মোজা

অনীক চক্রবর্তী

 

একেবারে মোক্ষম মুহূর্তে গন্ধটা নাকে এসে লাগল সোমনাথের। তীব্র, ভ্যাপসা একটা গন্ধ। তার আবার কব্জি থেকে শুরু করে পাঁচ আঙুলের ডগা পর্যন্ত একখানা বলিষ্ঠ হাত আছে। সোমনাথ সেটা আগে জানত না। কিন্তু গন্ধটা ওর আর তানিয়ার সদ্য ছোঁয়া ঠোঁট দু’টোর একটু ওপরে, দু’জনের নাকের মাঝে ছোট্ট স্পেসটায় ঢুকে এসে এত জোরে একটা থাপ্পড় মারল ওদেরকে যে দু’জনে ছিটকে গেল দু’দিকে। তখন সোমনাথ জানতে পারল রঙ, রাগ বা সাহসের মতো গন্ধেরও একটা হাত থাকে। সে মোক্ষম সময়ে থাপ্পড় মারলে দু’মাস ধরে করা ছক এক সেকেন্ডে ঘেঁটে যায়।

সোমনাথ মুখার্জির বয়স আঠাশ বছর চার মাস তেরো দিন, বা হাঁতের বাইসেপে একটা বড়সড় ট্যাটু, এবং দুই পায়ে ভেরিকোজ ভেইন। সে বাইপাসের ধারের যে কোনও একটি নার্সিংহোমে ল্যাব টেকনিশিয়ান। কোন নার্সিংহোম তা আমি ঠিক জানি না তাই আপনাদের বলতে পারব না। কিন্তু তানিয়া বসু যে সেই নার্সিংহোমেরই রিসেপশনিস্ট সেটা জানানোই যায়। তানিয়ার বয়স বাইশ-তেইশ হবে, সে ছোটবেলায় কোথায় একটা পড়েছিল ‘যে শিশু ও ফুল ভালোবাসে না সে অনায়াসে মানুষ খুন করতে পারে’— তারপর থেকে সে ফুল খুব ভালোবাসে কিন্তু চেষ্টা করেও শিশুদের সেরকম একটা ভালোবাসতে পারেনি এখনও, এবং তার ডান ওভারিতে কয়েকটি সিস্ট আছে। সোমনাথ আর তানিয়া চব্বিশে অক্টোবর সন্ধে সাতটার সময় পরস্পরের দিকে প্রথমবার তাকায় এবং হেসে ওঠে। আজ একত্রিশে ডিসেম্বর। সোমনাথের মেসের বন্ধুরা বোধহয় পার্কস্ট্রিটে গিয়েছে, বা নিজের নিজের বাড়ি। ওরা আজ দু’জনেই নিজের ডিউটি ম্যানেজ করে ছ’টায় বেরিয়ে এসেছে। পরস্পরকে ভালোবাসে কিনা সে ব্যাপারে কেউই ঠিক সিওর না এখনও।

আরও অনেক কিছুর মতোই শ্যু পরতেও একেবারেই ভাল লাগে না সোমনাথের। তবু পরতে হয় চাকরির খাতিরেই। এইচ আর থেকে একেবারে কড়া নির্দেশ– ওনলি ফরমাল। বাকি বিভিন্ন ভালো না-লাগাগুলোর সেরকম নির্দিষ্ট কোনও কারণ না থাকলেও শ্যু পরতে না চাওয়ার একটা কারণ অবশ্য আছে সোমনাথের। ওর পায়ের চেটো বড্ড ঘামে। হাতের তেলোও। সেদিন ল্যাবের নির্মাল্যদা’র কাছ থেকে শুনেছে ব্যাপারটা থাইরয়েডের গণ্ডগোলের জন্য হতে পারে, এবং সে একটা রক্ত পরীক্ষা যেন অবশ্যই করিয়ে নেয় সেটাও বারবার করে বলে দিয়েছে নির্মাল্যদা। সোমনাথ ভেবে রেখেছে সেটা সামনের সপ্তাহে করিয়ে নেবে।

তা যাই হোক, আট ঘণ্টা ওই ঘেমো পায়ে শ্যু পরে থাকলে প্রচণ্ড গন্ধ হয়। বিদঘুটে একটা গন্ধ। নিজেরই মাথা ধরে যায় তো বাকিদের অবস্থাটা সহজেই অনুমেয়। এই অসুবিধে তো আর আজকের না, যবে থেকে চাকরিতে ঢুকেছে তবে থেকেই। তার আগে পা ঘামলেও সোমনাথ কোনওদিনই সেভাবে শ্যু পরেনি। পায়ে দু’বার করে সাবান, রোজ কাচা মোজা, পাউডার– ডিও পর্যন্ত— কত কিছু চেষ্টা করেছে ও এই দেড় বছরে, কিন্তু কোথায় কী। গন্ধটা বেরোতে শুরু করে ওই বিকেল নাগাদ। তখন এত অস্বস্তি হয় ওর, লজ্জায় মাথা কাটা যায়। লোকজনের থেকে একটু দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করে। নিজের থেকে যদিও পারা যায় না। বোঁটকা গন্ধে মাথা ধরে যায় সোমনাথের। ও তখন তানিয়ার ব্যাপারে ভাবতে চেষ্টা করে। মানে ওর শরীরের ব্যাপারে। কাজ হয় কিছুটা। ল্যাব রিপোর্টগুলো তৈরি করে দ্রুত হাতে। মোটা কাচের জানলার ওপারে সন্ধ্যা নামে অভ্যাসমতো।

‘উঁহহ’ ছিটকে সরে যায় তানিয়া। সাজানো ভুরু দুটোর মাঝখানে স্পষ্ট বিরক্তি এসে বসেছে, একবার নাক কুঁচকে পরক্ষণেই একটা জোরে নিশ্বাস ফেলে সে।

‘কীসের গন্ধ বলো তো?’

টিউবলাইটের আলোর নীচে সোমনাথকে অপরাধী দেখায়। জুতো আর মোজা দুটো বারান্দায় খুলে রাখা। নিজের পায়ের গন্ধটা নাকের ভেতর ঢুকে সোজা একেবারে মাথায় গিয়ে ধাক্কা মেরেছে তারও। তানিয়ার ব্যাগটা আর বিকেলে ওকে দেওয়া গোলাপটা আপাতত বিছানার একপাশে অলস শুয়ে আছে— ওরা সবাই যেন সোমনাথের কাছ থেকে একটাই উত্তর চায়। নাকি ক্ষমা প্রার্থনা? নিজের পা দুটোর দিকে তাকায় সোমনাথ। যেন কিছুই হয়নি এভাবে পড়ে আছে আগোছালো। আর এক অদৃশ্য শয়তান গোড়ালি থেকে, পাতা থেকে, আঙুলগুলোর ফাঁক থেকে বেরিয়ে এসে তাদের ঘিরে বিকট হাসছে, একটা মানুষকে প্রথমবার চুমু খেতে গিয়ে আচমকা ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার যাবতীয় কারণ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা ঘর জুড়ে।

‘আমার পায়ের গন্ধ। খুব বাজে গন্ধ হয় আমার পায়ে। একটু বসবে, আমি বাথরুম থেকে ঘুরে আসব?’— সোমনাথ দিন কয়েকের মধ্যেই নিজের পা দুটোর চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়ার প্ল্যান করতে করতে বাথরুমে ঢোকে। জোরে জোরে সাবান ডলে পায়ে। নিরানব্বই ভাগ জীবাণু ধ্বংস করে নাকি। শালা! আর তার পাঁচ মিনিট পরে নিজের ওভারি দুটোকে কেটে বাদ দিয়ে দেবে এই প্ল্যান করতে করতে বাথরুমে ঢোকে তানিয়া। শালা ডেটের কোনও মা বাবা নেই যেন। শিট। লেগিংসে রক্ত লেগে গেছে একেবারে!

‘আমি বারাসাতে একটি কলেজে ইতিহাস পড়ছি। ফার্স্ট ইয়ার। বাড়িতে বাবা মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো। নিজের গার্লফ্রেন্ড আছে, তার সঙ্গেও সুস্থ স্বাভাবিক সম্পর্ক। ফেসবুক করি, ফোনে খুটখুট করি, ভিড় ট্রেনে বিরক্ত হই, মেসিকে মনে করি গ্রহান্তরের জীব, বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে সবাই মিলে দঙ্গলও দেখে এলাম এই সেদিন। সত্যি বলতে কি ইতিহাস গ্র্যাজুয়েটদের নিজের কেরিয়ার নিয়ে ঠিক যতটুকু দুশ্চিন্তা থাকার কথা আমার জীবনে ঠিক সেটুকু দুশ্চিন্তা ছাড়া আর কোনও কিছু নিয়েই চিন্তা নেই। অস্বাভাবিকত্ব বা উত্তেজক কিছু তো নেইই। কিন্তু ইদানিং একটি অদ্ভুত সমস্যার মুখোমুখি পড়েই এই চিঠি লিখছি।

আমার ভীষণ ভালো এক বন্ধু আছে। চাড্ডি বাডি বলতে পারেন। ধরা যাক তার নাম কৌশিক। গোটা স্কুল জীবন একসাথে কাটিয়েছি। তবে আমি ইতিহাস হলেও ও আপাতত ইঞ্জিনিয়ারিং। এবার ঘটনাটা শুনুন। বড়দিনের ছুটিতে পুরনো বন্ধুরা মিলে পাহাড়ে গিয়েছিলাম। তা সারাদিন ঘুরে টুরে হোটেলে এসে সবাই মিলে জাঁকিয়ে বসে খাওয়াদাওয়া করলাম, মদও খেলাম কিছুটা। গান হল, আড্ডা হল, মেয়ে নিয়ে আলোচনা হল। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ। দেখি কৌশিক আমার পায়ে ওর গাল দুটো ঘষছে আর জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। আমি নেশা আর ঘুমের যৌথ ঘোরের মধ্যে ধড়মড় করে উঠে ওকে জোরে ঠেলতে ও পড়ে যায় বিছানা থেকে। তারপর অনেক ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে, অনেক ইতস্তত করে, অনেক ‘ভুল বুঝিস না প্লিজ’ করে শেষপর্যন্ত যেটা জানায় তা সংক্ষেপে বললে দাঁড়ায়, আমার পায়ের গন্ধ ওর ভালো লাগে! অনেকদিন ধরেই। আগেও গন্ধ নিয়েছে, আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু আজ নেশার ঘোরে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। আমার প্রথমে খুব অস্বস্তি হলেও শেষ পর্যন্ত ভেবে দেখি ব্যাপারটা অত্যন্ত অস্বাভাবিক টাইপের কিছু নয়। তাছাড়া সত্যি বলতে কি, আমারও বেশ ভালোই লেগেছিল– কেমন একটা শিরশিরানি সারা গা জুড়ে ডালপালা মেলে ধরে। ফলে সেই রাতে তো বটেই, তারপরেও আমরা বিভিন্ন সময় লুকিয়ে এই মজাটা নিয়েছি। কিন্তু মুশকিল হল, আমার পায়ে সেরকম গন্ধ হয় না। একই মোজা দু’-তিনদিন পরে থাকলে সামান্য একটু গন্ধ হয়। আপনি কী বলতে পারবেন ঠিক কী করলে আমার পায়ে রোজ গন্ধ হতে পারে? আপনার উত্তরগুলো ওই বাকি মুশকিল আসান ওয়ালাদের চেয়ে একটু অন্যরকম লাগে– সেনসিটিভ এবং বুদ্ধিমান মনে হয়। উত্তর পেলে ভালো লাগবে। ধন্যবাদ।’

–শিবালিক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

চিঠিটা ঠিক দু’বার পড়েন অনিরুদ্ধ সেনগুপ্ত। প্রৌঢ় কপালে দুটি সমবয়সী ভুরুর মধ্যে এতটুকুও অতিরিক্ত কুঞ্চন দেখা যায় না। ধীরেসুস্থে টেবিলে রাখা মোবাইলটা তুলে অনেক খুঁজে একটি নম্বর ডায়াল করেন।

‘হ্যাঁ, সুভাষদা, ব্যস্ত আছেন? কথা বলা যাবে একটু? না না, সেরকম আর্জেন্ট কিছু নয়।’ ওপাশ থেকে বক্তা কী বললেন তা বোঝা যায় না ঠিক। কিন্তু অনিরুদ্ধ সেনগুপ্ত তারপর ঠোঁটের কোণে অল্প হাসি টেনে বললেন ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি তো ফাঁকাই। দিনের আবার একত্রিশ আর এক। ওকে, ওওকে। সন্ধ্যেয় দেখা হচ্ছে তাহলে…’

‘দেখো আমাদের চামড়ায় বেশ কিছু জীবাণু বসবাস করে। তারা জন্মায়, নিজেদের মতো করে থাকে, বংশবিস্তার করে, তারপরে মরে যায়। এবার ধরো একজন মুখবন্ধ জুতো পরেছে। তখন তার পায়ের ঘাম আর শুকোতে পারছে না ঠিকমতো, উপরন্তু সেই ঘাম মোজায় শোষিত হচ্ছে। ফলে জীবাণুদের পোয়াবারো। একখানা কালচার মিডিয়া পাওয়া গেছে। তারা মহানন্দে বেড়ে উঠছে– গায়ে গতরে, ঝাড়েবংশে। আর তাদের মেটাবলিজমের ফলে তৈরি হচ্ছে হরেক যৌগ। গন্ধখানা মূলত সেই যৌগদের অবদান। এই হল গিয়ে থিয়োরি। ফলে প্র্যাক্টিক্যালি, বিভিন্ন ফ্যাক্টরগুলোকে বাড়িয়ে কমিয়ে আমরা গন্ধটাকেও বাড়াতে কমাতে পারি। আর তুমি যেটা বললে সেটাকে চলতি টার্মে বলে ফুট ফেটিশ। স্বাভাবিক হতে পারে, অস্বাভাবিকও হতে পারে। আমি ঠিক বলতে পারব না। এবার বলো…’ বলে সিগারেটে বড় করে একটা টান দেন বাষট্টি বছরের দীর্ঘকায় মানুষটি। তার একমাত্র ছেলের বাইপোলার ডিসঅর্ডার, তিনটে আলমারি জুড়ে ছোট-বড় সব মিলিয়ে ছ’শোর একটু বেশি বই, আর ডান কিডনিতে একটি ছোট্ট পাথর আছে যা তিনি নিজেও জানেন না।

অনিরুদ্ধ সেনগুপ্ত মুখে কিছুই বলেন না। তিনি শুধু ঠিক করেন খুব ইচ্ছে থাকলেও ছেলেটার প্রশ্নের উত্তর তিনি দেবেন না। তারপর চায়ে চুমুক দিয়ে ঠোঁটের কোণে পরিচিত হাসি টেনে বলেন, আচ্ছা সুভাষদা, মানুষ তো বিবর্তনের একেবারে শেষ ফসল, তাই না? কত কোটি বছর বলুন তো? আচ্ছা, এক কোটি বছর ঠিক কতটা সময় সেটা আমরা কেউ আমাদের মাথায় ধারণ করতে পারি? মানে বলতে চাইছি একটা জিনিসকে জাস্ট মাপলেই তো হল না, তাকে আদৌ ধারণ করতে পারছি কিনা সেটাও তো দেখা উচিত, তাই না?

সুভাষবাবু কী উত্তর দেন, আদৌ কোনও উত্তর দেন কিনা তা শোনা যায় না ঠিক। কারণ তখন সিডনি অপেরা হাউসের ঠিক একশ মিটার ওপরে প্রচণ্ড আওয়াজ করে, সারা আকাশ আলোয় ভাসিয়ে পৃথিবীতে নেমে আসছে নতুন বছর। সারা পৃথিবীর মানুষ নাচে-গানে-চিৎকারে স্বাগত জানাচ্ছে তাকে। অন্তত টিভিতে সেরকমই দেখাচ্ছে। আর ল্যাব টেকনিশিয়ান সোমনাথ মুখার্জির মেসের বারান্দায় খুলে রাখা দুটি মোজায় অসংখ্য জীবাণু পরস্পরকে জড়িয়ে ধরছে খুব স্বাভাবিকভাবে। তাদের শরীরের ভেতরে মেসোজোম নামক একটি অঙ্গ, একটি ক্রোমোজোম এবং বাদবাকি সারা শরীরভর্তি পিলি।

পৃথিবীতে যে এখন অ্যানথ্রোপোসিন মহাযুগ চলছে, তারা কেউই জানে না।

 

ছবিঋণ – ইন্টারনেট

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...