জল

প্রতিভা সরকার

 

দিলদার ঠিকই বলে, মেয়েরা জলের মতো, যে পাত্রে ঢালো তার মতোই হয়ে যেতে হয়, ঘাসবিচালি কাটা পুরনো কলটার বিরাট চাকা দুহাতে ঘোরাতে ঘোরাতে আন্নু ভাবে। না হলে সে আর এই পাহাড়ের মতো চাকা! এত আসুরিক শক্তি লাগে কাজটায়, তবু যে সে তার মধ্যেও এসব ভাবতে পারে এটাই আশ্চর্য। হাতের কনুই বেয়ে টপ টপ ঘাম ঝরে, কপালে ঘের দেওয়া চুলের গোড়া রোদ পড়ে চকচক করে, বিভ্রম হয় বছর বিশেক না কাটতেই মেয়েটার চুলে পাক ধরল নাকি! জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটলেই নোনতা স্বাদ আসে, আর ঝটিতি দু পা একবার জোড়া করেই আবার ফাঁকা করে আন্নু। এঁকেবেকে মেরুদণ্ড ছাড়িয়ে কোমর আর পেটের খাঁজ থেকে ঘাম গড়িয়ে নামছে। পা মাঝে মাঝে জুড়ে নেবার কারণ ঢোলা নোংরা সালোয়ারের কাপড়ে যতটা পারা যায় ঘাম মুছে নেওয়া। পেছনটা একটু অদ্ভুত ভাবে বাঁকিয়ে, একটু বেঁটে হয়ে গিয়ে বার বারই এটা করতে থাকে আন্নু। চুলা-দাপানো আগুনের মতো গনগনে রোদ এড়াবার জন্য উড়নিটা আর একটু টেনে নেয় কপালের ওপর। নিজের ঘামের গন্ধে নিজের নাকের পাটা অল্প ফুলে ওঠে তার।

রাস্তার পাশে নিমগাছের ছায়াঘেরা জায়গাটায় বসে হুঁকো খাচ্ছে গামা সিং, সম্পর্কে আন্নুর শ্বশুর। শ্বশুর বটে, কিন্তু নজর এখন আন্নুর বুক, কাঁধ, হাত মিলিয়ে যে শক্তির আবর্ত তৈরি হচ্ছে তার কেন্দ্রে। শক্তসমর্থ একটা মেয়ের সুঠাম বুকজোড়া কাজের তালে ওঠানামা করছে এর চেয়ে উত্তেজক দৃশ্য গামা সিংয়ের মতো নিকম্মা পুরুষের কাছে আর কী হতে পারে!

গামা সিংয়ের এই অদ্ভুত নামকরণের ইতিহাস আন্নু সবটা জানে না। তাকে এরা মানুষ মনে করলে তো বলবে। এদের কাছে ও একটা পিকদান যাতে খাঁকারি পর খাঁকারি দিয়ে গলার অনেক নীচ থেকে তামাটে কালো হয়ে যাওয়া থুথু পিচিক করে ফেলে গামা সিং আর দিলদার। সে কেবল ভাসা ভাসা শুনেছে গামা পালোয়ানের মতো চেহারা ছিল যৌবনে, তাই গামা সিং। শরীর স্বাস্থ্য এখনও যা আছে তা সামলানোই আন্নুর পক্ষে কষ্টকর। এই ধকল নিতে না পেরেই বোধহয় গামা সিংয়ের রোগা বৌ দেহ রেখেছে। থিতু হবার পর আন্নু তাকে দেখেইনি কখনও, শুধু পড়শিদের কাছে গল্প শুনেছে। প্রথম দিন থেকে আজ অব্দি ঘর বার সে একাই সামলায়।

বিচালি কাটা হলে একটু জিরোয় আন্নু। তারপর কুঁজোতে রাখা আখের রস একটা জাম্বো কাঁসার গ্লাসে ঢেলে গামা সিংয়ের সামনে এসে যখন দাঁড়ায় তখন ঘোমটা নাক অব্দি, চুন্নি গলায় প্যাঁচানো, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বোতাম লাগানো কলার দেওয়া ফুলহাতা আঙরাখার ওপর ছোপ ছোপ ভেজা ঘামের দাগ। আখের রসে মন দেয় না গামা, নিজের চওড়া ছড়ানো উরু দেখায় ছেলের বৌকে,

–ইত্থে আ।

বুনো ঘোড়ার মতো আন্নুর বাঁকানো ঘাড় দেখে বুড়ো ফিচেল হাসে। আবার বলে,

–ইত্থে আ, দের না করিন।

এই শুরু হল নখড়া। আন্নু গজগজ করে। গরুমোষগুলোকে ছাড়তে যেতে হবে গন্না খেতের মধ্য দিয়ে। খেতের সীমানা পার করে যেখানে একগাদা পপলার গাছ, তার নীচে হলুদ সর্ষে চাষ হয়েছে, আর পাশেই নরম কাঠ দিয়ে প্যাকিং বাক্স বানাবার কারখানা, যেতে হবে সেই অব্দি। ফিরে এসে দুপুরের সর্ষোঁ দা শাগ আর গেঁহুর রুটি পাকানো। অথচ আজ রকম দেখেই বোঝা যাচ্ছে সারাক্ষণ তাকে জ্বালিয়ে মারবে বুড়োটা। ছোঁকছোঁক করবে সে যেখানে যাবে সেখানেই। আর এইভাবেই দুপুরের খাবার নিয়ে বসার সময় যখন পাবে আন্নু তখন সূর্য পপলার বনের পেছনে, মাথা দোলানো সর্ষে ফুলগুলোকে প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে।

পপলার গাছ এখানে আসবার আগে কখনও চোখে দেখেনি আন্নু। তাদের মালদাতে অনেক গাছ ছিল, আম জাম কাঁঠাল, নারকেল, ছোট ছোট সবুজ টক ফলের গাছ, সবাই বলত রয়েল, কিন্তু এমন অদ্ভুত রোগা গাছ ছিল না, এই সোনালি পাতায় মোড়া, আবার শীত একটু গাঢ় হতেই পুরো ন্যাড়া! সরু সরু ডালপালা আকাশের দিকে খাড়া হয়ে আছে যেন আঙুল তুলে গাছগুলো কাউকে অভিশাপ দিচ্ছে। ওদের পায়ের কাছে উজ্জ্বল সর্ষেক্ষেত না থাকলে একদলা জমাট কান্নার মতো লাগত পপলার গাছগুলোকে। ভাগ্যিস এখানে প্রায় সব ক্ষেতিতেই সর্ষে চাষ করা হয়, ফলে সারা শীতই ওদের পায়ের কাছে এই ঝকঝকে হলুদ জাজিম পাতা থাকে।

প্রথম প্রথম তার খুব আগ্রহ ছিল গাছগুলোর ধরনধারণে। দিলদারকে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল,

–এই পেড়গুলো অ্যায়সা কিঁউ?

তখন এক ফোঁটা পাঞ্জাবিও জানত না পনের বছরের আন্নু ওরফে অনু। বাংলা মেশানো টুকরো হিন্দিই ছিল তার জবান।

দিলদার তাকে ভেঙিয়ে বলল,

–অ্যায়সা তো অ্যায়সাহি। ওয়ে পপলার দা দ্রাখৎ হ্যাঙ্গে নে।

হাঁ করে তাকিয়ে থেকে আন্নু এইটুকু বুঝে গিয়েছিল গাছকে পাঞ্জাবিতে বলে দ্রাখৎ আর এগুলোর নাম পপলার। কোথায় সে শুনেছে নামটা, ভাবতে ভাবতে উত্তেজিত হয়ে পড়ছিল আন্নু। নাহয় ক্লাস এইটের বইগুলো সাদা টিনের বাক্সে রেখে এসেছিল চৌকির নীচে, কিন্তু মাথাটা তো সাফ ছিল, পালাবার আগে এবং পরেও। ভূগোল বইয়ের পাতাটা চোখের সামনে যেন জ্বলজ্বল করে উঠল, পপলার একটি পর্ণমোচী বৃক্ষের নাম। উত্তরে হিমালয়ের পার্বত্য এলাকা থেকে শুরু করে হিমাচল প্রদেশ হয়ে এই পাঞ্জাব, হরিয়ানা। ভূগোল দিদিমণি অনেক নম্বর দিতেন অনুকে। এতদিন পরেও দিদিমণির চশমা পরা গোল মুখ প্রায় স্বপ্নে দেখা দেয় আন্নুকে। তবে আগের মতো হাসি নেই সেই মুখে। দিদিমণি বলে,

–পালিয়ে গেলি অনু! শুনি তোকে পাচার করে দিয়েছে কোথায়! আহারে, কত ভালো ছিলি ভূগোলে। ভেবেছিলাম তুই অনার্স নিয়ে পড়বি।
–কী করে পড়ব দি?

ঘুমের মধ্যেই আন্নুর ঠোঁট নড়ে,

–কী করে পড়ব বলুন। মা মরে যাবার পর বাবাটা পুরো পালটি খেল। রাতদিন অশান্তি। অথচ আমার চোখে তখন কত খোয়াব! যেদিন সৎমা ঘরে আসবে সেদিনই আমি ভোঁ কাট্টা। আজিনমাসি বলেছিল, ভালো ঘরবর দেখে বিয়ে দেবে, যারা বিয়ের পরও পড়াবে। সে যে নামমাত্র মালাবদল করিয়ে বিক্রি করে দেবে পাঞ্জাবের প্রত্যন্তে এই রঙ্গপুরি গ্রামে যেখানে পাচার হয়ে আসা মেয়েরা বৌ তো বৌ, দাসী তো দাসী, সেটা আমি কী করে জানব বলুন, বলুন দি…

আন্নুর বিড়বিড়ানি আর হাত পা ছোঁড়ায় পাশে শোয়া দিলদার সিং বিরক্ত হয়। সারাদিন ট্রাক চালিয়ে পপলার-প্লাইউড সাপ্লাই দিয়ে কাঁহাতক আর ভালো লাগে রাতে এই নখরা। জোর কনুইয়ের গুঁতো মারে সে,

–ওয়ে বঙ্গালিন…

তারপর গলা নামিয়ে কয়েকটা অশ্রাব্য গালি ঝাড়ে। পাশের ঘরে শোয়া বাপের কান বাঁচিয়ে। সে বুড়োর আবার রাতে ঘুম নেই।

তবু দিলদার সিং লোক ভালো, আন্নু ভাবে। অন্য মেয়ের পেছনে ছোঁকছোঁক নেই, প্রাণে দয়ামায়া আছে। মাঝে মাঝেই ট্রাকের খোপ থেকে বেরোয় আন্নুর জন্য বেণীতে লাগাবার জরির টাসেল, নখপালিশ। শুধু বাপের বদমাশিগুলো যেন আগে দেখেও দেখত না।

ছ মাস পর ছেলের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে গামা প্রথম যেদিন অনুর ওপর চড়াও হয়, সারা শরীরে তামাকের গন্ধ আর নখ দাঁতের দাগ নিয়ে ঘেন্নায় বমি টমি করে সারারাত নিম গাছের তলাতেই বসেছিল আন্নু। ভোর ভোর দিলদার এসে তাকে ঐভাবে বিধ্বস্ত দেখে এবং একটি কথাও না বলে হাতপা ধুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। দুপুরে নিজেই খানা পাকায়, তারপর আবার ঘুমোয়। দুদিন ট্রাকে বসে থাকা শরীর আর দিচ্ছিল না। সেই ঘুম ভাঙে আন্নুর চিৎকারে, কারণ গামার অবস্থা বহুদিন বাদে রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘের মতো। হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে ঘরে ঢোকাচ্ছিল মেয়েটাকে, হঠাৎ লাফ দিয়ে দিলদারের আবির্ভাব। চোখ থেকে তখনও ঘুমের ঘোর কাটেনি, লাল শিরাগুলো যেন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, হুংকার দিয়ে বাপকে বলল,

–ওকে ছেড়ে দাও।

গামা বিপুল মুখ খিঁচিয়ে ছেলেকে বলে,

–ওয়ে পুত্তর, ভুলে গেছিস নাকি, খরিদ করবার টাকা দিয়েছিলাম আমি। শর্ত তো এইই ছিল, না?

দিলদার উত্তেজিত হয় না। চুলা ধরাবার জন্য ডাঁই করা পপলারের ডাল থেকে একটা হাতে তুলে নেয় শুধু। বাপকে বলে,

–তোমার পাইপয়সা আমি শোধ করে দেব। মেয়েটাকে তুমি আর বিরক্ত করবে না।

ছেলের ফুলে ওঠা পেশি, লাল চোখের দিকে তাকিয়ে গামা আর কথা বাড়ায় না। মাঝ উঠোনে আন্নুকে ফেলে রেখে ঘরের ভেতর ঢুকে যায়। উপুড় হওয়া আন্নুর ফুলে ফুলে ওঠা পিঠ অনেকক্ষণ দেখে দিলদার। কেঁদে হালকা হবার সুযোগ দেয় যেন। তারপর ধরে তাকে তোলে, সালোয়ারের ধুলো ঝেড়ে দেয়, জল খাওয়ায়।

সেদিন রাতেই তাকে অনেক বোঝায় দিলদার,

–আমরা জাঠরা দায়ে পড়ে এইরকম করেই থাকি। কী করা যাবে বল, মেয়েছেলে এখানে বড় কম। টাকা দিয়ে খরিদ করে আনতে হয় দূরদেশ থেকে। গরুমোষের মতো। একজন মরদের কত ক্ষমতা যে ক্ষেতিবাড়ি সব একা সামলাবে? গা গরম হলেও বিয়ের পাত্রী পাবে না দূরদূরান্তরের গ্রামেও।

সারাদিনের অত্যাচারে আন্নুর চোখ জড়িয়ে আসছিল, দিলদারের মোটা মাংসপেশি থেকে উঠে আসা উষ্ণতা আর নীচু গলায় কথা বলবার অন্তরঙ্গ ভঙ্গি তার ঘুমভাবকে আরও বাড়িয়ে দিল। ছোট্টবেলায় বাবার বুকের তলে যেমন করে সেঁধিয়ে যেত আন্নু, ঠিক তেমনি করে দিলদারের লোমশ বুকের গন্ধ নিতে নিতে তার কানে আবছা গেল তার কথার রেশ,

–বাবা তোকে আর বিরক্ত করবে না মনে হয়। কিন্তু মাথায় রাখিস মেয়েরা হল গে জলের মতো। যে পাত্রে রাখবে সেই পাত্রের আকারই নিতে হবে তাকে… কুড়িয়া পানি য্যায়সে হন্দেনে। যেড়ে পর্তন হুইচ পাও ওয়াইসি হো যান্দেনে। পালাবার চেষ্টা করেছিস কি মেরে কেটে সুতলেজের জলে ভাসিয়ে দেব। কেউ টেরও পাবে না।

শেষের কথাগুলো মালদায় গরমের দুপুরে কাঁঠালের ভেতরে হাত ঢোকানো মায়ের চারপাশে নীল ডুমো মাছির গুনগুনানির মতো যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসে। তারপরই আন্নু গভীর ঘুমের অতলে তলিয়ে যায়।

টাকাকড়ি কি লেনদেন হয়েছে বাপছেলের মধ্যে খবর রাখে না আন্নু, কিন্তু গামা তাকে আর চূড়ান্ত হেনস্থা করেনি এ ক’বছর। অবশ্য টানা বিরক্ত করায় বুড়োর কোনও আলস্য নেই। উঠোন ঝাড় দিচ্ছে হয়তো আন্নু, পেছন থেকে পা টিপে টিপে এসে কোমর জড়িয়ে এক হাতেই তুলে নিল, আর আন্নু বাতাসে এলোপাথাড়ি চার হাত পা ছুঁড়েও মুক্তি আদায় করতে পারল না। আন্নু মোষের দুধ দুইছে সকালে, দুই উরুর মাঝে ধরা পেতলের ভারী বালতি, পেছন থেকে এসে কলারওয়ালা আঙরাখার গলার ভেতর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিল। শক্ত হাতের মোচড়ে বুক ছিঁড়ে যাচ্ছে মনে হলেও নড়ার উপায় নেই। চলকে দুধ নষ্ট হলে জুটবে চড়, থাপ্পড়, লাথি।

তবে এসবই দিলদার বাড়িতে না থাকলে। আর দিলদারের বাড়িতে না থাকাটা এখন এতই বেড়েছে যে আন্নুর মাঝে মাঝে গামার চোখের দিকে চাইতে সাহস হয় না। আসলে পাঁচবছরে পূর্ণাঙ্গ হয়ে যাওয়া পপলার পুরোদমে কাটা এবং তার নরম কাঠ থেকে ম্যাচবক্স ও প্যাকিং বক্স বানানো চলছে পুরোদমে। সিজনের শেষটা প্রত্যেক বছরই কাজের চাপ দেখে, এবার পপলার জীবনচক্রের পাঁচবছরের শেষ বছর হওয়ায় আরও বেশি দেখছে। এবার পুরনো গাছের জায়গায় বসবে নতুন চারা।

তাই ট্রাক নিয়ে দূর দূরান্তে সাপ্লাই দিতেও যেতে হচ্ছে দিলদারকে। তিন চারদিনেও ফিরতে পারছে না সে। কাজকাম সেরে হাতপা ধুয়ে আন্নু ধোয়া সালোয়ার কামিজ পরে কান খাড়া করে রাখে সন্ধের পর থেকে। রাত গভীর হতে থাকে, কিন্তু চেনা হর্নের আওয়াজ আর কানে আসে না।

বরং পাশের ঘর থেকে নানা অস্বস্তিকর শব্দ ভেসে এসে আন্নুর নিরাপত্তাহীনতা আরও বাড়িয়ে দেয়। কখনও মদের বোতল গলায় উবুড় করার উল্লাস, কখনও জড়ানো গলায় নোংরা গান, আবার কখনও ইত্থে আ বঙ্গালিন বলে প্রথমে তর্জনগর্জন, তারপর কাতর গলায় অনুনয় বিনয় শেষে গামা সিং বিবশ ঘুমোলে তবে দরজা খুলে পেটে জমে থাকা তরল উন্মুক্ত মাঠে খালি করে আসে আন্নু। আর শুকনো পাতার ওপর নিজের পায়ের শব্দে নিজেই চমকে ওঠে। এ তল্লাটে তার মতো খরিদা নারী সবারই ভোগ্যা। মাঠে ক্ষেতে নদীর ধারে চিত করে ফেললেই হল। তবু দিলদার সিংকে লোকে তার দৈহিক শক্তির জন্য একটু হলেও ডরায় এইটুকুই যা বাঁচোয়া।

চাঁদ সেদিন সরু হতে হতে সুতোর মতো, যেন সেদ্ধ ডিম ফালি করা যাবে তা দিয়ে। নিমগাছটায় রাতজাগা কাকের পালক ঝাড়ার আওয়াজ কানে এল আন্নুর। রাত কত হল কে জানে, সাতদিন পার করে আজও দিলদার ফিরল না। আপসোস। পাশের ঘর থেকে ক্রমাগত ধর্ষণের হুমকি আর দেওয়ালে লাথি মারার আওয়াজ এই সবে থামল। ঝুলে পড়া তলপেট খালি করতে যাবার এই তো সময়। আন্নু খসে পড়া ওড়না তুলে মাথায় দেয়। খোলামাঠে উদোম হয়ে বসার সময়ও মাথার কাপড়টি ঠিক রাখতে হবে। নাহলে রীত ভঙ্গ হয়। বাহারে দুনিয়া, বাপ ছেলে এক নারীকে ভোগ করলে, টাকা দিয়ে মেয়ে কিনে তাকে ভঁইসার মতো খাটালে, কোনও রীত ভাঙে না তাতে। দুনিয়া উলটে যায় শুধু মাথায় কাপড় না থাকলে!

ভাবতে ভাবতে আন্নু দেখে মাঠ পেরিয়ে সে সোজা চলেছে প্লাইউড কারখানার দিকে। অন্ধকার আকাশের ঢালে তারার মতো অজস্র আলো। সিমলা পাহাড়ের বসতি। কত মানুষ কত আবেগে রাত জাগছে। তাই সারারাত বাতি নেবে না। কী এক পাগলামি পেয়ে বসে তাকে, অন্ধকারে রাতচরা পাখির মতো শুধু ডানার ঝাপটে সব তুচ্ছ করতে মন চায়। খুব পরিষ্কার না হলেও আন্নু অনুভব করে জলের মতো তার এই অকিঞ্চিৎকর জীবন যে দিকে ঢাল সেদিকেই গড়িয়ে এল এতকাল। আজকের রাতটিই কেমন আলাদা যেন! হঠাৎ মনে হয়, কেমন হয়, আজ যদি সে সুতলেজের ধারে গিয়ে বসে থাকে সারারাত বা সোজা হাঁটতে থাকে পাহাড়ি আলোর দিকে! পপলারের বনে দমকা হাওয়া চলে প্রেতের নিশ্বাসের মতো। সর্ষে ফুলের পরাগ একটা অদ্ভুত গন্ধ বিলোয়। ফিসফিসিয়ে কারা যেন বলে, ভাগ যা আন্নু, ভাগ যা। আরও জোরে জোরে পা চালাতে থাকে আন্নু। যেন গামার অশ্লীল অপমান, দিলদারের ঔদাসীন্য সব ছাড়িয়ে সে ফিরে যাচ্ছে তার কৈশোরের দুনিয়ায়, যখন পত্রমোচী বৃক্ষ সে চোখে দেখেনি কখনও। পাত্রের আকারে বাঁচা তার জন্য আর নির্ধারিত নয় এই জেনে পরম উল্লাসে মাথার কাপড় বাতাসে উড়িয়ে দেয় আন্নু। সে জল হতে পারে, তবে সে হবে বহতা নদীর জল বা ঝর্ণার উতরোল ঢল। পাত্রে বদ্ধ জলের গণ্ডুষ হতে তার বয়েই গেছে। অন্ধকারেই একপাক নেচে নেয় আন্নু, হাওয়ায় তার খোলা মাথার চুল ওড়ে, যেন পপলার বন থেকে বেরিয়ে আসা এক শীর্ণ কিন্তু উচ্ছল প্রেতিনী।

ঠিক তখনই তার পেছনের রাস্তায় ট্রাকের আলো পড়ে। ইঞ্জিনের গর্জনের সঙ্গে কানে আসে চেনা হর্নের আওয়াজ। ছড়ানো পাঞ্জা আর শক্ত মাংসপেশির মুশকো জোয়ান দিলদার এক হপ্তা বাদে ঘরে ফিরছে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4643 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. অদ্যাবধি প্রতিভা সরকারের যে সকল লেখাপত্র পড়ার সুযোগ হয়েছে, তাতে লেখককের পরিব্রাজক রূপটি দেখি। বানিয়ে বানিয়ে শৌখীন গল্প লেখা নয়, লেখক ভারতবর্ষের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর পথে প্রান্তরে পড়ে থাকা জ্যান্ত জ্যান্ত গল্প টুকিয়ে আনছেন -সে সব গল্পে কাদামাটি ঘাম রক্ত লেগে রয়েছে – যা পড়লে আমার মত নাগরিক পাঠক অস্বস্তিতে থাকেন।
    এ কাহিনীও তাই।
    নমস্কার নেবেন।

Leave a Reply to সলিল বিশ্বাস Cancel reply