বুবুন চট্টোপাধ্যায়
কত রকম, কত বিষয়ের বই। কত রঙের ভাবনা। হাজার খানেক স্টল। লক্ষ খানেক লেখক। দু, আড়াই মাইল জুড়ে শহরের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় দশদিন ধরে চলছে বইয়ের উৎসব। সন্ধেবেলা ভিড় দেখলে ভিরমি খাওয়ার জোগার। এমন দৃশ্য খুব অনায়াসেই প্রতিবছর কোলকাতায় রচিত হয়। বইমেলা কোলকাতাবাসীর হকের ধন। তারা অবাক হন না। তারা জানেন এমনটাই তো হওয়ার কথা। তাই হচ্ছে। কিন্তু ভিড় থেকে সরে গিয়ে একটু ভাবলে অবাক না হয়ে উপায় কী? বই নিয়ে এমন উন্মাদনা দশ-এগারো দিন হওয়া অত সোজা নয়। কোন রাজ্যে, কোন শহরে হয় বলুন তো? কিন্তু এ রাজ্যের জেলায়, জেলায় গেলেও এখন সে আগুনের ওম পাওয়া যায়।
বইমেলায় চিরদিনই আমি একা যাওয়া, একা ঘোরায় বিশ্বাসী। তাতে নিজের মতো বই দেখার আরাম এবং ফুরসৎ দুইই পাওয়া যায়। কাল মেলায় অনুষ্টুপ, তালপাতা, প্রতিক্ষণ বিভিন্ন স্টলে গিয়ে বইপত্র উলটে একটি জিনিসই বারবার মনে হচ্ছিল যে এখন বেশ কিছু প্রকাশক বই নিয়ে বেশ পরীক্ষানিরীক্ষা করছেন। এমনকি হারিয়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপি পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রেও তাঁরা এখন অনেক বেশি সজাগ। যেমন— তালপাতায় দেখলাম গিরিশ ঘোষের সাক্ষাৎকার বিষয়ক একটি বই। একই সঙ্গে আশ্চর্য ও মুগ্ধ হলাম। থিমা কল্যাণী দত্তর সেকাল বিষয়ক একটি অসামান্য বই করেছে। এবার মেলায় আর একটি উল্লেখযোগ্য বই প্রকাশ হল গুরুচণ্ডালি থেকে যশোধরা রায়চৌধুরীর সম্পাদনায় ‘লক্ষ্মীর পাঁচালি’। সাবেক লক্ষ্মীর পাঁচালিকে এইসময়ের লেখিকারা কোন দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখছেন তাই পয়ারে গাঁথা। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বই।
বেশিরভাগ নতুন, নতুন প্রকাশক একটি কথা সম্যকভাবে বুঝেছেন বাজারে টিকে থাকতে হলে প্রোডাকশানের ক্ষেত্রে জোর দিতে হবে। প্রচ্ছদ থেকে পশ্চাদ্ একটি আভ্যন্তরীণ রুচির ছোঁয়া রাখতে হবে। না হলে বাজারে টিকে থাকা মুশকিল। সব দেশের, সর্বকালের লেখকেরা তো এটাই চান। বই ছাপার কাজে যতবেশি শিক্ষিত লোকের প্রবেশ ঘটবে তত বেশি লাভ। কারণ বলাই বাহুল্য বইব্যবসা এবং আলুর ব্যবসার মধ্যে বিস্তর ফারাক। কিন্তু বইব্যবসায় শিক্ষিত, সজ্জন প্রকাশকের পাশাপাশি অশিক্ষিত, ভুঁইফোর প্রকাশকও কম নেই। উঠতি লেখককুল তাদের সফট টার্গেট। পয়সা ফেলুন নাম, যশ, খ্যাতি সবকিছু দেওয়ার জন্য তারা বসে আছেন। কী লিখছেন, কেন লিখছেন সেসব সেইসব লেখককুল জানে। প্রকাশকের কাজ শুধু লেখকের টাকার বিনিময়ে সাহিত্যের হাটে লেখককে লাইমলাইটে আনা। এত দ্রুত সাহিত্যিক খ্যাতি পেয়ে যাওয়া নতুন লেখকের কাছেও সোনার ডিমের মতোই আকর্ষক ঠেকছে। জীবিতকালে বিখ্যাত হতে কে না চায়?
“মহাকাল” “ইতিহাস” এই সাইবারের মতো আবছা জগতে কেউ মনে রাখবে না। এই প্রকাশকরা এই সময়ের বাংলা সাহিত্যের প্রভূত ক্ষতি করছেন। বিজ্ঞাপনের আলোয় পাঠককে গুলিয়ে দিচ্ছেন কাকে পড়ব? আর কাকে নয়? লেখক দেবতোষ দাশ বললেন, একটি বই ঘিরে পাঠক এবং লেখক দুজনেরই একধরনের জার্নি গড়ে ওঠে। তবেই একটি বই সার্থক হয়ে ওঠে। সত্যিই একসময় তাই হত। সিরিয়াস পাঠক একসময় যেমন অশোক মিত্রর ‘কবিতা থেকে মিছিলে’ পড়েছে, শঙ্খ ঘোষের ‘ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবাম’ পড়েছে, পাশাপাশি বইমুখী তরুণ-তরুণীরা পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘কথোপকথন’ গোগ্রাস গিলেছে। কথোপকথনের নন্দিনী, শুভঙ্করের কথা হাজার, হাজার প্রেম পত্রে কোট হয়েছে। এরকম হাজার একটা বইয়ের কথা বলতে পারি। কিন্তু সে লেখার পরিসর এখানে নয়।
এবারে মেলায় আর একটি ব্যাপার দেখলাম। ছবি আঁকিয়েদের দেখতে পেলাম না। কেন? বইয়ের সঙ্গে তাঁদের তো কোথাও বিরোধ নেই। অন্তত মাটির অলঙ্কারের বদলে তো ছবি অনেক সুস্বাদু ছিল।
আমরা যারা সারা বছর বই কিনি বইমেলা তাদের ক্ষেত্রে অনেকটাই ভবিষ্যতে কী কিনব তার একটি তালিকা বানানো এবং পছন্দের বই ছুঁয়ে দেখা, কিছু কিছু কিনেও ফেলা। আমার বন্ধু, স্বজনরাও তাই করেন জানি। কিন্তু ভিড়ের বেশিরভাগ মানুষের বেশ-ভূষা, আলাপচারিতা লক্ষ করলে সত্যিই বুঝতে পারি না এরা কেন এসেছেন? ভিড় দেখতে? মানুষ দেখতে? মেলা দেখতে? পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে আমি থেকে দেখেছি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে প্রথম বিশ্বের দেশের পাবলিক ফেস-এর অনেক তফাৎ আছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশ যেমন ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষের চোখে এখনও অপুর মতো বিস্ময়। যেন চোখ দিয়ে সব গিলতে চায়। তার উপর বহু কর্মক্ষম মানুষের কোনও কাজ নেই। বেকার। এই শ্রেণির মানুষেরা মানুষ দেখতে খুব ভালোবাসে। আর একটি মানুষ কীভাবে হাঁটছে, কীভাবে কথা বলছে, এটি এদের কাছে একধরনের নির্দোষ আমোদ। সেই কারণে এখানকার মতো যত্রতত্র রক, ঠেক, পান-বিড়ির দোকান আর কোথাও খুঁজে পাবেন না। এটা তৃতীয় বিশ্বের মানুষের একান্ত আহ্লাদ। প্রথম বিশ্বের মানুষ মানুষকে প্রয়োজন ছাড়া অত পাত্তা দেয় না। তার উপর তাদের স্বভাবে ছোটবেলা থেকে একধরনের প্রাইভেসি বা গোপনীয়তা কাজ করে। অহেতুক হাটে যেতে তারা যেমন প্রয়োজন বোধ করেন না, সেরকম নিজেকে হাট করে দেখানোতেও তাদের মধ্যে একধরনের সঙ্কোচ কাজ করে। কাজেই ওখানে সারা বছর মেলা-ফেলার অত চক্কর নেই। কারণ মেলা করনেওয়ালারা নির্ঘাৎ জানে লোক টানতে পারবে না। কাজ নেই, শুধুই ফুরসৎ এমন লোক ওখানে বিরল। কিন্তু এখানে আমি অনেক নিরীক্ষণ করে দেখেছি এই ভিড়টা সেই ভিড়। কিছু লোক দেখতে ভালোবাসা, আমোদগেড়ে মানুষ রোজ আসছেন। মেলা আর খেলায় এদেশের মানুষের কোনও ক্লান্তি নেই। এই চরম সত্যটি আমাদের জননেত্রী মর্মে মর্মে বুঝেছেন। কাজেই এ রাজ্যে সারাবছরই মেলায় মেলায় একটা উৎসবের বাতাবরণ। ভিড় নেই অথচ মেলা সে যতবড় শত্রুই হোক এ কথা বলতে পারবে না। সর্বত্র ভিড়। উপচে পড়া ভিড়। কারণ মানুষ। এ দেশে মানুষের জন্মনিয়ন্ত্রণ নেই। যেমন বইয়েরও নেই। এই কথাটি কদিন আগে বললেন, বিশিষ্ট সাংবাদিক অনিমেষ বৈশ্য। ঠিকই বলেছেন। বইয়ের বার্থ কন্ট্রোল থাকলে বেশ কিছু হাবিজাবি, বস্তাপচা প্রতিরোধ করা যেত। কিন্তু কে করবে? কার বাপের কটা মাথা। তা ভিড় হোক। মানুষ আসুক। কাতারে, কাতারে মানুষ আসুক। বইমেলা গিলতে। বইমেলাকে চব্যচোষ্য করে খাক। কাল ফেরার পথে বইমেলায় এক ঘোষক বলছেন শুনলাম, “মেলায় যেসব দর্শনার্থীরা এসেছেন…!!!”
ভালোই তো। আরও দর্শনার্থী আসুন। ‘মিও আমোরে’, ‘আরামবাগে’র মাঝে যদি ভুল করে একজন সতীনাথ ভাদুড়ি, আশাপূর্ণা, স্বপ্নময়, কবিতা সিংহ নিদেনপক্ষে বুবুন চট্টোপাধ্যায় ঢুকে যায় তাই বা কম কী!!!
দর্শনার্থীরা আসুন।
মন্দির খোলা।
আমরা আপনাদের অপেক্ষায়।
প্রতিদিন, প্রতিবছর।
জানুয়ারির হাল্কা শীতের সন্ধ্যায়।