ছাত্রছাত্রীরা কি পারবে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ে যুঝে চলতে?

প্রবুদ্ধ ঘোষ

 




লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের রিসার্চ ফেলো। দাবাড়ু, প্রশিক্ষক এবং বেঙ্গল চেস অ্যাসোসিয়েশনের মিডিয়া-কোঅর্ডিনেটর

 

 

 

অথচ তারই হাতে দেখছি মুক্তপাখা
যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত
আমারই পতাকা

ছাত্রছাত্রীদের কিছু বলার ছিল, অনেকদিনই। কিন্তু, শোনার কেউ ছিল না। এমনকি, তারা নিজেরাও হয়তো প্রস্তুত ছিল না শোনানোর কিংবা শোনার জন্যে। সেই সুযোগ করে দিল ভারতের বর্তমান শাসকদল। যে চূড়ান্ত মেরুকরণের দিকে দেশকে ঠেলতে ঠেলতে যাচ্ছে শাসকদল, তাতে সমস্ত সুরক্ষাবলয় ভেঙে যাচ্ছে। নিশ্চিন্তির যে ঘেরাটোপে থেকে বাইরের জগতের সবরকম আলোড়ন থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখা যায়, সেই সব নিশ্চিন্তির পরিসর মুছে যাচ্চে খুব দ্রুত। তাই, ছাত্রছাত্রীদের এতদিনের বলতে চাওয়া কিন্তু না-বলা কথাগুলো উঠে আসছে শাসকের শান্তিকুলুপ ছিঁড়ে। সমাজের সমস্ত স্তরের এবং শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব থাকে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে; তাদের নিজস্ব শ্রেণিভাগ হয় না, যেহেতু সামাজিক উৎপাদন পদ্ধতিতে তারা সরাসরি সম্পর্কিত নয়। অথচ, সমাজের সমস্ত স্তর ও শ্রেণির কাছে নিজেদের বক্তব্য পৌঁছে দেওয়ার বাধা থাকে অনেক; আর, সেই বাধাগুলো বোধহয় সরে যাচ্ছে যখন সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র সন্ত্রাসের পক্ষে অথবা সন্ত্রাসের বিপক্ষে এই দুই ভাগে ভাগ করতে চাইছে সমাজকে।

যে ছাত্ররা সেলফি নিতে ব্যস্ত ছিল, যারা পাবজি খেলতে খেলতেই খেত ঘুমোত, যারা ফেসবুক চ্যাটবক্সের বাইরের দুনিয়ার কথা মানতে চাইত না এবং যারা নেটফ্লিক্স-হইচই-এর বাইরে বাস্তবচিত্রের বিশাল পটভূমির সঙ্গে পরিচিত ছিল না, তারাই আজ হাতে হাত রেখে ১৫ কিলোমিটার মানববন্ধন তৈরি করছে। ‘স্মার্টফোন গোটা একটা প্রজন্মের মাথা হেঁট করে দিল’— এই যে রসিকতার বাস্তব, তাকে কিছুটা হলেও অস্বীকার করে মাথা উঁচু করে বন্ধুদের সঙ্গে স্লোগান দিচ্ছে। যে প্রজন্মকে বরাবর শিখিয়ে আসা হয়েছে ‘রাজনীতির কুপ্রভাব’, যাদের চেতনায় ‘অ্যাপলিটিক্স’ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল রাষ্ট্রনীতির খুব সচেতন কিছু প্রয়োগে, তারাই এখন ভারতবর্ষের মানচিত্র রক্ষার দায়িত্ব নিচ্ছে এবং ‘দেশ’ শব্দের মানে শাসকের অভিধানের থেকে আলাদা করে বুঝে নিচ্ছে রাজনৈতিক বলিষ্ঠতায়। যাদবপুর-জেএনইউ-হায়দ্রাবাদ সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির মতো কিছু বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে ‘সক্রিয় রাজনীতি’-র সচেতন চর্চা হয়, তাদের আলাদা বর্গে ফেলে দেওয়ার রেওয়াজ গড়ে উঠেছিল সাম্প্রতিক দু দশকে। দেশের অন্যান্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রছাত্রীরা যে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্রছাত্রীদের মতো আন্দোলনমুখর থাকে না, সেটাই যেন ছিল শাসক-মতাদর্শের স্বস্তির প্রচার। ছাত্র-রাজনীতির প্রভাবমুক্ত ‘আইআইটি’ বা ‘আইআইএম’ কিংবা ‘সেন্ট জেভিয়ার্স’-ই যে আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে পারে, ‘ছাত্রানাম্‌ অধ্যয়নং তপঃ’ যে একমাত্র ঠুলি হতে পারে ছাত্রদের— সেইসব প্রচারে বিভ্রান্ত করা হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের। অথচ, ভারতের বা পৃথিবীর ইতিহাস ঘাঁটলে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, তাজা রক্তের সংবহনের মতোই ছাত্রছাত্রীসমাজ যে কোনও প্রতিষ্ঠানবিরোধী, শাসকবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে থেকেছে। যে ছাত্রছাত্রীরা ১৮ বছর বয়স হলেই ভোটাধিকার পায়, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় পছন্দের ‘শাসক/শোষক’কে বেছে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে, তাদেরই রাজনীতিবিমুখ করে তুলতে এত প্রয়াস কেন রাষ্ট্র অথবা পরিবারের? আর, তাদের রাজনৈতিক বোধ যদি সমগ্র সমাজকাঠামোকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে, তাহলে তো ত্রাহি ত্রাহি রব ওঠে সমাজবৃত্তে।

 

***

Get out of the lecture rooms of the SS corporals and sergeants and the party bootlickers! We want genuine learning and real freedom of opinion. No threat can terrorize us, not even the shutting down of the institutions of higher learning. This is the struggle of each and every one of us for our future, our freedom, and our honor under a regime conscious of its moral responsibility.

–Sixth Leaflet, The White Rose

১৯৭০ দশক পরবর্তী সময়ে ভারতীয় রাজনীতিতে বা বাংলার রাজনীতিতে নিঃশব্দে যে মতাদর্শকে চারিয়ে দিয়েছে শাসক, তা হচ্ছে ‘নিরাজনীতিকরণ’। ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা বা উপনিবেশ-পরবর্তী দেশি শোষকদের শাসনে ’৭০ দশক অবধি ছাত্রছাত্রীসমাজের ব্যাপক সক্রিয়তা ছিল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী দুই ধারাতেই এই সক্রিয়তা ছিল। কিন্তু সত্তরের দশকের মুক্তি-সম্ভাবনা স্থগিত হয়ে যাওয়ায় ও সংসদীয় পথে শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের আপসকামী চেষ্টা প্রাতিষ্ঠানিক শাসনস্বীকৃতি পেয়ে যাওয়ায়, শোষকশ্রেণির অনুকূলে সমাজকাঠামো ফের স্থিতাবস্থার জাড্যে ফিরে গেল। অহরহ প্রচারিত হতে থাকল উদারনৈতিকতার বাণী, ‘মেধাবী কিন্তু মিসগাইডেড’, ‘বিপ্লব ভালই কিন্তু পথ ভুল’ এবং ‘রাজনীতি করে সমাজ পাল্টানো যায় না, উচ্চশিক্ষার মধ্যে দিয়ে দুনিয়া বদলানো যায়’— ইত্যাদি। ‘শিক্ষা আনে চেতনা এবং চেতনা আনে বিপ্লব’ দেয়াললিখনে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল ভরে উঠলেও ‘চেতনা’-র আগে ‘শ্রেণি’ শব্দটি (অর্থাৎ শ্রেণিচেতনা) সচেতনভাবে বাদ চলে গেল। আর, উচ্চশিক্ষা ক্রমেই চলে গেল উচ্চ-অর্থ-বিনিয়োগকারীদের হাতে। শাসকশ্রেণি জনগণমনে ‘রাজনীতি ভদ্রলোকের বা সৎ লোকের জন্যে নয়’ এই বাক্যটি গেঁথে দিতে সক্ষম হল; প্রাতিষ্ঠানিক পত্রিকা ও সাহিত্যগ্রন্থে উত্তাল ছাত্র-রাজনীতির দশকগুলোর সামাজিক অভিঘাত ভুলিয়ে দিয়ে ‘রোম্যান্টিক’ নিরাজনৈতিক ভাবাদর্শকে ও তজ্জনিত ছাত্র-যুবমনের হতাশাকে প্রাধান্য দেওয়া হল। ’৯০ দশক জুড়ে মধ্যবিত্তের আকাঙ্খা-কামনার ভরকেন্দ্র অতিদ্রুত পাল্টাতে থাকল, সঙ্গে সঙ্গে পরের প্রজন্মের চাহিদাও। এ এক বিশাল ও তর্কমূলক প্রতর্কের সম্ভাবনা, এই প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই, তবু এটুকু ধরতাই ছাড়া ছাত্রছাত্রী জাগরণের কয়েক দশকের মিসিং লিঙ্ক পাওয়া মুশকিল। ২০১৯ সালের শেষে এসে ছাত্রছাত্রীরা যখন লাঠি-গুলি অগ্রাহ্য করে রাস্তায় নামছে, প্রায় প্রতিদিনই মিছিল-মিটিং করছে এবং নিজেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সঙ্গে বৃহত্তর শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে লড়াইকে মিলিয়ে নিচ্ছে তখন আমরা আবার চমকে উঠছি, হয়তো খুশিও হচ্ছি। উপমহাদেশের শীতকালে বহ্ন্যুৎসবের আঁচ কী ফিরে আসছে আবার? শাসকবিরোধী ছাত্রছাত্রীসমাজের দ্রোহের উৎসবে? তবে এতগুলো বছর শীতঘুমে কাটানোর আলিস্যি আর স্রোতের পক্ষে থাকার যন্ত্রণার প্রতিষেধক নিশ্চয়ই নিয়েছে তারা।

সোফি স্কল। হিটলার যখন মধ্যগগনে, হিটলারের প্রবল প্রতাপে দেশের ভেতরে সব বিরোধী স্বর স্তব্ধ, কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ এবং হাওয়ামোরগের মতো ‘শুভ বুদ্ধিজীবী’রা যখন হিটলারের স্তোত্রপাঠ করছে, তখন কিছু ছাত্রছাত্রী একটি গোপন সংগঠন গড়ে তোলে। হোয়াইট রোজ্‌। নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী তারা— সোফি স্কল, হান্স স্কল, উইলি গ্রফ, ক্রিস্টোফ প্রবস্ট, আলেকজান্দ্র স্কমরেল ও অধ্যাপক কার্ট হুবর্‌। ১৯৪২ সালের জুন থেকে তাঁরা নাজিবিরোধী লিফলেট ছড়াতে শুরু করেন। গোপনে টাইপ করা, টেলিফোন বুথে রেখে দেওয়া কিংবা ঘনিষ্ঠ অধ্যাপক ও বন্ধুদের কাছে পাঠানো। গেস্টাপোদের নজর এড়িয়ে দেয়ালে হিটলারের পতনকামনা লেখা। আর, বহুসংখ্যক ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ মানুষকে আহ্বান করা নাজিশাসনের, ইহুদিনিধনের বিরোধিতা করতে। স্টুটগার্ট, কোলন, ভিয়েনা, হামবুর্গ, বার্লিনে পৌঁছতে লাগল হোয়াইট রোজের বারুদ। পঞ্চম লিফলেটে জনসাধারণকে তাঁরা আহ্বান করলেন, “Make the decision before it is too late. Do not believe the National Socialist propaganda which has driven the fear of Bolshevism into your bones. Do not believe that Germany’s welfare is linked to the victory of National Socialism for good or ill. Freedom of speech, freedom of religion, the protection of individual citizens from the arbitrary will of criminal regimes of violence-these will be the bases of the New Europe. Support the resistance. Distribute the leaflets!” শেষ লিফলেট বিলির সময় ১৮ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩, মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে ধরা পড়ে গেলেন সোফি আর হান্স; একে একে বাকিরাও। বিচারের প্রহসনে, ফাঁসি। তবু নাজি-মতাদর্শে মানিয়ে নেওয়া মরা বা আধমরা জনগণকে জাগিয়ে দেওয়ার সেও এক শুরু। গেস্টাপো, এসএস, নাজি-বিচারপতির চোখে চোখ রেখে ‘Es lebe die Freiheit!’ (আজাদি) দাবি করার দুর্দম সাহস। আত্মধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলা উগ্র জাতীয়তাবাদী এক রাষ্ট্রের প্রায়মৃত বিবেক/চেতনা জাগানোর লড়াই।

 

***

ম্যাঁয় জান্‌তা হুঁ কি দুশমন ভি কম্‌ নহি
লেকিন হমারি তরাহ্‌ হাথেলি পে জান থোড়ি হ্যাঁয়
সব্‌হি কা খুন শামিল ইয়াঁহাঁ কি মিট্টি মেঁ
কিসি কে বাপ কা হিন্দুস্তান থোড়ি হ্যাঁয়

যে সমস্ত ভারতীয় ছাত্রছাত্রী বিদেশের নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়া বা গবেষণায় ব্যস্ত, তারাও নেমেছে সেইসব বিদেশি শহরের পথে। অথচ, বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন সত্যি করা ছাত্রছাত্রীরা রাজনীতির সংস্রব থেকে নিজেদের বাঁচিয়েই রেখেছিল। ভাল পড়াশোনা করলে, কেরিয়ার তৈরি করলে এবং ‘রাজনীতির বদসঙ্গে’ না মিশলেই যে বিদেশে (প্রধানত পশ্চিম ইউরোপ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) পড়া বা কর্মসূত্রে যাওয়া যায়— ভারতীয় সমাজে সেই ধারণা কিশোরমনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তার সামাজিক পরিসরে। তবুও, বার্লিনের রাস্তায়, নিউ ইয়র্কে, কানাডায়, লন্ডনের ‘এলিট’ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্রছাত্রীরা প্ল্যাকার্ড হাতে, স্লোগান ঠোঁটে সঙ্ঘবদ্ধ। রাজনীতির সঙ্গে কেরিয়ারের/বিলেতযাত্রার বিপ্রতীপতার যে শর্ত, এই ছাত্রছাত্রীরা তা অগ্রাহ্য করছে।

৮ই জানুয়ারি লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনের সামনে ১২ ঘণ্টাব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অক্সফোর্ড, ওয়েস্টমিন্সটার সহ সোয়াস থেকে বহু ছাত্রছাত্রী যোগ দেন, পথনাটক করেন, ‘হাম হোঙ্গে কামিয়াব’ সমস্বরে গান এবং বক্তব্য রাখেন— “সিএএ-এনপিআর-এনআরসি শুধু মুসলিম বিদ্বেষী নয় বরং শ্রমজীবী-বিদ্বেষী এবং অসাংবিধানিক”। ফিনল্যান্ডে ‘ইন্ডিয়ান এগেইনস্ট সিএএ’ নামে প্রতিবাদ কর্মসূচী পালিত হয়েছে ডিসেম্বরের শেষে, যার উদ্দেশ্য ক্রমশ অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী পথে এগিয়ে চলা ভারতরাষ্ট্রকে সচেতন করা এবং সিএএ-বিরোধী আন্দোলনকে দমনমূলক পদ্ধতিতে চুপ করানোর নিন্দা করা। ১৯শে ডিসেম্বর অক্সফোর্ড, এমআইটি-র ছাত্রছাত্রী গবেষকরা ভারতের সদ্য-পাশ নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে পথে নামে, প্ল্যাকার্ডে লেখা— ‘Merry Crisis and Happy New Fear’। ২৬শে জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসে, নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন ডিসিতে ছাত্রছাত্রীসহ অন্যান্য ভারতীয়েরা প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করেন মোদি-শাহের ফ্যাসিস্ট নীতির বিপক্ষে। বস্টনের হার্ভার্ড স্কোয়ারে ২৪ ঘণ্টার কর্মসূচি পালিত হয়, সান ফ্রান্সিসকোয় ভারতীয় দূতাবাসের সামনে ভারতীয়দের প্রতিবাদ। আরএসএসের নীতিতে হিন্দুরাষ্ট্রের যে মডেল তৈরি করছে বিজেপি, তারই বিরুদ্ধে স্বতস্ফূর্ত বিক্ষোভ। অথচ, বিলেতে ঠাঁই পাওয়া মানে তো জীবনে ‘সেটল্‌’ হয়ে যাওয়া; আমেরিকার সামাজিকতায় একবার মিশে গেলে, জীবন ‘সার্থক’ বলে চরম সুখকে মেনে নেওয়াই ছিল দস্তুর। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে মোদির সভায় ‘হাউডি মোদি’ চিৎকারে একাংশের সমর্থনও পেয়েছিল বিজেপি, এনআরআই-রা বিজেপির সমর্থক এর’ম প্রচারও লালিত হয়েছে অধিকাংশ মিডিয়ায়। কিন্তু, মোদি-শাহের সমস্ত ডমিন্যান্ট ন্যারেটিভের আড়ালে চাপা পড়ে গেছিল ছাত্রছাত্রীদের স্বর; বিদেশে পাঠরত বা গবেষণারত ছাত্রছাত্রীরা ভুলে যায়নি নিজের অস্তিত্বের শিকড়। আর, সেইজন্যেই, দেশ যখন বিপন্ন তখন আপাত নিশ্চয়তার ঘেরাটোপ ভেঙে বেরিয়েছে তারা রাস্তায়। ক্রমশ ‘নেশন-স্টেট’ করে তুলতে চেয়ে ভারতের আইন-বিচারব্যবস্থা-সংবিধানকে যেভাবে দুমড়ে মুচড়ে নিচ্ছে শাসক, ‘মুসলমান’ সম্প্রদায়কে এবং দলিত-আদিবাসীদের যেভাবে সন্ত্রস্ত-বিপন্ন করে তোলা হচ্ছে প্রতিদিন, তাতে বিপন্ন বোধ করেছে ছাত্রছাত্রীরাও। তাদের নাগরিকত্ব ও অধিকারও যে সঙ্কটে!

পিয়েরে বোর্দ্যু বলেছিলেন ‘কাল্‌চারাল ক্যাপিটাল’ বা সাংস্কৃতিক পুঁজির কথা। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে শিক্ষা, ডিগ্রি, মেধা এইসমস্তই সাংস্কৃতিক পুঁজির আওতাভুক্ত। ‘অভিজাত’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের বিশেষ আচরণ, বাচনভঙ্গি কিংবা ‘মেধা’র অনুষঙ্গে নিজেদের আলাদা করে নেওয়া এবং সচেতনে বা অবচেতনে শাসকনির্ধারিত ‘আভিজাত্যে’ নিজেদের সগর্বে মুড়ে ফেলা বহু সময়ে বহু আন্দোলনে বৃহত্তর সমাজ ও শাসককথিত ‘অনভিজাত’ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের থেকে তাদের নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। এই বিচ্ছিন্নতার ইতিহাস নির্মাণ করেছে রাষ্ট্র ও তার মতাদর্শগত অনুগামী শিক্ষাব্যবস্থা। তাই, কোনও আইআইটি বা আইআইএমের ছাত্রমিছিলে প্ল্যাকার্ড থাকে, “কী বাজে পরিস্থিতি। আমাদেরও পথে নামতে হল!” কিংবা, কলকাতার এক ‘অভিজাত’ স্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের মিছিলে নিজেদের পরিচয়পত্র আনার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু, তবু তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিচ্ছে সর্বসাধারণের মিছিলে কারণ, সাংস্কৃতিক পুঁজির জোরে ‘উচ্চতর’ সামাজিক পরিসরে পাওয়া ‘অ্যাক্‌সেস’-টুকু তো বটেই, টান পড়েছে অস্তিত্বের শিকড়েও। প্রত্যন্ত জেলার ‘পিছিয়ে পড়া’ ছাত্রটির সঙ্গে ঝাঁ-চকচকে শহরের তথাকথিত ‘এগিয়ে থাকা’ ছাত্রটির একাত্মবোধ ওইখানেই, নাগরিকত্বের অস্তিত্বের, সত্তার বিলোপ-আশঙ্কায়, বন্ধুত্বের-সম্পর্কের আসন্নবিচ্ছেদে। পুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ৩৭০ ধারা বিলোপের বিরোধিতা করে বা নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করে নাটক বা জমায়েত/বিতর্কসভা করতে চাইলে কর্তৃপক্ষ তাঁদের স্মরণ করিয়ে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাজনীতির ‘ঐতিহ্য’! আইআইটি বম্বের কর্তারা ছাত্রছাত্রীদের সিএএ-এনপিআর-এনআরসি বিরোধী যে কোনও কার্যকলাপ ‘নিষিদ্ধ’ বলেছে, প্রতিষ্ঠানের ‘সুনাম’ অক্ষুণ্ণ রাখতে। কিন্তু, কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব প্রশ্নের মুখে পড়ে যাচ্ছে এখন। মোদি-শাহের কুশপুতুল পোড়াতে শাসকের ভাগ করে রাখা সাংস্কৃতিক পুঁজির গণ্ডিভাগ কাজ করছে না আর! ‘ন্যাক’ র‍্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে থাকা কলেজের ছাত্রছাত্রীরা কিংবা ‘মুসলিম’ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রছাত্রীরা, যাদের সঙ্গে ‘ন্যাক’-এর প্রথম সারির কলেজের ছাত্রছাত্রীরা হাঁটেনি এর আগে, তাদের সবার গলা মিশে যাচ্ছে, “জুল্‌মি জব জব জুল্‌ম করেগা সাত্তা কি হাতিয়ারোঁ সে/ চপ্পা চপ্পা গুঞ্জ উঠেগা ইন্‌কিলাব কি নাড়োঁ সে”। ভাষার ভাগ থাকছে না, একই মিছিলে হিন্দি-উর্দু-বাংলা-ইংরাজি, প্রতিবাদ তো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে! দেশের মাটির ঘ্রাণ আসে, দেশের পাঠ নেওয়া যায় চোখ ভরে। ধর্ম-বর্ণ আর লিঙ্গের যে বিভাজন শাসক-মতাদর্শ করেছিল সমাজে, ছাত্রছাত্রীরা অবিরাম চ্যালেঞ্জ করছে তাকেও। একটা টোটালিট্যারিয়ান সরকারের বিরোধিতার সুরে মিশে যাচ্ছে সমস্তরকম কর্তৃত্ব-বিরোধিতার সুর; পিতৃতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যবাদী কাঠামোকে নস্যাৎ করছে বলেই কি এই ‘কার্নিভ্যাল’ এত তীব্র প্রতিস্পর্ধী? তাই সন্ত্রাসবাদী আরএসএস-র উদ্যত বন্দুকের সামনে বুক পেতে এগিয়ে যান জামিয়া মিলিয়ার ওই ছাত্র!? আতঙ্কবাদী এবিভিপির রড-তক্তার আঘাত মাথায় নিয়েও স্লোগান ভোলেন না বিশ্বভারতীর দলিত ছাত্রটি!? সেইজন্যেই সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীটি একাই বিজেপির গুণ্ডাবাহিনীর দাঙ্গাকামী মিছিলের সামনে অকুতোভয় দাঁড়ান ‘নো এনআরসি’ পোস্টার উঁচিয়ে!? আইআইটি মাদ্রাজের ছাত্রটি তার সামাজিক অবস্থানের পরোয়া না করে তুলে ধরে ‘The need to protect the Constitution is understood by the student community now. And this is happening across the country.’ মিছিলের ধুলো আর খররোদ থেকে নিজেকে বাঁচানো আইআইএমের তরুণী এখন ধরে রাখছে অন্ধকার সময়ের প্রতি তীব্র ঘৃণা- ‘Hindurashtra is Rapist’।

 

***

সব্‌ ইয়াঁদ রাক্‌খা জায়েগা
সব্‌ কুছ ইয়াঁদ রাক্‌খা জায়েগা
তুমহারি লাঠিয়োঁ সে গোলিয়োঁ সে জো কতিল্‌ হুয়ে হ্যাঁয়
মেরে ইয়ার সব্‌
উন্‌কি ইয়াঁদ মেঁ দিলোঁ কো বরবাদ্‌ রাক্‌খা জায়েগা
সব্‌ কুছ ইয়াঁদ রাক্‌খা জায়েগা

জামিয়া ও জেএনইউ নিয়ে আগের লেখাটিতে যে কথা উহ্য রেখেছিলুম, তা হল, যারা হামলা চালিয়েছিল জেএনইউ-র হস্টেলে, যে ছেলেটি জামিয়ার ‘সংবিধান রক্ষার মিছিল’-এ গুলি চালাল, কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায়-বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে যারা প্রতিবাদের ওপরে সন্ত্রাস নামিয়ে আনছে, তাদের অনেকেই তো ছাত্রছাত্রী! তাহলে, কোন মন্ত্রবলে প্রচুর ছাত্র দেশরক্ষায় যথার্থ নাগরিকের ভূমিকা পালন করছে আর কিছু ছাত্র রাষ্ট্ররক্ষায় সন্ত্রাসবাদীর ভূমিকা পালন করছে? কারণ, মতাদর্শ। শাসকের মতাদর্শ মায়াঞ্জন পরিয়ে রাখে শাসিতের চোখে, ভারতে ধর্ম-জাতি-লিঙ্গ-ভাষা যে মোহমায়াঞ্জনকে গাঢ় করে তোলে আরও। ‘মানুষ’ পরিচয়ের চেয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে তোলে ধর্ম বা বর্ণের পরিচয়। ‘অপর’কে গুঁড়িয়ে দিতে পারলেই যেন ‘আত্ম’ মর্যাদা পায়, ‘অন্য’কে দমিয়ে দিলেই যেন ‘স্ব’ জেগে ওঠে প্রত্যয়-উপসর্গে; এটা নিশ্চিত করতেই মিডিয়া থেকে শুরু করে বিচারব্যবস্থা সবকিছুই মুঠোয় পুরে নেয় শোষক। আর, এর ঠিক বিপরীতে ‘জেগে থাকার ধর্ম’ বুকে প্রতিস্পর্ধার ভাষা খুঁজে চলে শোষিতের মতাদর্শ বুঝতে শেখা ছাত্রছাত্রীরা। শাসকের পরানো মায়াকাজল মুছে দেখতে থাকে স্বাধীনতার স্বপ্ন, রাষ্ট্রকে প্রত্যাখ্যান করে দেশকে ভালবাসার আখ্যান। কাশ্মীরের ‘আজাদি আজাদি আজাদি’ সমস্বর কখন যেন সারা ভারতের ছাত্রছাত্রীসমাজের স্বর হয়ে ওঠে। ভারতরাষ্ট্র ১৯৪৭-এর পর থেকেই বিভিন্ন অজুহাতে যাদের চেনাতে চেয়েছিল ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে, তাদের নয় বরং ভারতরাষ্ট্রকেই আসল সন্ত্রাসবাদী বলে চিনে ফেলে ছাত্রছাত্রীরা। সংবিধান আর দেশ বাঁচানোর যুদ্ধে নেমে এই যে পরস্পরকে চিনে জেনে নেওয়ার কমরেডশিপ, তা যেন অটুট থাকে। ভারতরাষ্ট্র এবং আতঙ্কবাদী আরএসএস যে যুদ্ধ ভারতদেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে ঘোষণা করেছে, সেই যুদ্ধ সবে শুরু হয়েছে। অনেকটা পথ এখনও বাকি, ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের জুড়ে নেওয়া বাকি শ্রমজীবী কৃষিজীবী নিপীড়িতদের সঙ্ঘবদ্ধতায়, এক নতুন গণতন্ত্রের লক্ষ্যে।

ফরওয়ার্ড মার্চ, অ্যাডভান্স টু রেবেল!

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. যুক্তি, বুদ্ধি ও ইতিহাসচেতনা দিয়ে খুব ভাল একটি লেখা।

Leave a Reply to Sailen sarkar Cancel reply