বাঙালি মধ্যবিত্তের উটপাখি জীবন: ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কী ফল পাবে

আশীষ লাহিড়ী

 

একটা খুব কটু এবং খারাপ কথা বলতে ইচ্ছে করছে। সুধীন দত্তর উটপাখি কবিতার দুটি লাইন— “ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কী ফল পাবে?/মনস্তাপেও লাগবে না ওতে জোড়া।” আমি এক অর্থে খুব আনন্দিত হয়েছি যে বিদ্যাসাগরের মুখে জুতো মারা হয়েছে, বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা হয়েছে। কারণ, আমাদের এই যে মধ্যবিত্ত উটপাখিরা যাঁরা এতদিন ধরে ধরি মাছ, না ছুঁই পানি করে যাচ্ছেন— “ও… ঠিক আছে!” “বিজেপি-আরএসএসের কি এত ক্ষমতা হবে যে আমাদের সংস্কৃতি— হুঁ হুঁ বাওয়া… সে তো চাট্টিখানি কথা নয়— তাতে হাত দেওয়ার…?”— তাদের গালে একটি সশব্দ থাবড়া মেরে গেছে  হিন্দুত্ববাদী কোম্পানি। উত্তর কলকাতার বুকের ওপর ঘটনাটা ঘটল। যেখানে ঘটনাটা ঘটেছে তার সামনেই সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের পুরনো মন্দিরটা, ওখান থেকে পশ্চিমে একশো তিরিশ পা হাঁটলেই জোড়াসাঁকো, বাঙালি সংস্কৃতির পীঠস্থান। ওখানকার লোক বলে আমি খুব গর্ব অনুভব করি। আমাদের বাড়ি ছিল ওর পাশেই— সুকিয়া স্ট্রিটে। তা, আজ সেইখানে দাঁড়িয়েই এদের এত সাহস হল, যে ওরা দেখিয়ে দিল – দেখো, আমরা সবই করতে পারি! হে সংস্কৃতিমান বাঙালি, তোমাদের এই উটপাখির সংস্কৃতিকে আমরা থোড়াই কেয়ার করি।

যে ঘটনাটা ঘটেছে, তার চার আনা-ছ আনার রাজনীতির খোলস ছাড়ালে মোদ্দা যেটা দেখা যাচ্ছে—  একটা ফ্যাসিস্ট গুন্ডাদের দল, তারা কোথায় যাচ্ছিল? তারা যাচ্ছিল নাকি বিবেকানন্দকে শ্রদ্ধা জানাতে, তাকে প্রণাম জানাতে! মাঝপথে তারা কার মূর্তি ভাঙল? না, বিদ্যাসাগরের। তো, এই ঘটনাটা কি বহুকাল ধরে ঘটার অপেক্ষাতেই ছিল না? বাঙালি ভদ্রলোক, সংস্কৃতিবান লোকেরা এটা কোনওদিন স্বীকার করার চেষ্টা করেনি যে, বিদ্যাসাগর আর বিবেকানন্দ দুটো আলাদা পথ। দুটো পথ, দুটো মানুষ। একজন এটা চেয়েছেন, অন্যজন অন্যটা। দুটো কোনওদিনও মেলেনি, মিলতে পারেও না। কিন্তু আমাদের ধামাচাপা দেওয়ার যে সংস্কৃতি, তা দিয়ে আমরা চিরকাল একই ফ্রেমের মধ্যে এদিকে বিদ্যাসাগর— অর্থাৎ যুক্তিবাদী সংস্কৃতি, আর ওদিকে বিবেকানন্দ— অর্থাৎ ধর্ম, ভক্তিবাদ, ধর্মই নাকি আমাদের সব, এই দুটোকে মেলানোর চেষ্টা করে এসেছি। এবং যখনই দিগন্তে কালো মেঘ দেখা গেছে, আমরা উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে থেকেছি।

আমি তাই অমিত শাহকে ধন্যবাদ দেব, এই আরএসএস এবং হিন্দুত্ববাদওয়ালাদের ধন্যবাদ দেব। এরা দেখিয়ে দিয়ে গেল, বলা ভালো মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে গেল, যে আমাদের এই ধামাচাপা দেওয়ার সংস্কৃতি, এই ‘তুমিও ভালো, আমিও ভালো’— এ চলতে পারে না। এটা একটা ক্রনিক বিষফোঁড়ার মতো হয়ে রয়েছে। মাঝেমাঝে পাকছে, অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে, শুকিয়ে যাচ্ছে, আমরা ভাবছি সব ঠিক আছে। কিন্তু এবারে সেই ফোঁড়া একদম ফেটে তার পুঁজ রক্ত গলগল করে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। এ থেকে ফেরবার আর কোনও পথ নেই। উটপাখিরা  চিৎকার করছে— আমি স্টেটমেন্টগুলো পড়লাম— আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি সম্পর্কে ‘ওরা’ কী জানে?— আরে তোমরা নিজেরা কী জানো? বিদ্যাসাগরকে নিয়ে তোমরা কবে কী করেছ? সিপিএম আমলে হত, আমার মনে আছে। ওরা নানারকম চেষ্টা করত। খুব গভীরে যেত না, কিন্তু কিছু করত। কিন্তু রামকৃষ্ণকে নিয়ে, বিবেকানন্দকে নিয়ে, রামকৃষ্ণ মিশনকে নিয়ে আমাদের এই জমানায় পশ্চিমবাংলায় যে অপরিসীম বাড়াবাড়িটা হয়েছে, তার শতাংশ কেন, অযুতাংশের একাংশও কি বিদ্যাসাগরকে নিয়ে হয়েছে? আজকে বিদ্যাসাগরের দুশো বছর উদযাপিত হতে চলেছে। আমি কতগুলো এরকম প্রয়াসের সঙ্গে যুক্ত আছি। বিদ্যাসাগরের যে বাদুড় বাগানের বাড়িটা, ওইখানেই আমার ছোটবেলা কেটেছে। ওই বাড়িতে, দেখলে অবাক হয়ে যাবে, তার গায়ে, বাঙালি ভদ্রসন্তানরাই, পেচ্ছাপ করছে! কেউ প্রতিবাদ করলে বলা হচ্ছে, কী আছে? রাস্তায় তো সবাই করে! তাহলে আমাদের কালচার এই জায়গায় এসে নেমেছে। এই ঘটনাটা বিবেকানন্দ জন্মভিটের সামনে ঘটতে পারত?  রাজনৈতিকভাবে আমরা এই ধামাচাপার কালচার চালিয়ে যাচ্ছি। কোনও না কোনওদিন তো এই অস্বাভাবিকত্বের বিস্ফোরণ হবেই। আজ যেটা প্রকাশ্যে চলে এসেছে, মিছিল করে যারা যাচ্ছিল বিবেকানন্দকে প্রণাম করার জন্য, মাঝপথে তারা বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙে দিয়ে, বিদ্যাসাগরের নামের কলেজকে নষ্ট করে দিয়ে গেল। এই বিদ্যাসাগর সান্ধ্য কলেজের প্রাক্তন প্রিন্সিপাল আমাদের বন্ধু— অভিজিৎ লাহিড়ী, নামকরা পদার্থবিজ্ঞানী, খুবই শান্ত ও যুক্তিবাদী মানুষ। আমি এই ঘটনাটা শুনেই ওকে ফোন করেছিলাম। বললাম, জানো তোমার কলেজে…?  ও বলল, ‘হ্যাঁ শুনলাম একটা গণ্ডগোল হয়েছে’। আমি বললাম, গণ্ডগোল নয়, একদম মূর্তি ভেঙে দিয়েছে! ও খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। তারপর আমি বললাম, শুধু তাই নয়, বিদ্যাসাগরকে জুতো ছুড়ে মেরেছে। তখন ও শান্তভাবে বলল, ‘হ্যাঁ, এটাই তো বিদ্যাসাগরের পাওনা।’ এই জায়গায় অবশেষে আমরা পৌঁছে গেলাম।

কিন্তু এতেও কি আমাদের চৈতন্য আসবে? কেন বলছি কথাটা, বিদ্যাসাগরকে যাঁরা খুব মহৎ বলে শ্রদ্ধা করেন, তাঁদের যদি জিজ্ঞাসা করা যায় যে বিদ্যাসাগর কেন মহৎ, উত্তর আসবে, তিনি বিধবা বিবাহ চালু করেছেন;  তিনি শিক্ষার জন্য যা করেছেন সত্যিই তার তুলনা হয় না। কিন্তু বিদ্যাসাগরকে দার্শনিক দিক থেকে কে বুঝল?  সেই ১৮৫৩ সালে যাঁর হিম্মৎ ছিল, বেদান্তকে এবং বেদান্ত-ঘেঁষা সাংখ্যকে একদম লিখিতভাবে ফলস্‌ সিস্টেম অব ফিলোজফি বলার, তাঁর সাহসের মাত্রা কতটা! প্রমথনাথ বিশী লিখেছিলেন যে বিধবা বিবাহ চালু করতে তাঁর যে সাহস, বহুবিবাহ রোধ করতে তাঁর যে সাহস, বা আরও নানান ব্যাপারে তাঁর সাহসের যে নমুনা পাই, সেই সব কিছুকে ছাপিয়ে যায় তাঁর এই একটা কথা বলার সাহস। এর জন্য হিন্দু পণ্ডিতেরা আজ পর্যন্ত তাঁকে ক্ষমা করেনি, আজ পর্যন্ত। এখনও তাঁদের একটা বড় অংশ বলে, উনি সৎ লোক ছিলেন, মহৎ লোক ছিলেন, কিন্তু ওসব দর্শন-টর্শন বুঝতেন না। আমি নিজের কানে শুনেছি।

ধরা যাক পুরনো সর্বদর্শনসংগ্রহ-এর কথা। বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ নিয়ে তুমুল ব্যস্ততার মধ্যেও এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে নিজে সম্পাদনা করে এই বইটির নতুন সংস্করণ বের করেছিলেন। এবং শুধু বের করেছিলেন, তাই নয়, রামকৃষ্ণদা (ভট্টাচার্য) দেখিয়েছেন, তিনিই প্রথম লোক যিনি সর্বদর্শন সংগ্রহের মধ্যে চার্বাকের কথা বলেন। চার্বাকের যে দর্শন তার তো প্রায় কিছুই পাওয়া যায় না। টুকরো টুকরো এখানে একটা শ্লোক, ওখানে একটা সূত্র, এইরকম কিছু পাওয়া যায়, এবং সেগুলিও কারা লিখেছে, না চার্বাকের যারা বিরোধী। সেইসব শ্লোক সংগ্রহ করে উনিই পৃথিবীর মধ্যে প্রথম ভারতীয় বস্তুবাদী দর্শনকে সর্বদর্শনের অন্তর্ভুক্ত করেন। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য বলছেন— যিনি এ বিষয়ে একজন অথরিটি— সেই সময় থেকে চার্বাক নিয়ে সারা পৃথিবীতে যেখানে যত কাজ হয়েছে, সবকিছুরই ভিত্তি বিদ্যাসাগরের সম্পাদিত ওই ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’। এবং তখনই বিধবা বিবাহ প্রচলনের আন্দোলনও চলছে। তা যে মানুষটা নিজের বাস্তব জীবনকে নিজের তাত্ত্বিক মতাদর্শগত জীবনের সঙ্গে এইরকমভাবে মেলাতে পারেন, সেই মানুষটাকে আমরা কতটা মূল্য দিলাম?

একটা ঘটনার কথা বলতে ইচ্ছে করছে, কথামৃতে আছে। যে কেউ চাইলে পড়ে নিতে পারে। শ্রীম বিদ্যাসাগরকে জিজ্ঞাসা করছেন, আচ্ছা ঈশ্বর সম্পর্কে আপনার কী মনে হয়? উনি বলছেন, দেখো ঈশ্বর সম্বন্ধে আমি তো কিছু জানি না। এ বিষয়ে আমার কোনও ধারণাই নেই। আর যে জিনিস জানি না সে সম্পর্কে আমি অন্যকে জ্ঞান দেব কী করে? তবে উনি চেঙ্গিজ খাঁর উদাহরণ দিয়ে ওঁর মত বোঝাবার চেষ্টা করলেন। চেঙ্গিজ খাঁ একটা জায়গা দখল করে তিন হাজার না পাঁচ হাজার লোককে বন্দি করেছে। তার সেনাপতি এসে বলছে, জনাব ওই পাঁচ হাজার লোককে খাওয়াতে তো আমাদের বিরাট খরচ হয়ে যাবে। তখন চেঙ্গিজ বলছে, মেরে দাও। মানে? মানে সবকটাকে মেরে দাও। কোতল করে দাও। তাহলে আর খরচাটা হবে না। গল্পটা বিদ্যাসাগর বলছেন, বলে কনক্লুড করছেন, তোমার ঈশ্বর তো ওপর থেকে দেখলেন এত বড় ‘ন্যায় বিচার’টা! একটা আঙুলও তো নাড়ালেন না। তা, এহেন ঈশ্বর থাকলেন, কি না-থাকলেন, তা নিয়ে সময় নষ্ট করতে আমি রাজি নই।

এইট্টিন ফিফটিজে একটা লোক এই কথা বলছে। এবং সে ওই মানের একজন অ্যাকাডেমিক পণ্ডিত, কোনও রাস্তার লোক নয়। এই জিনিসটাকে আমরা কবে কতটুকু গুরুত্ব দিয়েছি? গুরুত্ব দূরের কথা, পাত্তাই দিইনি। আমরা বিদ্যাসাগরকে মহাপুরুষ বলি কেন, না তিনি বিধবা বিবাহ চালু করেছিলেন। খুব দয়ালু লোক ছিলেন। কারও, বিশেষ করে মেয়েদের, দুঃখ দেখলে তাঁর চোখ দিয়ে জল পড়ত। তিনি অজস্র দান করেছিলেন। এগুলো সবই ঠিক। এগুলো সবই তিনি করেছিলেন। কিন্তু সবার ওপরে এই যে একটা সেকিউলার চিন্তাভাবনার বীজ রোপণ করেছিলেন বাঙালি মধ্যবিত্তদের হৃদয়ে, কোথায় গেল সেটা? এই ধারাটাকে যিনি সবচেয়ে বেশি করে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলেন তিনিই তো স্বামী বিবেকানন্দ।

স্বামী বিবেকানন্দ খোলাখুলি বিদ্যাসাগরের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বর্ণপরিচয় ওইসব দিয়ে কিছু হবে না। পরিষ্কার বলেছিলেন, ওই গোপাল বড় সুবোধ বালক, ওইসব দিয়ে কোনও কাজ হবে না। তিনি নিবেদিতাকে এসব বলেছিলেন, ‘স্বামী-শিষ্য সংবাদ’-এও বলেছেন এবং ইতিহাসকে বিকৃত করছেন। কীভাবে বিকৃত করছেন? সিস্টার নিবেদিতাকে তিনি বলছেন, বিদ্যাসাগর তো আগে ওরকম ছিলেন না, ওই যে ১৮৬৪ সাল নাগাদ একটা বিরাট দুর্ভিক্ষ হল, তখন উনি মানুষের দুঃখ দেখে বলতে থাকেন ‘আর ভগবান মানি না, আর ভগবান মানি না।’ এই কথা বলে তিনি অজ্ঞেয়বাদের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিলেন। অথচ ঘটনা হচ্ছে, সেই ১৮৫৩ সাল থেকেই বিদ্যাসাগর এইসব কথা বলে আসছেন। হঠাৎ একটা ঘটনায় ভীষণ দুঃখ পেয়ে ‘আমি আজ থেকে আর ভগবান মানি না’ এরকম ঘোষণা করার মতো লোক তো তিনি ছিলেন না। তিনি একটা দর্শন ও যুক্তিবাদের ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেন যে, আমি অজ্ঞেয়বাদী; আমি জানি না, ঈশ্বর বলে কিছু আছে কি না। আমি তাকে নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নই। আমি চাই এই সমাজটা এমন হয়ে যাক, যে পৃথিবীটাই যেন স্বর্গ হয়ে ওঠে। এইটা তাঁর কথা। যে লোক এইট্টিন ফিফটিজে বা এইট্টিন সিক্সটিজে এই কথাগুলি বলছেন, তাঁর এই কথাগুলিকে কি আমরা আজও কোনও গুরুত্ব দিয়েছি? সুতরাং আজ যারা বলছে যে, বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙে দেওয়াটা আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ, এ আমরা সহ্য করব না— তারা তো চাট্টি ভোটের জন্য এই কথা বলছে। কিন্তু ব্যাপারটা তো ভোটের নয়! ব্যাপারটা অনেক অ-নে-ক গভীরে। বাঙালির চিন্তাভাবনার গভীরে যে ফাঁকিবাজিটা আছে, শিক্ষিত বাঙালির, পরিশীলিত, সংস্কৃতিবান বাঙালির ভেতরে যে ফাঁকিবাজিটা আছে, যার দৌলতে তাঁরা বিদ্যাসাগরেও থাকেন, বিবেকানন্দেও থাকেন, সমস্যাটা সেইখানে। তাঁরা ধর্মেও আছেন, জিরাফেও আছেন।

আমি তাই কৃতজ্ঞ থাকব অমিত শাহ নামক এই গুণ্ডাটির কাছে। সে এসে দেখিয়ে দিয়ে গেল যে ধর্ম আর জিরাফ নিয়ে একসঙ্গে চলে না। হয় জিরাফে এসো, নয় ধর্মে যাও। নইলে মেরে মুখ গুঁড়িয়ে দেব। কোনও প্রতিবাদ হবে না। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, ওখানে লোকগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘটনাতা দেখেছে! চিন্তা করা যায়, উত্তর কলকাতার ওই জায়গায়, যেটা নাকি সংস্কৃতির পীঠস্থান, সেখানে একটা লোকও এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করেনি কেন? কলেজের ভেতর থেকে তৃণমূলের ছেলেরা যদি ঢিল ছুড়ে থাকে, বেশ করেছে! আরও আগে ছোড়া উচিত ছিল। কিন্তু বাইরের লোকেরা কী করছিল? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল! ওখানেই ওদের ওই বিদ্যার্থী পরিষদের অফিস আছে। বিশ বছর আগে দেখতাম, দুটো একটা লোক, টিমটিম করত। আর আজ রমরম করে সে জায়গা! কারা এরা? আমি জানি যারা মূর্তিটা ভেঙেছে তারা বাঙালি নয়। কিন্তু বাঙালিদের সমর্থন আছে। একটা বিরাট অংশের সমর্থন আছে।

আমি বিবেকানন্দকে ছোট করছি না। যিনি তাঁর ভক্ত, তিনি তাঁর ভক্ত। কিন্তু তিনি একই সঙ্গে বিদ্যাসাগরেরও ভক্ত হতে পারেন না। এই কথাটা পরিষ্কার হওয়া দরকার। এটা ভাবার কথা যে কেন অমিত শাহর মতো একটা লোক বিবেকানন্দর জন্মভিটায় যাবে? ভোট পাবে বলেই তো! সে জন্মভিটা যাঁরা পরিচালনা করেন তাঁরা কি ঘটনাটা জানেন না, নাকি তারা ওয়েলকাম করছেন? অমিত শাহর মতো একটা লোক কীভাবে এখানে এসে বিবেকানন্দকে প্রণাম করে যায়? বিবেকানন্দকে এর চেয়ে ছোট আর কীভাবে করা যায়? বিবেকানন্দ-ভক্তরা এটা কী করে অ্যালাউ করেন? আমার বিবেকানন্দর সঙ্গে মতের মিল না হতে পারে, কিন্তু তিনি যে মস্ত মাপের মানুষ ছিলেন সে তো সত্যি। কোন অধিকারে এই লোকটা ভোটের স্বার্থে বিবেকানন্দকে প্রণাম করার সাহস পায়? ওই বাড়ির কর্তা যাঁরা, যাঁরা ওই জন্মভিটে দেখাশোনা করেন, নিশ্চয়ই তাঁরা সেই অনুমতিটা দিয়েছিলেন। তাই সে এতখানি সাহস পেয়েছিল। সে আবার বলছে, যে আমার তো প্রণামটা করা হল না! কলকাতা শহরে, আমরা বাঙালিরা এ জিনিস সহ্য করছি? কোনও প্রতিবাদ নেই! যে প্রতিবাদ হচ্ছে, ওটাকে প্রতিবাদ বলে? ওখানকার লোকেরা কী করছিল? ওখানকার লোকেরা ওদের মেরে তাড়িয়ে দিতে পারল না? আজ থেকে তিরিশ বছর আগে হলে মেরে তাড়িয়ে দিত। সিম্পলি মেরে তাড়িয়ে দিত। একদম সেটারই দরকার ছিল। ওরা তো এসেছিল সব লাঠিসোটা হাতে রেডি হয়ে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে তো। আর আমাদের বাঙালিরা? ওর পাশেই তো কৈলাস বোস স্ট্রিট, বিবেকানন্দ রোড, সুকিয়া স্ট্রিট। ওই কৈলাস বোস স্ট্রিটেই তো বিদ্যাসাগর প্রথম বিধবা বিবাহটা দিয়েছিলেন, সেটা ওখান থেকে তিন পা দূরে। তা সেসব জায়গার লোকেরা কোথায়? লোকেরা এইরকম নির্বীর্য হয়ে গেল কেন? এটা কি শুধুই ভোটের ব্যাপার? আসলে সারাক্ষণ যদি একটা স্ট্রং ইমপালসের মধ্যে রেখে দেওয়া হয়— ধর্ম ধর্ম ধর্ম ধর্ম— তার ফল যা হবার তা-ই আজকে ফলছে।

এ একদিক থেকে যেমন মারাত্মক, তেমনি আরেকদিক থেকে খুব ভালো। সেপটিক ট্যাঙ্কের ওপরের ঢাকনাটা যেন ভেঙে গেছে। ময়লা দুর্গন্ধটা একদম সামনে চলে এসেছে। এটার খুব দরকার ছিল। এবার দেখি বাঙালির চেতনা ফেরে কিনা। সভ্য ভদ্র রবীন্দ্রপ্রেমী বাঙালি, রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া বাঙালি— তারা কোথায়?

হ্যাঁ, এটা ঠিক যে যারা মূর্তিটা ভেঙেছে তারা বিদ্যাসাগরের মতাদর্শ জেনে মূর্তি ভাঙেনি। আমি তো এরকমও শুনলাম, ওখানে নাকি বিবেকানন্দরও একটা মূর্তি ছিল, সেটাকেও তারা ভেঙে দিয়েছে। তারা জানেই না। এটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল যে ওখানে একটা গণ্ডগোল পাকাতে হবে। আমি ঘটনাটার প্রতীকী দিকটার কথা বলছি। আর স্থানটার কথা বলছি। এই ঘটনাটাই যদি রাজারহাট নিউটাউনে হত, আর সেখানকার লোকেরা নীরব থাকত, আমি আশ্চর্য হতাম না। কিন্তু এই ঘটনাটা ঘটছে উত্তর কলকাতায়! ওখানে রামমোহনের বাড়ি, বিদ্যাসাগরের বাড়ি, রবীন্দ্রনাথের বাড়ি, বিবেকানন্দের বাড়ি, সুনীতি চাটুজ্জের বাড়ি, জগদীশ বোসের বাড়ি, প্রফুল্লচন্দ্রর বাসস্থান, সত্যেন বোসের বাড়ি, কার নয়! ঊনবিংশ শতাব্দীর সব নামকরা বাঙালির বাড়ি ওখানে। কী হল ওখানকার লোকেদের? তারা সবাই এইরকম হীনবীর্য হয়ে গেল কেন? এই ব্যাপারটাই আমাকে অবাক করে দিচ্ছে!

তৃণমূল আজ এই ঘটনাটা নিয়ে মাইলেজ নিতে চাইছে; কিন্তু আগেই বললাম, গত দশ বছরে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে, অন্তত বিদ্যাসাগর যা করতে চেয়েছেন সেটা নিয়ে রুলিং পার্টির কোনও লোক কথা বলেছে বলে আমি শুনিনি। বিদ্যাসাগর ঈশ্বরভক্ত ছিলেন না, বিদ্যাসাগর অজ্ঞেয়বাদী ছিলেন, বিদ্যাসাগর বেদান্ত পছন্দ করতেন না, অথচ বিবেকানন্দের মতে বেদান্তই নাকি সব! দুটো মানুষের মত দুরকম হতেই পারে। কিন্তু এই সংঘাতটা যে আছে, সেই সংঘাতটাকে চেপে দেওয়ার যে-কালচারটা আমাদের মধ্যে চালু রয়েছে, এটা তো তার ফল। আজকে তৃণমূল যদি বলে, আমরা ভীষণ মর্মাহত, সে তো তোমরা ভোটের জন্য মর্মাহত। তোমরা জিতে এলে কি পরেও এটা নিয়ে কিছু করবে? নাঃ, কিচ্ছু করবে না! আসলে বিদ্যাসাগরের এই যে দার্শনিক লড়াই,  এটা এরা জানেই না। সিপিএম আমলে তবু দু চারটে লোকের মুখে এগুলো শোনা যেত, এখানে ওখানে লেখা হত। এরা আসার পর থেকে এইসব জিনিসগুলিকে ওই রামনবমী আর অমুক আর তমুকে ঢুকিয়ে দিয়েছে। চতুর্দিকে কেবল পুজো, গণেশ পুজো, শীতলা পুজো, পৌষকালী পুজো, আরও কত হবে জানি না! এসবের মধ্যে বিদ্যাসাগর কোথায়? বিদ্যাসাগরের যে র‍্যাশনালিজম সে তো এদের চেতনা থেকে বিলুপ্ত। তাই আজকে এরা যখন বলছে, বিদ্যাসাগরের ওপর যে-আঘাত এসেছে, একে আমরা বাংলার ওপর, বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আঘাত মনে করি, তখন আসলে তো এরা বিদ্যাসাগর বলতে সেই ‘জিকে’ বইতে পড়া বিধবা বিবাহ আর শিক্ষা-সংস্কার, এর বাইরে কিছু ভাবতেই পারছে না! ভাবতেই পারছে না আসলে আঘাতটা কোথায় গিয়ে পড়ছে। তাই আজকের এই ঘটনার অনুঘটক তৃণমূলই। তৃণমূলের অর্থাৎ শাসকদের দর্শনের কথাই বলছি এক্ষেত্রে। শাসকদের সংস্কৃতি আসল জিনিসগুলিকে আমাদের বাঙালিদের মন থেকে ধুয়ে মুছে দিতে চাইছে। এক তো আছে ওই সিরিয়াল, বিশ্বকাপ বা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট। তার ওপর এইসব বিষয়ের সমস্ত আলোচনা, সমস্ত কিছু বন্ধ হয়ে গেছে। তারা বলছে আমরা আরএসএস, বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে ঠেকাব কী করে? না, আরও বেশি পুজো করে! ওরা যদি দশটা রামনবমী করে, আমরা নিরানব্বইটা করব। তাহলে তুমি কার অ্যাজেন্ডা ইমপ্লিমেন্ট করছ? কী তফাত? আদর্শগত দিক থেকে আমি বুঝি না বিজেপি আর তৃণমূলের কী তফাত! হ্যাঁ ঠিক কথা, ভোটের জন্য তৃণমূল মুসলিমদের চটাবে না, মুসলিমদের জন্য কিছু ভালো কাজও হয়তো করবে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু মতাদর্শগত দিক থেকে আমি তো কোনও তফাত দেখি না! আমি সদ্য দক্ষিণ কলকাতার যেখানে এসে থাকা শুরু করেছি, তার সামনে একটা পুজো মণ্ডপ আছে। সেখানে অষ্টপ্রহর, মানে সকাল থেকে রাত দশটা বারোটা অব্দি, তৃণমূলের ছেলেরা আড্ডা মারে, এবং তাদের একমাত্র অ্যাক্টিভিটিই হচ্ছে পুজো। যেসব পুজো হয় সেসব পুজোর নামও আমরা কোনওদিন শুনিনি। তার পাশেই একটা পুরনো মাজার আছে। এটাও বলা দরকার। কোনওদিন কোনও অশান্তি কিন্তু দেখিনি। এটা কিন্তু ঠিক কথা। মাজারের কাছেই অনেক মুসলমানের বাস। কিন্তু একদিনের জন্যও কোনও গণ্ডগোল দেখিনি। এটাও খুব জোর গলায় বলার দরকার। এটা পজিটিভ সাইড। কিন্তু আমার প্রশ্ন বা আশঙ্কা হচ্ছে, মতাদর্শগত দিক থেকে একটা চেক যদি না দেওয়া যায়, এটা কতদিন থাকবে? এখানেই একজন বলছিল, যে যদি কোনওদিন রাতারাতি দেখা যায় যে এনটায়ার তৃণমূলটা বিজেপি হয়ে গেছে, অবাক হওয়ার কিছু নেই। যারা ধর্মকে কেন্দ্র করে রাজনীতি করে, তাদের মধ্যে তো মিল থাকবেই। সে মুসলমানরাও হতে পারে, তারা যখন নিজের ধর্মের প্রশ্নে আসে তখন তো সেই একই জিনিস করবে! ওইখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্যই বিদ্যাসাগরের মতো মানুষের দরকার।

আর তার জন্য দরকার বিদ্যাসাগরের অজ্ঞেয়বাদী, ঈশ্বর-নিঃস্পৃহ, ইহবাদী, মানবদরদি মনটাকে বোঝা। ধর্মর সঙ্গে আপস করলে সে-কাজ হবার জো নেই।

পুনশ্চঃ এখন ভোটের বাজারে নানান হাওয়ার খেলা, তার সবটাই হয়তো মৌসুমি বায়ু নয়। বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার মৌলিক কৃতিত্ব কার, তৃণমূল স্তরের বাঙালিদের, না বহিরাগত হিন্দুত্ববাদীদের, তা নিয়ে ‘ফরেন্সিক’ প্রশ্ন উঠেছে। তা উঠুক। তাতে আমার মূল বক্তব্য বদলায় না। আমার সগোত্র উটপাখি ভ্রাতা ও ভগিনীরা কেউ কেউ নিশ্চয়ই বালির মধ্য থেকে মুখ তুলে দুনিয়া দেখবে, এটুকুই ভরসা।  

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

6 Comments

  1. আশীষদা, অনেক অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা এই লেখাটার জন‍্য। এটা পড়ে ভুলে যাবার নয়। মনে রেখে কাজ করার। আবারও বলি, আরো লিখুন এই বিষয়ে। ধারাবাহিকভাবে।

  2. Bhalo lekha, Bidyasagar moshaier ei dikta ekebarei jana chilo na. Bidyasagar o Bibekananda dujonei social reformer, kintu dujoner path o mat alada.

  3. এইরকম, ঠিক এইরকম থাপ্পড় মারা এবং অকাট্য যুক্তিময় লেখার অপেক্ষা ছিল। বিদ্যাসাগরের যুক্তিবাদ এবং আধুনিকতা নিয়ে বাঙালীর সত্যিই কোন মাথাব্যথা নেই । তিনিও এখন কেবলমাত্র ভোট কুড়োবার ফিকির!

  4. জরুরী কথাটি খুব স্পষ্টভাবে প্রকাশ করার মাধ্যম 4numberplatform এবং এই কারণেই আমার অত্যন্ত কাছের, অত্যন্ত প্রিয়।
    লেখাটি আমার মনের মতো। যা নিজে কখনো লিখতে পারবো না, সেরকম লেখা কেউ লিখলে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ তো থাকতেই হবে।
    আশীষ লাহিড়ীকে ধন্যবাদ জানাই।

  5. অসম্ভব শক্তিশালী একটি লেখা। খুব ভাল লাগল। গুরুবাদী বাঙালীর কাছে বিদ্যাসাগর চিরকালই পরিত্যাজ্য ছিলেন। ঘরে ঘরে আপনি রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দর ছবি দেখতে পাবেন, কিন্তু বিদ্যাসাগর নৈব চ। এইবারই এয়ারপোর্ট থেকে ফেরার পথে দেখলাম বাঙালি মনীষীদের ছবির ভিড়ে কোথাও বিদ্যাসাগর নেই।

Leave a Reply to Prabhash Chandra Roy Cancel reply