এক বহমান ধারায় অবগাহন যেন

Neil MacGregor

রুদ্র সেন  

 

বিশ্বের অতি আধুনিক ইতিহাস প্রত্যক্ষ করলে বোঝা যায় যে সমাজ সংসার যে সদা পরিবর্তনশীল তার বহমানতার সাপেক্ষে যে ঘটনাগুলোর বিন্যাস মানুষের নিজের আর জগতের ইতিহাস বারবার পরিবর্তন করছে তা হল বিশ্বাস বা belief system. সারা বিশ্বব্যাপী আজ হিংসার অস্থিরতার রন্মোত্ত রূপ আমরা দেখে চলেছি, ২য় বিশ্বযুদ্ধ পটসড্যাম কনফারেন্সে শেষ হলেও যুদ্ধ কোনওদিন বন্ধ হয়নি। আর এটাই আক্ষেপের যে বিশ্বের বহুদেশ আজও নিজেদের মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুদ্ধে ব্রতী।

পরিবর্তন হয়েছে শুধুমাত্র যুদ্ধের আছিলার- দুর্যোধনের মতো ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী’ সূচক যুদ্ধের কান্না তেমন আজ নেই। মানুষ যত সুসভ্য হয়েছে, যত তার বৌদ্ধিক বিকাশ ঘটেছে ততো তার আগ্রাসনের মাত্রার মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে। এখন যুদ্ধ চলছে নিজ বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ, নিজের মান্য মানতা চাপিয়ে দেওয়ার একটি পাশবিক সমাধানের জন্য বিশ্ব তৎপর। এক্ষেত্রে ধর্ম বিশ্বাসের ভূমিকাই সবচেয়ে আলোড়ন তোলে। কারন ক্রুসেড পরবর্তী সবচেয়ে বড় সংগঠিত ধর্মযুদ্ধ আজ বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। এই যুদ্ধের দাবানল আর ঘৃণার জগদ্দল পাথর বারবার বিকৃত করে চলেছে আমাদের সুশীল সমাজকে। আর আজকের বিশ্বব্যাপী অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ থেকে ভারতও নিজেকে বাঁচাতে পারেনি। সেই সূত্র ধরে সুশীলসমাজের মনে এই প্রশ্নটা আসা খুব স্বাভাবিক ধর্মবিশ্বাসের আড়ালে থাকা খোদা, আল্লা, ভগবান আর গডদের মাতব্বরি করা এই সমস্তটার শুরু কি করে হল।

বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে Neil MacGregor-এর ভগবানের এই এই সুলুক সন্ধান করাটা খুব একটা অপপ্রয়াস না। ‘Living with the Gods’ আমাদের মগজাস্ত্রের মরচে ধরা অংশগুলিতে তেল দেওয়ার উদ্দেশ্যে একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজ। লেখক বিশ্বাসের শুরুর একদম প্রথমদিকের হালহকিকত দিয়ে শুরু করেছেন তাঁর এই বিশাল কর্মকাণ্ডের। আদিম বর্বর মানুষ ধীরে ধীরে যখন প্রকৃতিকে একটু একটু করে আয়ত্তে আনছে তখন থেকেই তার নিজস্ব ক্ষমতা নিয়ে বারবার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। আগুনের ব্যবহার কখনো তার ক্ষমতা আস্ফালনের ভিত্তি হয়েছে কিন্তু তার সাথে সাথে নিরালম্ব অবস্থায় প্রকৃতির কাছে তার সমর্পন তাকে কিছু কিছু জিনিস ভাবাতে শিখিয়েছে। জীবন সংগ্রামের আদিম অবস্থায় যখন খাদ্য সংগ্রহ একমাত্র চিন্তার ভিত্তি হওয়া প্রয়োজন ছিল তখন অন্য কিছু ভাবতে পারাটাই হয়ত আধুনিক কালের বিলাসিতার সমতুল। তাও মানুষ অন্য কিছু ভেবেছে, সমানে নিজের মধ্যে কথা বলেছে সেই অজানা এক বিশাল অস্থিত্বের সাপেক্ষে যা কিনা সে নিজেও প্রত্যক্ষ করেনি। অজানা সেই অস্থিত্বের সাথে নিরন্তর সে কথোপকথন একটি বিশ্বাসের জন্ম দিল, যে বিশ্বাস কিনা পরে কল্পনা করে নিল অতিপ্রাকৃতিক সেই শক্তিশালী অস্থিত্বের যা কিনা তৎকালীন আদিম উপাচারে মানুষকে অস্তিত্বের সঙ্কট থেকে মুক্তি দেয়। ভগবানের বিশ্বাসের প্রথম ভিত্তি স্থাপিত হয়। বর্তমান তুর্কির Gobekli Tepe আমাদের সেই আদিম ধর্মবিশ্বাসের প্রথম পীঠস্থান। প্রত্নতাত্ত্বিক বিচারে অত্যন্ত আধুনিক এই আবিষ্কার বিবর্তনের ধারাকে বহুলাংশে ব্যাহত করেছে। জার্মান প্রত্নত্ত্ববিদ Klaus Schmidt এর ১৯৯৪ এর Gobekli Tepe এর পুণঃখনন মানুষের বিশ্বাসের ইতিহাসই বদলে রেখে দেয়। মানুষের সংগঠিত ধর্মাচরণ-এর প্রাচীনতম নিদর্শন এটি যার কিনা সূত্রপাত হয় ১০ মিলেনিয়াম বি সি থেকে।

তেমনই আরেকটি অদ্ভুত আবিষ্কার হয় ১৯৩৯-এ ২য় মহাযুদ্ধের ঠিক শুরুতে। জার্মান প্রত্নবিদ Robert Wetzel আর ভূতত্ত্ববিদ Otto Völzing হলস্টেইনের গুহা থেকে আবিষ্কার করে বসেন cave mammoth এর দাঁতের তৈরি একটি প্রত্নকর্ম, মানুষের মতো দাঁড়িয়ে থাকা সিংহের মুখবিশিষ্ট একটি প্রাণীর, যা কিনা পরে The Lion Man হিসেবে পরিচিতি পায়। যুদ্ধ পরবর্তী গবেষনায় ফুটে ওঠে ৩০,০০০ বছর আগে গুহামানবের কল্পনায় মনুষ্যরূপী একটি সিংহের অবয়ব আসলে কোন ধর্মাচরণের বশে বহুযুগ ধরে পূজিত হয়েছে। তাই মানুষের এই বিশ্বাসের ধারায় সিঞ্চিত হয়ে ধর্মাচরণ-এর এই মেঠোপথ ধীরে ধীরে রাজপথে পরিণত হয়। আর ধর্মাচরণ-এর সেই বিচিত্র আয়োজনকে নিয়েই ‘Living with the Gods’।

ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত এমন শতাধিক আয়োজনের মাধ্যমে পৃথিবীর ধর্মাচারন আর ঈশ্বর বিশ্বাসের ধারণাকে সম্পূর্ণতা দিতে এই বই অগ্রনায়কের ভূমিকা পালন করবে। ক্ষিতি অপ: তেজ মরুৎ ব্যোম এর ব্যাপ্তি নিয়ে আমাদের সম্যক বিশ্বাসের ধারণা কীভাবে বিভিন্ন যাঁতাকলে বারবার পেষিত হয়ে বর্তমান বিশ্বাসের ভিত্তি রচনা করেছে তা এক কথায় অনবদ্য। হিন্দু শাস্ত্রের বহু ঈশ্বরের ধারনা থেকে শুরু করে গ্রিক, রোমান দেবদেবীর প্রান্ত ধরে ইসলামিক আর খ্রিস্টান মতাদর্শে বিশ্ব প্লাবনের ধারা Neil MacGregor সুনিপুণ দক্ষতায় ধরার চেষ্টা করেছেন। Godless Society নির্মাণে Anthony Grayling ভূমিকা বারবার আলোচিত হয়েছে। নিজের একান্ত বিশ্বাসের নামে জগৎব্যাপী যে নরমের যজ্ঞ সমানে চলেছে তার দাওয়াই হিসেবে Anthony Grayling এর কথা আজও প্রাসঙ্গিক। কিন্তু শীত যুদ্ধের আবহে ঈশ্বরবিশ্বাসী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর নাস্তিক সোভিয়েতের পার্থক্য বোঝাতে মার্কিন ডলারে ‘In God We Trust’ এর মূদ্রণ সেই ধর্মাচরণের সংহত যুক্তি প্রয়োগের আধুনিকতম নিদর্শন। বর্তমানে ইসলামিক স্টেটের হাত ধরে কিম্বা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নিজের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার যে নগ্ন কর্মকান্ড আমরা প্রত্যক্ষ করলাম তার জন্য বারবার মনে হয় আদিম মানুষের আত্মরক্ষার তাগিদে তৈরী নিজের সেই একান্ত বিশ্বাস আজ সংকটকালেই উপস্থিত।

কোন একটি বিশ্বাসের তাবেদারী না করে নিঃস্বার্থভাবে এক বহমান ধারাতে যেন লেখক আমাদের স্নান করাতে চেয়েছেন, শুধুমাত্র নিজেদের চৈতন্য বিকাশের উদ্দেশ্যে। আর প্রচ্ছদে বিপ্লবী ফ্যারাও আখনাতেনের স্মিতহাস্য এক চিলতে মুখ বইটির একটি অদ্ভুত সমাপতন, সেই মানুষটির দৌলতে যিনি কিনা সম্ভবত বিশ্বের ইতিহাসের সর্বপ্রথম একেশ্বরবাদের প্রণেতা।

Living With The Gods
Neil MacGregor
Publisher: Allen Lane
Price: ₹699/-

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...