সোনালী চক্রবর্তী
লেখক কবি, গদ্যকার ও অনুবাদক।
পলাশ,
জীবনকে যারা কয়েকশো কোটি মুহূর্তের বিস্ফার দিয়ে পদ্মপাতায় জল জেনে থাকে, শীতের শেষ আঁচে কাজল তুলে নেওয়ার পর তীব্র দাবানল কি শুধু বসন্ত তাদের জন্যেই বরাদ্দ রাখে? কী ক্রান্তিকালে এই চিঠি লিখছি তোকে আজ? সমর্পণের দেয়ালা ধুয়ে গেছে আতঙ্ক জলে। আর কখনও বলা হবে না বরাবর যা বলতাম তোকে পরিহাসের ছলে, যার থেকে বড় সত্যি কোনওদিন কিছু ছিলই না। বলেছিলাম, গোটা আয়ু আকাশ করে ভরে দিলাম মুঠোয়, রামধনুতে শেষ তুলির টানটা দিয়ে আমার কাছে আসিস, হয় চিতা না হয় কবর, শেষ ‘হাগড স্লিপ’টা একসাথে। স্বীকারোক্তি আজ লিখে দিলাম, এটাই একমাত্র চাওয়া ছিল।
অবচেতনের পারদ চিনতে না পারলে এই দহনজন্মের উত্তরাধিকার পেতাম না, পেয়েছি। আজ রাত থেকে স্নায়ুর সবটুকুতে আগুন তার দখল নিয়ে নিয়েছে। মাতৃভূমিতে রাতারাতি আউটসাইডার হয়ে গেছি। সিজোফ্রেনিয়ার রোগীর মত হাতড়ে ফিরছি স্মৃতি, কোথাও যদি পরিচিত বিশ্বাসের ডাঙা ভেসে ওঠে, আস্থা রাখার মত চর একখানি, পাচ্ছি না তো। কথা ছিল ধূ-ধূ শালের মাটি থেকে সূর্যের চোখে চোখ রাখার, নিথর হ্রদের পাশ থেকে চাঁদে হারানোর। ভষ্ম হয়ে গেছে এই সব বিকার গণহত্যার পাথরতন্ত্রে। কাব্যের ধারাপাতে কখনও ছিলাম না তো আমি। কুম্ভ রাশির জাতিকা নিজেরই ভিতর ডুবে ছিলাম বরাবর কুণ্ডলিণীকে ঘুমন্ত খরিশ করে। আমার কৈশোর ভাঙিয়েছিল মার্কেজ নামের প্রবল পুরুষটি। কখন যে সেই ঘনঘোর চতুর্থ ইন্দ্রিয়ে পাওয়া নিষিদ্ধ স্বাদের মতো সমগ্র অস্তিত্বকেই আচ্ছন্ন করে ফেলল, বুঝে উঠতে পারিনি, চাইওনি অবশ্যই। ক্রমে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম জনস্রোতের ইথার থেকে। অলীক আমার পুরো যাপন। এ দাবির প্রামাণ্য নথিরা আমার সঙ্গেই মুছে যাবে, এইটুকুই অর্জন। ল্যাবাইরিন্থ যারা জেনে যায়, একমাত্র সলিচিউডেই তারা শ্বাস নিতে পারে জিওলের ভঙ্গিমায়। আমি তো বেঁচেই ছিলাম প্রবল। ইউলিসিসের আকাঙ্ক্ষার মত প্রতিটি পল, অনুপল, দণ্ডকে দুমড়ে, মুচড়ে, নিংড়ে, ছিবড়েটুকুও না ফেলে। মৃত কোষের মত মায়াকে সযত্নে ছেড়ে রেখে আসতাম ধ্যানান্তে সেই বৃক্ষেরই ছায়ায়, যে ছায়ার স্বরূপ খুঁজিনি কোন মানুষের দর্পণে। কেন যে এলি? কেন এলি? আমার যোগিয়া অহং এর পাল ছিঁড়লো, নির্লিপ্তির নোঙর উঠলো, সদ্যোজাত একটা ডোডো কানে শিস দিয়ে গেল ‘প্লাবনকাল সমাগত’।
হ্যাঁ, নজর তো লাগেই, কালের। নাহলে কোনও মানুষকে তো সন্ধান দিইনি সামাজিকতার সর্ব অর্থেই একটা পাবলিক ফিগারের সমস্ত পাবলিক পোস্টে দিয়ে চলা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ইঙ্গিতের রহস্যময়তার। তুইও কি পেরেছিস? জানি না। জানার সমস্ত পরিখায় প্রাচীর গেঁথে গেছে। এখন অকাল। এই হ্যালুসিনেশনে একাকার হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীতে অদ্যাবধি ঘটে আসা সব জেনোসাইডের তথ্য ও দৃশ্য। নিজেকে কখনও পাচ্ছি ম্যাকেন্ডো থেকে ছেড়ে যাওয়া ওয়াগন ভর্তি মৃতদেহের স্তূপে, কখনও স্বস্তিক আঁকা সৈন্যটির চোখ থেকে নেমে আসা জলের ফোঁটা যে ধর্ষিতাটির ঠোঁট ছুঁল, তার খোলা চোখের তারায়। দুর্ধর্ষ সাহস ছিল তোকে রাতবিরেতে লিখতে পারার রেন ফরেস্টে স্নান থেকে শুরু করে বেদুইন তাঁবুর মশালে মরুভূমি দেখা ফ্যান্টাসির ইতিবৃত্ত। সেই আমি আজ সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না কটা ছোবল জিভে নিলে সায়ানাইডের থেকে কম সময় লাগবে। যে শরীরকে মাত্র একবার দেড় সেকেন্ডের জন্য জড়িয়ে বলেছিলি “কী নরম রে তুই”, আমি সে রেশমকে আর নষ্ট কী করে করি? সেই প্রথম দেখা, সেই শেষ। জানি, সকালে কারণ নিয়ে তদন্ত হবে বিস্তর। বেনারসের শৈব ব্রাহ্মণ বংশে জন্মানো মেয়েটির আত্মহত্যার কলঙ্ক অনুসন্ধানে শরীরকে যতটা ছেঁড়া হবে, তার থেকে অনেক বেশি হবে চরিত্রের খনন, সংবাদের সুখাদ্য প্রয়োজন। কেউ জানবে না, জানতে দেওয়া হবে না রাষ্ট্রের পৈশাচিকতার দায় ধারণ করে আমি অব্যাহতি নিয়েছি নিতান্ত লজ্জায়। তোর চোখে আর চোখ কী করে রাখি, সেই অসহায়তায়। প্রস্তরের থেকেও কঠিন এই মেয়েটিকে প্রথমবার যে বসন্তে উন্মাদ করে দিয়েছিল, আমি কী করে আর তাকে গিয়ে বলি, এই দেশে জন্মে এই হিন্দু আমি, বিশ্বাস কর, ‘তোকেই ভালোবাসি’। আমার বলা হল না। কেউ না জানুক, তুই মনে রাখিস, এই আত্মহণন শুধু সামান্য এক প্রতিবাদ উত্থিত ধ্বজাধারী স্বৈরাচারে। আমার শেষ দীর্ঘশ্বাস যেন অভিশাপ হয়ে ধ্বংস করে রক্তবীজের চাষ। দেখ, কী অদ্ভুত বৃষ্টি নামল এখন। ভিজে যাচ্ছে বসন্তের চরাচর, ভিজে যাচ্ছে তেপান্তর। তোকে বলা হয়নি, জন্মমুহূর্ত থেকে শুরু করে আমার প্রতিটি ঘটন অঘটন দুর্ঘটনে বৃষ্টিই নামে অভ্রান্ত প্রতিবার। স্বীকৃতি এল যেন আজও ব্যতিক্রম না ঘটায়। কত কিছু তোকে বলা হল না, কেন যে ভুলে যাই কিছুই বলা হল না, Adieu জুনিয়র হক সাহেব।
ইতি,
…………….