আমাদের দেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্য…. সত্যি না স্বপ্ন

প্রাথমিক স্বাস্থ্য

মানস গুমটা

 

স্বাস্থ্য এমন একটা বিষয় যেটা দু-চার কথায় বোঝা এবং বোঝানো বেশ কঠিন। সাধারণভাবে জনগণ তার চেতনার মান অনুযায়ী ব্যাখ্যা করলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া সংজ্ঞাই হল সবচেয়ে ছোট এবং সহজবোধ্য। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী, স্বাস্থ্য শুধু শারীরিক নয়, পূর্ণ মানসিক এবং সামাজিকভাবে ভালো থাকা। অর্থাৎ আপনাকে শারীরিকের পাশাপাশি মানসিকভাবেও সুস্থ থাকতে হবে এবং গোটা সমাজকেও সুস্থ রাখতে হবে।

কোনও মানুষ একা একা ভালো থাকার চেষ্টা করলেও সেটা বাস্তবে সম্ভব নয়। তার প্রতিবেশী যদি ভালো না থাকে, তার গ্রাম, তার শহর যদি সুস্থ না থাকে… তার রাজ্য, তার দেশ যদি সুস্থ রাখার, সুস্থ থাকার ব্যবস্থা না করে তবে কারও পক্ষেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া সংজ্ঞায় পৌঁছানো সম্ভব নয়।

সেই কারণেই স্বাস্থ্য কোনও একক ব্যক্তি মানুষের বিষয় নয়… ব্যক্তির ভূমিকার গুরুত্ব থাকলেও, তার সম্প্রদায়ের, তার সমাজের ভূমিকা এবং সর্বোপরি তার দেশ ও রাজ্যের ভূমিকাই তার ভালো থাকার চাবিকাঠি। কোনও ধনী ব্যক্তি সুউচ্চ ফ্ল্যাটে থেকে ভাবতেই পারেন তার সুস্থ থাকার জন্যে কোনও কিছুর দরকার নেই। কিন্তু প্রশ্ন এখানেই যে তিনি কি বাঁচতে পারবেন তার চারিদিকের পরিবেশ দূষণ থেকে? তার ফ্ল্যাটের নিচে অন্ধকার বস্তিতে কোনও রোগের মহামারী হলে, তাকে প্রতিদিন তা মাড়িয়ে গিয়ে তার পক্ষে সুস্থ থাকা কি আদৌ সম্ভব? উত্তরটা অবশ্যই— না। সেই কারণেই স্বাস্থ্যের দায়দায়িত্ব যৌথ… স্বাস্থ্যের জন্যে শুধু দরিদ্ররাই দৌড়বে বা দাবি জানাবে এরকমটা একদমই নয়… বরং ধনী এবং শিক্ষিতদের কিছু বাড়তি দায়িত্ব নেওয়াটাই সময়ের দাবি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেমন স্বাস্থ্যকে সহজভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে, তেমনি তিনটি স্তরে ভাগও করেছে। একটা ব্রেন টিউমার অপারেশন বা একটা জটিল হার্টের অপারেশন এই স্তর বিভাজনের সর্বোচ্চ স্তর এবং এটাকে বলা হয় টারসিয়ারি কেয়ার যেখানে উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গে দরকার ভালো পরিকাঠামো। একইভাবে একটা পিত্তথলির পাথরের অপারেশন, হাড় ভাঙলে প্লাস্টার করা বা ছোটখাটো অপারেশন করে জোড়া লাগানো মোটামুটিভাবে মধ্যবর্তী স্তর বা সেকেন্ডারি কেয়ার বলে ধরা যেতে পারে… যদিও একদম সহজভাবে বোঝার জন্যেই এই উদাহরণগুলো দেওয়া তবুও একটা বিষয় পরিষ্কার একটা জনজাতির খুবই অল্প সংখ্যক মানুষের দরকার পড়ে এই স্তরগুলির চিকিৎসা।

কিন্তু সবচেয়ে জটিল এবং কঠিন স্তরটি হল একদম নিচের, প্রাথমিক বা প্রাইমারি কেয়ার। এটাই হল গোটা বিশ্বের মাথাব্যাথা এবং আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য আলোচনার মূল বিষয়। স্বাস্থ্যই সম্পদ কথাটা যেমন একশো ভাগ ঠিক তেমনই সুস্বাস্থ্যে পৌঁছাতে একদম নিচের স্তরেই যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দরকার এটা স্বাভাবিক বুদ্ধিতেই বোঝা সম্ভব। একটা বাড়ির ভিত যেমন বাড়িটির টিকে থাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত, তেমনি আগুন লাগলে লাফালাফি করার চেয়ে আগুন যাতে না লাগে তার ব্যবস্থা করাটাই যুক্তিযুক্ত।

একটা গাছ সর্বোচ্চ ফল ফুল তখনই দিতে পারে যদি তার পরিচর্চা অঙ্কুরিত হওয়ার সময় থেকেই করা হয়।

ঠিক একইরকমভাবে… প্রাইমারি স্বাস্থ্যের মূল ভিত্তি হল পরিচর্চা করো অঙ্কুরিত হওয়ার সময় থেকে। লালন পালন করো চারা গাছের মতো। তাকে বাঁচাও দূষিত পরিবেশ থেকে। তাকে পুষ্টি দাও। ব্যবস্থা করো সুষম খাবারের। তাকে দাও পরিশ্রুত জল। টিকা দাও যাতে সে বাঁচতে পারে বেশ কিছু রোগের থেকে। একই সঙ্গে তাকে দিতে হবে খেলতে। যাতে বিকাশ হয় মনের। একই সঙ্গে তাকে শেখাতে হবে খাওয়ার আগে হাত ধুয়ে নেওয়ার গুরুত্ব। সবুজ পরিবেশের গুরুত্ব।

গ্রামীণ জনজীবনে খেলার জায়গা, সবুজ পরিবেশ সহজ হলেও, পরিশ্রুত জল এবং শৌচালায়ের অভাব তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির গ্রামীণ জনপদের অভিশাপ। এক বিপুল অংশের মানুষ এখনও বাধ্য হয় দূষিত পুকুর, কুয়ো বা নদীর জল খেতে।

একইরকমভাবে শহরে পরিশ্রুত জলের ব্যবস্থা থাকলেও, নেই খেলার মাঠ, নেই সবুজ প্রকৃতি। আছে শুধু ইট-সিমেন্টের কংক্রিট। আছে বিষাক্ত এবং দূষিত হাওয়া এবং যান্ত্রিক জীবন। খোলা নর্দমা ও বস্তি জীবনের অভিশাপ।

অপুষ্টি আছে। গ্রামেও আছে। শহরেও আছে। গ্রামে আছে দারিদ্রতার অপুষ্টি। পর্যাপ্ত এবং সুষম খাবারের অভাব। শহরে আছে প্রাচুর্যতা, ঘরে তৈরি খাবারের থেকে কারখানায় তৈরি খাবারের প্রতি আকর্ষণ।

সবুজ পরিবেশ যেমন গ্রামীণ জনপদের সম্পদ… অপরিশ্রুত জল এবং শৌচালয় না থাকা তার অসুস্থতার মূল কারণ।

এই আলোচনা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার… আগুন লাগলে তার জন্যে দৌড় ঝাঁপ করার চেয়ে আগুন না লাগতে দেওয়াই একটা সমাজ, একটা জাতি, একটা দেশের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। আগুন নেভানোর খরচ যেমন বেশি… তেমনি একটা স্বাস্থ্যবান জাতিই দেশের সম্পদ তৈরির কারিগর। আলোচনার বিষয়গুলোকে সূত্রায়িত করলেই পাওয়া যাবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যের মধ্যে কী কী আছে….

  1. স্বাস্থ্য শিক্ষা
  2. পরিশ্রুত জল
  3. পুষ্টি
  4. প্রতিষেধক টিকা
  5. প্ৰয়োজনীয় ওষুধের ব্যবস্থা
  6. ছোঁয়াচে রোগের চিকিৎসা
  7. সবার জন্যে শৌচালয়
  8. মা ও শিশুর যত্ন
  9. পরিচ্ছন্ন পরিবেশ….

প্রাথমিক স্বাস্থ্য তাই কোনও একক ব্যক্তির বিষয় হতে পারে না। জনগণকে তার নিজের এলাকার স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন জানতেও হবে, তেমনি রাষ্ট্রেরই মূল দায়িত্ব সমাজকে সচেতন করার। সম্প্রদায়, সমাজ, দেশ, জাতির একটা সমন্বিত যৌথ ভূমিকাই দিতে পারে জনগণের প্রাথমিক স্বাস্থ্য এবং সেখানে রাষ্ট্রের ভূমিকাই মুখ্য হওয়া উচিত।  অর্থনীতির কথাতে… রাষ্ট্র নেবে যাদের আছে… দেবে যাদের নেই। কিন্তু ব্যবস্থা থাকবে সবার জন্যে সমান… প্রাইমারি স্বাস্থ্য পাওয়ার বা দেওয়ার ক্ষেত্রে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে ভাগাভাগি চলবে না। কোনও একটি বিশেষ এলাকায় তার প্ৰয়োজনের ভিন্নতা থাকতে পারে কিন্তু ব্যবস্থা থাকবে সাম্যের নীতিতে। সবার জন্যে। বিভিন্ন সমীক্ষায় এটা প্রমাণিত, শুধু মাত্র পরিশ্রুত জল, স্যানিটেশন, সুষম খাদ্য এবং কিছু রোগের টিকাকরণ এবং মা ও শিশুদের দিকে নজর দিলেই একটা দেশের রোগের বোঝা অর্ধেকেরও বেশি কমে যায়… যেটা আখেরে স্বাস্থ্য খরচে লাগাম পরাতে পারে।

১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কাঝাকস্তানের আলমা আটায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আন্তর্জাতিক সম্মেলন থেকে প্রাইমারি স্বাস্থ্যের জন্যে, জরুরি ভিত্তিতে, সমস্ত দেশ, সমস্ত স্বাস্থ্য কর্মী এবং বিশ্ব কমিউনিটিকে সামিল হওয়ার  আবেদন জানানো হয় এবং ২০০০ সালের মধ্যে “সকলের জন্যে স্বাস্থ্য”র লক্ষ্যে সামিল হতে বলে। এটাই ছিল প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন যা প্রাথমিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব নির্ধারণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অন্তর্ভুক্ত সমস্ত দেশগুলি এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর অঙ্গীকার করে। পাঁচ বছর বাদে অন্যান্য দেশও এই পথেই হাঁটা শুরু করে এবং “সবার জন্যে স্বাস্থ্য” এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যেই যে সবচেয়ে বেশি জোর দরকার সেটা স্বীকার করে নেয়। স্বাভাবিক ভাবেই আলমা আটার ঘোষণা বিংশ শতাব্দীর একটা মাইল ফলক হয়ে দাঁড়ায়। ২০০০ সালের মধ্যে “সবার জন্য স্বাস্থ্য” এই লক্ষ্যে দৌড় শুরু হয় দেশে দেশে। আমাদের দেশও সেই লক্ষ্যে সামিল হয়।

২০১৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ এবং কাঝাকস্থান সরকার ওই দেশেরই আস্থানায়, যৌথভাবে, আলমা আটা ঘোষণার ৪০ বছর পূর্তি উদযাপন করে। ওই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সবার জন্যে স্বাস্থ্যের লক্ষ্যে কতটা পৌঁছানো গেছে, কোথায় ঘাটতি থেকে গেছে তার অনুপুঙ্খ আলোচনা হয় এবং বিশ্ব নেতৃত্বকে সার্বজনীন স্বাস্থ্যের জন্যে আবারও প্রাথমিক স্বাস্থ্যেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার আবেদন করা হয়।

আমাদের দেশ সার্বজনীন স্বাস্থ্যের অঙ্গীকার করলেও তার স্বাস্থ্য অভিমুখ সেই পথে চলেছে বলে মনে হয় না। একই সঙ্গে হাঁটা শুরু করলেও আমাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা আমাদের থেকে বেশ কয়েক কদম এগিয়ে গেছে। এমনকি টিকাকরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও আমরা তস্য গরিব আফ্রিকার বেশ কিছু দেশের থেকে পিছিয়ে আছি। আমাদের সরকার জিডিপির মাত্র ১ শতাংশ খরচ করে স্বাস্থ্যে। তারও বেশিটাই চলে যায় রোগজ্বালা সারাতে। সেই জন্যেই সবচেয়ে বেশি টিবি রুগীর বাস যেমন আমাদের দেশে, সবচেয়ে বেশি অপুষ্ট শিশুও থাকে আমাদের দেশে। টিবি রোগের ওষুধের ব্যবস্থা করলেই যে টিবি নির্মূল হবে না সেটা কে বোঝাবে? মাতৃযান থাকলেও সেই মাকে প্রসব করানোর জন্যে প্রশিক্ষিত কর্মী ও পরিকাঠামোও তো দরকার। কেমন যেন খাপছাড়া ব্যাপার! এখন তো আবার শোনা যাচ্ছে বিমার নামে স্বাস্থ্য খাতের সব টাকাই তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে স্বাস্থ্যব্যাবসায়ীদের হাতে। ভারতের বিপুল অংশের জনগণকে তার প্রাথমিক স্বাস্থ্য কিনতে হচ্ছে নিজের পকেটের টাকা দিয়ে এবং সেই টাকার পরিমাণ প্রায় ৭০ শতাংশ। অপরিকল্পিত শহর, খোলা নালানর্দমা, মশার আঁতুড় ঘর হয়ে রয়েছে। কীভাবে কমাবেন মশাবাহিত রোগ? মা ও শিশুর দিকে নজর না দিলে আমরা কি পারব সর্বজনীন স্বাস্থ্যের দিকে এগোতে? গোড়ায় জল ও সার না দিলে কি ফল ফুল দিতে পারে কোনও গাছ? পরিশ্রুত জল নেই, সুষম খাবার নেই। পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নেই। দূষণের নিয়ন্ত্রণে কোনও জোরদার ব্যবস্থা নেই। আসলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যের সবকিছুই আমাদের দেশে দুয়োরানি হয়ে আছে। আর আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বজনীন স্বাস্থ্য দেওয়ার  চুক্তিপত্রে সই করে বসে আছি। অভিমুখের পরিবর্তন না হলে, প্রাথমিক স্বাস্থ্যে অবহেলা বন্ধ না হলে আমাদের দেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্যের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...