার বুক ভরে তুলে আমিও পা নাচাতে শুরু করলাম, উল্টোদিকে বসে থাকা রোমহীন মানুষটার পা নাচানোর তালে তালে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

5 Comments

Leave a Reply to নাহার তৃণা Cancel reply