এ মাসের কবি: জগন্নাথদেব মণ্ডল

জগন্নাথদেব মণ্ডল-এর কবিতা

 

(১)

 

এই যে নারীভ্রমে অফুরন্ত দুধ দিয়েছে বৃন্তে এ আমি কাকে গেলাই?

কাঁসার বাটিতে স্তন্য গেলে মাছের মুখে গিয়ে ধরি।
পুকুরের পিছল ঘাটে পিছলে উরু ভাঙে!

মাজায় গরম চুন-হলদির প্রলেপ দেবে এমন নতুন মানুষ কই?
চর্তুদিকে শুধুই গোরস্থান; রসুনগোটার জঙ্গল।

অই গৌররঙের সেখের পো আমার কাছে এনে দাও।
ফর্সা বাছুরের মতো রাং, ঈষৎ বন হয়েছে বাহুমূলে।

ওকে নাওয়াই খাওয়াই মাখাই বাতাস করি তালের পাখায়।
নলকূপে পানি তুলে বেড়ার ধারে উচ্ছেপুষ্প ছুঁতেই মনে হল পাহাড়ে লহুবর্ণের ফুল ফুটছে আর ভগবান শীত কাটাচ্ছেন সেখানে।

কামিনী নেউলের মতো মতো টলতে টলতে এসে ধপাস শব্দে শুয়ে বলি-
ওগো সুন্দর, কেশপাশ আঙুলে নিয়ে এই ঘোটকীর গায়ে চাপো। রথ চালাও।

আল্লা, তোমাকে অশ্বের শক্তি প্রদান করুক অথবা তিতির পাখির কলিজা-খাওয়া বল দিক!

আমাকে মর্দন করে চোঁ চোঁ শব্দে পান করে ছিবড়ে করে দাও যেন ধুন্দুল ফলের খোসা!

এবারে পাঠিয়ে দাও নির্জন পলাশফুলের মঠে।
সেখানে যেন হাওয়ায় দোলে স্তব, কাম কচ্ছপের মতো জলে শ্লথ শুয়ে থাকে।

আমি ভিক্ষুণী হয়ে দুবেলা দু মুঠো যেন যোগাড় করি ভিখ মেগে।
তুমি কানসোনা গ্রামের গো-চিকিৎসক হয়ে গেছ ততদিনে;
তোমায় দেখে দুগ্ধঋণ শোধ করা সন্তান বোধ হচ্ছে আমার।

দুয়ারে দাঁড়ালেও আমায় চিনতেই পারছ না।
ভিক্ষা দিচ্ছ আতপচাল আর জলে পাওয়া পাথরের এক শান্ত বুদ্ধমূর্তি।

 

(২)

 

আজকাল বিকেলের দিকে আর ছেলে পড়াতে যাওয়া থাকে না, সন্ধ্যার মুখটাতে একা ঘরে থাকাটা দায় হয়ে পড়ে তাই বেরিয়ে পড়ি।

বেরিয়ে পড়ার মূল হেতু কিন্ত একটা শান্ত নীল কবর। ছোট তালচারা আর বনখেজুরের ছায়ায় ঢাকা থাকে, শ্যাল- কুকুরের নখথাবা থেকে বাঁচানোর জন্য নরম মাটি উঁচু করে রাখা। আর একটি গাঢ় ময়ূররঙ মশারি নীচুস্বরে কবরের ওপরে টাঙানো।

এই গভীর মহৎ শান্ত দৃশ্য আমাকে কেবলই এখানে টেনে আনে। অল্প অল্প ফুটে থাকে হলদে হলদে মনসাগাছের ফুল।

কর্কশ ধাতুবর্ণের মানুষের ভিড় ছেড়ে থোকা থোকা ফলভারে নীচু গাছের মতো এখানে একা এসে বসলে মরে যাওয়া বন্ধুর বোনের সাথে দেখা হয়। সে বলে- দাদা, চেহারা খারাপ হয়ে গ্যাছে, ফতুয়ার ফাঁক দিয়া তো পাঁজরার হাড় গোনা যায়।

আমি কি নিজেও খারাপ হয়ে যাইনি বোন?

সে ছাগল চরানো শেষে চলে যায়।

হঠাৎ যাকে ভালোবেসেছিনু তাঁর মুখ দশমীর জলে কেঁপে যাওয়া বোধ হয়। মনে পড়ে শৈশববিকেলের চটি হারিয়ে ফেলার তুচ্ছ ঘটনাটি। একটু খুঁড়িয়ে চলা মা আমার রাতের ভ্যাপসা রসুইঘরে কেমন আছে?

আচ্ছা, গোরে শুয়ে থাকা মানুষের মুখ থেকে কি মুছে গেছে আতরঘ্রাণ?
সঙ্গে আছে কি এখনও আছে তাবিজ?
ও তো আমার পিতা, পুত্র, প্রেমিক, বড়ো দাদাও হতে পারত।

এসব ভাবলে নিজেকে চিমটেহীন ন্যাংটা সাধু মনে হয়। মনে হয় দোকান থেকে শাদা খই আর পাতলা বাতাসা খরিদ করে খাই।

বুঝি আমার ভোগ যায়নি। লাল শান্ত জবাগাছটির ডালকে তাঁর রোগা উরুসন্ধি বলে ভ্রম হয়। কতকাল চুম্বন করিনি মানুষের আমিষ ঠোঁট।

চারিদিক উপনিষদের মতো থমথমে। বাঁশবনের অন্ধকার সমুদ্র ঢেউ তুলে ঝাপিয়ে নামে। আর আমাকে মহাবিস্ময়ে সাইকেল চালাতে দেখে আকাশের-পাথরের সুপুরুষ, গৌরবর্ণ, গভীর নাভির জ্যান্ত দেবতা মিটিমিটি হাসে…

 

(৩)

 

ডুগডুগ করে ঢোলক বাজছে দূরে।

শান্ত চোখের কালো ভইস উঠে এল জলের ভিতর থেকে। আশেপাশে ডুলুং নামের কেনও নদী নেই, নেই শালবন।

শেষবাস ধূলো উড়িয়ে চলে গেল।
এখানে হাড়িয়াও অ্যাতো সহজে মেলে না।

শুধু তুমি আমি বসে আছি পাষাণ সোপানে।
ডুমুরগাছ, পাশেই সনকা দেবীর মন্দির।

আমার কান যেন বদলে গ্যাছে অপরূপ যোনিতে।
তোমার সমস্ত বাক্য উত্থিত পুরুষাঙ্গের মতো প্রবেশ করছে ভিতরে।

ধীরে ধীরে রাঙা মেঘের ভিতর দিয়ে উঁকি দিল সন্ধ্যাতারা,
উড়োজাহাজ চলে যাওয়ার চিহ্ন আকাশে।

ভিতরে ভিতরে রমণ চলেছে আমাদের,
আর খুলে খুলে যাচ্ছে মেরুদণ্ডে লুকিয়ে রাখা পদ্মফুল।

 

(৪)

 

এই ব্রহ্মাণ্ড আসলে বাজার।
প্রতি সকালে বিকিকিনি হয় আলু, তামাক, নারকেল মালার পানপাত্র।

২৮ বিঘে চাষ করার পর ঢের ব্যর্থ কৃষক গোয়ালঘরের দড়ি হাতে চলে যায় জামশাখায়।

নিবিড় হয়ে আসে হাওয়া;
দমের সাধনা জানা সাধু হাতের মুদ্রায় পদ্মফুল চমকায়।

যদিও এই ফুল রান্না করে খাওয়া যায় না।

বজ্জাত মহিলার চুল বেয়ে উঠে আসে সাপ।

কাজ হারানো ছেলের মেরুদণ্ড, চক্র, স্বাধিষ্ঠান উনুনে চড়ায় মা।

আমি একলা রাতের একলা পাগল এসব দেখে বিড়বিড় করে বলি-
অন্ধকার, তুমি আমার ভগ্নীপতি হবে?

 

(৫)

 

টুকুমাসি, আজ তোমার হারমোনিয়াম মনে পড়িতেছে। পাশেই পুকুর; তোমার গানে ঘাই মারিতেছে মাথায় ঘিলু উঠে যাওয়া শোল মাছ।

রোগা শিমূল দাঁড়িয়ে। ওর তুলোর বালিশ ছুঁড়ে মেরেছিলাম তোমার নাকের সোনার নারকেলফুলের দিকে। কেটে গিয়ে লাল রক্ত। কেন তুমি ফাঁকা বাড়িতে ভেজা বাঁশপাতা আর গোটানো মশারির ভিতর বাবাকে একরাত নাও?

চাঁদ উঠলে কেন মায়া বিস্তার করে গাইছিলে বনশ্রী সেনগুপ্তের গান। রোদ ছিটোনো শান্তিনিকেতন বলবার সময় আমি দেখছিলাম মেয়েদের স্কুল। সারি সারি মেয়ে কান ধরে ছাতিমতলায় দাঁড়িয়ে। তখনও তো বোলপুর যাইনি। বড়দিদিমণি গেট খুলে ইস্কুলে ঢুকছেন। আমার ঘুম পায় এইসময়গুলোয়।

তবু বাবার হৃদযন্ত্র প্রায় বিকল তাই অর্জুনের ছাল আনতে চললাম। বাবাকে সাবধানে রেখো। গা মুছিয়ে ঢেঁকি ছাটা চালের ভাত আর হাল্কা সবজি রেঁধে দিও উনুনে।

নেপালি দারোয়ানের কাছে খৈনি চেয়ে নেব না। পথ শুধিয়ে নেব সন্দীপের মায়ের কাছে। গোটাসেদ্ধ খেতে পারি। পায়রা দেখলে দু-একবার হাততালিও মারব সিটি দিয়ে।

মায়ের গন্ধ ভাসছে লেবুবনের ভিতর। বাবা কি চিনদেশ থেকে আসা বই পড়তে গিয়ে আগুন ধরিয়ে ফেলল বিছানায়?

এসব কিচ্ছু জানি না। সাঁওতাল কালো বউটাকে জলে দেখছি শুধু। পোড়ামাটির বুক ভাসিয়ে আছে।

ভিতরে পিঁপড়ের বাসা। পিঁপড়ের ডিম খাব বাসকের মধু মাখিয়ে।

না, খাব না, ঔষধ আনতে হবে যে বাবার। উমনো ঝুমনো বোনের মতো গাবতলায় পা ছড়িয়ে কাঁদছি। পোড়া মাটির হাতি বৃক্ষতলে। পোঁটলার খইমুড়ি শেষ। অবিকল মা হারা ছেলে লাগছে আমারে। আর দুষ্টুমি করবনি। ফিরে আয় মা, ঘরের শালকাঠ থেকে নেমে আয়।

তোর ব্রতকথার গান কেন ফেলে গেলি?

টুকুমাসি আর আসে না এখন, তাই ঢলে ঢলে গান হয় না। উলুঝুলু ঘুম হাঁটুতে মুখ গুঁজে ভালো লাগছে না এখন, তুই বল খিদে পেলে কার ভালো লাগে এই বনপথে নাকের সিকনি হুসহুস টেনে খেতে?

তুই আয় আর লক্ষী আসুক গৃহে। তোর জবাফুল ছিঁড়ে নেয় বাসি কাপড়ে ওই মাসিমাগি, ওরে বিদেয় করে আমার গরম ভাতের গর্তে ডাল ঢেলে দে, পাতে বকফুল ভাজা…

 

(৬)

 

জাঁতিতে অপূর্ব কুচো কুচো সুপারি কাটত ছেলেটি; আর কাটে না। তবে চোতমাসে নিমগাছে, বেলগাছে মধু জমলে কলোনীর পুষ্করিণীতে চান করে উপবাস করত শিবরাত্রির।

আগের রাত্রে মেঝের টানটান কম্বলে শুত। শিবলিঙ্গে বহুক্ষণ ধরে গহন গাভীর দুধ ঢালত।

জানালা দিয়ে ওকে সুপারির কথা জানতে চাইলে বলত, ওসব আর কুচিয়ে কাটি না, ঠাকুর বলেছেন মুখশুদ্ধি হিসেবে খেলে কামভাব বাড়ে।

বিকেলে চারখানা করে হাতে তৈরি রুটি খেত, একটু দুধ। মিনি বেড়াল, দুটো খরগোশ পোষ্য।

মাটির গামলায় কৈ মাছ জিইয়ে রাখত ও। চোখ করমচা লাল করে বলত- আমার ঠাকুরকে অল্প মশলা, তেজপাতা দিয়ে রেঁধে দোব।

এখন ঘরে আটকে রাখা হয় ওকে। লোকে বলে-পাগলের বাড়ি।

মায়ের চুলের মতো আকাশ ছেয়ে অন্ধকার নামলে উন্মাদ ছেলেটি চুপ করে থাকে। চেয়ে থাকে লুকোনো ওড়না, মধুর কাঁচুলির দিকে। চেয়ে থাকা কাঁচে বাঁধানো একটি ছবির দিকে, তোমাদের চৈতন্য হোক লেখা সমাধিস্থ রামকৃষ্ণদেব।

লেজকাটা একটা হনুমান স্থির পাঁচিল থেকে ছাতে উঠতেই, ও দুপুরবেলার চিলের ছাত থেকে হাত বাড়িয়ে কলা খেতে ডাকে। আর বলে- আয়, ভয় কী রে, মায়ের হাত থেকে খেয়ে যা বাছা। হাত ঘুরিয়ে বলে- এই দ্যাখ, আমার হাতে শাঁখা, পলা, নোয়া…

এমনি মেঘঘন সময়ে ওকে প্রশ্ন করো যদি- নাম কী? নিবাস কোথায়?

তাহলে গামছার ঘোমটা সলজ্জ টেনে মৃদু বলবে- থাকি নহবত বাড়ি, নাম সারদামণি…

 

(৭)

 

পদ্মবাবুর ঘর। দরজায় পাথরের ভাঙা সিংহ বসানো। এখনও রাত্রিবেলায় তামাকের শাদা ঘ্রাণ, টানা পাখা, ছোট মায়ের স্বর্ণ-কাঁকন হারায় পাতকুয়োর জলে।

প্রশস্ত উঠানে জলঢোঁড়া সাপের মতো স্থলপদ্ম গাছ।

শস্তা ঘিয়ে ভাজা হয় লুচি। লম্বা ডাঁটির এলোকেশী বেগুনে পোস্তভাজা ছড়ানো।

গাজনের বাজনায় আম্রমকুল গুটি হয়। মাধবের ভোগ রাঁধেন বছর বিয়ানো ফ্যাকাশে বউটি।

মাধবের ঠান্ডা গৃহের পাশে পায়রাখোপ। চিলেকোঠা। বিয়ে না করা মেজ ছেলেটি থাকেন একটু দূরেই। ঘরে ঢুকতে গেলে প্রাচীন মেঝেয় লক্ষ্মী পায়ের আলপনা-ছাপ।

ছেলেটি এখন করতলে ঘুমন্ত-মাথা রেখে মধ্যরাতে স্বপ্ন দেখছেন। স্বপনে তার নয়ন ভেসে যায় অশ্রুজলে, গলায় মন্দার ফুলের মালা।

এবার এক নাপতিনী এলো কাছে, ন্যাকড়ায় তার পা রেখে, ঝামায় ঘষে, আলতা পরিয়ে দিল।

ছেলেটির নিজস্ব কুমার এসে সাপের মণি গোবরে ঢেকে, রাক্ষস মেরে, তাকে পক্ষীরাজে চড়িয়ে উড়িয়ে নিয়ে গেল অম্বিকা কালনার দিকে। বালির চকচকে খেতে ফুটি ফলে আছে।

ঘোড়ার পাখনার সোঁ সোঁ শব্দ অবধি কানে শোনা গেল।

পাঞ্জাবিতে লুকোনো ভারী দুটি পদ্মকুঁড়ি বুক ধীরে ধীরে চাপ দিতে লাগল নরম করে।

দুই চামড়া ওঠানো চন্দনদণ্ড ঘর্ষণে কোনও সন্তান নেই এ বোধ তাদের বিষন্ন করল না এতটুকু।

এরপর ঘুম ভাঙল মেজ ছেলেটির। বসন আলুথালু ভিজে গেছে। লুকিয়ে পরা কাজল লেপ্টে গেছে। পাশে কার্পাস তুলোর পুরুষ্টু যুবকদেহের মতো সাদা বালিশ। পা জুড়ে যেন স্বপ্নের মৃদু আলতা-ছাপ।

তাকালে দেখা যায় জানালার বাইরের পুকুরে জলভরতে যাচ্ছে কারা। বিবাহবাজনায় ফেটে যাচ্ছে আকন্দ ফল।

সুপবন বইছে আর
বিসমিল্লার খেপিয়ে তোলা সানাইয়ে অশ্রু-ঝলোমলো করিতেছে পদ্মবাবুদের পুরোনো জমিদারবাড়িটি।

 

(৮)

 

বন্ধুকে সর্ষে তেলের বাটি হাতে ঝুঁকে আসা কিনারায় দাঁড়া করিয়ে পুকুরজলে নেমেছিল বলরাম সর্দার। জলে নামতেই তাঁর কালো রোমশ দেহ বহন করে নিয়ে গেল নাগপুরুষেরা। কোনও আপত্তি না শুনেই সেখানে নহবত বাজিয়ে নাগকন্যা সুরবালার সাথে বিবাহ হল। ঘড়া ঘড়া উড়ে গেল পচানো আখের গুড় দিয়ে তৈরি মদ।

বিবাহের বছর কয়েক কাটতেই তিনজন সন্তান। ঢের বয়েস বেড়ে গেল তাঁদের। এখন জলের নীচে জেলিমাছ শখ করে পোষে প্রৌঢ় বলরাম, বুকের চুল পেকে গেছে। সুরবালা বোনে পশমের টুপি। বিকেলের মতো বিবর্ণ রঙ নেমে এসে গুলে যায়।

একদিন বলরাম উল্টে গেল শামুকে পা লেগে। বাঁধানো দাঁত ছিটকে গেল, আর সে পুকুরতল থেকে ডাঙায় ভেসে উঠল ভুস করে।

উপরে উঠতে দ্যাখে বন্ধু তেল ভর্তি বাটি হাতে তেমনি দাঁড়িয়ে। বেলা এতটুকু ঢলেনি। ওদিকে জলের নীচে বিবাহ, সংসার। ৩৫ বৎসর কেটে গেছে।

মাঝে মাঝে ভাবি আমি এমন বলরামের মতো জলে ডুবে নেই তো! কাকে অপেক্ষায় দাঁড়া করিয়ে রেখে এসেছি স্থলভূমিতে? এই নারী, নক্ষত্র, পুরুষ, পানলতা, খয়ের, মোতিহারি তামাকের বন সবটাই জলছায়া নয়তো?

একথা ভাবতেই আমার কঙ্কাল কেঁপে ওঠে, চোখের পাতলা মণি ফেটে যেতে চায় কাঁচের মতোন…

 

(৯)

 

জীবনে মাত্র ২ বার সে মদ্যপান করেছে। একবার বাড়িতে গঙ্গাপুজোর দিন পাঁঠার মাংস সহযোগে; আরেকবার বন্ধুরা মিলে কাঁচের গ্লাসে ঠান্ডা জামগাছের নীচে ভাঁটিখানায়।

প্রথমবার মদ খেয়ে নিজেকে তার মকরমাছ বলে মনে হয়েছিল। সে ভাবছিল ডাঙায় সাঁতার সম্ভব কিনা।
দ্বিতীয়বার মাঢ়ী যেন স্মৃতিপ্রবণ হয়ে গঙ্গামাটিতে তলিয়ে যেতে চাইছিল।

অথচ মরে যাওয়ার কথা বহু আগেই, তার জলে ফাঁড়া। প্রায়শই ইচ্ছে করত তালডোঙায় চড়ে নদীর গভীরে যেতে।

স্বপ্নে পাওয়া মাদুলি হাতে ধারণ করে করে, চ্যাং মাছ ভাজা খেয়ে খেয়ে সেই জলদোষ কাটিয়ে দিয়েছিল তার নিজস্ব মা।

আজ সে ভাঁড়ে ভাঁড়ে পান করছে তাড়ি।
আর মনে হচ্ছে এই পয়লা বৈশাখের দিন নেশার ভিতর জল থইথই করছে। সাঁতরে আসছে কালো এক মহিষ। মোষের পিঠে মুগুর হাতে এক কালো ষণ্ডা লোক।

লোকটি এসে দুধ দুইয়ে বালতি-উনুনে চা করছে, চিপে দিচ্ছে গন্ধরাজ লেবুর রস। বলছে-খেয়ে নিন বাবু, খুব নেশা হয়েছে তো, খোয়ারি কেটে যাবে!

রাঢ়দেশের মাটিতে শুয়ে মৃত্যুকে নিয়ে অপরূপ এই ঠাট্টায় অনেকদিন পর সে শিশুর মতো খিলখিল করে হেসে উঠছে। আর আকাশ হয়ে উঠছে বরিশালের মতোন। তিমির কাঁপিয়ে সাতখানি তারা উঠছে জ্বলজ্বল করে।

 

(১০)

 

উল্টোরথের দিন তোমার বুকে অন্য ছেলের ছায়া কেন দেখলাম সৈয়দদা?

তরমুজ বিচির চেয়ে একটু উজ্বল ফুলে ওঠে স্তনবৃন্তের কাছে ও কোন নরম কিশোর?

আমি কি তবে তোমার সবটুকু নই?

তাই মসজিদের পাশে সূর্য অস্ত যাক, হিলহিলে ঠান্ডা নামুক ঠান্ডা পানির ভিতর।

আর আমাকে আবার তোমাদের হিম বদনা, গোসলঘর, গোলপায়রা পার করে পেয়ারা গাছের পাশ দিয়ে নিয়ে গিয়ে ঘরে তোলো। তোমার চাচির ছেলে তখন দুলে দুলে পড়া তৈরি করছে।

এদিকটায় কেউ আসবে না সুতরাং ইচ্ছে করে নিজস্ব লিঙ্গ দুহাতে পায়ের ভিতর চেপে যোনি বানাই। নারকেল মালা অথবা জলপুঁটলি দিয়ে নকল স্তন। চোখে কাজল দিই। মেহেন্দি। হাতে রঙিন কাচের চুড়ি।

কবরখানা, পাশে তিনটে জিওল গাছ, এবার একটি মুর্গি জবাই হোক। কিন্তু আজ রাতে খাব না বলে দিয়েছি।

এবারে আমাকে প্রতিটি রোমকূপ দিয়ে আমূল নাও। তোমার দেহে স্থান দাও। আমাদের দেখতে অর্ধনারীশ্বর লাগুক।

বিছানার পাশে তেলের শিশিবোতল। কম পাওয়ারের ফ্যাকাশে আলো। দেয়ালে ছবি সাঁটা তীর্থস্থানের।
এর ভিতরে আমার অর্ধেক যেন আলতা রাঙা পা, হাতে আয়না, সিঁথি জুড়ে সিঁদুর, কোমরে বিছে আর তোমার জটায় আটকানো চাঁদ, দেহে ভস্ম, বাঘছাল সাপ দিয়ে বাঁধা।

সকালের বাসি সিমুই আমার অর্ধমুখে এবারে তুমি দিতেছ। তারপর পড়া করবার আছিলায় পাটি বিছিয়ে তোমার অর্ধেকদেহ পুরোনো খাতা খুলে বসতেই সব ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে আমার অর্ধ।

আর সারারাত দুজনে গেঁথে থাকছি। চোখে আনন্দজল। এই তো জল ভেঙে এল আমার। টসটস করছে গা কদম্বকাঁটায়। ভোররাতেও বিচ্ছিন্ন হতে ইচ্ছে করছে না।

কুয়াশায় এক হাত দূরের লোক অস্পষ্ট লাগছে। জামের পাতা হতেছে নরম। কুয়ো থেকে পানি তুলছে তোমার নানি। কবরের কাছটায় দাঁড়িয়ে ভোরের প্রথম কচি গন্ধ শুঁকছে আনন্দ-মোরগটি…

 

(১১)

 

এই একুশ বছরের যুবক-হাঁটু মুড়ে প্রায় সন্ধেয় ঘরের এক নির্জনে বসে নিরামিষ ভাত খাচ্ছি।
সাদা থান আড়াল করে আখায় শুকনো আইড়ীর শাখাপ্রশাখা জ্বেলে প্রেতের জন্য মাছ ভাজছে পিতা।

কুশের আংটি অনামিকায় পরে আতপ চাল, গঙ্গাজল, তিল, কলা চটকে পিণ্ড প্রস্তুত হয়েছে।

সমস্ত পুষ্করিণীতে ফেলে নেয়ে উঠেছি; দইভাণ্ড মাটিতে আছড়ে ভেঙে গড়াগড়ি দিয়েছি আঙিনায়।

এইভাবে কী সম্পূর্ণ  ঠাকুমাকে ভুলে যাব?
অই ঘোলা ঘোলা চোখ, বেড়ালের জন্য মাছভাত রেখে দেওয়া ঠান্ডা হাত…

হিমদিনে তিনবার স্নানে শোক ধুয়ে গ্যাছে খানিক;
শীতবোধ আর খিদেই বরঞ্চ তীক্ষ্ণ হয়েছে।

মন্ত্র আর শান্তিজল তলতা বাঁশের বেড়া দিয়েছে গৃহের চারিদিকে; যাতে প্রেতকুয়াশা পেরিয়ে বুড়ি ফিরে এসে মিষ্টান্ন চাইতে না পারে আর…

কীর্তন বসছে নবদ্বীপ থেকে আসা রাধাশ্যাম
সম্প্রদায়ের। ঠাকুমার পাকা কলায় অরুচি চিরদিন, আতপচালে বিষণ্ণ। ফিরে যাচ্ছে মুখ নীচু করে।

আমি কি পাত্রে সাজিয়ে পঞ্চব্যঞ্জন ভাত কুলের চাটনী নিয়ে যাবে জলার ধারে?

জানুয়ারী মাসের সাঁঝবেলা নামছে ধীরে লয়ে;
মনে পড়ছে শ্মশানে ঠাকুমা-পোড়া ঘ্রান;
উঠে আসা ডান পা সপাটে মেরে শুইয়ে দিয়েছিল ডোমের লাঠি।

এক পায়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঠাকুমা চলে যাচ্ছে ওর প্রতিদিনের শীতল গ্রিলের ঘর, উলকাঁটা, বেড়াল ছেড়ে…

 

(১২)

 

রোদের দিকে চাইলেই বোঝা যায় এ রোদ মাতৃহারা। তীব্র শোক যেন রাগসংগীতের মতো বিছিয়ে আছে চারিদিকে।

এ সব দিনেই কুলপুরোহিত গৃহে আসেন। স্বপাক খান। জাতক কাহিনী নিবিষ্ট মনে পাঠ করে ফলন্ত জবাগাছ অবধি গিয়ে ফিরে আসেন; তারপর ঠাকুমাকে জপমন্ত্র দিয়ে যান।

সাতাত্তর বছর সাত মাস সাত দিন পেরোতেই ঠাকুমা শয্যা নেন। শয্যায় বৈতরণী নদী, আস্তাবল আর পাবলিক পেচ্ছাপখানার গন্ধ পাওয়া যায়।

এরপর মধ্যদুপুরে টাকমাথা, কপালের কাছে আব-গজানো বৃদ্ধ ডাক্তারবাবু স্কুটি চড়ে আসেন। বলে যান- আপনারা তাড়াতাড়ি রান্নাবান্না করে খেয়ে নিন, বিকেল পেরুবে না..

প্রাণ চোখে এসে স্থির হয়। মায়াজল ত্যাগ করে ঠাকুমা। বিচালির বিছানায় সকলে বসে দুধগঙ্গাজল খাওয়ায়। শীর্ণ চোয়াল অতল গহ্বরের দিকে ঢুকে আসে। নাভিশ্বাস উঠল। শ্লেষার ঘড়ঘড় শব্দ…

মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল প্রাণ। মুখ খোলা অবস্থায় মারা গেলেন। হা মুখে গুঁজে দেওয়া হল একমুঠো আতপ চাল।

নামাবলী, তুলসীমালায় মাছি এসে বসছে।

বাঁশের শয়নযানে করে নিয়ে আসা হল দেহ। শ্মশানের বটগাছে অজস্র কাক কালো হয়ে বসে আছে। হরিধ্বনিতে বুকের বাম পাঁজর কেঁপে উঠছে। গঙ্গা থেকে উঠে আসছে হিমঠান্ডা হাওয়া।

দাহ শেষ হলে তপ্ত নাইকুণ্ড ডোম খুঁজে খুঁজে মৃৎপাত্রে দিচ্ছেন।

বাবার গা গুলিয়ে বমি আসছে; তাই খানিক সুগন্ধি বকুল আঠার ধুনো দেওয়া হল তাতে…

একদা এই নাড়ির বন্ধন দাইমা ছিন্ন করেছিলেন গরমজল আর বাঁশের চোঁছে। আঁতুরঘরের পাশে মহানিম গাছ ছিল; সেই গাছের ঝিরিঝিরি পাতার ভিতর ছিল কুয়াশা জড়িত পক্ষীডিমের মতো চাঁদ…

আজ তেমনই রাত্রি, তেমনই চাঁদ। শেয়াল যাম ঘোষণা করছে।

আর এইসব মৃত্যু, এইসব দৃশ্য আমাকে আর একটু বিষণ্ণ, আর্ত, কাতর ও চাপা আনন্দিত করে তুলছে…

 

‘ছড়ের মায়ায় যার বেজে ওঠে মানবজমিন’

[জগন্নাথদেব মণ্ডলের লেখালিখি বিষয়ে দু-এক কথা]

 

শাশ্বতী সান্যাল

সহজভাবে কথা বলার সুর ভুলে যাচ্ছি আমরা। ভুলে যাচ্ছি মাটির গন্ধ, বুনো ঘেঁটু আর আকন্দের সারল্য। ইট কাঠ পাথরের সভ্যতার নীচে ক্রমশই চাপা পড়ে যাচ্ছে আমাদের নরম ব্রতকথা, শীতলাষষ্টি, মনসামঙ্গল গান, ভাদু, টুসু, রাধিকার মানভঞ্জন পালা। শুধু বাস্তব জীবনেই নয়, কবিতার পৃথিবীতেও আজ নগরায়নের দাপট। আমরা জটিল হচ্ছি মনে-মননে। আধুনিক হচ্ছি। সরে আসছি গ্রামীণ পৃথিবীর সারল্য থেকে, তার স্বাধীন আলোবাতাস থেকে। আমাদের কবিতাও মেখে নিচ্ছে সেই জটিলজীবনের ভাষ্য…

আর এখানেই জগন্নাথদেব মণ্ডলের স্বাতন্ত্র্য। নদীমাতৃক বাংলার ঘাস, মাটি, জল, অকৃপণ আলোবাতাসের বুক থেকে উঠে এসেছে তার লেখা। সরল জীবনের জল-কাদা মাখা এক মৌলিক গন্ধ আছে তার লেখার গায়ে। আর আছে এক বিস্মিত, আবিষ্ট বালকের চোখ। জগন্নাথের লেখা আমাদের হারিয়ে যাওয়া শৈশবের কথা বলে। একদা যে শিশুর সারল্য, বিস্ময় আর রূপমুগ্ধতা নিয়ে বাঙালি চোখ পেতেছিল প্রকৃতি ও জীবনের অলিতে গলিতে, সেই বিস্ময়মুগ্ধ বালকের দৃষ্টিই যেন লুকিয়ে আছে তার প্রতিটি লেখায়।

জগন্নাথের এইসব লেখা মূলত ভাবপ্রধান। বক্তব্যের মধ্যেই তার যথার্থ সৌন্দর্য। অহেতুক পাণ্ডিত্যের ভারে, ছন্দের কারুকাজে সে নিজেকে ভারাক্রান্ত করেনি। তার শব্দচয়ন, বাক্যগঠনের মধ্যেও রয়েছে এক প্রাচীনত্বের সৌরভ। সবমিলিয়ে জগন্নাথের কবিতা শ্যাওলা জমা গ্রাম্য বাওড়ের জলের মতো সবুজ, সরল… সেই জলের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়া নগ্ন কিশোরের মতো অনাবিল, ভণিতাহীন।

প্রথম কবে পড়েছিলাম জগন্নাথকে তা আর মনে নেই। কিন্তু ভুলতে পারিনি তার প্রথম লেখাটি। সহজ আলোর ছুরির মতো সে বিঁধে আছে আমার একান্ত পাঠকহৃদয়ে –

“আমার ছোটদাদু রাধাভাবে ভাবিত ছিলেন। বিয়ে করেননি আজীবন। চিলের ছাদে একলা ঘরে একটা রাধাহীন কৃষ্ণমূর্তি ছিল। কৃষ্ণের মাথার পাখাটি ছিল সত্যি ময়ূরের” (মাঃ সেঃ ১ম লেখা)

খুব সহজ গল্প বলার ধরণে শব্দ গেঁথে গেঁথে সিঁড়ি তৈরি করেছে এ কবিতা। এই সিঁড়ি বেয়েই পাঠক একটু একটু করে নেমে আসবে সম্মোহিত সাপের মতো। সে বুঝতেই পারবে না কোথায় বেজে চলেছে কুশলী সাপুড়ের বীণ। আমরাও বুঝতে পারি না কীভাবে ছোটদাদুর আখ্যান বদলে যায় জন্মান্তরের কাব্যে। কীভাবে কিশোর কবি শব্দের আড়ালে নকশা তুলে গেঁথে দেন একের পর এক গ্রাম্য কথকতা, শ্লোক – আমাদের চিরায়ত বাংলা ভাষার সুর…

“কা-কা-কা তিতে বাড়ি থেকে মিঠে বাড়ি যা
গোয়ালবাথানে যা, দই দুধ খা”

“আঁকড় ধানের হুড়ুম দিমু পানের সাথে গুইয়া
খাওনদাওন শ্যাষ করিয়া ডিঙায় যাইও নাইয়া”

জগন্নাথের কবিতা জুড়েই সহজিয়া জীবনের অজস্র ছবি – সে ছবি এত জীবন্ত, এত রক্তমাংসের, যেন এক্ষুনি শাদা পাতা ভেদ করে উঠে আসবে আমাদের সেলফিসর্বস্ব যাপনের মধ্যিখানে। প্রাকৃতজীবনের কাদা ছুঁড়ে পণ্ড করে দেবে আমাদের নির্ঘণ্ট মানা নষ্টজীবনের সাধনভজন।

তার কবিতার নারী মাত্রই মাতৃমূর্তি নয়, এমনকি উদ্ভিন্নযৌবনা সরসা কিশোরীমূর্তিও তেমনভাবে উঠে আসে না তার অক্ষরের বুকে। অথচ সেটি হলেই তুলনায় স্বাভাবিক হত। যে কোনও স্বাভাবিক স্বাদুতার প্রতি অদ্ভুত অনীহা এই বছর ২১শের অদম্য তরুণটির। তার অস্বাভাবিক মেধা ও মনন থেকে কবিতায় উঠে আসে আগুনের মতো কিছু নারী। তাদের কেউ ডাইনি, কেউ বোষ্টমী, কেউ বা ইস্কুলের দিদিমণি, কেউ বা গ্রামের নামহীনা বিধবা ‘বৌটি’।

— বিনু নামের মেয়েটি আসলে ডাইনি। ভীষণ বিপরীত সঙ্গম পছন্দ করে ও। শক্ত পুরুষমানুষ দেখলেই ছিঁবড়ে করে দেয়। ও এখন চাষিমেয়ের মতন নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আছে। ওর আঁচলে বাঁধা আছে ঢ্যাপের খই আর চালভাজা। নদীতে ফুটে আছে নীলাভ পদ্ম। ফুলের মৃণালে গোখরো সাপের বাসা” (মাঃ সেঃ ১৬ সংখ্যক লেখা)

–“এখন আমার নীচের দিকটা সরু,পিচ্ছিল, মসিবর্ণ,রাগি এবং শঙ্খপ্রিয়। জিভ তবু চেরা নয়। আবার তালবনে তালবনে ঘুরে বেড়াই। খর এবং ধারালো তালপাতা জিভে রেখে ঘষি। চিরে যাক মনুষ্যজিভ। তারপর দিদিমণির কাছে যাই। তিনি স্নান সেরে, ফণীমনসা পুজো করেন, নতুন ঝাঁপি হাতে বসে আছেন। আমাকে বলছেন, ইহা গচ্ছ, ইহা গচ্ছ, ইহ তিষ্ঠ। ” (মাঃ সেঃ ৩২ সংখ্যক লেখা)

-“বৌটি আচমকা গোল স্তন খুলে দাঁড়ালেন। বৃন্তে বিষ নয়, মধু মাখানো, স্তনযুগল নিমিষে মধুর বাটি

….

তিনি আমায় উল্টেপাল্টে খেতে লাগলেন। রাক্ষসীদাঁত বের করে পা গিললেন, নাভি, জিভ, অধর। সদ্য জন্মানো ঘাস সরিয়ে পুরুষফুল ছুঁলেন” (অগ্রন্থিত)

এমন জান্তব অথচ প্রাণময় বর্ণনা বাংলা কবিতা বহুকাল পায়নি। আর এভাবেই হয়তো কিছুটা অজ্ঞানেই জগন্নাথ তার কবিতায় তুলে এনেছে প্রাণসম্পদে ভরপুর একের পর এক স্বয়ংসম্পূর্ণা সহজিয়া নারীকে। পুরুষসভ্যতার সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে এসব নারীরা রিরংসায় প্রেমে কামে বাৎসল্যে স্বয়ংসিদ্ধা। জগন্নাথের রূপদক্ষ আঙুল নিপুণ পটুতায় একের পর এক মৃন্ময়ীর চক্ষুদান করে গেছে। এমনকি জগন্নাথের কবিতার পুরুষ চরিত্রদের অন্তরেও যেন এক নারীরই বাস। পুরুষ শরীর সেখানে এক খোলস মাত্র। যে খোলসের মধ্যে ছটফট করে এক অতৃপ্ত আসঙ্গকামী নারীহৃদয়

– “কবিরাজের দেহে দেবীপীঠ জেগে উঠেছিল। ডান হাতের পাশে সতীচিহ্ন। সেই থেকে সে অন্তরে অন্তরে নারী। গর্ভবতী মাটিতে বীজ ছড়াতে গেলেই কাঁদত, গুনগুন করত রামপ্রসাদী” (মাঃ সেঃ ৫ সংখ্যক লেখা)

– ” আমার কাছে এখনও লন্ঠনের মায়া আলোয় কেষ্টঠাকুরের দেহ আভা। বৃষ্টিপাতে রাধারানির নূপুর। তমালগাছের নীচে মাঝরাত্রে আমি নারী হয়ে যাই। বিশেষত রাসপূর্ণিমায়। নারীস্বভাবী আমি ফুল-পাপড়িতে শ্যামকিশোরের চোখ মোছাই। কাজল দিই মেঘের মতো। মান করি, মানভঞ্জন হয়” (মাঃ সেঃ ২৫ সংখ্যক লেখা)

“ওই গাছের ঝিকিমিকি ছায়ার ভেতরে বসে আছে এক যুবক। মগ্ন হয়ে বাজাচ্ছে বাঁশি। ইচ্ছে করছে ভ্রমণ শেষ করি। ত্যাগ করি পুরুষদেহ, রাইঅঙ্গ পাই। ধীরে ধীরে গিয়ে বুক রাখি ওই যুবক বুকে” (মাঃ সেঃ ৪৫ সংখ্যক লেখা)

“এই যে নারীভ্রমে অফুরন্ত দুধ দিয়েছে বৃন্তে এ অামি কাকে গেলাই?” (অগ্রন্থিত)

জগন্নাথের লেখায় এভাবেই ভিড় করে আসে অসংখ্য নারী-পুরুষের মুখ। তাদের কোনওটি স্পষ্ট, শিশিরজলে ধোওয়া। কোনওটি জঙ্গলের কুয়াশার মতোই অস্পষ্ট, আধেকলীন। আর এই প্রতিটি চরিত্রকে ধারণ করে আছে যে চালচিত্র, তা গড়ে উঠেছে নদীমাতৃক এই বাংলারই আলো মাঠ ভাঁটফুল নিয়ে। চালচিত্র বললে বোধহয় অন্যায়ই করা হয়। জগন্নাথের প্রতিটি কবিতারই অন্যতম প্রধান চরিত্র হয়ে উঠেছে প্রকৃতি। আমাদের হারিয়ে যাওয়া গ্রামসভ্যতা, তার পালাকীর্তন, পদ্মাপুরাণ, আগমনী, রামপ্রসাদী, বিদ্যাপতি-গোবিন্দদাসের পদ তাদের হারিয়ে যাওয়া যাবতীয় রূপ-রস-গন্ধ নিয়ে ফিরে ফিরে এসেছে জগন্নাথের লেখায়। ফিরে এসেছে দেশজ আচার আর রীতিনীতির টুকরো অজস্র অনুসঙ্গ; আবহমান গ্রামবাংলার খণ্ড খণ্ড ছবি। জগন্নাথের চোখ দিয়ে পাঠক দেখে ফেলেন অধুনা বিলুপ্ত সেই সনাতন বঙ্গদেশকে, তার ষড়ঋতু, তেরোপার্বন, বারোমাস্যা, ব্রতগান, লৌকিক ও অতিলৌকিক সহ। অবশ্য যে কবি তার এখন অবধি প্রকাশিত একমাত্র সংকলনগ্রন্থটি (মাটির সেতার; প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ২০১৮) উৎসর্গ করেন মা-বাবার পাশাপাশি “জল আলো হাওয়া ধান মাঠ পাখিকে”, তার পক্ষে এই তো স্বাভাবিক।

প্রসঙ্গত বলে রাখি, জগন্নাথের এই লেখা কতদূর কবিতা হয়ে উঠেছে তা নিয়ে আলোচক ও চিন্তকমহলে কিছু তর্ক উঠতে পারে। জগন্নাথ নিজেও তার এই টানাগদ্যের লেখাগুলিকে ‘কবিতা’ বলার বিশেষ পক্ষপাতী নয়। কিন্তু নিছকই গল্প বলার ছলে যেভাবে লেখাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে তারপর তাকে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে বাস্তব আর রূপকথার মধ্যবর্তী শূন্যতায়; যে অসাধারণ দক্ষতায় আর শব্দের মিতবাক মোচড়ে একের পর এক জীবন্ত ছবি গেঁথে দেওয়া হয়েছে তার বুকে; পাড়াগাঁয়ের মেয়েদের হাতের নিপুণ আলপনার মতো যে অনায়াস চিত্রকল্প ফিরে ফিরে এসেছে এ লেখার বুকে সেসব পাঠ করে, বলা ভালো সেই অনাস্বাদিতপূর্বের সামনে দাঁড়িয়ে আমি অন্তত এ লেখাকে কবিতা বলেই জেনেছি। আর তাই জগন্নাথের এই লেখাগুলি সম্পর্কে বারবার ‘কবিতা শব্দটির উল্লেখও করে গেছি। আমার এই ব্যক্তিগত পাঠকপ্রবণতার জন্য গুণীজনের কাছে অগ্রিম ক্ষমা চেয়ে রাখলাম।

সবশেষে বলি, জগন্নাথকে নিয়ে আমি একাধারে আশান্বিত এবং আশঙ্কিত। জীবনের প্রাচুর্য ও জৌলুস থেকে অনেকখানি দূরে একেবারে স্বতন্ত্র এক যাপন আর বিশ্বাসের মাটিতে গড়ে উঠেছে তার কবিসত্তা। তাই এমন নিজস্ব মাটির গন্ধ তার প্রতিটি লেখায়। আমি চাইব এই অমলকান্তিটি তার দূরবর্তী নিলয়ের রোদ্দুর হয়ে বাঁচুক। শহুরে সভা-সমিতি, উৎসব, সম্মাননা, পৌনঃপুনিকতার ভিড়ে যেন হারিয়ে না যায় বাংলা কবিতার এই নওলকিশোর…

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. জগন্নাথ দেবমন্ডলের কবিতা আগে বা পড়ার জন্য অপরাধী মনে হচ্ছে। কী অদ্ভুত এক জগত, এই কবিতাগুলির পাঠে এক না-চেনা পৃথিবীর ডাক থাকে যেন। একটানা পড়া যায় না। এক একটি পংক্তি পাঠে কেমন ঘোর তৈরি হয়।

  2. অনন্তের সৌন্দর্যসন্ধানী এক চিত্রকরের কবিতা

Leave a Reply to Sailen sarkar Cancel reply