লিঙ্গপরিচয়ের ছক ভাঙো, বাইনারির বাইরে যাও, শেখাল বেঙ্গালুরুর জেন্ডার বেন্ডার

স্রোতা দত্ত আচার্য

 

“অ্যাপ বলছে, তুই ৬২ শতাংশ মেয়ে!”

“মানে? আমি আপাদমস্তক একজন হেটেরোসেক্সুয়াল পুরুষ! আর তোর অ্যাপ বলছে, আমি মেয়ে? অ্যাপটাকে আস্তাকুঁড়ে ফেল!”

আমাদের জন্মগত লিঙ্গ যা-ই হোক না কেন,‌ আমাদের মধ্যেই রয়েছে বিপরীত‌ লিঙ্গের বহু‌ উপাদান, অনুপান, উপকরণ। সমাজ, বাণিজ্য, বিপণন, পশ্চিমি প্রভাব আমাদের ১-2 বাইনারির ছকে ফেলে বেঁধে ফেলার যতই চেষ্টা করুক না কেন, বাঁধন আলগা হবেই। শেষতক আরও একবার সেই কথাটাই গলা‌ ফাটিয়ে বলল বেঙ্গালুরুতে আয়োজিত’জেন্ডার বেন্ডার ২০১৯ ফেস্টিভ্যাল’।

জেন্ডার বেন্ডার ২০১৯ ফেস্টিভ্যালের পোস্টার (গ্যেটে ইন্সটিটিউট, ম্যাক্সমুলার ভবনের সৌজন্যে)

ভারতবর্ষের মতো দেশে কত কোনায়-কোনায় কত রকমের সামাজিক মিলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন আমার আপনার মতোই পাঁচজন। কিন্তু লিঙ্গ‌নির্ভর কোনও উৎসব আর কোথাও হয় কি? অথচ, এটা হওয়াটা‌ অত্যন্ত জরুরি। বিশেষত,‌ একদল মানুষ যখন ৩৭৭ ধারা লোপের দাবিতে আন্দোলন করে তৃতীয় লিঙ্গের অস্তিত্বের স্বীকৃতি‌ আদায় করে নিয়েছেন, তখন তাঁদের কথাটুকু শোনার দায় ‘প্রথম‌’ ও ‘দ্বিতীয়’ লিঙ্গের উপর বর্তায় বইকি!তাঁদেরও একান্ত নিজস্ব ভাষা, বক্তব্য আছে! ‘অন্যরকম’ বলে নিজেকে‌ কুঁকড়ে রাখার, লুকিয়ে রাখার যন্ত্রণা আছে। তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অবমাননা সইতে-সইতে তার থেকে জেগে ওঠা তীব্র ক্রোধ আছে। তার কতটুকু জানি আমরা? এই নানাধরনের আবেগের আদান-প্রদানেই তো উৎসবের সার্থকতা। আয়োজক ‘স্যান্ডবক্স কালেক্টিভ’ ২০১৫-য় গ্যেটে ইনস্টিটিউট/ ম্যাক্সমুলার ভবন বেঙ্গালুরুর পূর্ণ সহযোগিতায় এই বাৎসরিক‌ উৎসবের আয়োজন করা শুরু করে।‌ প্রথম,‌ দ্বিতীয়, তৃতীয় লিঙ্গের রং-বর্ণ-গন্ধ-স্বর মিলেমিশে যে সুর ওঠে, তাতে এই ‘প্রথম’,‌ ‘দ্বিতীয়’ ‘তৃতীয়’ লিঙ্গের সামাজিক বিভাজন কতটা বৈধ, পঞ্চম‌বর্ষের জেন্ডার বেন্ডার ফেস্টিভ্যালে যোগ দিয়ে বারবার এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি।

ভাবনা আমার‌ বরাবরই বিচিত্রগামী। বিয়ের‌ মতো‌ আদ্যন্ত ‌সামাজিক প্রতিষ্ঠানের আড়ালে যে বিশাল বাজার, সেখানে প্রথম পণ্য মানুষ। পাত্র-পাত্রীর তুল্যমূল্য‌ বিচারের বাজারে তাদের যৌন বৈশিষ্ট্য পরিবেশিত হয় এক-এক ভাবে। মেয়েদের ক্ষেত্রে শারীরিক গঠন, গায়ের রং,নাক-ঠোঁট‌‌-মুখের গড়ন, চুলের ঢালের উপর ভিত্তি করে চলে যোগ্যতাবিচার। ছবি তুলে বিয়ের বাজারে তা সুচারুভাবে পরিবেশিত হয়। আমার বিষয়, এই সম্বন্ধের জন্য ছবিগুলো। যেখানে অভিনেত্রী‌ বা‌‌ মডেল হিসেবে নয়, নিজের ভাগ্যনির্ধারণে কখনও স্বেচ্ছায়, কখনও অনিচ্ছায়, কখনও সামাজিক রীতি মেনে, নিজেকে ‘আদর্শ ভাবী গৃহবধূ’ হিসেবে শুধু ক্যামেরার সামনে নয়, বাজারেও নিজেকে উপস্থাপন করা হয়। সাজগোজে নিজের রুচির পরিচয় ছাড়াও ভিস্যুয়ালি সে কতটা বিবাহযোগ্যা, তা প্রমাণের দায় ফোটোগ্রাফারের। প্রকারান্তরে তিনিও সামাজিক জীব হওয়ায়, এই বিশেষ ধরনের ছবিও একটা ছক মেনে চলে। তাই শুধু ভিস্যুয়াল নয়, তা ধারণ করে বহু‌ ‘মেয়েলি’ গল্প। সেগুলোকে ঘেঁটে ‘মেয়ে দেখা-র তরিকাগুলো জানাই আমার উদ্দেশ্য। তারই কয়েকটা ছবি-গল্প নিয়ে গিয়েছিলাম বেঙ্গালুরুতে।

ড্র্যাগ কিং-এর ছবি

ফেস্টিভ্যাল আয়োজিত হয়েছিল বেঙ্গালুরু ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে। ঢোকার মুখেই ছিল বেশ কিছু বড়-বড় ছবি। সেই ছবি দেখেই জীবনে প্রথম পরিচিত হলাম নতুন একটি শব্দবন্ধের সঙ্গে – ‘ড্র্যাগ কিং’! ড্র্যাগ কিং সাধারণত মহিলাদের পারফরম্যান্স। তাঁরা সাধারণত পুরুষদের পোশাক পরে, পুরুষোচিত হাবভাব করে পারফর্ম করেন। আমরা জানি, হাঁটা-চলা-বসা-কথা বলায় নারীপুরুষের মধ্যে একটা নির্মিত বিভাজনরেখা কাজ করে চলে। মেয়েদের এভাবে পা ফাঁক করে বসতে নেই। কিংবা, ছেলেদের এভাবে মেয়েদের মতো করে দাঁড়াতে নেই। ১৩জন ক্যুইয়র মহিলা সেই ছককে ভেঙে দক্ষিণী ফিল্মের হিরোদের মতো সেজে, তাঁদের আইকনিক পোজ নকল করে পারফর্ম করেছেন – তার ছবি। তার পাশাপাশি চোখে পড়ল, সেন্টারের সিঁড়িতে লাগানো পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মেক্সিকো-সহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা লিঙ্গ-সংক্রান্ত গোটা পঞ্চাশেক পোস্টার। তাদের কোনওটি ছবি-নির্ভর, কোনওটি আবার লেখা-আঁকা।

আগে থেকেই আন্দাজ করেছিলাম, ব্যাপারটা আর পাঁচটা ফেস্টিভ্যালের মতো নয়। কিন্তু তা যে এতটাই অন্যরকম, তা সত্যিই আঁচ করতে পারিনি। সবমিলিয়ে দশজন গ্রান্টি। তার মধ্যে একজন‌ মিশরের। বিষয়টা উল্লেখযোগ্য, কারণ দশজনের মধ্যে এই প্রথম এক যোগদানকারী‌ বিভুঁইয়ের। আর মজার বিষয়টা‌ হল, এই দশজনই শিল্পী‌ হিসেবে অভিহিত। অথচ এঁদের কেউই প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষায় দিক্ষীত নন। কেউ বা লেখক-সম্পাদক, বা হ্যাকার, গবেষক,‌ নাট্যকার। কেউ আবার বস্তি এলাকায় ছোট ছেলেমেয়েদের পড়ান। কেউ ফিল্মমেকার বা ফোটোগ্রাফার। ছবিতে তুলে ধরেছেন আন্নাম্মা ও তাঁর মতো আরও অনেক ট্রান্সজেন্ডারের লড়াইয়ের কথা। তাঁদের অপূর্ণ ইচ্ছা, ‌স্বপ্নের কথা। একজন বানিয়েছিলেন ‘রেনবো বুক নামে ইন্টারঅ্যাক্টিভ জ়িন (ছোট গোষ্ঠীর মধ্যে নিজেরই প্রকাশিত ছোট বই)। সেখানে তথাকথিত তৃতীয়‌ লিঙ্গের পোশাক-আশাক নিয়ে আকাঙ্ক্ষা সাজিয়়ে তোলার ভার ছেড়ে দিয়েছেন দর্শক-পাঠকদের উপর।‌ তেমনই দেখলাম‌, নানা আনুষঙ্গিক উপস্থাপনা‌-সহ ল্যান্ডলাইন ফোনে গল্প রেকর্ড করে সাধারণ মহিলাদের দৈনন্দিন জীবনের আপাত ছোট জয়,‌ পাওয়া না-পাওয়ার গল্প‌ ইন্টারঅ্যাক্টিভ ইনস্টলেশনে তুলে ধরেছেন একটি দল। অন্য আর এক দল,‌ নানা ঘরোয়া-মেয়েলি‌ জিনিসের‌ মধ্যে রাখা ফোনে গল্প রেকর্ড করে তুলে ধরেছেন বিবাহিত মহিলাদের প্রবাসী জীবনে মানিয়ে নেওয়ার গল্প। বেশ‌ মজার‌ লেগেছে আটের দশকে বিদেশের আইকনিক এক্সারসাইজ ভিডিও নিয়ে তৈরি একটি‌ ভিডিও ইনস্টলেশন! তাতে পরতে-পরতে মহিলা-পুরুষের বাইনারি নিয়ে সুতীব্র‌ ব্যঙ্গ! পাঠক, ইচ্ছা করেই এইসব শিল্পীদের জন্মগত লিঙ্গপরিচয় দিলাম না। আপনারা ভেবে নিন‌ না, কে কোন দলে বা এখানে তাদের লিঙ্গপরিচিতি আদৌ প্রাসঙ্গিক কি না!

রেনবো বুক

এ তো গেল দশজন গ্রান্টির কাজের কথা। এ ছাড়াও তিন দিনের এই উৎসবে ছিল মহিলা-পুরুষ‌, ১-2 নিয়ে স্ট্যান্ড-আপ কমেডি,‌ সদ্যোপ্রকাশিত ‘তওয়াইফনামা’‌ নিয়ে লেখকের সঙ্গে আলোচনা, কমিক্‌সে মেয়েরা,‌‌ ক্যুইয়র‌ লাইব্রেরি,‌‌ সিস্টার লাইব্রেরির মতো নানা বিষয় নিয়ে ভাবের আদান-প্রদানের পরিসর। ডেটিং অ্যাপ নিয়ে এক আলোচনায় নানা প্রশ্ন‌‌ উঠে‌ এল।‌ বিশেষত, এই অ্যাপে কি হেটেরোসেক্সুয়াল ও ক্যুইয়রদের‌ ব্যবহারে‌ কোনও তফাৎ‌ লক্ষ্য করা যায়? শেষদিন‌ ছিল‌ গে‌ এবং ক্যুইয়র‌দের নিয়ে তৈরি ব্রাজিলের‌‌ একটি সিনেমা। জীবনে প্রথম বুঝতে পারলাম অন্য‌রকম একটি যৌন জীবনের কথা – তার সার্বিক প্রতিবাদ,‌ আপসের কথা। তা ছাড়াও যেটা মনে দাগ কেটেছে,‌ লিঙ্গপরিচয়ে পুরুষের‌ শিৎকারের প্রসঙ্গ। আদৌ কি কোনও পার্থক্য আছে?

ইন্টারঅ্যাক্টিভ ইনস্টলেশন

একটা খুব উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটল শেষ দিনে। যেখানে‌ আমি‌ ছিলাম, তার নাম‌ ওয়ান শান্তি রোড, বেঙ্গালুরুর একটি‌ শিল্পপ্রতিষ্ঠান। সারাদিন নানারকম‌ লোকের আনাগোনা, বসবাস, রেসিডেন্সি… ফেস্টিভ্যালে যাওয়ার জন্য‌ যখন তৈরি হচ্ছি, তখন দেখলাম,‌ একদল লুঙ্গি পরা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। লুঙ্গি তো দক্ষিণের একটি সম্ভ্রান্ত পোশাক,‌ তাই শেষদিনের পোশাক নিয়ে বিশেষ উৎসাহ। দেখাদেখি আমিও উৎসাহী হয়ে উঠলাম। এক ‘তথাকথিত’ পুরুষ এক ‘আপাত’ মহিলাকে কী আশ্চর্য স্বচ্ছন্দতায় শিখিয়ে দিলেন দক্ষিণী কায়দায় লুঙ্গি পরার ধরন। পরে দিব্যি ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছি, এক বিদেশি বলে উঠলেন, “বেশ তো দেখাচ্ছে, অনুষ্ঠানে তুমিও পরে যাও না কেন?” আমিও প্রাথমিকভাবে উৎসাহিত হলাম। “বেশ বেশ, তাই হবে! কিন্তু যদি খুলে যায়?” সড়াৎ করে‌ বেরিয়ে এল‌ ভেলক্রো- লাগানো লুঙ্গি। যদিও, কেন জানি না, শেষ পর্যন্ত আর ক্রস ড্রেসিং করে উঠতে পারলাম না। তা কি আমার অভ্যাসলালিত লিঙ্গপরিচয় হারানোর ভয়ে? তবে শেষ পর্যন্ত সান্ত্বনা পেলাম (আমি জানি না ‘সান্ত্বনা’ শব্দটা এখানে সুপ্রযুক্ত হল কি না… ‘সান্ত্বনা’ নয়, ‘ভরসা’-ও নয় ঠিক… ইংরজির ‘রিঅ্যাশুয়োরেন্স’ শব্দটা হয়তো এর খানিকটা কাছাকাছি যায়) ফেস্টিভ্যালে আগত একজনকে দেখে। চুলে তাঁর খানিকটা পুরুষালি ছাঁট ও খোঁপা। কপালে কালো টিপ, চোখে চশমা, গালে সযত্নলালিত দাড়ি। ঊর্ধ্বাঙ্গে পাঞ্জাবি। নিম্নাঙ্গে কুঁচি দিয়ে শাড়ি। তার আঁচল‌ উত্তর ভারতীয়দের‌ মতো করে পিছন থেকে ডান কাঁধে এনে, প্লিটগুলো‌ সুন্দর একখানা ব্রোচ দিয়ে সামনে ফেলে আটকানো। পায়ে মানানসই জুতো। অনভ্যস্ত চোখে এই পোশাক কারও কাছে‌ হাস্যকর, কারও কাছে উপহাসের, কেউ বা হয়তো অবাকই হবেন। কিন্তু তাঁকে দেখে মনে হল, আমি যে সাহস পাইনি, সেই প্রতিবাদের সাহসের পরিচয় যেন এঁর কাছে পেলাম! যেখানে সামাজিক বোধ, পরিচয় নিয়ে কোনওরকম আপস করার প্রশ্নটাই অবান্তর হয়ে যায়। আমার ইচ্ছা,‌ সাধ প্রকাশের স্বাধীনতা আমারই। জেন্ডার বেন্ডার সামাজিক বাইনারির বাইরে বেরিয়ে,জন্মগত লিঙ্গপরিচয় ভেঙে সেই নিজস্ব উন্মুক্ততার কথাই বলে চলল নানা ভাবে!

দেশবিদেশের পোস্টার

 

[ছবি: মানস আচার্যের সৌজন্যে]

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. একদম অন্যরকম একটা ফেস্টিভ্যালের অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন স্রোতা। লেখাটির জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।

Leave a Reply to নাহার তৃণা Cancel reply