রাজ্য বনাম সিবিআই : একটি অনৈতিক পরাজয়ের আখ্যান

রাজ্য বনাম সিবিআই

প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

 

ভালোবাসা ও যুদ্ধে সব কিছুই সঙ্গত। অরণ্যের এই প্রাচীন প্রবাদ সকলেরই জানা৷ কিন্তু রাজনীতিতে? রাজনৈতিক পরিসরে এই যুক্তি কতটা প্রাসঙ্গিক? নীতিবাগীশরা মনে করেন, যথেষ্টই। ভালোবাসা ও যুদ্ধের আড়ালে লুকিয়ে আছে নানাবিধ প্যাঁচপয়জার, চিন্তন, কর্ম, স্ট্র‍্যাটেজি, কূটনৈতিক মারপ্যাঁচ ও সুবিধাবাদী তত্ত্ব। অর্থাৎ এককথায় রাজনীতি। তাই অলিখিতে এই প্রবাদটি রাজনীতির ক্ষেত্রেও সমান প্রাসঙ্গিক ও যুক্তিযুক্ত। প্রাচীন এই তত্ত্বটি নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনার রসদ জোগাল সাম্প্রতিক রাজনীতিতে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় টানাপোড়েন তথা সিবিআই বনাম রাজ্য পুলিশ সংঘাতের বেনজির দৃষ্টান্ত। সেই সংঘাত যা কালক্রমে কেন্দ্র ও রাজ্যের পরিধি অতিক্রম করে পৌছেছিল শীর্ষ আদালতের আঙ্গিনায়। কে ঠিক, কে ভুল তা নিয়ে সম্ভাব্য নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে শীর্ষ বিচারবিভাগ তার সিদ্ধান্ত স্পষ্ট করেছে৷ দিয়েছে জরুরি নির্দেশ। সেই তত্ত্বকেই সামনে রেখে নিজ নিজ মহিমা-কীর্তনে ‘নৈতিক জয়ে’র যুক্তি খাড়া করেছে উভয় পক্ষই। কিন্তু সর্বব্যাপী রাজনীতিতে নৈতিকতা বলে আদৌ কিছু আছে নাকি সে নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। তাই একই সঙ্গে, বারবার প্রশ্ন উঠেছে নৈতিক মানদণ্ডের বাহক প্রকৃত অর্থে কে? কেন্দ্র না রাজ্য? নাকি সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়? নাকি কেউই নয়? যেহেতু রাজনীতিতে সবকিছুই সঙ্গত, সে ক্ষেত্রে নৈতিক জয় বা পরাজয়ের আদৌ কোনও গুরুত্ব আছে কিনা তা ভেবে দেখা উচিৎ! এমন নয় তো যে পুরোটাই নৈতিকতার আড়ালে এক বিরাট প্রহসন? এক রাজনৈতিক ‘ক্যামোফ্লাজ’? সাংবিধানিক ষড়যন্ত্র নাকি তারও বেশি কিছু? বরং একটু তলিয়ে দেখা যাক!

আশির দশকের মাঝামাঝি সারা দেশ জুড়ে কম বেশি বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার উদ্ভব। ওই একই সময়ে তা উঠে আসে পশ্চিমবঙ্গের বাম জমানাতেও। পরে তা ধীরে ধীরে মহীরুহে পরিণত হয় গত ১৫-১৬ বছরে। শুধু বাংলাই নয়, বিহার-ঝাড়খন্ড-ওডিশা ও উত্তরপ্রদেশের মত রাজ্যেও ফুলেফেঁপে ওঠে এই বেআইনি ব্যবসা। কেন্দ্র যে একেবারেই চোখ বুঁজে ছিল এমনটা বলা যায় না। কিন্তু প্রভাবশালী তত্ত্ব ও তার অনুষঙ্গে তারাও ক্লীব, অসহায়। এই দুর্নীতির মৌরসিপাট্টায় মওকা বুঝে শিকড় আরও মজবুত করে বিভিন্ন পঞ্জি-সংস্থাগুলি। সাধারণ মানুষের ভাঁড়ার থেকে শুরু করে প্রশাসন, আইনকানুন, সরকার সবই তাদের মুঠোয়, করায়ত্তে। দুর্নীতির শাখা-প্রশাখায় তাদের বিস্তার ও বাড়বাড়ন্ত। এভাবেই কেটেছে সময়। মাঝে সংবিধানের ন্যুব্জ অলিখিত নিয়মে কেন্দ্রে এবং রাজ্যে হয়েছে সরকার বদল। কিন্তু দাপট কমেনি অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির। নির্বাচনের প্রাক মুহূর্তে সামান্য চাপান-উতোর চোখে পড়লেও তেমন প্রভাব পড়েনি এই বিকল্প অর্থনৈতিক সংস্কৃতিতে। কারণ সেই অর্থে ‘পুনঃ মুষিক ভব’ বলার মত ক্ষমতা কম ছিল তদানীন্তন সরকারপক্ষের। এ এক অদ্ভুত লজ্জা, বিড়ম্বনার ইতিহাস।

রাজ্য বনাম সিবিআই

বাংলায় এরপর আসে ২০১১ সাল। ৩৪ বছরের বাম শাসন ঘুচিয়ে ক্ষমতা দখল করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মা মাটি মানুষে’র সরকার। তার তিন বছরের মধ্যে বড়সড় বিবর্তন আসে কেন্দ্রেও। ১০ বছরের ইউপিএ জমানার শেষে গেরুয়া শিবির দখল করে দিল্লি। গুজরাতের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও সংঘের ঘনিষ্ঠ নরেন্দ্র মোদির হাত ধরে। প্রায় গোটা ভারত জয় সম্পন্ন হলেও বাদ থাকে তার পূর্বাঞ্চল। এরপরেই শুরু হয় অবিজেপি শাসিত রাজ্য দখলের লড়াই। কিন্তু তা এত সহজসাধ্য ছিল না। যদিও হাল ছাড়েনি মোদি। লেগে থেকেছেন৷ আর তার নিদর্শন সিবিআইয়ের মত কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে বেলাগাম দুর্নীতির কথা বলে সেই সব রাজ্য দখলের নকশা চূড়ান্ত করা। নির্বাচনের আগে ও পরে রাজ্যের শাসক দলীয় প্রতিনিধিদের চাপ সৃষ্টি করা।

কলকাতার বুকে ঘটা সাম্প্রতিক ঘটনাটি সেই কেন্দ্রীয় ‘স্ট্র‍্যাটেজি’রই প্রতিফলন৷ অবশ্য রাজ্যের শাসক দলও যে একেবারে ধোয়া তুলসিপাতা এমনটি হলফ করে বলা মুশকিল। তবুও অনিবার্যভাবে ভোটের আগেই ঘটল অঘটন। বেআইনি অর্থলগ্নি দুর্নীতিকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে খোদ কলকাতা নগরপালের বাড়িতে চড়াও হল সিবিআই। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বেনজিরভাবে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার পথ আটকাল কলকাতা পুলিশ। গোটা ভারতীয় রাজনীতি ও প্রশাসনিক জগতে উঠল তোলপাড়। এর আগে কোনও রাজ্যে এভাবে সিবিআই’কে মুখ চুন করানো হয়নি। সে অর্থে বিজেপির রথযাত্রা রুখে দেওয়ার মতনই বড় ঘটনা এটি। পুলিশ কমিশনারকে বাঁচাতে আসরে নামলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী৷ সরাসরি বসে পড়লেন ধর্নায়। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দলীয় নেতাদের উপেক্ষা করে এক সরকারি আধিকারিকের জন্য বসে পড়লেন আন্দোলনে। এও কম নজিরবিহীন নয়। অন্যদিকে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও যত্ন সহকারে সেই আগুনে ঘি ঢালার কাজ শুরু করে দিলেন। শুরু হল যুক্তি ও পালটা যুক্তির মহড়া। একপক্ষ বলল, শীর্ষ আদালতের নির্দেশে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই রবিবার রাতে নগরপালের কাছে গেছিল সিবিআই। ক্ষমতার অপর প্রান্তে থাকা রাজ্য শাসকদলের দাবি, কলকাতা হাইকোর্ট ইতিমধ্যেই এই মামলায় বিশেষ নির্দেশিকা জারি করে বলেছে ১৩ ফেব্রুয়ারির আগে নগরপালের কেশাগ্র স্পর্শ করা যাবে না৷ গোটা বিষয়টিই কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যতাড়িত। কলকাতা পুলিশ ও সিবিআই সংঘাতকে কেন্দ্র করে শুরু হল এবার এক অভিনব দড়ি টানাটানির খেলা। মামলা পৌঁছাল সুপ্রিমকোর্টে। দুপক্ষের বয়ান শুনে শীর্ষ আদালত বেছে নিল ‘মধ্যপন্থা’। জানানো হল গ্রেপ্তার করা যাবে না পুলিশ কমিশনারকে, কিন্তু তাকে তদন্তে সহযোগিতা করতে হবে। অর্থাৎ সাপও মরল, লাঠিও রইল অক্ষত। সেই সুযোগে উভয়পক্ষই সেই রায়কে তাদের ‘নৈতিক জয়’ বলে ঢক্কানিনাদ বাজিয়ে দিল। কিন্তু গল্প কি এখানেই শেষ হল? এটাই কী সেই কাঙ্ক্ষিত মধুরেণ সমাপয়েত? নাহ, গল্প এখানে শেষ নয়। বরং এখান থেকেই শুরু! অজস্র, অসংখ্য প্রশ্নচিহ্ন এল উঠে সেই গল্পের মাঝে। আজও যার তল খুঁজে পাচ্ছে না রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ, পর্যবেক্ষক মহল।

সেই সব প্রশ্নগুলোর দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। গোটা দেশ আজ তন্নতন্ন করে যার উত্তর খুঁজছে।

সারদা-রোজভ্যালি-নারদা-আইকোর, সাম্প্রতিক সময়ে রাজ্য অর্থনৈতিক দুর্নীতির এক একটি ঐতিহাসিক দলিল। খতিয়ে দেখলে দেখা যায় প্রতিটির সূত্রপাত কমবেশি বাম জমানায়। ফুলেফেঁপে ওঠে তৃণমূলের শাসনকালে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মধ্যস্থতা করেছিল কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার। শুরু হয় ইডি, সেবি, সিবিআই দিয়ে তদন্ত। শুরু হয় রাজ্য ও কেন্দ্রীয়স্তরে বহু প্রভাবশালী ব্যাক্তিত্বকে তলব, ধরপাকড়, গ্রেপ্তারি। কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কেন? কেন এতদিন সক্রিয় থেকে আচমকাই মাঝ পথে থেমে গেল তদন্ত? কেন সিবিআইয়ের এহেন শীতঘুম? সেখানেও তো ছিল শীর্ষ আদালতের নির্দেশ। তাহলে তা কি তার অবমাননার দৃষ্টান্ত নয়? কেন আচমকা হাত গুটিয়ে নেওয়া হল? তবে কী রাজ্যের শাসকদলের সঙ্গে কেন্দ্রের হয়েছিল কোনও ‘অদৃশ্য’ আঁতাত? বাড়ানো হয়েছিল কি একে অন্যের প্রতি রাজনৈতিক মুনাফা চরিতার্থের সংকেত? যদি তাই না হয়, তবে কিসের জোরে কেন্দ্রীয় শাসক দল রাজ্য বিধানসভায় দ্বিতীয় প্রধান বিরোধী দলরূপে উঠে আসে? কী করে ভাগ হয় ভোট? ঢাকা পড়ে যায় গেরুয়া ঝড়ে ‘হাত’ ও ‘কাস্তে হাতুড়ি তারা’র মৌরসিপাট্টা? দানের তো প্রতিদানও থাকে। সেই সূত্রেই কি শাসকদলীয় সাংসদদের দুর্নীতিকাণ্ডের তদন্তে নিয়োজিত আদবানির সংসদীয় ‘নীতি কমিটি’ একটা বৈঠকও ডাকতে পারে না? তদন্তের পূর্ণাঙ্গ বিবৃতি প্রস্তুত করা সত্ত্বেও কেন সংসদে পেশ হল না ‘এসটিমেট কমিটি’র বয়ান? কেন দেখা গেল দুর্নীতি নিয়ে কেন্দ্রের বিচিত্র উদাসীনতা?

এখানেই শেষ নয়। এরপরেও উঠে এসেছে প্রশ্ন। এই মুহূর্তে এই যে গোটা দেশের চোখ শিলং-এর দিকে, তা কি সম্পূর্ণ রূপে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত? দেশের আমজনতার দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিয়ে নেপথ্যে চলছে না তো আসন ভাগাভাগির হিসেব নিকেশ? রাজ্যে লোকসভা আসনের সংখ্যা ৪২৷ কেন্দ্রীয় শাসকের ভাগে মাত্র ২টি আসন, যা যথেষ্টই অনুগ্রহসূচক। ২টি বাম ও ৪টি কংগ্রেসের। দুটি দলই কেন্দ্রীয় ও রাজ্যের শাসক দলের কাছে চক্ষুশূলের কারণ। কেন্দ্রীয় শাসক দল প্রথমে দাবি রেখেছিল ২২টি আসন জিতবে৷ কী এমন ঘটল যাতে সেই অংক আচমকাই নেমে এল ১২তে? সূত্র জানাচ্ছে, সিপিএম ও কংগ্রেসের আসন ৬টির প্রতি নজর বিজেপির। ভোট শেয়ারের অংক মেনে সেই ৬টি আসনের দিকে নজর ঘোরাচ্ছে না তো তারা? আসন্ন নির্বাচনে অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় বাংলায় সিপিএম ও কংগ্রেসের অবস্থান দুর্বলতম। তবে কি দুর্নীতি তদন্তে রাশ টানতে মুচলেকা স্বরূপ সেই ৬টি আসন বিজেপির হাতে সঁপে দিতে চাইছে রাজ্য শাসক দল? ভোট দিয়ে ভোট কাটার এই সমীকরণ নিঃসন্দেহে বহুমাত্রিক ও অনুল্লেখিত। উভয় শাসক দলেরই এই পর্দার আড়ালে থাকা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড একাধিক প্রশ্নবোধক সংকেতের জন্ম দেয়।

রাজ্য বনাম সিবিআই

সিবিআই-রাজ্য পুলিশ সংঘাত যতই রাজনৈতিক পরিসরে টানটান উত্তেজনা বা নাটকীয় মুহূর্তের সৃষ্টি করুক না কেন, এই কথা অনস্বীকার্য যে এই প্রবল হইহট্টগোলে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে অবৈধ অর্থনৈতিক তছরুপের ‘সফট টার্গেট’ সারা রাজ্যের নিঃস্ব হয়ে যাওয়া হাজার হাজার সাধারণ খেটে খাওয়া, বঞ্চিত প্রতারিত মানুষের কথা। তাদের কথা কেউ বলে না। তারা শুধু ভুখা পেট ‘আপনা টাইম আয়েগা’র মন্ত্রে দীক্ষিত৷ তারা শুধুই কালের নিয়মে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের চোরাবালিতে তলিয়ে যাওয়া গণতন্ত্রের শেষ নিশান। তাদের অস্তিত্ব বা সাংবিধানিক অধিকার বলতে কেবলই আর্তনাদ ও হাহাকার মেশা জীর্ণশীর্ণ আঙুলে এক ফোটা কালির দাগ! তারা আগে, পরে ও এখনও শুধুই অনৈতিকতার রাজনীতির ‘নৈতিক’ পরাজয়ের আখ্যান। এরপরও এ মামলায় ‘নৈতিক জয়’ নিয়ে আপত্তি ও সওয়াল-জবাবের প্রহর উঠবে দিকেদিকে, বজায় রাখার দোহাই দেওয়া হবে গণতান্ত্রিক ন্যায়বিচারের। আর এখানেই সংবিধানস্বীকৃত সবচেয়ে বড় অবহেলা ও বঞ্চনার নজিরবিহীন ইতিহাসের সূত্রপাত৷

আমানতকারীরা মরিয়া প্রমাণ করিবেন যে এই ‘জয়’ কতটা নৈতিক। বাকিটুকু যা কিছু সময়ের গর্ভে বিলীন। এই আমাদের নৈতিক পরাজয়ের ভাষ্যপাঠ, যা আসলে মনে হয় রাজনৈতিক বাজি জিতবার নৈতিক অবক্ষয়ের দিনলিপি।

‘মেঘে ঢাকা তারা’র পর শিলং পাহাড় জুড়ে আরও একবার বেজে উঠবে দুর্নীতিকাণ্ডের শিকার হাজার হাজার প্রতারিত মানুষের সেই বেঁচে থাকার ‘বধির’ কাতর আর্জি। আমরা যা কোনও দিনও শুনতে পাব না। আমাদের যা কোনও দিনই শুনতে দেওয়া হবে না।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...