পার্কসার্কাস-শাহিনবাগ: মেয়েদের হার, মেয়েদের জিত

অর্ক দেব

 



লেখক সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।

 

 

 

এই রাজ্যে আশির দশকের শেষাশেষি জন্ম যে প্রজন্মের, গণআন্দোলনের রূপরেখা ঠিক কেমন সে বিষয়ে তাঁদের প্রথম ধারণা হল ২০০৭ সালের এসে। নন্দীগ্রামে পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে দিন রাস্তায় নেমেছিল হাজার হাজার মানুষ। ইচ্ছেশক্তির কাছেই সেদিন পরাজিত হয়েছিল গলিত স্থবির একটা অবস্থা। সময়ের চাকা নিজের নিয়মে ঘুরে গিয়েছে। প্রায় ১৩ বছর পেরিয়ে আজ আবার রেগে যাওয়া মানুষ রাজপথের দখল নিচ্ছে বারবার। তবে এবার প্রেক্ষিত অন্য, পরিধিও বড়। দেশজুড়েই রোজ মহড়া চলছে গণআন্দোলনের, রোজ মঞ্চস্থ হচ্ছে নতুন নতুন লড়াই। আর সমস্ত ছোট-বড় সব বিরুদ্ধতার প্রাণভ্রমরাই যেন রাখা পার্কসার্কাসে, শাহিনবাগে। মেয়েদের আন্দোলনের স্থায়ী আখড়ায়। সেখানে জড়ো হচ্ছেন মুসলিম পরিবারের মেয়েরা। তাঁদের সঙ্গে পালা করে রাত জাগছেন ছাত্র, শিক্ষক, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মীরা, এক কথায় নানা বর্গের সাধারণ মানুষ। শাসকের সাথে লড়াই যখন রাতারাতি দেশের ছবিটাই বদলে দিল, তখন সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে মেয়েদের জমায়েতের চরিত্র।

যে কোনও আন্দোলনই অনেক ত্যাগ ও তিতিক্ষার মধ্যে দিয়ে ‌‌‌‌‌‌যাত্রাপথ রচনা করে। পার্কসার্কাসের মেয়েদের জমায়েত তার ব্যতিক্রম নয়।‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ এই আন্দোলন শাহিনাবাগের নয়, এই আন্দোলন নন্দীগ্রামেরও নয়, পার্কসার্কাস স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে আন্দোলনের যে নতুন অভিজ্ঞান তৈরি করছে তা স্বাধীনতাত্তোর ভারতেতিহাসে বিরলের মধ্যে বিরলতম। এই লেখা সেই আন্দোলনের একটি নথি বই কিছুই নয়।

এখানে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন তাঁরা যাঁদের আন্দোলনের কোনও অভিজ্ঞতা নেই, নেই স্লোগান তোলার অভ্যেস। কেন তাঁরা এই আকস্মিকের খেলায় মাতলেন? নয়া নাগরিকত্ব আইন পাশ করার জন্যে কেন্দ্রের তরফে যে পদক্ষেপগুলি নেওয়া হয়েছিল, টিভিতে তা দেখেশুনে নিজেকে আর স্থির  থাকতে পারেননি আসমত জামিল নামক এক গৃহবধূ। প্রতিবেশী বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেন তিনি। ৭ জানুয়ারি দুপুরে পার্কসার্কাসের ময়দানে এসে গুটিকতক সাথীকে নিয়ে তিনি যে ধর্ণা শুরু করেন তা-ই আজ স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। একজনকে দেখে রাত জাগছেন অগণন। রোজ আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন নতুন নতুন মুখ, কারও কোলে দুধের শিশু, কেউ ছিয়াত্তর শেষ করে সাতাত্তরে পা দেবেন। আর এদের পরিখার মতো ঘিরেছে অন্যেরা। তাঁরা বাইরের শক্তি।

জমায়েতে গেলেই দেখা হয়েছে অমিতা সেনের সঙ্গে। যোধপুর পার্ক নিবাসী গৃহবধূ। মেয়ে সুস্মিতা বিশেষ ভাবে সক্ষম, হুইলচেয়ারে করে নিয়ে এসেছেন তাঁকে।  সঙ্গে স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখছেন বেশ কয়েকজন সমাজকর্মী, কার কখন দরকার পড়ে। নাগাড়ে আসছেন ছাত্ররা। কোনও দলীয় পতাকা নয়। হাতে হাতে ঘুরছে জাতীয় পতাকা। দ্বিধা না রেখেই বলছি, প্রাথমিক ভাবে এটি একটি বিপদগ্রস্ত গোষ্ঠীর আন্দোলন। সরাসরি অস্তিত্ব সংকট তৈরি হওয়ায় আজ ঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন কলকাতার মুসলমান সমাজের মেয়েরা। আর এই বেরিয়ে আসাটাই অজুত সম্ভাবনার দিগন্ত খুলে দিয়েছে।

এই আন্দোলনে স্বতপ্রণোদিত ভাবে যোগদানকারী ছাত্র- শিক্ষক-সাধারণ মানুষ অনেকেই থেকে যাচ্ছেন রাতে। আবার অনেকেও ফিরে যাচ্ছেন। আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে থাকাটা তাদের রাজনৈতিক অনুশীলন। তবে মুসলমান মেয়েদের কাছে এই আন্দোলন অধিকার রক্ষার লড়াই, নিজের দেশে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক না হয়ে যাওয়ার জেহাদ। আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী লুবনা আহমেদ বা আসমা সিদ্দিকিরা অনেকেই রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। প্রত্যেকের পরনে হিজাব। একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে, অনেকের আশেপাশেই  রয়েছেন ওদের বাপ-দাদা। আর এখানেই জয় এই আন্দোলনের। মুসলমান মেয়েদের জীবন আমূল বদলে দেয়নি এই আন্দোলন। রাতারাতি স্বাধীনতার চাঁদ করতলগত হয়ে যায়নি তাঁদের। তবে পিতৃতন্ত্রের চাবিটা যাদের হাতে থাকে বেশিরভাগ সময়ে, তারাই আজ সামনে ঠেলে দিচ্ছে এই মা বোনেদের। পরম মমতায় খেয়াল রাখছেন, যাতে কোনও বিপদ না ঘটে যায়। একটি সমস্যাকে প্রতিহত করতে এসে আসলে অচলায়তনে কুঠারাঘাত করছেন বিক্ষুব্ধরা। আজ যারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চোখ রাঙাতে শিখে যাচ্ছেন আগল ভেঙে কাল তারা এই শিক্ষাই কাজে লাগাবেন ঘরে বাইরে। বিপ্লব তো একদিনে হয় না। তার জমি কর্ষণ করতে হয় ধীরে ধীরে। নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদের সিজিলমিছিল যেন বিপ্লবেরই সেই আগুনছোঁয়া সঙ্কল্পের ইঙ্গিত।

২০০৬ সালে সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হলে দেখা যায়, গোটা দেশে শিক্ষাছুটের সংখ্যা ১৩.২ শতাংশ। কিন্তু মুসলিম সমাজে শিক্ষাছুট ১৭.৬ শতাংশ। ২৫ শতাংশ মুসলিম শিশু ৬ থেকে ১৪ বছর বয়েসের মধ্যেই স্কুলের পাট চুকিয়ে দেয় চিরতরে। স্নাতকস্তরে ছাত্রদের মধ্যে মুসলিম উপস্থিতির হার প্রতি ২৫ জনে ১জন। স্নাত্তকোত্তরে সংখ্যাটা প্রতি ৫০ জনে ১ জন। বলাই বাহুল্য মহিলাদের অবস্থা আরও সঙ্গীন। পুরুষ ও এবং নারীর শিক্ষার অনুপাত মুসলিম সমাজে চোখে পড়ার মতো বেশি। সাচার কমিটি যদিও দেখিয়েছিল, ৬৬ শতাংশের বেশি মুসলিম মহিলা পড়তে ও লিখতে পারেন। তবে জোয়া হাসান, ঋতু মেননের মতো আন্দোলনকারীরা মনে করেন এই পড়তে লিখতে পারা কোরান পড়া ও ঊর্দু হরফ লিখতে পারার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ২০০৯ সালে ইউজিসি রিপোর্টে দেখা যায় স্নাতকে মুসলমান ছাত্রছাত্রীর অন্তর্ভুক্তির পরিমাণ অন্য সব জনগোষ্ঠীর থেকে কম। খ্রিস্টান ছেলেমেয়েদের গ্রস এনরোলমেন্ট রেট ১৭.২১ আর মুসলমান ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে মাত্র ৭.৭। কুমার রানা ও  সাবির আহমেদ পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান প্রবন্ধে রাজ্যের প্রেক্ষিতে এই বিভাজন তুলে ধরেছেন. তারা দেখিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের সিংহভাগই ক্ষমতার কেন্দ্রস্থল শহর থেকে অনেক দূরের বাসিন্দা। আমলাতন্ত্র, প্রচারমাধ্যম, শিল্প সংস্কৃতি ইত্যাদি সবই যেহেতু শহরমুখী তাই সেখানে মুসলমানের অনুপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। তাঁরা মূলত কায়িক শ্রমের জোগানদার। আবার শহুরে মুলস্রোতেও তাঁরা অঙ্গীভূত হতে পারেননি। জনতথ্য আধিকারিকের দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকে মুসলমান ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা মাত্র ৪.৮ শতাংশ। গত কয়েকবছরে অবস্থাটার খুব বদল হয়েছে এমনটা বলা যায় না। প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে দেশে/রাজ্যে মুসলিম এবং দলিত সমাজ এখনও অন্ত্যজই। অপরই। এই অপরকেই চিহ্নিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী। দিনকয়েক আগে বলেছেন, দেশে নৈরাজ্য তৈরি করছে যারা তাদের পোষাক দেখে চেনা যায়। প্রধানমন্ত্রীকে দোষী করে লাভ নেই। আমরা তো সত্যি জানি না আমাদের প্রতিবেশীর পোশাক রুচি খাদ্যাভাস সম্পর্কে। প্রতিবেশী বলছি, মুসলমান কি আমার প্রতিবেশী হবে আদৌ সেই প্রশ্নেও আমাদের মুখোশ খুলে যেতে বাধ্য। তাই আজ স্বাভাবিক নিয়মেই আন্দোলনের বাইরের শক্তি যে গান গায়, যা খায় তার সঙ্গে বিস্তর ফারাক পার্কসার্কাসের মা-বোনের বাঁচার নিয়মে। কিন্তু রাতের শিশিরে ভেজা মঞ্চই প্রথমবার অনেককে মুসলমান মেয়েদের জীবনের সঙ্গে প্রথমবার পরিচিত হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে। আলো পড়ছে শতকের অন্ধকারে।

প্রথম পরিচয়, তাই আড়ষ্টতা আছে। তবে বারবার পরস্পরের হাতের তালু ছুঁলে ঘষে যাচ্ছে আমাদের দৈন্য। বিভেদের বীজ ছড়ায় যারা , এই জানাশোনা, শ্রেণির দেওয়ালে ফাটল তাদের পাঁজর কাঁপিয়ে  দিতে পারে। বলতে পারি, আজ এক বড় দুঃখ মিলিয়ে দিয়েছে সকলকে। এই আগল ভেঙে এগিয়ে আসাটাই মুসলমান মহিলাদের জন্যে সবচেয়ে জরুরি এই মুহূর্তে। অন্য দিকে ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির পক্ষে বিপদ সঙ্কেতও। কেননা এই দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে কোথায় গিয়ে শেষ হবে তা বলা মুশকিল। এই যোগাযোগের জেরে বিশ্ববিদ্যালয় ফেরত শিক্ষাকর্মীর থেকে যদি ভাল-মন্দ অধিকার প্রসঙ্গ জেনে নিতে পারেন মুসলমান মহিলারা তবে নেতাদের আফিম খাবেন কেন? প্রয়োজনে নোটায় ভোট দেবেন।

পার্কসার্কাস যেমন কাছে টেনে নিয়েছে, তেমন দূরেও ঠেলে দিয়েছে। এখানে সব ব্যক্তিমানুষ স্বাগত। অথচ এই আন্দোলন ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে ডাকসাইটে রাজনৈতিক নেতাকে। আাবার দেখেছি পার্কসার্কাসের মেয়েরা দু’হাতে বরণ করে নিলেন উমর খলিদকে। বামমনস্ক শত সহস্র মানুষ এখানে পরস্পরের চেনা মুখ হয়ে গিয়েছে অচিরেই।  আসলে আন্দোলনটি একটি সতেজ চারাগাছের মতো। জীবনীশক্তিই তার একমাত্র সম্পদ। তার জোরে শিখতে শিখতে পরিণত হয়েছে আন্দোলনটি। দ্বিধা থেকে ভুল থেকে শিখছেন আন্দোলনকারীরা নতজানু ছাত্রের মতো। বামেদের রাস্তার রাজনীতির অভিজ্ঞতার পুঁজি তাঁদের শক্তিশালী করছে, ছাত্রের উদ্যম তাদের রাত জাগতে শিখিয়েছে। উজমা, আসমতরা বিভিন্ন কলেজে গিয়ে মুসলমান ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের আসতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এই উদ্যোগের ফলে বহু বামমনস্ক মানুষও দলীয় শৃঙ্খলার বেড়ি খুলে সুযোগ পাচ্ছেন মিলিত হওয়ার। এই মানুষের সমুদ্রে মুসলমান মহিলাকে হিজাব, মুসলমান পুরুষতে ফেজটুপি খুলে নাস্তিকতার জানান দিতে হয় না। বামমনস্ক মানুষরা, স্বাধীন চিন্তা নাগরিক সমাজ এই আন্দোলনের শরিক হতে চাইছেন তাদের চিহ্নগুলিকে মান্যতা দিয়েই।

বহু বিপদের মুখোমুখি হয়েছে পার্কসার্কাস। পার্কসার্কাসে শাহিনবাগের মতো বায়োটয়লেট ছিল না। পুলিশ বায়োটয়েলেট বসাতে বাধা দিয়েছিল , দাবি করেছিলেন প্রতিবাদীরা। রাতের নির্দিষ্ট সময়ে বন্ধ হয়ে যায় রাস্তার সুলভ কমপ্লেক্স। বন্ধ হয়ে যায় মসজিদের দরজাও। কাজেই অনকেই বাড়ি যেতে হত বাথরুম সারতে। আন্দোলনের শরিক কিডনির রোগে আক্রান্ত বৃদ্ধা থেকে আট বছরের শিশু সকলে এই প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়ে গিয়েছেন রাতের পর রাত। মাথার ওপর ছাদের অনুমতি চেয়েও বারবার প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা। প্রথমে জোটেনি তাঁবু। শিশির ভেজা মাঠেই জেদ নিয়ে রাতভর জেগে ছিলেন অনেকে। অসুস্থ হয়েছেন, ওষুধ খেয়ে ফের রাত জেগেছেন। যে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই নয়া নাগরিক আইনের বিরোধী, তাঁর কাছে এই বাথরুম তাঁবুর অনুরোধটুকু পৌঁছে দেওয়া যায়নি তিন সপ্তাহ, এ এক আশ্চর্য তথ্য! ‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের’ প্রতি তাঁর অনুভবী নজরের কথা তো সুবিদিত। অবশেষে এসেছে টয়লেট, তাঁবুও পেয়েছেন আন্দোলনকারী মেয়েরা। আন্দোলন মঞ্চেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন সিআইটি রোডের বাসিন্দা সামিদা খাতুন। কমরেডরা তাঁকে ধরাধরি করে নিয়ে গিয়েছেন হাসপাতালে তবে শেষরক্ষা হয়নি।

শাসকের থেকে কোনও বাড়তি সুবিধে কামনা করেনি পার্কসার্কাস, কেন না তাঁরা আজ ভাবতে শিখছে শাসক যত দেবে ততটাই ফেরত চাইবে। অসহোগিতার সঙ্গেই তো লড়াই ঘরে-বাইরে। তবে জুলজুলে চোখের আগুনে একবার চাইলেই এই বোঝা যায় আজ যারা বাইরে বেরিয়ে এসেছে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে  যাওয়া সেই মানুষগুলি মরার আগে মরে যাবে না আর কিছুতেই। এই জেদের কথা বিলক্ষণ জানেন প্রধানমন্ত্রী। মেয়েদের রোষই তাঁর ঘুম কেড়ে নিয়েছে। উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা ভোটের আগে তিন তালাক তুলে দেওয়ার ফল সরাসরি ভোট বাক্সে পড়েছিল। কাজেই মেয়েদের, বলা ভাল মুসলমান মেয়েদের শাহস-শক্তি-সম্ভাবনা তাঁকে ভীত সন্ত্রস্ত করবেই। দিল্লিতে ভোটের লড়াই নয়, লড়াই ছিল শাহিনবাগের সঙ্গে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তেমনই জানিয়েছিলেন। শাহিনবাগ সমুচিত শিক্ষা দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে ওখলা অঞ্চলে। শাহিনবাগ ওখলা বিধানসভারই অংশ। দাঙ্গা লাগানোয় পারঙ্গম গেরুয়া বাহিনী এর বদলা নিয়েছে। সরকারি হিসেবেই প্রাণ গিয়েছে ৪৯ জনের। আগুনের এই লেলিহান শিখাও টলাতে পারেনি পার্কসার্কাস-শাহিনবাগকে। অথচ যে শক্তি প্রয়োগে শরজিলকে রাতারাতি তুলে নেওয়া গিয়েছিল, তা দিয়ে এই আন্দোলন দমনও সম্ভব নয়। কাজেই নতুন পথ বাতলেছেন আমাদের মসিহা। নারীদিবসে তিনি তাঁর সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট মেয়েদের হাতে ছেড়ে দিচ্ছেন। এর উত্তর দেবে মেয়েরাই। আশার কথা এই যে. দূর থেকে দেখলে এই সামগ্রিক অবস্থাকে যত ভীতিপ্রদ মনে হয়, ততই দেখি নতুন দিনের মশাল জ্বলে।

উর্বশী বুটালিয়া, কমলা বাসিনরা বারবার দেখিয়েছেন,  প্রাক স্বাধীনতা পর্বে ভারতীয় নারীদের আগল ভাঙার ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়নি। রাসসুন্দরী দাসী, মানদাদেবী, স্বর্ণকুমারীদেবী, বিনোদিনী দাসীদের আত্মকথার ওপরে নির্ভর করেই আমাদের সমাজপরিস্থিতি বুঝতে হয়। পরিস্থিতি অল্প হলেও বদলায় স্বাধীনতা আন্দোলনের দ্বিতীয়ার্ধে। অ্যানি বেসান্ত  ও ডরোথি জিনারজাদশা ওম্যান’স ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তোলেন। জওহরলাল নেহরু ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়ায় লিখেছেন, “অধিকাংশ পুরুষরাই তখন জেলে। সে সময়েই আমাদের মেয়েরা ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসেন। হাল ধরেন আন্দোলনের। মহিলাদের স্বর ছিলই। তবে এখন তাঁরা নেতৃত্বস্থানে। এই পরিবর্তন ব্রিটিশ সরকার আর তাঁর পুরুষ প্রতিনিধিদের চমকে দিয়েছে।” লবণ সত্যাগ্রহে গাঁধী প্রাথমিক ভাবে মহিলাদের অংশগ্রহণ চাননি। কিন্তু সমলোচনার চাপেই তিনি মত বদলাতে বাধ্য হন। আইন অমান্য আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিয়ে গাঁধী লেখেন, “ভারতীয় মহিলারা আজ জানেন দেশ তাঁদের থেকে বাড়ির কাজের দেখাশোনার চাইতেও বেশি কিছু চাইছে।‍‍”এই কালপর্বে দেশসেবা সঙ্ঘ, নারী সত্যাগ্রহ সমিতি, মহিলা রাষ্ট্রীয় সঙ্ঘ ইত্যাদি নানা দল তৈরি হয়েছে যাদের অংশগ্রহণ ব্যাতীত  স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হত না। কিন্তু, এগুলি কি স্বয়ংস্বম্পূর্ণ নারী আন্দোলন? আন্দোলনের রাশ, সিদ্ধান্ত প্রণয়নের ক্ষমতা কি নারীদের হাতে ছিল? প্রশ্ন থেকেই যায়। স্বাধীনতাত্তোর ভারতে মন্ত্রীসভার কাঠামো দেখলে এই প্রশ্নের উত্তরও পরিষ্কার হয়। ক্রমে ভারতীয় নারী শক্তি সংগ্রহ করেছে চিপকো আন্দোলনে, ভিল আন্দোলনে। দুই মহিলার ধর্ষণের প্রতিবাদে ১৯৭০ এর দশকে এই আদিবাসী নারীরা ঝড় তুলে দেন। এই আন্দোলনের ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে লিখতে হয়। পার্কসার্কাস বা শাহিনবাগকে দেখে একজন বহিরাগত হিসেবে, বহিরাগতের দৃষ্টিভঙ্গিতেই মনে হয়, বৃত্ত সম্পূর্ণ হচ্ছে। দেশগঠনে গলা তুলতে, স্বৈরাচারীর মুখোশ খুলতে ভারতীয় মহিলারা আজ একাই একশো। পুরুষের ভূমিকা সমর্থকের অথবা বিরুদ্ধতার।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. অর্ক বাবু ,

    একটাই প্রশ্ন , তসলিমা নাসরীনকে শাহিনবাগ বা পার্কসার্কাস মেনে নেবে তো ? স্বপ্নময় চক্রবর্তী প্রশ্নটা রেখে/করে বিপদে পড়ে গেছেন |

Leave a Reply to Shamik Cancel reply