মধুময় পাল
লিটল ম্যাগাজিন-এর ছাউনি থেকে শুরু করেছিলাম ঘোরাঘুরি। বরাবরের মতো। এভাবে শুরু সেই কবে, আজ স্পষ্ট মনে পড়ে না। কারও হাত ধরে হয়তো এসেছিলাম। গাঁ-মফসসলের মানুষ শহর এবং ভিড় দেখলে ঘাবড়ে যাই চিরকাল। এই ছাউনিতে স্বস্তি পাই, নিজের জায়গা মনে হয়। এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে, প্রতিষ্ঠান-বিরোধী অবস্থানের জন্য লিটল ম্যাগাজিন শিবিরে। প্রতিষ্ঠান-বিরোধী অবস্থানও একটা প্রতিষ্ঠান। কোনও পক্ষে দাঁড়ানোর ন্যূনতম যোগ্যতা আমার নেই৷ ছোট পত্রিকার গরিব চালায় ঠাসাঠাসি থাকেন বন্ধুরা, আত্মীয়রা, চেনাজানা মুখ সব। ভরসা পাই। এখন তো কর্পোরেট-আক্রান্ত, খাই খাই-গ্রস্ত, হিন্দি আর সেল্ফি-খচিত বইমেলায় এই ছাউনি আমার অভয়ারণ্য। কীভাবে পৌঁছতে হবে তার নির্দেশ আগেই জোগাড় করা ছিল। কাছাকাছি যেতেই রাতুল চন্দরায়ের ডাক শুনলাম। ‘বাতিঘর’। বালতিতে কেটলি লুকিয়ে চা ঘুরছিল। গিল্ডের বর্ডার পেরিয়ে কীভাবে যেন ঢুকে পড়ে। যেমন পারাপার হয়, পাচার হয়। হয়তো এখানে সিভিল-বিএসএফ আছে। রাতুলের আপ্যায়নে চা দিয়ে শুরু হল যাত্রা। এবারের ‘বাতিঘর’-এ তুমুল আড্ডা রাহুল পুরকায়স্থ ও বিভাস রায়চৌধুরীর। রাহুল এক জায়গায় বলছেন, জীবনানন্দকে বোঝার মতো বা বিনয়কে ধরবার মতো মেধা নীরেন চক্রবর্তীর ছিল বলে আমার মনে হয় না। আরও কত কথা। বেশ ইন্টারেস্টিং ‘পশু’ ক্রোড়পত্র। লিখেছেন শিবাজীপ্রতিম বসু, মোহিত রণদীপ, হিন্দোল ভট্টাচার্য, মতিয়ুর রহমান প্রমুখ। ‘কালধ্বনি’-র টেবিল এড়ানো সম্ভব নয় কখনই। এবারের সংখ্যা সীমান্ত-দেশান্তর-পুনর্বাসন-নাগরিকত্ব বিষয়ে। এই মুহূর্তে আমরা এই বিতর্ক ও সন্ত্রাসের মধ্যে বাস করছি। লিখেছেন অমিত কান্তি সরকার, মঞ্জিরা সাহা, অম্লান বিশ্বাস, দেবাশিস আইচ, অসিত রায়, সুজাত ভদ্র, দিলীপ রায় প্রমুখ। আসামে এনআরসি আর বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিয়ে লেখাগুলো পড়তেই হবে। ছাউনি ছেড়ে বেরোবার মুখে চোখে পড়ল নকশালপন্থী আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা সরোজ দত্তের জীবন ও কাজ নিয়ে তথ্যচিত্র ‘এস ডি’। প্রতিরোধের সিনেমার টেবিলে। মনে পড়ে গেল, আমাদের বন্ধু অশোক চট্টোপাধ্যায়ের নতুন বই বেরিয়েছে সরোজ দত্ত ও সমর সেনের বিতর্ক নিয়ে। ‘এ ব্রতযাত্রায়/ সরোজ দত্ত ও সমর সেন’। প্রকাশক- ঠিকঠিকানা। সেখানে অবশ্য যাওয়া হয়নি। শেষদিকে এলোমেলো হয়ে যাই। অশোক চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘সাংস্কৃতিক সমসময়’-এর চলতি সংখ্যাটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ভূপেন্দ্রনাথ দত্তকে নিয়ে লিখেছেন বিনয় সরকার, ‘কথা ও কলম: উত্তরবঙ্গের প্রথম নাট্য আন্দোলন’ বিষয়ে লিখেছেন দেবাশিষ চক্রবর্তী। নকশালবাড়ি নিয়ে কাজ করার সময় শিলিগুড়ি যেতে হয়েছিল বছরদুয়েক আগে। তখন কথা ও কলম সম্পর্কে প্রথম জানি। শুনেছি, নকশালপন্থী রাজনীতির সমর্থনে একটি নাটক মঞ্চস্থ করার দায়ে গোটা নাট্যদলকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। তখন অভিনয় চলছিল। ‘পুলিশ কখনও কোনও অন্যায় করে না তারা যতক্ষণ আমার পুলিশ’। আত্মজা-য় এবার নতুন বইয়ের হাট। একটি বই কেনা হল। প্রবীর বিকাশ সরকারের লেখা ‘সূর্যোদয়ের দেশে সত্যজিৎ রায়’, যাতে সত্যজিৎ রায়ের জাপান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, আকিরা কুরোসাওয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ-এর কথা ধরা আছে। গ্রন্থ তালিকা চেয়ে নিয়েছি। বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন আমার প্রিয় জায়গা। কেন জানি না মনে হয় বাংলাভাষা শেষ পর্যন্ত টিকবে ওই দেশেই। বরাবর যেটা করি, এবারও সেটা করতে চাইলাম। বাংলাদেশের প্রকাশনীগুলির গ্রন্থ তালিকা সংগ্রহ। পরে তালিকা ধরে, আবশ্যকীয়তা বুঝে কিছু কিছু করে বই আনিয়ে নেওয়া যাবে। ‘নয়া উদ্যোগ’-এর মালিক বন্ধুবর পার্থশঙ্কর বসু এনে দেন। অনেককাল ধরে। এবার আর হল না। গ্রন্থ তালিকা শেষ সব স্টলেই। সবাই কি আমার কায়দা ধরল? নাকি নিছক ক্যাটালগ কালেকশন৷ এবার অবশ্য আমার বইমেলা যেতে দেরি হয়েছে। অনুজ বন্ধু সৌরভ সেনের ‘সহজ পাঠ’ দারুণ একটা বই বের করেছে। যুগান্তর দৈনিকের একদা বার্তা সম্পাদক দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের অভিজ্ঞতা-সমৃদ্ধ ‘সেইসব দিনরাত্রি/ যুগান্তর এবং আরও কিছু’। কেনা হল না মাঠে। হবে পরে। পুরনো বইয়ের দোকানে বেশ কিছু খরচ হয়ে গেছে আগেই। প্রেসিডেন্সি রেলিং থেকে হারিয়ে যেতে-থাকা বাংলা বইয়ের বিস্ময়কর সম্ভার নিয়ে হাজির হয়েছেন মুরাদ। মনে পড়ে, সুবর্ণরেখা’র দিনগুলো। ইন্দ্রনাথ মজুমদারের রত্নঘর। তেমন বই নেই এখানে যদিও। তবু ভিড় দেখে ভালো লাগে। পুরনো বই প্রকৃত পাঠক টেনে আনে। আমরা যে বইরচিত বইমেলাকে চিনেছি, তার অবশেষ যেন পাই এখানে। এবার সম্ভবত পুরনো বইয়ের চারটি স্টল ছিল। বাকিগুলোতে যেতে পারিনি। কলেজ স্ট্রিটে যাদের বই চাইলেই পাওয়া যায়, তাদের স্টলের সামনে দাঁড়ান যাঁরা, তাঁরা আদৌ পাঠক কিনা এ সন্দেহ আমার বহুদিনের। সেই ছোট স্টলের কাছে যেতে হয়, কলেজ স্ট্রিটে ঘর পাওয়ার সঙ্গতি যাদের নেই, যাদের নিজস্ব আউটলেট নেই। তারা মেলার ভরসায় আসে। তারা বাঁচলে বাংলা প্রকাশনা বাঁচবে। অনেক কষ্টে অন্যরকম একটি প্রকাশনা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন ‘ঊর্বী’ তথা ‘একালের রক্তকরবী’-র প্রদীপ ভট্টাচার্য। কত ভালো বই করেছেন। অবিরাম স্বপ্ন-দেখা মানুষ। স্বপ্ন দেখতে দেখতে নিজেকে ফুরিয়ে ফেলেছেন। বইমেলার মাঠে, নিজের স্টলে দাঁড়িয়ে বই নিয়ে ক্রেতার সঙ্গে কথা বলতে বলতে চলে গেলেন। তখন বিকেল, ৮ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯। আমার দেখা এক আশ্চর্য ড্রিমার। তাঁর স্বপ্নের জোর ছিল, পুঁজির সমর্থন ছিল না। বিদায়, প্রদীপ। যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন।